আসন্ন দুর্গাপুজোর অপেক্ষায়, সেপ্টেম্বর মাস থেকেই যেন চারদিকে একটা উৎসবের আবহাওয়া গড়ে ওঠে। মেঘ সরে যে নীলের ছোঁয়া দেখা যায়, তাকে আমরা একমাত্র পুজোর আকাশ নামেই চিনি। এ-শহরে, দুর্গাপুজোর প্রকৃত পরিচয় যেন সুবিস্তীর্ণ এক শিল্প উৎসব হিসাবে— মন্ডপে-মন্ডপে, লোকসমাগমে প্রাণবন্ত যে সাইট-স্পেসিফিক ইন্সটলেশন আমরা দেখতে পাই, তার জুড়ি পৃথিবীতে মেলা ভার।
প্রবাদপ্রতিম শিল্পী সোমনাথ হোরের জন্মশতবর্ষ রেট্রোস্পেকটিভ; দশানন রাবণের বলিউডি নায়ক-রূপে বিনির্মাণ; শুধুমাত্র সাদা-কালোয় একটি গোষ্ঠী প্রদর্শনী। মণ্ডপে শুধু নয়, শহরের গ্যালারি এবং শিল্পকলাকেন্দ্রগুলিতেও থাকছে বৈচিত্রেরই জয়জয়কার।
১০০ ইয়ার্স অফ সোমনাথ হোর
আকার প্রকার; অক্টোবর ১৫ অবধি
সোমনাথ হোরের শতবার্ষিকী উদযাপন বাংলার শিল্প সম্প্রদায়ের পক্ষে গর্বের বিষয়; আকার প্রকারে তাঁর কাজের বিস্তারিত প্রদর্শনীতে এই আবেগ পুরোমাত্রায় উপস্থিত। দেশের ইতিহাসে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাওয়া একটা সময়ের সাক্ষী যে শিল্পী, তাঁর শিল্পযাপন, এবং তাঁর শিল্পে সেই সময়, এবং সময়োত্তীর্ণ প্রতিফলন, এই প্রদর্শনী তুলে ধরে।
সোমনাথ হোরের রাজনৈতিক অবস্থান এবং তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা তাঁর শিল্পকর্মের থেকে আলাদা ছিল না। এই অভিজ্ঞতা আরো বহু শিল্পীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, কিন্তু তাঁর ইমেজারি অনন্য, এবং শিল্পের প্রযুক্তিক উৎকর্ষে প্রায়-অতিমানবীয় শ্রেষ্ষ্ঠত্বের দৃষ্টান্তস্বরূপ। তাঁর ‘উন্ডস’ সিরিজের ছাপচিত্র, অসাধারণ শৈলীতে আঁকা কালি-তুলির কাজ এবং তাঁর কাব্যময় ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য্য— সোমনাথ হোর নামের শিল্পীর সঙ্গে প্রথম পরিচিতি, বা বার-বার তাঁর কাজে ফিরে যাওয়ার তাগিদ, এবং সেই আকর্ষণের উত্তর খোঁজা, দুই-ই শুরু হতে পারে আকার প্রকারের প্রদর্শনী থেকে।
‘কো-একজিস্টেন্স’, গোষ্ঠী প্রদর্শনী
বিড়লা আকাদেমি, সেপ্টেম্বর ১১ অবধি
৪৫-জন শিল্পীদের কাজ নিয়ে চলছে ‘কো-একজিস্টেন্স’, যার প্রধান বিষয় আলো-আঁধারের খেলা। এচিং, কাঠ-খোদাই, অ্যাক্রিলিক এবং কালি-পেনের কাজে দেখা যাবে শুধু দুটো রং— সাদা আর কালো। থাকছে প্রতিষ্ঠিত এবং তরুণ উদীয়মান শিল্পী, দু-দলেরই কাজ।
‘রুম ফুল অফ মিররস্’, প্রবীর গুপ্ত
কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটি, সেপ্টেম্বর ৩০ অবধি
প্রবীর গুপ্ত উত্তাল সত্তরের দশকের তরুণ; তাঁর কাজে বহমান অস্থিরতাই একমাত্র ধ্রুবক। দ্রুত পরিবর্তনশীল জীবনের মেটাফর হিসাবে তাই তাঁর প্রদর্শনীর নামাঙ্কন; বর্তমান সমাজ যেন এক ঘরভর্তি আয়নায় শুধু নিজেদের অবিরাম প্রতিফলন।
প্রবীর গুপ্তের ক্যানভাসগুলি বিশালায়তন। কিন্তু একই সঙ্গে, তাঁর বিস্তারিত ন্যারেটিভে এই বিশাল আকার প্রমাণিত সত্য; যন্ত্রণাদায়ক, কিন্তু অননুতপ্ত শিল্প।
কেসিসি আর্টস ল্যাব ৭.০: রাবণ রিলোডেড
কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটি, সেপ্টেম্বর ১১, সন্ধ্যা ৬.৩০
রামায়ণের ‘পুনরাবৃত্তি’ বা ‘পুনর্গঠন’ নয়, দেবাশিসের পরিচালনা, চিত্রনাট্য এবং শিল্প নির্দেশনায় রাবণ রিলোডেড-কে বলা যেতে পারে দশাননের কাহিনিকে সম্পূর্ণ অন্যরূপে তুলে ধরা একটি উপস্থাপনা। নিখাদ অশুভের প্রতিমূর্তির বদলে রাবণ এই ‘নাটকে’ বরং একটি সামাজিক নির্মাণ। তার ক্ষমতার জন্ম দেয় ত্রুটিযুক্ত সামাজিক পরিকাঠামো।
কেসিসি’র ‘থিয়েটার ল্যাব’-এর থেকে উঠে আসা রাবণ রিলোডেড একটি সাইট-স্পেসিফিক নাটক, যেখানে সারা বাংলা থেকে অডিশনে বাছাই করা দশজন অভিনেতা অভিনয় করবেন।
সময়োপযোগী এই নাটকের সংস্করণে নায়ক রাবণ বলিউডে নাম কেনার দিবাস্বপ্ন দেখে। রামলীলা অভিনয়কারী পিতার শিল্পধারা পুত্র সহ্য করতে পারে না, এবং নতুন সুযোগের খোঁজে তাই অযোধ্যার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে সে পাড়ি দেয় সুদূর মুম্বইয়ে। কিন্তু শহর নিষ্ঠুর, এবং রাবণের ভাগ্যে জোটে শুধু অপমান এবং লাঞ্ছনা। এক সময়ে, ভাগ্যের নিদারুণ পরিহাসে এবং নামের সাযুজ্যে তাই সে হয়ে ওঠে মন্দ রাবণ; ভয়ানক এক অপরাধী।