ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • রেখে গেছেন ম্যাজিক


    রাহুল বোস (Rahul Bose) (June 11, 2021)
     

    আমার সঙ্গে বুদ্ধদার প্রথম দেখা হয় মুম্বইতে, একটা শহরতলির লাক্সারি হোটেলে। উনি কফি শপ-এ বসে, ‘কালপুরুষ’ ছবির গল্পটা আমাকে শোনান। উনি এত নিচু গলায় কথা বলতেন, আর রেস্তরাঁর টেবিলগুলো এত বিশাল ছিল, ওঁর প্রত্যেকটা কথা ভাল করে শোনার জন্য আমায় অনেকটা ঝুঁকে পড়তে হচ্ছিল। শুনে দারুণ পছন্দ হল। এমনিতে গল্পটা মিষ্টি আর সরল, কিন্তু ওঁর অন্যান্য ছবির মতোই, তার মধ্যে আরও অনেক অনেক কিছু বলা ছিল। ওটার মধ্যে একটা মৃদু কিন্তু অবধারিত বিষণ্ণতা ছিল, যেরকম থাকলে নিজেকে সামলাবার আগেই চোখটা জলে ভরে ওঠে। পবিত্রতা, ট্র্যাজেডি, আফশোস, আর একটা ভালবাসার ও ভালবাসার পাওয়ার সরল আকাঙ্ক্ষা একদম মিলেমিশে ছিল। আমি তক্ষুনি হ্যাঁ বলে দিলাম। তার কয়েক মাস পরে, কলকাতায় ওঁর অফিসে দেখা হল। আমি প্লেন ধরে এসেছি, শুটিং শুরু হবে। শিডিউলটা এমন ছিল, যাতে পুরো ছবিটাই শুরু থেকে শেষ অবধি একবারে শুটিং হবে, আমার এটা খুব ভাল লাগে, কারণ ছবিটার মধ্যে, ছবিটার পৃথিবীর মধ্যে, চরিত্রটার মধ্যে, নিজেকে একেবারে ডুবিয়ে দেওয়া যায়, বাস্তবের ন্যূনতম হস্তক্ষেপ ছাড়াই। আমি যখন অফিসে ঢুকলাম, উনি কয়েকবার অবাক হয়ে চোখের পাতাটা ফেললেন, যেন মগজ হাতড়াচ্ছেন, কেন আমাকে এত চেনা-চেনা লাগছে। আমি মুখে একটা হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। উনি দাঁড়িয়ে রইলেন, চিন্তামগ্ন হয়ে। তারপর একগাল হেসে আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন, উষ্ণভাবে। পরে বুঝেছিলাম, কী হয়েছিল। উনি বলেছিলেন, আমি যেই ঢুকেছিলাম, উনি আমাকে দেখেছিলেন সুমন্ত (আমার চরিত্রটা) হিসেবে, আর হাজারটা ভাবনা ওঁর মাথায় খেলছিল, আমায় সুমন্ত হিসেবে কেমন মানাবে সেই বিষয়ে। সংক্ষেপে, এই হলেন বুদ্ধদা। তাঁর এক-পা থাকত এই জগতে, আর অন্যটা ঘুরত ছ’টা মহাদেশ জুড়ে— কবিতা, বেদনা, আর সম্ভবত ভালবাসার খোঁজে।

    ছবিটা তোলার সময়, আমাদের একটু সময় লেগেছিল, দুজনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে। পরিচালক হিসেবে  উনি কী চাইছেন, সেটা সোজাসুজি বলতেন না, ওঁর একটা অদ্ভুত ঘুরিয়ে বলার ধরন ছিল। ধীরে ধীরে আমি সেই ধরনটা বুঝতে শিখলাম, ওঁর ইঙ্গিতগুলো ধরতে পরের দিকে আর অসুবিধে হত না। ওঁর কাছে, ছবিটার প্রাণভোমরা ছিল ‘অনুভূতি’। ছবি করার সময়, একবারও উনি ‘ইন্টেলেকচুয়াল মোটিভেশন’ বা ‘সেরিব্রাল ইমপালস’ নিয়ে কথা বলেননি, মানে বুদ্ধি বা সাধারণ বোধের দিক থেকে ব্যাপারটাকে দেখেনইনি। সুদীপ চ্যাটার্জি ছিল তাঁর ছবির একেবারে উপযুক্ত ক্যামেরাম্যান, যে ওঁর ভাবনাগুলোকে নিখুঁত ভাবে দৃশ্যায়িত করতে পারবে। ‘কালপুরুষ’-এর শুটিং-এর সময়টা আমাদের কাছে কী আশ্চর্য ছিল, তা নিয়ে এখনও সুদীপ আর আমি কথা বলি। মিঠুনদার সঙ্গে কাজ করেও আমি বুদ্ধদাকে অনেকটা বুঝতে শিখেছিলাম। বুদ্ধদার ভাবনা আর কাজ করার ধরন নিয়ে, মিঠুনদা আমাকে খুব ভালবেসে বুঝিয়েছিলেন।

    ‘কালপুরুষ’ সিনেমার একটি দৃশ্যে অভিনেতা রাহুল বোস

    বার্লিন চলচ্চিত্রোৎসবের ‘মাস্টারস’ সেকশনে ‘কালপুরুষ’ দেখানো হল। সে বছর ওই ফেস্টিভ্যালের অন্যতম ‘মাস্টার’ ছিলেন বুদ্ধদা। কী অসামান্য সম্মান! যদ্দূর মনে পড়ে, ফিল্মটার প্রিমিয়ার হয়েছিল একটা দুরন্ত প্রাচীন অভিজাত প্রেক্ষাগৃহে, তাতে খানদানি ব্যালকনি, ড্রেস সার্কল— সব ছিল। বার্লিনের দেওয়াল ধ্বংসের আগে এই হলটা পূর্ব জার্মানিতে ছিল। ছবিটা দেখে দর্শকেরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। প্রশ্নোত্তরের সময়, যতক্ষণ না সঞ্চালক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন, কেউ একটাও প্রশ্ন করেননি। ওই অনুষ্ঠানটা শেষ হয়ে গেল যেই, যখন দর্শকেরা আমাদের সঙ্গে মিশে গল্প করতে শুরু করলেন, তখন প্রচুর স্বতঃস্ফূর্ত প্রশ্ন আমাদের দিকে ধেয়ে এল। বুদ্ধদা একদম ফর্মে ছিলেন সেদিন, মজা করে কথা বলছিলেন, আবার চিন্তার খোরাক থাকছিল কথায়, আর অভিনেতা ও কলাকুশলীদের প্রশংসা করছিলেন মন খুলে। তারপর আমরা এক জায়গায় গেলাম, একটু মদ্যপান হল, তখন কথা বলছিলাম বন্ধুর মতো, ঠিক পরিচালক ও অভিনেতা হিসেবে নয়। তখন আমাদের মধ্যে প্রাথমিক আড়ালটা ভেঙে গেছে। 

    এরপর দেখা হয়েছে টরন্টোতে ফিল্মোৎসবে, মুম্বইতে একটা ফিল্মোৎসবে (বোধহয় ‘মামি’) আর অবশ্যই কলকাতায়। এইসব শহরের রাস্তায় আমরা হাঁটতাম, গল্প করতাম, হো-হো করে হাসতাম, আর আমাদের ঘিরে বয়ে চলা বিভিন্ন পৃথিবীর সুর শুনতে পেতাম। আর অবশ্যই মদ খেতাম দু-এক পাত্তর। আমি যখন বলতাম, আমার চারপাশের বিশ্ব আমায় কীভাবে গড়ে তুলছে বা বদলে দিচ্ছে, উনি খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। কতটা মনোযোগ দিয়ে? যাঁরা ‘কালপুরুষ’ দেখেছেন, তাঁরা জানেন, ছবিটার শেষদিকে একটা দৃশ্য আছে, যেখানে সুমন্ত একটা সমুদ্রসৈকতে তার মৃত বাবার সঙ্গে কথা বলে। সেখানে সে বাবাকে জিজ্ঞেস করে, বাবার কি মনে আছে, সুমন্ত যখন ছোট ছিল, বাইরে বেরোলেই বাবা কেমন বলতেন তাঁর হাতের তর্জনীটা ধরে থাকতে, আর একদম না-ছাড়তে? সুমন্ত যে সংলাপ বলে তা কতকটা এইরকম— ওই আঙুলটা ধরলে আমার নিজেকে এমন নিরাপদ মনে হত, যেন আমি একটা গাছের গুঁড়ি ধরে আছি।

    ছবিটার শুটিং-এর আগের কাজকর্ম চলছিল যখন, তখন বুদ্ধদাকে আমি গল্প করেছিলাম, আমার যখন ৬-৭ বছর বয়স, তখন বাবা বাজার গেলে আমি সঙ্গে যেতাম। বেরোবার আগে, বাবা আমাকে সবসময় বলতেন, তাঁর তর্জনীটা ধরে থাকতে, যাতে আমি হারিয়ে না যাই। আর আমার এত নিরাপদ লাগত, যেন আমি একটা গাছের গুঁড়ি ধরে আছি। বুদ্ধদা সেই কথাটা ভোলেননি। উনি আমায় জিজ্ঞেস করেছিলেন, যদি চিত্রনাট্যে এটা ঢুকিয়ে দেন, আমি কিছু মনে করবে কি? আমি বলেছিলাম, ‘একেবারেই মনে করব না। কিন্তু এই গল্পটার মধ্যে কী আছে, যা আপনাকে এতটা নাড়া দিযেছে?’ উনি বলেছিলেন, ‘এর ম্যাজিক।’ এখন শান্তিতে ঘুমোন, বুদ্ধদা। আপনি আমাদের জন্যে যথেষ্ট ম্যাজিক রেখে গেছেন।  

    কভারের ছবি ঋণ: www.berlinale.de

    Read in English

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook