ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • হিয়া টুপটাপ জিয়া নস্টাল: পর্ব ৩৫


    শ্রীজাত (April 23, 2024)
     

    শব্দের সুর

    সুরধুনি সঙ্গীতালয়’ আর ‘মডার্ন টাইপিং স্কুল’, এই দুজন ছিল পাশাপাশি। দু’খানা প্রায়-পড়তি রংচটা দোতলা বাড়ি, একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকত যারা। তাদের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে গিয়ে মনে হতেই পারত যে, এরা দুজন অভিমানাহত প্রেমিক-প্রেমিকা, বা প্রাচীন দুই বন্ধু যাদের আজ কথা বন্ধ। এমনই এক নিকট দূরত্ব ছিল তাদের মধ্যে। দু’বাড়ির মাঝামাঝি কোনও পাঁচিল নেই, গায়ে-গতরে এবং পরিস্থিতি ও অবস্থাতেও তারা একই গোত্রের, কিন্তু কোথাও যেন কিছু একটা ছিল, যারা এই এত মিলের মধ্যেও একখানা অমিলের অদৃশ্য পরিখা টেনে রাখত। সেইটাকে আরও বেশি করে প্রমাণ করবার জন্যই হয়তো একজন হয়েছে সঙ্গীতালয়, অন্যজন টাইপিং স্কুল।

    খুলেই বলি তাহলে। আমাদের পুরনো ছোট পাড়ার রাস্তাতেই দেখা মিলেছিল এদের দুজনের, আমরা প্রথম প্রথম বাসিন্দা হবার পরপরই হবে হয়তো। আমাদের আস্তানা থেকে বেরিয়ে ডান দিকে বাঁক নিলে দু’ভাবে যাওয়া যেত গড়িয়ার কোলাহলময় বড় রাস্তার দিকে। তার আগে অবশ্য পেরোতে হত আদিগঙ্গার উপর দিয়ে সেতু। সে নামেই সেতু যদিও, আদতে সিমেন্টের একফালি বাঁকানো চাঁদ, যার উপর সওয়ারি বেশি হয়ে গেলে গল্পগাছা শুরু হয়ে যেত। সে যা হোক, বাড়ি থেকে বেরিয়ে ডানদিকে ঘুরে বাঁ-দিক নিলে ছিল চওড়া রাস্তা, আর সিধে চলে গেলে ছিল পুকুড়পাড় ঘেঁষা একচিলতে একখানা রাস্তা, যে, সেই আবারও, অনেক বেঁকেচুরে সেই সেতুর দিকেই চলেছে।

    এই দ্বিতীয় পথকে ঠিক ‘রাস্তা’ আখ্যা দিলে বাড়াবাড়ি হবে, সে যেন ছিল কোনও বড় রাস্তারই ছোটবোন, বাড়িতে অতিথি এলে যার কাজ ছিল পর্দার ওপাশ থেকে দেখেই পালিয়ে যাওয়া। কেননা সে মুখচোরা, কারণ সে রোগাসোগা। রাস্তাদের মধ্যেও কি এমন সব ছোটবোনেরা থাকে না? ওই একজন ছিল তেমনই ছোটবোন, পায়ে চলা পথ। আমাকে কোনও ভাবে সেতু অবধি বা তারও পরের বিশাল পৃথিবীতে পৌঁছতে হলে আমি ওই রাস্তাকেই, মানে, ছোটবোনকেই বেছে নিতাম। সেখানে লোক চলাচল কম, পুকুর থেকে ব্যাঙের ডাক আর ঝিঁঝির ডাক শোনার সুযোগও বেশি। বাঁ হাতে একখানা বইপত্তরের দোকান আছে, সে বেশিরভাগ সময় বন্ধ, আর ডান হাতে একটা ছোট্ট পান-বিড়ির দোকান, সে সারাক্ষণই খোলা। এদেরই দুপাশে রেখে যেন সেই ছোটবোনের অপটু বিনুনি এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে পথ হয়ে। সন্ধের দিকে, খেলাধুলো শেষ হলে, আমি সেই পথ ধরে দু-একটা চক্কর মেরে আসতাম।  

    কেন? সেই ওই দুই পাশাপাশি দাঁড়ানো অভিমানাহত বাড়িদের জন্য। একজন ‘সুরধুনি সঙ্গীতালয়’, আরেকজন ‘মডার্ন টাইপিং স্কুল’। দ্রষ্টব্য তেমন কিছুই নয়, কোনও পথচলতি পথিক ফিরেও তাকায় না সে-দুই বাড়ির দিকে। আমি কেবল গিয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকতাম; তারপর, যেন কত কী ভাবছি, এমন একখানা ভাব নিয়ে এদিক-ওদিক পায়চারি করতাম, কিন্তু বাড়িদুটোর সামনে থাকতাম অনেকক্ষণ। দুই বাড়িরই একতলা ও দোতলায় পাশাপাশি দুটো করে গ্রিল-দেওয়া জানালা, তাতে মলিন পরদা ঝুলত সারাক্ষণ, দুয়েরই ভেতরে উঁকি দিলে দেখা যেত চলটা উঠে আসা দেওয়াল, তাতে লাগানো টিমটিমে একখানা টিউব। এই পর্যন্তই। এখন কথা হচ্ছে, দেখার মতো যখন ছিল না কিছুই, তখন ওই একরত্তি আমি, ও-দু’খানা বাড়ির সামনে ওরকম ভাবে দাঁড়াতাম বা ঘোরাফেরা করতামই বা কেন?  

    কেননা, শোনার মতো অনেক কিছু ছিল। ‘সুরধুনি সঙ্গীতালয়’-এ কারা যে আসত, তা আমি জানি। কারণ মাঝেমধ্যেই দেখতাম বাধ্য এবং গোমড়া মুখের, আমারই বয়সি ছেলে বা মেয়ে তাদের অভিভাবকদের হাত ধরে বেরোচ্ছে আর ঢুকছে। ওই রকম স্কুল-অতিক্রান্ত বিকেলবেলা খেলাধুলো ছেড়ে, গান শিখতে যাবার ইচ্ছে বাচ্চাদের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে থাকবার কথা নয়, ছিলও না। একরকম জোর করেই বোধহয় বাবা-মায়েরা নিয়ে যেতেন তাদের। আর আমি বাইরে দাঁড়িয়ে শুনতাম তাদের শেকল-পরা গান।  

    গান তো একরকম শুনেই আসছি ছোটবেলা থেকে, কিন্তু এই ‘মডার্ন স্কুল’ না থাকলে আমি অন্তত জানতেই পারতাম না যে, লেখারও একরকমের শব্দ হয়। লিখতে দেখেছি বাবাকে; বাড়িতে, নিউজপ্রিন্টের প্যাডের ওপর বল-পয়েন্ট পেন দিয়ে।

    কী গাইত তারা? কেন? বাইরে বোর্ডের নীচেই তো লেখা আছে। ‘যত্ন সহকারে রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত ও আধুনিক শেখানো হয়’। বুঝতাম, আগের চারজনের তৈরি গান যথেষ্ট আধুনিক নয় তার মানে। কিন্তু বাইরে দাঁড়িয়ে শুনতে বেশ লাগত। তখনও ‘গ্রুপে শেখানো’র ব্যাপারটা চালু হয়নি, একেকজন বাচ্চাকে আলাদা করে তালিম দেওয়াই ছিল চল। আমার বাড়িতেও তো সেটাই হত। কেউ ইমনের তালিম পাচ্ছে, কেউ শ্যামকল্যাণের, আবার কেউ টোড়ির। সে তো রোজ শুনছি দু’বেলা। কিন্তু এসব গান শুনতে চাইলে ‘সুরধুনি’ ছাড়া উপায় নেই। তাই আমি সন্ধের মুখটায়, বাড়ি ফেরার আগে ওখানে গিয়ে দাঁড়াতাম। ওইসব গোমড়া বাচ্চারাই হয়তো আগামীর সন্ধ্যা-আরতি-প্রতিমা-নির্মলা, বা ভবিষ্যতের হেমন্ত-মান্না-শ্যামল-মানবেন্দ্র।কে বলতে পারে?  

    কিন্তু ঠিক এই মোক্ষম সময়েই ‘সুরধুনি’র সঙ্গে ‘মডার্ন’-এর একটা খটাখটি বাঁধত। সম্ভবত এত নৈকট্য সত্ত্বেও ওই একটি কারণেই বিশেষ বনত না তাদের। খটাখটি মানে আক্ষরিক অর্থেই খটাখটি। ওইরকম সময়েই টাইপিং স্কুলে নিয়ম করে ঢুকত কিছু ছেলে ও মেয়ে, তারা বয়সে আমার চেয়ে ঢের বড়, কিন্তু কেমন যেন বিষণ্ণ। বুঝতাম, ‘সুরধুনি’র বাচ্চাদের মতো এদেরও কোনও বাধ্যবাধকতাই আছে টাইপিং শেখার। কেবল এরা বাবা-মা ছাড়াই আসছে, এই যা তফাত। গোলটা বাঁধত তখন, যখন নাগাড়ে টাইপিং ক্লাস শুরু হত। একসঙ্গে জনা কুড়ি মানুষ তেড়ে টাইপ করা শুরু করলে সে যে কী রকমের শব্দঝাঁক হতে পারে, তা এই ধরনের স্কুল বা কোর্ট চত্বরে না দাঁড়ালে বোঝা মুশকিল।  

    তাই ‘সুরধুনি’র অতুল-রজনীর সঙ্গে এই রোমান হরফদের একটা শাব্দিক ঝঞ্ঝাট শুরু হয়ে যেত তখনই। কখনও গান একটু জোরে, হয়তো এক গোলে এগিয়ে, আবার কখনও এমন জগঝম্প টাইপিং শুরু হল যে গান গেল তিন গোল খেয়ে! এই চলত… আর আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কীসব যেন দেখার ভান করতাম। আসলে শুনতাম। গান তো একরকম শুনেই আসছি ছোটবেলা থেকে, কিন্তু এই ‘মডার্ন স্কুল’ না থাকলে আমি অন্তত জানতেই পারতাম না যে, লেখারও একরকমের শব্দ হয়। লিখতে দেখেছি বাবাকে; বাড়িতে, নিউজপ্রিন্টের প্যাডের ওপর বল-পয়েন্ট পেন দিয়ে। সে-শব্দ মানুষের কানে ধরা পড়ে না, কেবল জলের ওপর জোনাকির মতো কাগজের গায়ে অক্ষর ফুটে উঠতে দেখা যায়।

    কিন্তু এখানে শোনা যায় লেখারও শব্দ। কী লিখছে ছেলেমেয়েরা, তা অবশ্য জানি না। কোনও কবিতার অংশ, নাকি উপন্যাসের কোনও প্যারাগ্রাফ? নাকি নেহাতই চাকরির জরুরি দরখাস্ত লিখছে? হবে কিছু একটা। কিন্তু ওইসব বিষণ্ণ মুখের ছেলেমেয়েদের রোগা-রোগা আঙুল থেকে ছড়িয়ে পড়ছে লেখার শব্দ, অক্ষর ফুটে ওঠার আওয়াজ। তারা সোচ্চারে জানান দিচ্ছে, লেখা হচ্ছে। কিছু একটা লেখা হচ্ছে। নিষ্প্রাণ নয়, লেখা আসলে গানেরই মতো জলজ্যান্ত! আমি তখনও জানি না, একদিন লেখালিখিই আমার সারাক্ষণের কাজ হয়ে উঠবে। আর এ-কথা তো জানিই না, কলমের বদলে হাতের সামনে আসবে ল্যাপটপ, যেখানে টাইপিং মেশিনের মতো না-হলেও, অন্তত স্পেসবার বা এন্টার দেবার সময় একটু আওয়াজ শোনা যাবে। লেখা, নড়েচড়ে উঠবে একবার ওর-ই মধ্য দিয়ে।

    যেমন আজ জানি না, ‘মডার্ন টাইপিং স্কুল’-এর সেই ছেলেমেয়েরা টাইপ শিখে চাকরি পেয়েছিল কি না কোথাও, তারা কেমন আছে আজ… যেমন জানি না, ‘সুরধুনি সঙ্গীতালয়’-এর সেইসব বাধ্য বাচ্চারা কেউ পৌঁছল কি না মঞ্চ অবধি, তাদের অনেক কষ্টে শেখা সব গান বাকিদের আনন্দ বিলিয়ে দিতে পারল কি না… জানা তো হল না অনেক কিছুই। কেবল স্মৃতির একটা জোনাকি-জ্বলা পুকুরপাড়ে মন কষাকষি করে দাঁড়িয়ে থাকল এই দুজন বাড়ি। তাদের মধ্যেকার ছেলেমেয়েরা ডানা মেলে ভবিষ্যতে উড়েও গেছে এতদিনে। কেবল আমি জানি, তাদের কেউ সঙ্গে নিয়ে যায়নি।  

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook