ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • মিহি মন্তাজ : পর্ব ২৩


    শুভময় মিত্র (June 23, 2023)
     

    হেডলাইন

    জেঠু মনে হচ্ছে। কিন্তু এ কী করে সম্ভব? আজ জেঠু আবার কোথা থেকে আসবে? অথচ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। ফুটপাথের কোণে লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তা পেরোবে বোধ হয়। অনেক বছর আগে, শেষ যখন দেখেছি, ধরে-ধরে বাথরুমে নিয়ে যেতে হত। লাঠি তখনও ছিল। মেঝের আন্দাজ পাওয়ার জন্য। যে-বাড়িতে এসব দেখতে পেতাম, সেটা উধাও হয়ে গেছে। সঙ্গে জেঠুরাও। এতদিনে বেঁচে থাকার কথাও নয়। অথচ নিশ্চিতভাবে জেঠুকে দেখতে পাচ্ছি সামনে। পরীক্ষা করলেই হয়। পৌঁছে হাত এগিয়ে দিতে বলল, ‘তুই কোথা থেকে আবার? একটু ধর তো, ফুটপাতগুলো এখন এত উঁচু করেছে… নামতে কষ্ট হয়।’ আগের মতোই ফতুয়া, পাজামা পরা। বুকের কাছটায় ময়লা বাদামি গুঁড়ো লেগে নেই, তাই নস্যির গন্ধটা পাচ্ছি না। চশমার কাচ, ফ্রেম পরিষ্কার। আগে এমন দেখিনি। আমি অনেক সময়ে সাবান দিয়ে ধুয়ে, শুকনো করে ফের পরিয়ে দিয়েছি। পরিষ্কার কাচের মধ্যে ঘোলাটে, বিস্ফারিত চোখে জেঠু বলত, ‘চোখে ঠান্ডা-ঠান্ডা লাগছে।’ কেউ এগিয়ে, পায়ের আঙুলে গলিয়ে না দিলে জেঠু চটি পরতে পারত না। নিজে চেষ্টা করলে গোলমাল হয়ে যেত। প্রায়ই দেখতাম এ-পায়ে নীল, ও-পায়ে কালো। যার চটি গুলিয়েছে, সে দৌড়োত পিছনে, ‘খোলো খোলো, এটা তো আমার। এইটা তোমার। বুঝেছ?’ অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে থাকত জেঠু। শূন্য চোখে। খালি পায়ে। বলতে শুনেছি, ‘অন্ধের কী বা লাল, কী বা নীল।’ সে একা-একা রাস্তায় বেরিয়েছে? ‘আগে তো আসতিস। একবার এলেও তো পারিস!’ শুনলাম পাশের পাড়াতে থাকে, নতুন ফ্ল্যাটবাড়ি। আমি চিনি। সামনে গুলমোহর গাছ আছে। বললাম, ‘যখন বলবে চলে আসব।’ ‘আমি কোথাও যাইনি, কোত্থাও যাই না।’ শুনে বললাম, ‘এই তো বেরিয়ে পড়েছ, কিছু হয়ে গেলে!’ এর বেশি বকাঝকার ইচ্ছে হল না। মনে-মনে একটা হিসেব করছিলাম জেঠুকে ধরে নিয়ে যেতে-যেতে। কত বয়স এখন? সব জানব। যাব তো বটেই। ফোন থাকার কথা নয়। দরকার কী! রাস্তার উঁচু-নীচু বাঁচিয়ে আস্তে-আস্তে চলছিলাম। দিব্যি যাচ্ছিল জেঠু। গাছটার তলায় দাঁড়ালাম। জেঠু বলল, ‘এখান থেকে আমি ঠিক চলে যাব।’ বাড়ির সিকিউরিটি দৌড়ে এসে চার্জ বুঝে নিয়ে খুব আনন্দ করে আমাকে জানিয়ে দিল, ‘কুছু ভয় নাই, বাবু এখুন বহুত বড়িয়া, বহুত তেজিয়া, হাঁ হাঁ। আসবেন, আসবেন, দেখে যাবেন।’

    জেঠু বসে থাকত মাঝের ঘরের একটা বাতিল সোফায়। অন্যরা চারপাশে যে যার ঘরে। এই বাড়িতে পাড়ার প্রথম টিভি এসেছিল। দুনিয়ার লোক আসত সন্ধেবেলা। চার পা-ওয়ালা ফ্রেমের ওপর কাঠের স্লাইডিং শাটার লাগানো সাদা-কালো টিভি। দূরদর্শনের যুগ। খবর পড়তেন দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায়, আমরা তাঁর মোটা কাচের চশমা দেখতাম। গান, সিনেমা, খেলা— হত অনেক কিছু। কালার আসতেই দৃশ্যটা বদলে গেল। প্রায় সবার ঘরে আলাদা টিভি ঢুকে পড়ল। সন্ধেবেলা রাস্তা ফাঁকা। কয়েক বছরের মধ্যে টিভির পার্টনার হল ভিসিআর, ভিসিপি। সেগুলো চালালে মাঝে মাঝে ঘরের দরজা বন্ধ রাখার সাবধানতা অবলম্বন করতে হত। জেঠুর টিভি দেখতে আর ভিড় হত না। টিভিটাও আস্তে-আস্তে খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। ছবি পরিষ্কার আসত না তেমন। কখনও একদম বন্ধ হয়ে যেত। ছাই-রঙা স্ক্রিনের ওপর এক ড্রপ মার্কারির মতো একটা আলোর বিন্দু স্থির হয়ে থাকত। ‘ওরে, একটু দেখবি?’ বলে ক্ষীণ হাঁক পাড়লে কেউ এসে হাজির হত বিরক্তমুখে। কমোডের মতো একটা ফাঁকা জায়গা ছিল টিভির তলায়। হামাগুড়ি দিয়ে সেখানে পৌঁছে টিভির পেটের মধ্যে কী সব নাড়াচাড়া করলে আবার যা হোক চালু হয়ে যেত। টিভি আর জেঠু, একসঙ্গে বুড়িয়ে যাচ্ছিল। আমার ধারণা জেঠু বিশেষ কিছু দেখতে পেত না। অভ্যেসে তাকিয়ে থাকত। টিভির স্ক্রিন চালু থাকলে অনেক সময়ে অদ্ভুত সব কাণ্ড হত। ছবি ভেঙেচুরে, ডিস্টর্টেড হয়ে, সে কী কাণ্ড! একদিন দেখি প্রবল বাঁটুল এক অমিতাভ মালপোয়ার মতো চ্যাপ্টা প্রেম চোপড়াকে তুমুল তড়পাচ্ছে। খুব হাসলাম। জেঠু বলল, ‘কী দেখাচ্ছে রে?’ কী করে বোঝাই! টিভির সাউন্ড বন্ধ হয়নি কোনওদিন। জেঠু ছবি ছাড়া খবর শুনে যেত দিনের পর দিন। মেড ফর ইচ আদার। শেষদিকে আর কিছু আসত না টিভিতে। ছাদে মড়ার খাটের মতো চেহারার খাঁচামার্কা অ্যানটেনা ভেঙে, তার ছিঁড়ে গিয়েছিল। কে সারাবে? তা সত্ত্বেও টিভি কথা বলে যেত। ভেতর থেকে মাঝে মাঝে দু’একটা কীসব যেন খসে পড়ত। তখন টিভি আবার বন্ধ হয়ে যেত। ওপরে, পাশে, জোরালো বা মৃদু থাপ্পড় মারলে ফের বেঁচে উঠত। একদিন বিকেলে এই অবস্থায়, শব্দ ফেরামাত্র ‘গোওওওল’ শুনে আমি বেজায় মুস্কিলে পড়ে গিয়েছিলাম। জেঠুর মুখে কিন্তু হাসি লেগেই আছে। কে দিল, কে খেল, কী হবে জেনে? খসে পড়া পার্টস্‌গুলো ছাড়াই যদি টিভি চলে, তাহলে ওগুলো আদৌ ছিল কেন কে জানে! 

    আমি জেঠুর কাছে যেতাম অন্য ধান্দায়। এই দুনিয়ায়, দেশে বা শহরে যা যা ঘটছে বলে জানছি, শুনছি, সেসবের কার্যকারণ সম্পর্কটা পরিষ্কার করে বলে দিত জেঠু। কাগজ পড়তে পারত না। খবরের অন্য সোর্স ছিল যথেষ্ট। একদা সেইল-এর বড় কর্তা। বহুদিনের অভিজ্ঞতা। বয়সের ভারে শরীর জীর্ণ হয়েছে। এখন বুড়ো হয়ে যাওয়া, কাজে-না-লাগা লোকের কাছে কেউ আসত না। সুবিধে হল, জেঠুকে অবান্তর পারিবারিক কোঁদল-কেচ্ছা, বিষয়-বিভ্রাটের গল্প শুনতে হত না। অনাদরের জীবন। একটা ক্যাকোফনিক আবছা জগৎ। বোধের জায়গাটাকে ঝাপসা হতে দেয়নি জেঠু। বুঝতে পারতাম। ঠিক এইখানে ছিল আমার আগ্রহ। যে-কোনও ঘটনা ঘটলে আগাছার মতো বেড়ে ওঠা রটনার কচুরিপানায় সবাই যখন হাবুডুবু খাচ্ছে, উত্তেজনা ছড়াচ্ছে, জেঠু তখন মাথা ঝুঁকিয়ে চুপ করে বসে ভাবত। টিভির পূর্ণ সমাধির পর জেঠুর হাতের নাগালে থাকত একটা ট্রানজিস্টর রেডিও। তার ব্যাটারি গলে গিয়েছিল। জল-রস বেরিয়ে পড়েছিল। জেঠুর চোখের মতো। আমি সরিয়ে-সুরিয়ে, আলাদা বাক্সে ব্যাটারি ফিট করে, তার জুড়ে, টেপ মেরে চালু করে দিয়েছিলাম। নানা রকম রেডিও-স্টেশন শুনত জেঠু। একদিন বলল, ‘আজ কি মেঘ?’ কেন জিজ্ঞেস করায় বলল, ‘পিকিং আসছে।’ আর একদিন বলল, ‘মস্কোতে ভালো বাংলা বলে।’ তারপর, ‘চোরের দেশ, কিন্তু বিবিসিটা ভালো।’

    তখন কলেজে পড়ি। দুম করে ইন্দিরা গান্ধীর ঘটনাটা ঘটে গেল। চারপাশে উত্তেজনা ছড়াতে শুরু করল। কে, কেন মেরেছে সেই নিয়ে রাস্তায় চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল। ট্রাক, ট্যাক্সিতে আগুন দেওয়ার খবর পাচ্ছিলাম। যেহেতু খুনিরা পাঞ্জাবের লোক। কলকাতায় এরা সবার আদরের, পছন্দের কম্যুনিটি। কী সহজে ভুলে গেল সবাই। একটু রাতে আমি দৌড়লাম জেঠুর বাড়িতে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হল বলো তো!’ সেদিন জেঠু যা যা বলেছিল, তার একটাও পরের দিনের কাগজে বেরোয়নি। টিভিতেও আলোচনা হয়নি। অনেক বছর পরে, একটু-একটু করে প্রকাশ পেয়েছিল। এরও অনেক বছর পরে জেঠু আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল রাজীব গান্ধীকে নিয়ে। এলটিটিই নামটা তখনই প্রথম শুনি। আবার একটা খারাপ ঘটনা ঘটে যাবে, আমরা কেউ ভাবতে পারিনি।

    জেঠুর সঙ্গে দেখা হল, আবার শুরু হবে যাওয়া-আসা। এটাই আনন্দের। এর মধ্যে অনেক পালাবদল ঘটে গেছে। আমরাও বদলে গেছি। কাগজ, রেডিও, টিভির জন্য কেউ আর অপেক্ষা করে না এখন। খবর সবার পকেট থেকে ঘোরাফেরা করে মুখে। আসল নিউজ তৈরি হয় মূল ঘটনা ঘটে যাওয়ার অনেক পরে। বঙ্গোপসাগরের নিম্নচাপের পূর্বাভাসে মাথা না দিলেও ঝড়ের পর তছনছ হয়ে যাওয়া জীবনের ছবি আমরা রসিয়ে দেখতে থাকি বিপদসীমার বহু দূর থেকে। অসহায়তার বিচিত্র রূপ লুপে ঘুরে আসে।

    ক্রুদ্ধ, উত্তেজিত, ধারাভাষ্যকারের অগ্নিবর্ষী শব্দমালার সুনামিতে আমাদের রক্তচাপ বাড়ে। ভাল লাগে অশান্তির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ শুনতে। রাজনৈতিক ভ্রষ্টাচার, বিকৃত যৌনাচার, নির্বিকার অমানবিকতা ছাড়া দুনিয়ায় ভালো আর কিছু ঘটে না বোধ হয়। যাই ঘটুক না কেন, তর্কের চড়ুইভাতি বসে যায় সঙ্গে-সঙ্গে। গলার শির তুলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা পরস্পরকে আঁচড়ে, কামড়ে, ক্ষতবিক্ষত করেন চির শীত-বসন্তের বাতাসিয়া স্টুডিওতে। ঝকঝকে কোটপ্যান্ট পরা চকচকে সঞ্চালকের ইন্ধনে। সকালে দাঁত মাজার আগে, রাতে শেষ পেগটা মারার মাঝখানের পুরো সময়টায়, একটু সুযোগ পেলেই আমরা বার বার দেখে চলি ডিজিটাল যুগের আরবান কক-ফাইট। স্ক্রিন রিফ্রেশ করতে থাকি অধৈর্য ভাবে। অবসাদ কাটিয়ে দিব্যি ফ্রেশ হয়ে উঠি। ভাগ্যিস জেঠুকে দুর্ঘটনায় সব কিছু তছনছ হয়ে গেলেও অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে রাবিশ সরিয়ে ঝটপট ট্রেন চালু হওয়ার পর নতুন যাত্রীদের বিস্ফারিত চোখে জানলা দিয়ে সাম্প্রতিক অতীতের উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ের দৃশ্যের ফোটোস্টোরি দেখতে হয় না।

    ডিজিটাল কারচুপি করে অনেক মিথ্যেকে আজকাল সত্যি বলে দেখানো হয়। সাংঘাতিক ট্রেন দুর্ঘটনা যে ঘটে গেল, সেটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না কি? আজকাল আমার মাথা ভোঁ-ভোঁ করে। কাগজ বন্ধ করেছি। টিভি নেই। খবরের ভাইরাস আটকানো যায় না কি? আমি বারান্দায় গেলাম। টানা গরমের পর একটু বৃষ্টি হয়েছে। পাতাগুলো সবুজ হয়ে আছে।

    ‘আসুন আসুন, বাবু রোজ বলেন, আসছেন না কেন? চলুন, চলুন!’ নতুন বাড়িতে পৌঁছে দেখি জেঠুর জায়গা হয়েছে দক্ষিণের একটা বড় ঘরে। অনেক জানলা। সামনে বারান্দা। গুলমোহর গাছটার ওপরে। চিকচ্যাক পাখি ডাকছে। বাকি ঘরগুলো অন্যদিকে। আগের বাড়ির বদলে নতুন বাসস্থান আর বেশ অনেকটা টাকা পাওয়ায় সবার সুবিধে হয়েছে। জেঠুর জন্য দিনরাতের লোক হয়েছে। সব থেকে জরুরি ব্যাপার, জেঠু আগের চেয়ে অনেক বেশি সচল। এটা কী করে হল জিজ্ঞেস করায় এক গাল হেসে বলল, ‘আমি আগের চেয়ে অনেক বেশি ফিট! বলব, বলব সব।’ যা বলল তার মর্মার্থ হল, আজকাল জেঠুর মন নাকি আগের চেয়ে অনেক ভাল আছে। তাই শরীরও। একদিন ‘এই দেখো তোমার জন্য কী এনেছি!’ বলে একটা প্যাকেট  বের করলাম। উজ্জ্বলার চানাচুর। জেঠু পছন্দ করত। হাত বাড়িয়ে বলল, ‘তোর মনে আছে?’ বুঝল কী করে? ‘জানিস তো, আমি গন্ধ পাই।’ জেঠু যে অনেক কিছু সেন্স করতে পারে, তা আমার অজানা নয়। কয়েকটা বাদাম বেছে খেল। জেঠুর ঘরে কোনও টিভি নেই, থাকার কথাও নয়। ‘তোমার রেডিও কোথায় গেল?’ ‘ফেলে দিয়েছি রে।’ একটু অবাক হলেও, ভেবে দেখলাম, এটাই স্বাভাবিক। এদিকে আমার যে মুশকিল হয়ে গেল! তাহলে কার সঙ্গে কথা বলব? কার কাছে কিছু জানতে-বুঝতে চাইব? আমার চেনাশোনাদের নিয়ে খুব অসুবিধে হয়। আমার সবাইকেই আজকাল রাজনীতির লোক বলে মনে হয়। সারাক্ষণ শুধু মিথ্যে কথা। কথা বলি না বিশেষ। শুনিও না। জেঠুকে আবার খুঁজে পেয়ে খুব শান্তি হল।

    জেঠু আমার খবর নিল, কী করি না করি। বললাম। শুনল। সব কথা বলিনি যদিও। জেঠু যেহেতু এখন সব খবরের বাইরে, কিছু জানতে-বুঝতে হলে আমাকেই জানাতে, বলতে হবে। রাশিয়া, পুতিন নিয়ে শুরু করলাম। পুতিন কি হিটলার? মিলিটারির কব্জায় থাকা পাকিস্তানের যথেষ্ট প্ররোচনা সত্ত্বেও ইন্ডিয়া কেন প্রত্যাঘাত করতে চায় না, সেটা অনেক বছর আগে জেঠু বুঝিয়ে বলেছিল। এখন অবশ্য সত্যিটা বুঝে নেওয়ার অনেক রাস্তা আছে। ইউটিউব অন্যতম। ঠান্ডা মাথায় রিসার্চ করলে অনেক কিছুই বুঝে নেওয়া যায়। এখন তো আমি যাদের অপছন্দ করি, বিরোধিতা করি, তারা কী বলছে সেটাও দেখে-শুনে নিই। আমার মতামত নিজের কাছেই সুরক্ষিত থাকে। কিছু ব্যাপার যদিও বোঝা অসম্ভব। মুশকিল হল, নেটে  ঢুকলে এর সঙ্গে অনিবার্যভাবে ঢুকে পড়ে আরও অনেক কিছু। সেসবের আকর্ষণ এড়াতে পারি, এমন নয়। মেজাজটা সারাক্ষণ খিঁচড়ে থাকে। 

    কীভাবে বোঝা মুশকিল, জেঠু ভেরি মাচ খবরের মধ্যে আছে। এখনও। ‘চিন ক্রমাগত বাঁদরামো করছে, অশান্তি পাকাচ্ছে, অথচ আমরা চুপ করে আছি কেন?’ জেঠু শান্তভাবে বলল, ‘কে চিল্লাবে? কী লাভ? সবাই সারা দুনিয়ার সব কিছু জানে। নুডল্‌স, সস্তা ইলেক্ট্রনিক্স ছাড়া চিনেদের সম্পর্কে কারুর কাছে কোনো ভাইটাল তথ্য আছে? সারা দুনিয়াকে খতম করে দেবে এরা। নিজেরাও হবে।’ এই ব্যাপারে কথা বলতে গেলে আমাকে আরও জেনে তবেই আসতে হবে। জেঠু একটু যেন মজা করে বলল, ‘তোদের ইউক্রেন কী করছে রে?’ জেঠু কি ইউক্রেনবিরোধী? কেন? আমি উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। ‘যুদ্ধটা ঠিক কোথায়, কতটা হচ্ছে, কেন, তুই জানিস? যা দেখছিস, সেটা তো দেখানো হচ্ছে। রাশিয়া কিন্তু অন্য কথা বলছে। তুই কোনটা নিবি এবার?’ এটা ঠিক যে, ফেক নিউজ এখন প্রচুর। ডিজিটাল কারচুপি করে অনেক মিথ্যেকে আজকাল সত্যি বলে দেখানো হয়। সাংঘাতিক ট্রেন দুর্ঘটনা যে ঘটে গেল, সেটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না কি? আজকাল আমার মাথা ভোঁ-ভোঁ করে। কাগজ বন্ধ করেছি। টিভি নেই। খবরের ভাইরাস আটকানো যায় না কি? আমি বারান্দায় গেলাম। টানা গরমের পর একটু বৃষ্টি হয়েছে। পাতাগুলো সবুজ হয়ে আছে। এক মাস ধরে একই হেডলাইন দেখছি, ‘বর্ষা ঢুকল দেশে, কলকাতায় কবে বৃষ্টি জানিয়ে দিল আবহাওয়া দপ্তর।’ ওসব দেখা বন্ধ করে দিয়েছি। সত্যি বৃষ্টি নামার অনেক পরে দেখলাম লিখেছে, ‘বৃষ্টিতে মানুষ স্বস্তিতে।’ এদিকে, চড়া রোদে পুড়তে-পুড়তে কারেন্ট ওয়েদার রিপোর্টে দেখি জলভরা মেঘ, তলায় হাই ভোল্টেজ কারেন্টের সিম্বল। এই ছ্যাবলামোগুলো না করলেই নয়? নিজেকে কীভাবে ডিসকানেক্ট করব বুঝতে পারি না। অসহ্য লাগে। ‘এত রেগে গেলে কী করে চলবে? সাইক্লোন তৈরি হওয়া, তার ইন্টেন্সিটির পূর্বাভাস, ল্যান্ডফলের অ্যাকিউরেসির অ্যানালিসিস, এগুলো সায়েন্স, প্রমাণিত বিষয়।’ চুপ করে রইলাম। রাগ হচ্ছিল। কথা ঘোরালাম। ‘কলকাতা না কি সমুদ্রের তলায় চলে যাবে?’ জেঠু হেসে বলল, ‘গেলে দেখা যাবে। টাইটানিক না কি যে, একদিন সকালে দেখলি বিছানা ভেসে যাচ্ছে?’ ‘তাহলে বলছে কেন?’ ‘সাউথ বেঙ্গলে রিয়েল এস্টেটের ব্যবসায়ীদের মধ্যে খুব রেষারেষি, বুঝলি না?’ জেঠু আমাকে খ্যাপাচ্ছে। গুলিয়ে দিচ্ছে। এই বয়েসে আছে, কিন্তু ভাল। মনে-মনে ভাবলাম, হিমালয় আবার ভাঙছে। যোশীমঠ ঝুলছে। আমরাও নিজেদের ঝুলে যেতে দিয়েছি মিথ্যেবাদীদের মাথায় তুলে। লগ স্টক ব্যারেল সবাই পাতালে নেমে গেলে জেঠুর কী আসে যায়? হি লিভ্‌ড হিজ লাইফ। তবে এই বুড়োকে আমি ছাড়ব না। কথা হবে। খেলা হবে। 

    এই মুহূর্তে যা নিয়ে ভীষণ রাগ হচ্ছে, অজস্র প্রশ্ন মনের মধ্যে, নিউজ না হলেও সেসব নিয়ে কথা হবে জেঠুর সঙ্গে। আগের দিন বলছিল, ‘কে কী দেখাল, সেটার চেয়ে মোর ইম্পর্ট্যান্ট তুই কী দেখলি। কী বুঝলি। বুঝতে তো অসুবিধে নেই, চোখ খোলা রাখলেই হল।’ আরে বাবা, বুঝব কী করে? মরুক দুনিয়া, আমি ফেঁসে আছি নিজের কাছে। অনেক ঝামেলা আমার। এই যেমন, আচ্ছা ও-প্রসঙ্গ থাক, অন্য কথা বলি। নিজের পলিটিক্যাল স্ট্যান্ডপয়েন্টটা কিছুতেই সেট করতে পারিনি। কনফিউশনে বেজায় ক্লান্ত। জেঠুর কাছে সেটিং তত্ত্ব বুঝে নিতে হবে। আঁটঘাঁট বেঁধে নিজের ফোন নিয়ে হাজির হলাম একদিন। দরকারে ব্যবহার করব। রেফারেন্স নিয়ে স্যাটাস্যাট লড়ব। উকিলদের মতো। জেঠু কিন্তু আমার পিছনে লাগাটা চালিয়ে যাচ্ছে অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির দিকে চোখ রেখে। তার রসবোধ এতটুকু টসকায়নি। কথা হচ্ছিল সিটি প্ল্যানিং, চার্লস কোরিয়াকে নিয়ে। দুম করে বলে দিল, ‘সব জায়গায় নীল-সাদা রং বলেই কি ধরে নিতে হবে এটা আর্জেন্টিনা?’ মাথা গরম না করে বললাম, ‘তুমি আর নস্যি নাও না?’ ‘নাহ্‌, আমার এখন অন্য নেশা।’ আমি একটা নির্দিষ্ট প্ল্যান করে এসেছিলাম। গিয়েই দুম করে ইন্টারভিউ শুরু করব না। সারাক্ষণ মাথা গরমের ডেকচিটা উল্টোতে হবে, তা নয়। একটু-একটু করে এগোব। চেপে ধরব। রোমেলের প্যানজার ডিভিশনের ট্যাঙ্কের মতো। হিউম্যান একজোডাসের প্রসঙ্গ উঠল। রোহিঙ্গাদের কথা বললাম। জেঠু যে এসবের খবরও রাখবে, সে-ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম। ‘পরিযান নতুন কিছু ব্যাপার নয়। আমার বড় ছেলেও তো আমেরিকাতে সেট্‌ল করে গেছে। জানিস বোধ হয়, প্রেসিডেন্সির গোল্ড মেডেলিস্ট ছিল। তা সে যেতেই পারে। সেভেন্টিজের কলকাতায় চাকরির হাল কেমন ছিল সেটা সবাই জানে। যেটা কেউ জানে না তা হল, আসলে সে পালিয়ে গিয়েছিল। নকশাল করত। সে নাকি ছিল ওদের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক! পুলিশ এসে আমাকে বলল, আপনার ছেলেকে সরান, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। ওয়ারেন্ট আছে। সেই যে গেল, ফেরেনি আর। ফিরলে ওকে পাবলিক মেরে দিত। এসেছে কয়েকবার, অনেক পরে। ততদিনে লোকে সব ভুলে গেছে।’ এসব জানতাম না। জেঠু কোনোদিন বলেনি। আজ বলছে। 

    একটা বয়েসের পরে, বয়েসে তফাতের ব্যাপারটার গুরুত্ব কমে যায়। এই যে আমার হাল খুব খারাপ, কেউ জানে না, কিন্তু আমি জানি যে একটা আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগছি, এমন অনেক কিছু করছি যা ঠিক নয়, এসব কি জেঠুকে বলা যেতে পারে? আর কাউকে বলার নেই যে! এই যে আমি এখন আমার ফোনে আর একটা উইন্ডো খুলে যেটার দিকে এমনিই তাকিয়ে আছি, সেটা দেখতে পেলে জেঠু নিশ্চয়ই সমর্থন করবে না। এ-বাড়িতে আসাটাই বন্ধ হয়ে যাবে। একটাই ভরসা, জেঠু ডিটেইলে কিছু দেখতে পায় না। জেঠুকে সেলফোনের কথা বললাম। একটু শুনে বলল, জানে। আমার ফোনের আলোকিত স্ক্রিনের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। কেউ স্বীকার করবে না, কিন্তু সবাই চেনে, একটা পর্নস্টারের ছবি। আলো-অন্ধকারের বাইরে যে-লোক কিছু অনুভব করে না, সে ওটার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলল, ‘মিডিয়া হেডলাইন করে না, করি আমরা। কোনো খবরই নিউজ নয়। কিছুই নতুন নয়। যার কাছে যখন যে-প্যাকেটটা ইম্পর্ট্যান্ট, তার কাছে সেটাই জরুরি। আমরা আলাদা লোক, আমাদের খবরও আলাদা।’ এ-কথা মাথায় আসেনি কোনোদিন। ‘কোনটা মেক্‌স সেন্স, কোনটা সুকুমারের ননসেন্স, কোনটা সেনসিটিভ, কোনটা সেন্সুয়াস, এটা কি নতুন করে শিখতে হয় না কি? তবে হ্যাঁ, কনফিউশন থেকেই যায়। তাহলে কি করণীয়?’ বলে জেঠু থামল। চুপ করে রইলাম। উত্তরটা চিরকাল জেঠুই দিয়ে এসেছে। বলল, ‘ক্রনোলজিটা বুঝতে হয়। আগে কোথায় কখন কী কী ঘটেছে, সেটা জানতে পারলে সুবিধে হয়। কার মনের মধ্যে কী চলছে, কেন, বুঝতে সুবিধে হয়। এখন কাজটা একটু সহজ হয়েছে। যদিও বুঝে আজ অবধি কারুর কোনো উপকার হয়নি। ইয়েট, কিউরিওসিটির কি শেষ থাকে না কি?’ বলে, জেঠু নিজের বালিশের তলায় হাত ঢুকিয়ে কী যেন খুঁজতে লাগল। পেয়েও গেল। একটা ট্যাব। ‘একটু খুললেই সব বেরিয়ে পড়বে।’ ট্যাবের তলার গোল রিং বোতামে জেঠু আঙুল ছোঁয়ানোর সঙ্গে-সঙ্গে স্ক্রিনে আলো খেলতে শুরু করল। জেঠু একটা ডেঞ্জারাস হাসি হেসে বলল, ‘ডন অফ সিভিলাইজেশন। খুললেই ভোর। সুইচ অফ করলেই রাত।’ চশমার মধ্যে জেঠুর চোখ জ্বলজ্বল করতে লাগল। বাঘের মতো। 

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook