ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • ঢাকা ডায়েরি: পর্ব ২


    পিয়াস মজিদ (March 12, 2021)
     
    ঢাকার শেষ আর্মেনিয়ান

    — ‘এই খালি যাবা, আরমানিটোলা?
    — ‘না স্যার। দুপুর ২টোয় কে যায় ওই মওতের মহল্লায়?’
    — ‘কেন, মওতের মহল্লা বলছ কেন?’
    — ‘আরে, কমু না ক্যান! পুরনো টাউনের যানজটের একটা সর্দার-এলাকা হইল গিয়া আরমানিটোলা। এত চিপা রাস্তা— তার মইদ্যে প্রাইভেট, মাইক্রো, রিক্সার ঠেলাঠেলি। একটা গাড়ির পিছ পিছ আর একটা গাড়ি য্যান বাঁশ দেয়ার লাইগা খাড়াই থাকে ঝিম ধইরা।’
    — ‘আরে ভাই, এত কথা না বলে নিয়ে চলো। তুমি তো যানজটের জন্য মওতের মহল্লা বললা। আর আমি আরমানিটোলায় আসলেই মওতের আস্তানায় যাব বলে বের হলাম। আর্মেনিয়ান গির্জা চেনো তো তুমি?’
    — ‘চিনুম না আবার! এক খিটখিট্টা বুড়ার বাসা। আর থাকে পান-খাওয়া কেয়ারটেকার শংকর। শুধু আপনে না, কত কালারের দেশি আর ফরেন মানুষ যে ওইখানে যাওয়ার লাইগা বায়না ধরে! আমার রিক্সা থেকে নাইমা অনেকে আবার একটু বাদেই এই রিক্সাতে ফেরত আসে। গির্জার গেট মেলা টাইম বন্ধ থাকে তো।’
    — ‘বলো কী! কিন্তু আমি তো জানি দুপুর থেকে কিছু সময় সবাইকে ঢুকতে দেয় ভেতরে।’
    — ‘দেয় কাউরে কাউরে। ফরেন মানুষরে দেয় বেশি। তয় আপনারেও হয়তো দিতে পারে। চলেন চলেন; রইদে চান্দি ফাডে, ভাড়া বাড়াই দিয়েন।’

    রিক্সায় বাড়ালাম পা, গন্তব্য আরমানিটোলা। আমি, যে কিনা এক সময় পড়েছি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘লুসি আর্মানির হৃদয়রহস্য’ কিংবা হরহামেশা পরে থাকি আর্মানি জিন্‌স, যদিও জানি এসবের সঙ্গে পুরনো ঢাকার আর্মেনিয়ান গির্জার দূরত্ব বিস্তর। একগুচ্ছ সমাধিই সেখানকার জীবনপ্রণালী।

    ‘এই থামো থামো’, বলে আর্মেনিয়ান গির্জার গেটে নামি। আশপাশে কত সুরভি-বিপণি। এই এলাকাকে পূতিগন্ধময় নগরের পারফিউম জোন বললে ভুল বলা হবে না। আর্মেনিয়ান গির্জার সামনে শুয়ে থাকা শত শত প্রয়াত শ্বাসেদের উদ্দেশে, ক্রয়-বিক্রয় হিসেবের বাইরে হয়তো এত সব পারফিউমের দোকানপাট থেকে বিনামূল্যে সুবাস ভেসে যাচ্ছে।

    গেটে বসা পাহারাদারকে বলতেই ডেকে দিল কেয়ারটেকার শংকরদাকে। অভিলাষটা ব্যক্ত করলাম তার কাছে। গোরস্থান ঘুরব, গির্জার ভেতরটা দেখব আর ঢাকার শেষ আর্মেনিয়ানের সঙ্গে প্রথমবারের মতো কথা বলব। 
    — ‘শংকর, কে কথা বলে?’ 

    বাপ রে! সাক্ষাতটা এভাবে ঘটবে, আগে বুঝিনি। এত দর্শনার্থী রোজ এখানে আসে যে বুড়োর খিটমিট করা অস্বাভাবিক না। আর সবার মতো আমারও যে উদ্দেশ্য এই গোরস্থান, গির্জা ঘুরে দেখা— তা বুঝতে বাকি রইল না তারও। 

    বললেন, ‘ঘুরে দেখো মাই সন, বাট নো পিকচার, নো সাউন্ড। এখানে ঈশ্বরের সন্তানেরা সব ঘুমিয়ে আছে। তাদের শান্তিভঙ্গ কোরো না।’

    যেখানেই পা রাখি সেখানেই সমাধি। যেন একটা এপিটাফ-সরণি। হবেই তো, তিনশোর উপরে সমাধি এখানে। আর আজকের তো না, প্রায় আড়াইশো বছরের বুড়ো গির্জা, তারও পুরনো কবরখানা। এর উপর দিয়ে বয়ে গেল কত ঝড়, ভূমিকম্প, দেশভাগ, দাঙ্গা, মুক্তিযুদ্ধ। রক্ত আর রক্ত আর রক্তের সদ্‌গতির জন্য প্রার্থনা অবিরত। আমি মৃতদের এপিটাফে উৎকীর্ণ নিঃশব্দ কাকলি ছেড়ে গির্জার ভেতরে ঢুকি। মাইকেল জোসেফ মার্টিন দেখান একটা তৈলচিত্র, নিকি পোগজের আঁকা ‘লাস্ট সাপার’। ঐন্দ্রজালিক ভোজের অনিন্দ্য চিত্র দেখে আমার ভেতরে কী ক্ষুধা জেগে ওঠে!

    কী আশ্চর্য, তখনই মার্টিন তার খিটখিটে ভাব ছেড়ে কোমল-কণ্ঠে বললেন, ‘চলো। এত রোদ মাথায় করে এসেছ। একটু খাবে চলো।’

    গির্জার পাশেই রক্তিম ইটের পুরনো বাড়ি, আমি আর মার্টিন মুখোমুখি। চা-বিস্কুট খেতে খেতে আমি শুনি দু’হাজার দশের দীঘল দুপুরে আশি বছরের ভারে নুয়ে আসা দেহধারী মানুষটার কথা। একটা মানুষের জীবনের বৃত্তে লেগে থাকে কাঁহা কাঁহা মুলুকের গল্প! বার্মা মুলুকের রেঙ্গুনে জন্ম, বাবার বাড়ি আর্মেনিয়া— ইরানি মা। দশ বছর বয়সে এসে ছেলের জীবনের পুরোটাই নিয়ে নিল ঢাকা। কে ভেবেছে পারিবারিক পাটের ব্যবসায় এসে গোরস্থানের গন্ধে কেটে যাবে তার জীবনযৌবন!

    মাইকেল জোসেফ মার্টিন

    হঠাৎ বেজে উঠে ফোন, কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন ধরতেই আমার কানে ভেসে আসে অবোধ্য কিন্তু আন্তরিক কিছু বর্ণের দ্যুতি। বুঝলাম নিজ ভাষায় কথা বলছেন কোনও নিকটজনের সঙ্গে। ফোন রেখে মার্টিন বললেন, ‘আমার মেয়ে এলিনর। কানাডা থেকে ফোন করেছিল। তিন মেয়েই তো দূর বিদেশে। আমাকেও হয়তো নিয়ে যাবে শিগগিরই কিন্তু আমি এই গির্জা-গোরস্থান ছাড়া বাঁচব কী করে! ভেরোনিকাও তো শুয়ে আছে এখানে।’
    — ‘ভেরোনিকা…’

    আমার প্রশ্ন পূর্ণাঙ্গ হওয়ার আগেই বললেন, ‘ভেরোনিকা আমার স্ত্রী। আমাকে ছেড়ে পাঁচ বছর আগে, ঈশ্বরের আহ্বানে সেও শুয়ে পড়ল ওই মাটির বিছানাতে।’

    একে একে ঢাকার অনেক আর্মেনিয়ান মারা গেছে, বাকিরা পাড়ি দিয়েছে বিদেশ-বিভুঁয়ে। মার্টিন বছর পঁচিশ আগে এই গির্জার পালকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু দীপ নিভে আসে বারে বারে। ক্রমশ স্বজাতিশূন্য মার্টিন প্রতিদিন এই গির্জার জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ নিবন্ধনের পুরনো খাতাগুলো ধুলো ঝেড়ো খুলে দেখেন, নোট রাখেন। বাংলায় আর্মেনিয়ানদের ইতিহাসের ধারাটা বুঝতে চেষ্টা করেন। নিজের কৌতূহলে তো বটেই, প্রতিদিন এখানে আসা উৎসাহী মানুষের জিজ্ঞাসার জবাব দিতেও। নিঃসঙ্গ মার্টিনকে কানাডা নিয়ে যেতে তিন মেয়ে কতবার তাগাদা দিয়েছেন, তবে তাঁর সাফ কথা ,‘আমি চলে গেলে এই গির্জা-গোরস্থান নিঃসঙ্গ হয়ে যাবে না একেবারে!’

    দুপুর ক্রমেই বিকেলের দিকে হেলে পড়ছিল। জুনের রৌদ্রতপ্ত দুরন্ত দুপুর ঘন হয়ে ঝড়ের রূপ নিচ্ছিল। কালো মেঘের বিদ্যুতে সাজে আকাশের আঙিনা। গির্জার গাছের ডালপালা নড়াচড়ার জোর শব্দেও যেন ভাঙতে চায় না এখানে জমাট-বাঁধা প্রাচীন নিস্তব্ধতা। 

    আমাকে এবার উঠতে হবে। যাওয়ার আগে মার্টিনের দিকে করমর্দনেচ্ছু হাত বাড়াতেই বললেন, ‘তোমার মতো অনেকেই রোজ আসে। তাদের অনেকের সঙ্গে দ্বিতীয় বারও দেখা হয়। তুমিও হয়তো আবার আসবে, কিন্তু ততদিনে হয়তো আমাকে চলে যেতে হবে মেয়েদের কাছে অথবা ঈশ্বরের কাছে।’

    বাইরে প্রকৃতির প্রকাশ্য আর্তনাদের চেয়ে আমার কানে এসে বাজতে থাকে বৃদ্ধ মার্টিনের অশ্রুহীন সঙ্গোপন আর্তির শব্দ। বোকার মতো প্রশ্ন করে বসি, ‘একটা কথা বলবেন কি! কেন এত বছর এই গোরস্থানে কাটিয়ে দিলেন, মৃতদের প্রতিবেশী হয়ে?’ 

    মার্টিন মনে হয় এই প্রশ্নটার অপেক্ষাতেই ছিলেন। ঝড়ে বিদ্যুৎহীন কক্ষে মোটা দীপদানিতে রাখা সরু মোমবাতিটার মতো হেলেদুলে অথচ বলিষ্ঠ স্বরে বললেন, ‘তুমি ইয়াং ছেলে। প্রথম প্রেম তো বুঝে থাকবে। ভেরোনিকা আমার প্রেম ছিল, সঙ্গিনী ছিল, কিন্তু আমার আসল প্রেম, প্রথম প্রেম ছিল এপিটাফ।’
    — ‘এপিটাফ?’
    — ‘ছোটবেলা থেকে গির্জাঘেঁষা এই গোরস্থানে দেখে আসছি মৃতদের প্রেমাস্পদেরা তাদের প্রয়াত প্রেমীজনদের স্মৃতিতে কত সুন্দর এপিটাফ খোদাই করে থাকে। এক সময় সেই জীবিত প্রেমীজনেরাও মরে ভূত হয়ে যায় কিন্তু থেকে যায় এপিটাফে লেখা তাদের প্রেমবচনেরা। দেখেছ তো তুমি, কত বিচিত্র অন্তরের অক্ষরে লেখা এক-একটা এপিটাফ— ‘শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকো প্রিয়। পুনর্বার দেখা হওয়ার আগ পর্যন্ত’, ‘ঈশ্বর, আমাকে দুঃখ দেওয়াই কি ছিল গূঢ় লক্ষ্য! তাই তাকে আমার কাছ থেকে অকালে ছিনিয়ে নিলে’ কিংবা ‘একটু নীরব থাকতে দাও এই কবরের মানুষটাকে, সে আমার বেঁচে থাকার সব ধ্বনি বুকে নিয়ে আজ ঘাস হয়ে গেছে’— এইরকম কতশত এপিটাফ! মহিমান্বিত ঈশ্বরের সন্তান হিসেবে আমি এই গির্জার পালক আর মৃত মানুষদের প্রেমের পাহারাদার। আমি ঢাকার শেষ আর্মেনিয়ান, এইসব এপিটাফ আমার প্রথম প্রেম।’

    ঝড় ততক্ষণে থামল, বৃষ্টি অবিরত। আমি বিদায় নিয়ে কোনওমতে একটা রিক্সা খুঁজে পেতে মৃতের মহল্লা ছেড়ে ছুটতে লাগলাম মরচে ধরা জীবনের প্রাত্যহিকের দিকে।

    এরপর কত দিন, বছর চলে গেছে। আরমানিটোলা বহুবার গেলেও গির্জায় ঢোকা হয়নি আর। এই সেদিন ফেসবুকে ভেসে এল ‘জাকার্তা পোস্ট’-এর একটা প্রতিবেদন, ‘নব্বইতম জন্মদিনের অল্প কিছু আগে কানাডার ওন্টারিওতে মারা গেছেন ঢাকার শেষ আর্মেনিয়ান মাইকেল জোসেফ মার্টিন।’ প্রতিবেদনে আরও লেখা ছিল— ২০১৪-তে গুরুতর অসুস্থ মার্টিনকে তাঁর মেয়েরা কানাডা নিয়ে যান।

    আমি প্রতিবেদনটা আঁতিপাঁতি করে খুঁজি। না, কোথাও নেই তার এপিটাফে কী লেখা হবে— সেই তথ্যটুকু। অগত্যা আমি সেই ঝোড়ো আবহাওয়ায় শোনা তাঁর শীতল কথামালার ফসিল থেকে তাঁর একটা এপিটাফ নির্মাণ করি—

    ‘মাইকেল জোসেফ মার্টিন
    জন্ম: বার্মা, মৃত্যু: কানাডা
    কিন্তু তাঁর প্রেম ছিল ঢাকা…’

    আমি আরও কী যেন লিখতে যাব, এর মধ্যে কোত্থেকে হঠাৎ মার্টিন নিজেই এসে সম্পূর্ণ করে দিয়ে যান তাঁর এপিটাফটি—

    ‘এবং এটা তো ঠিক 
    আমরা প্রায়শই আমাদের 
    প্রেমের কোলে
    মাথা রেখে ঘুমোতে ব্যর্থ হই
    তবে অনন্ত ঘুমের গভীরে 
    সে-ই প্রেমেই চির-জেগে রই…’।

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook