ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • বিনিদ্র: পর্ব ৮


    বিমল মিত্র (April 9, 2021)
     

    পর্ব ৭

    বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি চালাতে-চালাতে গুরুর সেদিনের আনন্দের কথা কোনওদিনও ভুলব না। যখন অনেকক্ষণ ধরে গাড়ি চালিয়েও তৃপ্তি হল না তখন গুরু বললে— চলুন, এবার আমার ফার্মে চলুন—

    ‘ফার্ম’ মানে গুরুর খামার বাড়ি। বোম্বাই থেকে আশি মাইল দূরে এই খামার বাড়িটা করে রেখেছিল গুরু। খামার বাড়ি মানে কয়েক একর জমি। তাতে ধান হয়, গম হয়, অন্যান্য চাষবাস হয়। ক্ষেতে লাঙল দেওয়ার জন্যে লোক-জন আছে। হাঁস-মুরগিও আছে। বিরাট কুয়ো আছে একটা। মানে ইঁদারা। আর একটা ছোট দেড়-কামরাওয়ালা বাঙলো বাড়ি আছে। তাতে ডায়ানামো বসিয়ে ইলেকট্রিক আলোর ব্যবস্থা আছে। খাট-বালিশ, ফ্রিজ, টেলিফোন, কয়েকটা চেয়ার, সবই রেখে দিয়েছে গুরু।

    পুনা রোড বিরাট রাস্তা। গাড়িটা সেই রাস্তা থেকে মোড় ঘুরে ফার্মের মধ্যে ঢুকল। কয়েকটা চেয়ার নিয়ে আমরা বারান্দায় বসলুম। সামনেই একটা আকাশ-ছোঁয়া পাহাড়। বৃষ্টিতে ঝাপসা দেখাচ্ছে সমস্ত।

    বললাম— এ খামার-বাড়িটা কেন করেছেন?

    কেন যে গুরু করেছে, এটা তো আর কেউ না বুঝুক আমি বুঝতে পারলাম। বোম্বাই মানেই গুরুর কাছে অনিদ্রা। গুরুর বোম্বাই-এর পালি হিলের বাড়ির ভেতরে আমি থেকে দেখেছি। সেখানে বাস করে আমার মনে হয়েছে, স্বর্গ যদি কোথাও থাকে সে এখানে। পালি হিলের সেই বাড়িটা এখন আর নেই। একদিন রাগ করে সে বাড়ি গুরু মিস্ত্রি-মজুর ডাকিয়ে ভেঙে ফেলেছিল। ঘরে, আধুনিক সাজ-সজ্জা সরঞ্জামের কারিকুরি কিছুই বাকি নেই। কিন্তু সেই আরাম-বিলাসের মধ্যে গুরু যন্ত্রণায় ছটফট করেছে।

    গুরু বার-বার বলত— বিমলবাবু, আমি এবার পাগল হয়ে যাব।

    মুখে যা বলত গুরু তা যে কত সত্যি, তা যতদূর জানি কেউ-ই বিশ্বাস করত না। ঐশ্বর্য আর বিলাসের মধ্যে থেকেও যে মানসিক সুখ-শান্তি পাওয়া যায় না, তা অন্যের চেয়ে আমি কিছু কম জানি না।

    আমি গুরুর মুখের দিকে চেয়ে দেখলাম। মুখ দেখে বোঝবার উপায় ছিল না। কিন্তু জানতাম, তখনও মনের ভেতরে তার আগুন জ্বলছে। গুরু যতক্ষণ আমাদের সঙ্গে রয়েছে, ততক্ষণ সাময়িকভাবে ভুলে থাকে। আর যখনই পাগল হয়ে যাবার অবস্থা হয়, তখনই এই লোনাভালার এই খামার বাড়িতে চলে আসে। এখানে এসে হাফ-প্যান্ট গেঞ্জি পরে ট্র্যাক্টর চালায় নিজের হাতে, রান্না করে। কিংবা কোনও কাজ না থাকলে জানলা-দরজার কাঠের ওপর রং লাগাতে বসে তুলি নিয়ে। কেউ থাকে না সঙ্গে এক রতন ছাড়া। রতন গুরুর পেছনে ছায়ার মতন ঘোরে। সাহেবের কি দরকার, কি দরকার নয়, তা কল্পনা করে নেয়। সব সময় রতনের কাছে একটা পেট-ফোলা ব্যাগ থাকে। ব্যাগের মধ্যে গুরুর যাবতীয় জিনিস সঙ্গে নিয়ে ঘোরে রতন। সিগারে-দেশলাই-বই-টাকা-টর্চ, তার মধ্যে সব থাকে। হঠাৎ যদি কোনোদিন গুরুর রাত তিনটের সময় সিগারেট তেষ্টা পায়, তার জন্যে রতনকে তার স্টক্‌ রাখতে হয়। তা ছাড়া গুরুর দাড়ি কামাবার সরঞ্জাম, ছুঁচ, সুতো, সাবান, কি যে নেই সে-বাক্সতে তার ঠিক নেই। নানা জিনিস রেখে ব্যাগটার পেটটা ফুলে উঠেছে।

    কিন্তু সেদিন শুধু আমরাই কজন। আমি, আব্‌রার আল্‌ভি, মিস্‌ ম্যাগী, আর অমলেন্দু। তারা অনেকদিন গুরুকে ঠিক এমন করে কাছে পায়নি। বাইরে ঝম্‌ ঝম্‌ করে বৃষ্টি পড়ছে। আর চিত্রনাট্যের কাজ থেকেও আমরা কয়েক ঘণ্টার জন্যে ছুটি নিয়েছি। আমার নিজের আনন্দ বিশেষ করে হচ্ছিল গুরুর জন্যে। গুরুকে দেখলাম খুব খুশি-খুশি ভাব। সামান্য বৃষ্টি দেখে এত খুশি হওয়া আমি কারোর মধ্যে দেখিনি।

    অথচ কাজ যে কিছুক্ষণ বন্ধ রয়েছে, তার জন্য ক্ষোভ নেই গুরুর। আমি বললাম— চলুন ফিরে যাই অনেক সিন লেখা বাকি রয়েছে—

    গুরুর তখন আনন্দের নেশা হয়েছে। বললে— না বিমলবাবু, কাজ এখন থাক। আপনি বড় কাজ পাগলা মানুষ। অত কাজ করতে ভালো লাগে না—

    তারপর হঠাৎ বললে— বড় মুড়ি খেতে ইচ্ছে করছে—

    মুড়ি! আমি অবাক হয়ে গেলাম। এত জিনিস থাকতে সামান্য মুড়ি।

    গুরু বললে— হ্যাঁ মুড়ি, আপনার কাছে কিছু টাকা আছে?

    ভাবলাম রতন কাছে নেই। রতনের কাছেই গুরুর টাকা-পয়সা যা কিছু সব থাকে। সে নেই সুতরাং গুরু এখন কপর্দকহীন।

    আমি পকেট থেকে দু টাকা বার করে দিলাম। খামার-বাড়ির মালি সেই টাকা নিয়ে তিন মাইল দূরে মুড়ি কিনে আনতে গেল সেই বৃষ্টির মধ্যে। গুরু বলে দিল যাবার সময়— মুড়ি আর আট আনার ছোলাভাজা নিয়ে এস।

    তারপরে হঠাৎ বুঝি মনে পড়তে বললে— আর হরা-মরিচ, কাঁচা লঙ্কা।

    এই হল গুরু। এই হল গুরু দত্ত।

    তারপরের দিন আমি যথারীতি ঘুম থেকে উঠে নিত্য-কর্ম শুরু করেছি। অর্থাৎ ‘দেশ’ পত্রিকার পরের সংখ্যার জন্যে আমার সাপ্তাহিক কিস্তি লিখতে বসেছি, হঠাৎ বিনা নোটিশে গুরু আমার ঘরে ঢুকল।

    সাধারণত গুরু এমন করে সে-সময় ঘরে আসত না। ও জানত সে-সময়ে এলে আমার কাজের ব্যাঘাত হয়। তাই ওকে দেখে আমি একটু অবাক হয়ে গেলুম। অবাক হলাম আরো ওর পোশাক দেখে। লাল-লাল ফুল আঁকা একটা বুশ-শার্টের মতো জামা আর খুব ছোট একটা হাফ-প্যান্ট। পায়ে একজোড়া চটি। এ-রকম পোশাকে কখনও দেখিনি গুরুকে।

    গুরু বললে— আমি একটু বোম্বে যাচ্ছি বিমলবাবু—
    — বোম্বে, কেন?
    — একটা আর্জেন্ট কাজ আছে, পরশু দিনই ফিরে আসব। বাকি সিনগুলো আপনি লিখে যান—

    সে-কথার উত্তর না দিয়ে বললাম— এ কি ড্রেস পরেছেন আপনি?

    — কেন? খারাপ দেখাচ্ছে?

    বললাম— হ্যাঁ।

    — কিন্তু এ তো পাম-বীচ্‌ সুট। এটা আমি লন্ডন থেকে কিনে এনেছি— আমি জানতাম গুরু দত্ত কিন্তু তা বলে এই পোশাকে!

    আমি বাইরে বেরিয়ে দেখলাম গুরু তার লাল রং-এর গাড়িটা নিয়ে হু-হু করে পাহাড় থেকে নিচেয় নেমে গেল। ঘরের জানলা দিয়ে দেখলাম গুরুর গাড়িটা পাহাড়ের বাঁকা-চোরা পথ বেয়ে দূরে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি আবার ঘরে চলে এলাম।

    কিন্তু যেদিন ফিরে এল সেদিন দেখলাম গুরু একেবারে অন্য মানুষ হয়ে গেছে। এই কদিন একসঙ্গে একবাড়িতে থেকে গুরুকে যে-রকম দেখেছিলাম, এ-গুরু যেন সে রকম নয়। গুরুর স্বাস্থ্য ভালো হয়ে গেছে দুদিনের মধ্যেই। জিজ্ঞেস করলাম— এটা কি করে হল?

    গুরু বললে— বোম্বেতে গিয়ে ডাক্তার দেখিয়েছিলাম, সে ডাক্তারের ওষুধ খেয়ে এখন ভালো আছি—

    আমিও ভাবলাম ভালোই হল। দেখলাম আগেকার মতো সন্ধের পরেও গুরু সুস্থ থাকে। শুধু সিগারেট-পান ছাড়া আর কিছু খাবার দরকার হয় না।

    তবে আমরা যখন সিনারিও নিয়ে কাজে ব্যস্ত, তখন হঠাৎ গুরু বেরিয়ে যেত। বলত— আপনারা কাজ করুন, আমি ফার্মে যাচ্ছি একবার—

    ‘ফার্ম’ মানে গুরুর সেই খামার-বাড়ি। সেখানে গিয়ে গুরু একলা নিজের ঘরের সামনে চেয়ার নিয়ে বসত। কিংবা একখানা বই নিয়ে পড়ত। কিংবা গমের ক্ষেতের আলের ওপর দিয়ে ঘুরে বেড়াত। একলাই থাকত সেখানে কয়েক ঘণ্টা। তারপর সন্ধে হয়ে আসত। গুরু চেয়ার নিয়ে সেইখানে ঘরের বারান্দার ওপর বসত, আর সামনে মেঝের ওপর বসে গুরুর খামার-বাড়ির তদারককারী পাটিল গল্প করত একনাগাড়ে। এক-একদিন আমার মনে হত গুরু আড্ডা ছেড়ে ওখানে অন্ধকারের মধ্যে একলা বসে থাকে কেন? কি আনন্দ পায়?

    গুরু বলত— সবসময়ে আমার লোক ভালো লাগে না বিমলবাবু, কখনো-কখনো গাছপালাকে ভালো লাগে—

    অনেক সময় গুরুকে দেখেছি জন্তু-জানোয়ার নিয়ে মাসের পর মাস মেতে থাকত। হঠাৎ, কোথাও কিছু নেই, একদিন গুরু বাড়িতে একটা কুকুর কোলে করে এসে হাজির। গীতাও অবাক, বাড়ির চাকর-ঝি দারোয়ানও অবাক। সাহেবের ফরসা জামা-কাপড়, কোলে একটা ময়লা কুকুর।

    গীতা এগিয়ে এসে বললে— এ কুকুর কোত্থেকে আনলে?

    গুরু বলল— শিগগিরই একটু দুধ দাও, এটাকে পুষবো— রাস্তায় পড়েছিল, আর কেঁউ কেঁউ করছিল—

    তারপর সেই কুকুরের সে কি যত্ন। কুকুরের জন্য ঘর তৈরি হল। শেকল কেনা হল। ঘুম থেকে উঠেই সেই কুকুরের সেবা। একজন চাকর রাখা হল শুধু কুকুরের সেবা করবার জন্যে। তারপরে একদিন সে-কুকুরের কথাই ভুলে গেল। একদিন যখন কুকুরটা আবার নজরে পড়ল, তখন কুকুরটার গায়ে ঘা হয়েছে। গুরু দত্ত একদিন হুকুম দিলে— ওটাকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে আসতে। যে কুকুরের জন্য অত খরচ, অত যত্ন, অত তদারকি, তার স্থান শেষ পর্যন্ত হল রাস্তায়। রাস্তা থেকে এসে রাস্তাতেই আশ্রয় পেলে।   

    পুনঃপ্রকাশ
    মূল বানান অপরিবর্তিত      

    পর্ব ৯

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook