ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • বিনিদ্র: পর্ব ১১


    বিমল মিত্র (May 7, 2021)
     

    পর্ব ১০

    আমি এই দ্বিতীয় মানুষটাকে মনে-প্রাণে ভালোবেসেছিলাম। তার এই দ্বিতীয় সত্তাটা রাত জেগে সাহিত্য-বিজ্ঞানের বই পড়ত। সে মানুষটা ভিখিরি। তার রাস্তা-ঘাটে দিন কাটত! সে ভগবান আছে কি নেই, তাই নিয়েই চিন্তা করত। সে মানুষটা নিঃসঙ্গ, সে-মানুষটার প্রয়োজন বড় সামান্য। একজোড়া রবারের চটি, একটা হাত-কাটা গেঞ্জি, আর একটা লুঙ্গি হলেই তার চলে যেত। সে মানুষটা মাঝে-মাঝে তাই পান্তাভাত খেত, মুড়ি খেত। সে-মানুষটার পকেটে তাই কখনও পয়সা থাকত না।

    গুরু দত্তের এই দ্বিতীয় সত্তাটাকে কেউ চিনতে পারেনি। ওয়াহিদা রেহমান চেনেনি, গীতা চেনেনি, গুরু দত্তের নিজের মাও চেনেনি। গুরুর ভাই-বোন-ভগ্নিপতি বন্ধু, সহকর্মী তারাও কেউই চেনেনি তাকে।

    গুরুর চরিত্রের প্রথম দিকটার কথা তাই সবাই জানে। পত্রিকায়, বন্ধুমহলে সেই দিকটাই উজ্জ্বল হয়ে আছে। তারা তার সঙ্গে এক টেবিলে বসে আড্ডা দিয়েছে, তাসের জুয়া খেলেছে, হাসছে হা-হা করে, গান গেয়েছে, হল্লা করেছে আর রাত তিনটে-চারটে পর্যন্ত ওই ভাবেই জেগেছে।

    তার নিদর্শনও আমি দেখেছি। ঘনিষ্ঠভাবে মেশার জন্যে আমি গুরুর দুটো রূপই দেখেছি। দুটো রূপই সত্য, দুটোই ধ্রুব। কিন্তু আমার কাছে মনে হত তার আসল রূপটা সন্ন্যাসী রূপ। সেখানে সে আর আমি বড় একাত্ম। মনে-মনে হিসেব করছিলাম কেমন করে লোনাভালার সেই পাহাড়ের উপর দেড়টা মাস নিঃশব্দে কেটে গেল। চিত্রনাটয় যা-হয় হোক, আমার তা নিয়ে মাথা-ব্যথা ছিল না। ছবির কারবারি আমি নই। সে আমার এক্তিয়ারের বাইরে। কিন্তু এই গুরু দত্তকে তো আমি দেখতে পেলাম। এখানে না-এলে সিনেমার বাইরের এই সন্ন্যাসী গুরু দত্তকে তো আর দেখতে পেতাম না।

    গুরু তখনও একমনে জাফ্‌রিতে রং দিয়ে চলেছে। এক-সময়ে বললাম— ছুটি নিয়ে কোথায় যাবেন?

    গুরু বললে— লন্ডনে—

    আমার আরো অবাক হওয়ার পালা। কাশী নয়, পুরী নয়, কাশ্মীর নয়, একেবারে লন্ডন। গুরু বললে— আমার ভাই আত্মা ওখানে চাকরি করে, তার কাছে যাব। আমার ফরেন-এক্সচেঞ্জের ভাবনা নেই—

    — ছবি কবে আরম্ভ করবেন?

    গুরু বললে— আমার ‘চৌধবী-কা-চাঁদ’ রিলিজড্‌ হবে পুজোর আগে, তার আগেই ফিরে আসব। ততদিন আব্‌রার হিন্দি স্ক্রিপ্টটা তৈরি করে ফেলবে। এ বছরের শেষের দিকে আরম্ভ করে দেবো—

    — পরিচালনা করবে কে?

    গুরু বললে— বুঝতে পারছি না। আমিও করতে পারি। জীবনে অনেক ছবি করেছি, কিন্তু এ-ছবিটা ভালো করে করতে চাই। এর আগে কখনও এমন করে পুরো চিত্রনাট্য শেষ করে ছবি করতে নামিনি—

    বেশ সুস্থ মনে, সুস্থ চিত্তে আমাদের কথা হচ্ছিল। এমন সময় বাইরে হঠাৎ একটা গাড়ির আওয়াজ হল। তাকিয়ে দেখি কারা যেন এল। তিনজন ভদ্রলোক। গুরুর বন্ধু-বান্ধব হয়তো। গুরুকে দেখে তারা হৈ-হল্লা করে উঠল! গুরুর মুখেও উল্লাসের ছবি ফুটে উঠল। গুরু বললে— আ রে, তোমরা কোত্থেকে ইয়ার?

    তারা বললে— সারা বোম্বাই ঢুঁড়ে-ঢুঁড়ে তোমাকে পাই না। শেষে শুনলুম তুমি লোনাভালায়—

    তারপর দেখি অবাক কাণ্ড। গাড়ি থেকে নামল কয়েক ডজন সোডার বোতল, হুইস্কি, বরফ। আর আছে মুরগি, পাঁউরুটি, ডিম ইত্যাদি-ইত্যাদি।

    তারপর শুরু হল হল্লা। সেদিন আমার চোখের সামনে শুরু হল আর এক দৃশ্য। দেখলাম গুরুর আর এক রূপ। দেখলাম যে গুরু আমার সঙ্গে একরকম, সেই গুরুই আবার তাদের সঙ্গে আর একরকম। আমার মন বড় পীড়িত হয়ে উঠল। মন বললে— এ কি! আমি তো এ গুরুকে চিনি না। এ গুরু তো আমার দেখা সেই গুরু দত্ত নয়। যে-গুরুকে আমি শ্রদ্ধা করি, ভালোবাসি, সে গুরু যেন ওদের মধ্যে হারিয়ে গেল। ওদের সঙ্গে একাকার হয়ে গেল। ওরা যেন গুরুকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিলে। আমি বেদনায় হাহাকার করে উঠলাম।

    অনেকদিন পরে গুরুকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম— ওদের সঙ্গে আপনি অমন করে মেশেন কি করে?

    গুরু হেসে বলেছিল— এ আর কি দেখছেন, আমাকে জীবনে এদের চেয়ে আরো জঘন্য লোকের সঙ্গে মিশতে হয়েছে। আমি কলকাতায় মানুষ, সেখানেই বড় হয়েছি, সেখানে গড়পারের বিষ্টু ঘোষের আখড়াতেই ছিল আমার আড্ডা—

    আমি গড়পারের বিষ্টু ঘোষের আখড়ার নাম শুনেছিলাম। জানতাম সেখানে শরীর-চর্চা হয়। তার বেশি আর কিছু জানতাম না। গুরুর কাছেই সব শুনেছি সেখানকার কথা। কিন্তু সেখানকার আখড়ার সভ্যদের কাউকেই আমি চিনি না। গুরুর কলকাতা সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা সেখান থেকেই। কলকাতার সমস্ত অলি-গলি তার মুখস্থ। সেখানেই প্রথম নাচ শেখবার আগ্রহ হয়। তখন কলকাতায় সংস্কৃতি বলতে উদয়শঙ্করের নাচ, মোহনবাগান ক্লাবের ফুটবল খেলা আর নিউ থিয়েটার্সের সিনেমা। বলতে গেলে তিরিশ আর চল্লিশের দশকে এই-ই ছিল কলকাতার সাংস্কৃতিক রূপ। বাংলা দেশের সে-যুগের মানুষ এই তিনটি প্রতিষ্ঠানকেই ব্ল্যাঙ্ক চেক লিখে দিয়েছিল। ঘটনাচক্রে গুরু দত্তের বাবা ঠিক সেই সময়েই এসে হাজির হয়েছিলেন এখানে। হয়তো গুরুর ভবিষ্যৎ জীবনের কর্মপদ্ধতির গোড়াপত্তনের সুযোগ দেবার জন্যেই।

    গুরু বলেছিল— তারপর চলে গেলাম আল্‌মোড়ায় উদয়শঙ্করের দলে—

    সেখানে তখন উদয়শঙ্কর নাচ শেখবার স্কুল করেছেন। সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা গুরু দত্তের। সবিস্তারে না বললে সে প্রতিষ্ঠানের যথার্থ মর্যাদা দেওয়া যাবে না।

    গুরু তারই বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছিল— তখন আমার উনিশ বছর বয়েস, একেবারে কাঁচা মন, যা দেখতুম তারই ছাপ পড়ে যেত মনে। দেখলাম জীবন কত জটিল, আবার কত সহজ। সেখানেই দেখলাম জীবন কত নিষ্ঠুর, আবার কত মহৎ। সেখানেই বুঝতে পারলাম বাইরের জগতে যাদের খ্যাতি, আড়ালে তারা কি! সেই থেকে আমার নিজের জীবনও সেইভাবে গড়ে উঠল। আমি ভাবতে শিখলুম—

    — তারপর?

    গুরু বললে— তারপর এলাম পুনাতে। প্রভাত ফিল্ম-এর স্টুডিওতে। সেখানে এসে আমার দেখা সম্পূর্ণ হল। দেখলাম ছবি কাকে বলে, ছবি কেমন করে তৈরি হয়, ছবির মানুষগুলোর রক্ত-মাংসের চেহারাটা কেমন।

    আবার জিজ্ঞেস করলাম— তারপর?  

    পুনঃপ্রকাশ
    মূল বানান অপরিবর্তিত

    পর্ব ১২

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook