ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • সামথিং সামথিং: পর্ব ১৬


    চন্দ্রিল ভট্টাচার্য (October 2, 2021)
     

    বিশ্বাসবাবু বাড়ি নেই

    আপনি সমুদ্রকে বিশ্বাস করে পুরী গেলেন, সুনামি এসে হোটেলের দোতলার বারান্দা থেকে পোষা টিয়া মুচড়ে নিয়ে ধাঁ। আপনি দপাস-দপাস হাঁটছেন আর বিশ্বাস করছেন পায়ের তলার মাটি চির-স্টেডি ঘাঁটি, সহসা ৮.৩৩ রিখটারে ভূমিকম্প আছড়ে চৌচির, ১৩টা গ্রাম তলিয়ে হাপিস। আয়ুকে বিশ্বাস করে পোস্টাপিসে টাকা রাখলেন, ১০ বছর বাদে ডবল হবে আর আপনি উদযাপন-বিরিয়ানি সাঁটাবেন রায়তা সহ, ও হরি, হার্ট-বাবাজি পরের মঙ্গলবারেই চকিত ডিগবাজি খেয়ে চাকরি ছেড়ে দেশে চলে গেল, শত ভেন্টিলেটর বাগিয়েও ঘুলঘুলিবাচক রশ্মি এসে পড়ল না লাস্ট সিনে। জীবন অনিত্য, পৃথিবী টলায়মান, লোকাল ট্রেনের মতো নিয়মিত ধূমকেতু মহাশূন্য দিয়ে সাঁইসাঁই, একটা স্লাইট ডাইনে কান্নিক খেয়ে ল্যাজের ঝাঁটা দিয়ে টাচ করলেই কোথায় মাসি কোথায় পিসি কোথায় ডায়াল টোন, তার মধ্যে বিশ্বাসের মতো গাম্বু ম্যাটার এসে চেয়ার টেনে বসছে কোত্থেকে?

    খোদ খবরের কাগজ রোজ গায়ে পড়ে অবিশ্বাস প্রচার করে যাচ্ছে। হেডলাইন দাবড়ে শেখাচ্ছে, বিশ্বাস করেছ কি মরেছ। ছোট মেয়ে কাকুকে বিশ্বাস করে পাড়ার লজেন্স খেতে যায়, ধর্ষিতা হয়। হাতি রেলগাড়ির শুভবোধকে বিশ্বাস করে লাইন পার হয়, কাটা পড়ে।

    অথচ বিশ্বাস সতত গামবাট, চব্বিশ-চাকা ট্রাকের মতো ধ্যাসকা, দৃঢ়, রাস্তা জুড়ে এমন দাঁড়িয়ে থাকে, সহজ বুদ্ধি ঢুকতে সাইড পায় না। পদে পদে, বাজারের গসিপে, সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এ, বাড়ির সামনের রাস্তায়, রাস্তার সামনের চায়ের দোকানে, ঘটনা ও তার ৭০০ ভায়রাভাই এসে পইপই বলে যায়, বিশ্বাস কোরো না বিশ্বাস কোরো না, ভগবানকে বিশ্বাস কোরো না জ্যোতিষীকে বিশ্বাস কোরো না মন্ত্রীকে বিশ্বাস কোরো না মাসতুতো দাদাকে বিশ্বাস কোরো না মিঠে ঝিরিঝিরি হাওয়াকে ভি বিশ্বাস কোরো না তুমি গোড়ালি চুলকোতে নিচু হয়েছ কি হওনি ও শনশন ঝড় বনে উড়িয়ে নিয়ে যাবে প্রেমপত্তর ও টুথব্রাশ। তবু গোদা আশা বগলে চেপে নিয়ে নিরক্ষর চাষার মতো আমাদের পথ-চলা, সব ভাল হবে সব দুর্দান্ত হবে ও যখন কথা দিয়েছে বাড়ি বয়ে এসে টাকা দিয়ে যাবে। এখন ফোন ধরছে না, নিয্যস বাথরুমে আছে। তা হয়? তোমার বাপের গার্জেনরা সবাই সম্পত্তি মেরে দিল, তোমার কাছ থেকে বন্ধু পুরো ফিজিক্সটা টুকল আর কেমিস্ট্রি পরীক্ষার দিন বলল ডিসটার্ব করিস না, দোকান করতে করতে কাক দেখতে উপরে তাকিয়েছ তো দু’কেজি চাল থেকে দু’মুঠো গাপ। 

    এই তো একজন ‘ফ্যান’ সিনেমার ট্রেলারে ‘জোবরা ফ্যান’ গান শুনে, মহা-প্রীত হয়ে, হল-এ গিয়ে দেখেন, ই কী, গানটা ফিল্মে কই? তেড়ে মামলা। প্রযোজকেরা বললেন, আরে, ওটা তো স্রেফ প্রোমো! উত্তরে আদালত বললেন, ট্রেলারের কাজটা কী? সিনেমায় যা যা আছে, তা থেকে স্যাম্পল বাগিয়ে মানুষকে হিন্ট দেওয়া। তাহলে সেথায় কী করে এমন পুর ঠুসে দাও, যা ছবিতে আদৌ নেই? প্রযোজকরা ফের আওড়ালেন, এরকমটাই আজকাল হয় স্যার। আদালত ফিরতি জিগালেন, ‘এরকমটাই হয়’, আর ‘এরকমটাই হওয়া উচিত’— এ দুটো একই কথা, কে বললে? মোক্ষম কোশ্চেন। আমরা ধরেই নিই, যেটা চলতি, সেটা নির্ঘাত ঠিক, নইলে আর চলছে কেন? লোককে ঈষৎ-বিস্তর ঠকানো এখন ‘চলতা হ্যায়’। জনগণেরই দায়িত্ব সেসব বিক্রয়-স্ট্র্যাটেজি সাপটে বুঝে, নিজের মনের হ্যান্ডেলে কিঞ্চিত লবণ ছিটিয়ে রাখা (বিটনুনও চলবে)। ক’বছর আগে একজনকে নিয়ে প্রকাণ্ড হররা ঘটেছিল, তিনি ডিওডোব়্যান্ট কোম্পানির নামে মামলা ঠুকেছিলেন। বিজ্ঞাপনে দেখানো হয়, ওই ডিও মাখলে মেয়েরা পালে পালে এসে গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, কিন্তু বাস্তবে তিনি সম্বচ্ছর প্রাণপণ উক্ত ডিও মাখার পরেও একটি ললনাও কাছ ঘেঁষেনি, তাই আদালতে নালিশ। সকলেই গড়াগড়ি, তবে তো টিভি দেখে বিশ্বাস করতে হয় ছায়াও আঠিয়ে যায় ফেভিকলের কৌটোর গায়ে, কিংবা হ্যাপিডেন্ট খেলে লোকের দাঁত থেকে সার্চলাইটের আলো ঠিকরোয়। কিন্তু ভদ্রলোকের দোষটা কী? উনি যা দেখেছিলেন, তা স্পষ্ট অমলিন বিশ্বাস করেছিলেন। মিথ্যে প্রচার যে করবে, দোষ তার নয়, বিশ্বাস যে করবে, সে উজবুক। এই হল এ যুগের পুন্টু-প্যারাডক্স।

    ক’বছর আগে একজনকে নিয়ে প্রকাণ্ড হররা ঘটেছিল, তিনি ডিওডোব়্যান্ট কোম্পানির নামে মামলা ঠুকেছিলেন। বিজ্ঞাপনে দেখানো হয়েছিল, ওই ডিও মাখলে মেয়েরা পালে পালে এসে গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, কিন্তু বাস্তবে তিনি সম্বচ্ছর প্রাণপণ উক্ত ডিও মাখার পরেও একটি ললনাও কাছ ঘেঁষেনি, তাই আদালতে নালিশ।

    যখন কেউ বলে, ‘অ্যাত্ত ভালবাসি, কক্ষনও ছেড়ে যাব না, ফরেভার চিপকে গেলাম’, তন্মুহূর্তে তা বিশ্বাস করি বটে, কিন্তু একই ক্যান্ডিডেট মাস-আষ্টেক পর কেশেকুশে যেই জানায়, ‘ইয়ে, চল্লুম’, তখন সেই প্রাচীন কোটেশন মনে করিয়ে বিশেষ লাভ (love) ঘরে তুলতে পারি না। বন্ধুর কাছেই এ নিয়ে হাঁউমাঁউ রচতে তোতলাই, আদালত তো দূরস্থান। যদি কেউ বলে ‘অমুক ফান্ডে টাকা রাখো, মাসে দ্বিগুণ!’, আর তারপর সেই চিটফান্ড পোঁ-পাঁ পাততাড়ি গোটায়, তখন আমি ডুকরে উঠলে লোকে ফেরেব্বাজকে যত দোষ দেবে, আমায় গালাবে তার দেড়া। কতশত লোক তো কানহাইয়া কুমারকে সমাজতন্ত্রের টগবগে সারথি বলে বিশ্বাস করে, ‘এইবার তরুণ তুর্কির ফিট-পেশি অবলম্বিয়ে ফের রক্তনিশান পতপতাবে রে!’ পুলকে প্রাক-ফুলশয্যার ন্যায় রক্তিমাভা ধারণ করলেন। সে দীপ্তি বাসি পমেটমের ন্যায় তাঁদের গণ্ড ও হৃদিতল হতে রগড়ে মুছে কানহাইয়া কংগ্রেসে যোগ দিলেন, কারণ সেই দল ‘দেশের প্রাচীনতম ও সর্বাধিক গণতান্ত্রিক সংগঠন’। বামপন্থীরা ভোট-মানচিত্র থেকে উবে গিয়ে, ইদানীং আঁতেল-ওষ্ঠ চকিয়ে অফবিট-সংস্কৃতি খেলছেন: সুনীল গাঙ্গুলি কেন হতে যাব ছ্যাছ্যা, মোরা কমলকুমার। সংসদীয় গণতন্ত্র নিয়ে মাতোয়ারা থাক আখের-গোছানি বেনে-মুৎসুদ্দি, মোরা মেহনতি মানুষের কল্যাণে নাড়ি উগরে আকুল। সেই ফেসবুকনিতে কানহাইয়া ছিলেন মেগাস্টার, কারণ তিনি পেল্লায় সরকার-বিরোধী আন্দোলনে গ্রেফতার, সিস্টেমদ্রোহী স্লোগানমোহী ছাত্রযুব আন্দোলনের পোস্টার-বয়, তাঁর বক্তৃতায় লাইক দিতে দিতে লোকের আঙুল ফুলে কাঁঠালি-কদলী, পারলে চে গেভারার পাশে তাঁর হাস্য-ক্লোজাপ গেঞ্জিও পসার হাঁকড়ায়।

    এহেন লোক তুড়ুক-ডিগবাজি খেয়ে ল্যান্ড করলেন কিনা সেই কংগ্রেসে, যে যুগ যুগ ধরে বামপন্থীদের গেছো-টার্গেট পেঁচো-শত্তুর, আর হবি তো হ পার্টি অফিস থেকে এসি-টাকে খুলে নিয়ে চলে গেলেন! এর চেয়ে উত্তপ্ত আবহ আর কেউ তৈয়ার করেছেন কি? এসি তাঁর পয়সায় লাগানো হয়েছিল ভাল কথা, কিন্তু তা বলে সর্বহারার নেতারা এখন আদর্শ-ফ্যাচাং ও রৌদ্রঘচাং— উভয়ের থাবড়ায় ঘেমেনেয়ে ম্যানিফেস্টো বিতাবেন! ঠিকই, উহাদের শৃঙ্খল ছাড়া হারাবার কিচ্ছুটি নেই, তাই একপিস শেকল রেখে যা-ই নিয়ে যাও ভেরিগুড, আর কানহাইয়া শত গোপিনী সহস্র বিরহিণীকে রোদনের গলাজলে চুবিয়ে অন্য বেন্দাবনে গমন করেছেন তা-ও পৌরাণিক জাস্টিস, কিন্তু এই ছিঁচকেমোর পর লোকে পরবর্তী বামপন্থী আইকনটিকে (যদি আগামী ৭৭ বছরে সে অবতারের উদয় হয়) বিশ্বাস করবেন কোন প্রাণে? ইউটিউবে তাঁর বুর্জোয়াঘাতী পুঁজিবাদ-থাবড়ু ক্রাউড-খ্যাপানি বক্তিমে শুনে তাঁরা কীভাবে নিশ্চিত হবেন, উনি যদি তরশু তৃণমূল বা আপ-এ কাছাকোঁচা লুটিয়ে প্রস্থান করেন, তবে গিজার, মাইক্রোওয়েভ, লুডোবোর্ড বগলে গ্যাঁড়া দেবেন কি না!

    বামপন্থীরা ভোট-মানচিত্র থেকে উবে গিয়ে, ইদানীং আঁতেল-ওষ্ঠ চকিয়ে অফবিট-সংস্কৃতি খেলছেন: সুনীল গাঙ্গুলি কেন হতে যাব ছ্যাছ্যা, মোরা কমলকুমার। সংসদীয় গণতন্ত্র নিয়ে মাতোয়ারা থাক আখের-গোছানি বেনে-মুৎসুদ্দি, আমরা মেহনতি মানুষের কল্যাণে নাড়ি উগরে আকুল। সেই ফেসবুকনিতে কানহাইয়া ছিলেন মেগাস্টার।

    ফ্রান্স অবধি এখন দেখা হলেই দু’গালে সপাসপ চুমু খাচ্ছে না। এ তাদের চিরকালীন আপ্যায়ন-আদর, অচেনা লোকের সঙ্গে সদ্য আলাপ হলেও তার দুটি গালে ওষ্ঠাধর চেপ্পে সাঁটাই দস্তুর। কোভিড এসে অন্যের মুখের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে গিয়েছিল, অনেকে বলেছিলেন, দুটো করে ভ্যাকসিনের পর নির্ঘাত প্যারিস ফিরিবে প্যারিসেই, এই ‘la bise’ আদর উনিশ-বিশ হতে হতে অধিষ্ঠান করবে ফের তার স্বরূপেই, কক্ষনও এই ঘনিষ্ঠপ্রথা ভয়ের আড়ালে স্ফুরিত উৎসুক ঠোঁট লুকোতে পারে না। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, চেনা লোকদের যদি-বা মাঝেসাঝে এই অভ্যর্থনা জোটে, অচেনা লোকের দশা ভারতীয়দের মতোই, শুকনো নমস্কারে তারে ফেরানো হতিছে। হে অমৃতের পুত্রকন্যাগণ, তবে ভ্যাকসিনের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, না ভাইরাসের প্রতি? পটাস পটাস চুম্বন কি ফ্রান্সের মতো অলজ্জ আশ্লেষ-ভজা দেশ থেকেও পাততাড়ি গুটিয়ে শেষে ঘুরপথে তালিবান অনুশাসনেরই মিক্সার-গ্রাইন্ডারে চূর্ণ হল, না তা অবিলম্বে তার লালা ঘ্রাণ আলিঙ্গন সহ দাপুটে প্রত্যাবর্তন ঘটাবে? কোভিড কি পেড়ে ফেলল আমাদের অন্যের স্বেদ ও স্বাদ গ্রহণের নাছোড় নোলা, তবে কি প্রেমের প্রতি কামের প্রতি দপদপে উদ্যত বিশ্বাসও, শার্টে গুড়গুড়োনো ছোট্ট কালো পোকার ন্যায় আমরা চটাস ঝেড়ে ফেললাম নিভন্ত ঝোপে ও ফুটপাথে? বিশ্বাসবাবু ফেরে পড়ে ফিসফাস অন্তে বলে, যদ্দূর মনে হয় আমারও চাকরি গেল, এখন জমানো পুঁজিতে যদ্দিন ঠাট বজায় থাকে।

    ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook