ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • বিনিদ্র: পর্ব ১


    বিমল মিত্র (February 14, 2021)
     

    কয়েকদিন ধরেই মনের মধ্যে নানা স্মৃতি ভিড় করে আসছে। কোনো প্রিয়জন হঠাৎ চলে গেলে যেমন ফেলে আসা পেছনের দিনগুলো চোখের সামনে আনাগোনা করে, ঠিক তেমনি।

    বোম্বে থেকে গুরু দত্তর হঠাৎ মারা যাওয়ার খবর পেয়ে যেমন চমকে উঠেছি তেমনি মানসিক ভাবে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি এই জন্য যে গুরু দত্ত এমন একজন মানুষ যে আমার মনের নিভৃত কোণে একটা স্থায়ী আসন করে নিতে পেরেছিল। বড় আপন, বড় প্রিয় সে জায়গা। সে জায়গাটা হঠাৎ খালি হয়ে গেল। বড় অসময়ে চলে গেল গুরু দত্ত।

    জীবনের সেই ছোট্টবেলা থেকে কত রকম মানুষের সংস্পর্শে এলাম। ছোট-বড়, গরিব-বড়লোক, অখ্যাত-বিখ্যাত তাদের কাউকে মনে আছে, কাউকে মনে নেই, কিন্তু গুরু দত্তকে বোধহয় কোনোদিন ভুলতে পারব না। বড় আপন করে কাছে টেনেছিল সে আমায়। তার চরিত্রে যে মাধুরীর পরিচয় আমি পেয়েছি, তা বুঝি কোনোদিনও আমি ভুলব না।

    এক-এক সময়ে ভাবি, গুরু দত্তের জীবনে কীসের অভাব ছিল? কেন সে এত অসুখী ছিল, কীসের তার এত যন্ত্রণা, কেন সে রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে কাটাত? দুনিয়াতে মানুষ সুখী হওয়ার জন্য যা যা জিনিস কামনা করে, তার সবই তো গুরু দত্তের ছিল। মানসম্মান, যশ-অর্থ-প্রতিপত্তি-সুনাম-স্বাস্থ্য, সুন্দরী স্ত্রী, সন্তান— কী ছিল না তার জীবনে? তবুও সে কীসের জন্য অস্থির হয়ে ছটফট করত? কী সেই যন্ত্রণা?

    এক-এক সময়ে ভাবি, গুরু দত্তের জীবনে কীসের অভাব ছিল? কেন সে এত অসুখী ছিল, কীসের তার এত যন্ত্রণা, কেন সে রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে কাটাত? দুনিয়াতে মানুষ সুখী হওয়ার জন্য যা যা জিনিস কামনা করে, তার সবই তো গুরু দত্তের ছিল।

    আমার মনে পড়ে গেল বোম্বের সেই দিনগুলোর কথা। কত আরামের, কত আনন্দের সেই দিনগুলো। পালি হিলের সেই বাংলোটায় ভেতরে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করা। আর শুধু বোম্বে কেন লোনাভালা, মহাবলীপুরমের সেই গেস্ট হাউস আর গুরুর ফার্ম হাউসও তো আছেই। কতদিন ধরে কত কাছের থেকে গুরু দত্তকে চিনেছি আর জেনেছি। সেই জানাচেনা মানুষ গুরু দত্তকে যতখানি দেখেছি এবং বুঝেছি, সে-কথাই লিখব বলে আজ কলম ধরেছি।

    তখন ১৯৬০ সাল। কলকাতার নিজের বাড়িতে বসে ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’-এর কিস্তি লিখছি। ‘দেশ’ পত্রিকায় তখন নিয়মিত ভাবে প্রতি সপ্তাহে ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ উপন্যাস বেরোচ্ছে। হঠাৎ একদিন সকালবেলা এক ভদ্রলোক এসে হাজির হলেন। নাম সূর্য লাডিয়া। কলকাতাতেই থাকেন। বোম্বের ‘গুরু দত্ত ফিল্মস্‌’-এর ইস্টার্ন রিজিয়নের তিনি ডিস্ট্রিবিউটর। তিনি যা বললেন তা শুনে আমি খুব একটা অবাক হইনি। কারণ মাসখানেক আগে বোম্বে থেকে ‘গুরু দত্ত ফিল্মস্‌’-এর ম্যানেজারের একটা ট্রাঙ্ককল  পেয়েছিলাম এবং তাতে জেনেছিলাম যে ওরা আমার ‘সাহেব বিবি গোলাম’ উপন্যাসটার হিন্দি সিনেমা করতে চান এবং সেই প্রসঙ্গে আমার সঙ্গে কিছু আলোচনা করার জন্য আমাকে বোম্বে যেতে বলেন। আমি সমায়াভাব জানিয়ে সবিনয়ে সে-প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করি।

    কিন্তু সূর্য লাডিয়া নাছোড়বান্দা। কিছুতেই আমার আপত্তি শুনবেন না। বললেন— আপনি একবার একটু সময় করে বোম্বেতে গিয়ে আমাদের ফিল্ম প্রোডিউসার গুরু দত্তের সঙ্গে দেখা করুন। আপনার কোনো কষ্ট হবে না। আমি আপনার এয়ার টিকিট কেটে নিয়ে আসব, আপনাকে গাড়ি করে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেব।

    আমার তখন খুব শরীর খারাপ। রাত্রে ঘুম হয় না। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ডায়েট চার্ট মিলিয়ে মিলিয়া খাওয়া-দাওয়া চলছে। বোম্বাই যেতে ভয় করতে লাগল। ভদ্রলোক তখন আমার মুখের দিকে চেয়ে আছেন।

    বললাম— না মশাই, আমার স্বাস্থ্য খারাপ, যা-তা খাওয়া চলবে না— আমি বোম্বে যেতে পারব না—

    ভদ্রলোক বললেন— আপনি যেমন-যেমন খেতে চাইবেন সেই রকম ব্যবস্থাই করা হবে— আপনি চলুন—

    বললাম— তাঁদের এখানে আসতে আপত্তি কি?

    ভদ্রলোক বললেন— তাঁদের এখানে এলে অনেক খরচ হয়ে যাবে, আর আপনি সেখানে গেলে গুরু দত্তর বাড়িতেই উঠবেন। গুরুর স্ত্রী বাঙালি, আপনি যা খাবেন তার ব্যবস্থা করে দেবেন—

    আমি তাতেও যেন রাজি নই দেখে শেষকালে তিনি বললেন— তাহলে এক কাজ করুন। আপনাকে এক্ষুনি কিছু উত্তর দিতে হবে না। আপনি বেশ ভালো করে ভাবুন। বিকেল চারটের সময়ে টেলিফোনে জানালেই চলবে—

    ব্যবস্থাটা খারাপ মনে হল না। আমি রাজি হয়ে গেলাম। কিন্তু আসলে আমার না যাওয়ার কারণটা ছিল আলাদা। তখন সপ্তাহে-সপ্তাহে ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ লিখছিলাম। বোম্বে গেলে যদি তাতে ব্যাঘাত হয়?

    তা সেদিন বিকেল চারটের সময়ে টেলিফোন তুলেই বললাম— না মশাই, আমার যাওয়া হবে না—

    ভদ্রলোক বললেন— তাহলে এক কাজ করুন আমি টিকিটটা কেটে ফেলি, আপনি রাত আটটার সময়ে আমার বাড়িতে আসুন, গুরু দত্তের সঙ্গে ট্রাঙ্ককলে আপনি না হয় নিজেই কথা বলবেন। তাতেও যদি আপনি না যেতে চান, তখন টিকিট ফেরত দিয়ে দেব—

    সেই ব্যবস্থাই হল। রাত্রি আটটার সময়ে গুরু দত্তের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বললাম। বড় মিষ্টি গলা। পরিষ্কার গলায় গুরু দত্ত বললে— আপনি এখানে আসুন, যদি আপনার ছবির রাইট দিতে অমত হয় তো আমি আপনাকে জোর করব না—

    তিন মিনিটের কথা। কী জানি গুরুর গলায় কী ছিল? আমি রাজি হয়ে গেলাম। পরদিন সকাল ন-টার সময়ে বাড়ি থেকে বেরোতে হবে। প্লেন ছাড়বে এগারোটায়। ছোটবেলা থেকে সমস্ত ভারতবর্ষে ঘুরে বেড়িয়েছি। কিন্তু সে ট্রেনে। প্লেনে চড়া এই প্রথম। ভাবলাম, গুরু দত্ত কীরকম লোক কে জানে! হয়তো আমাকে দিয়ে কীরকম কনট্রাক্টে সই করিয়ে নেবে। আমার ভয়-ভয় করছিল। কিন্তু প্লেনে উড়তে মন্দ লাগল না। মনে হল যেন আমার সব অসুখ সেরে গেছে। যেসব খাদ্য কখনও ভয়ে খাইনি, সেই সব খাবার নিশ্চিন্তে খেয়ে নিলাম। ঝরঝরে হয়ে গেল শরীরটা। হাতে ছিল ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’-এর ফাইলটা। উড়তে উড়তে সেইটে লিখতে লাগলাম। মনে হল যেন নিজের বাড়িতে টেবিলে বসে লিখছি।

    ঠিক সাড়ে চারটের সময়ে প্লেন গিয়ে নামল সান্তাক্রুজের বিমানবন্দরে। লোকও হাজির ছিল। আমাকে নিয়ে পালি হিলের একটা বাগানবাড়ির ভেতরে গাড়িটা ঢুকল।

    সেই প্রথম দিন বাড়িটা দেখা। বাড়ির সামনে-পেছনে-পাশে চারদিকে ফুলবাগান। তারপরে কতদিন সেই বাড়িতে বসে গুরুর সঙ্গে রাত কাটিয়েছি। আশ্চর্য, ওই বাড়িটাই যে পরে আবার একদিন গুরু ভেঙে গুঁড়িয়ে ফেলবে, তা কি গুরুই জানত! সে এক ইতিহাস। গুরুর কত সাধের বাড়ি। যে আসত সে-ই বলত। সে-বাড়িতে বসে ভাব ভাবা যেত না যে বোম্বে শহরে আছি। একদিন গুরু বলেছিল— আমার বহুদিনের সাধ ছিল পালি হিলের ওপরে একটা বাড়ি করব। ১৯৫১ সালে বোম্বে এসে প্রথম ভাড়াটে বাড়িতে ছোট একটা ফ্ল্যাট নিয়ে বাস করত গুরু। তখন খুব অবস্থা খারাপ। অল্প টাকা হাতে আসত। বাঁয়ে আনতে ডাইনে কুলোয় না। গরিবের ছেলে। ম্যাট্রিকটা কোনওরকমে পাশ করেছে কলকাতা থেকে। তখন গুরুর মাত্র ষোলো বছর বয়স। সেই ছোটবেলাতেই দিদিমার সঙ্গে সিনেমা দেখতে যেত। ভবানীপুরে পূর্ণ থিয়েটারের কাছাকাছি ছিল গুরুদের বাড়ি। দিদিমা নাতির হাত ধরে নিয়ে সিনেমায় ঢুকত। আর নাতি দেখত আর এক জগতের ছবি। ছবি নড়ে, ছবি কথা বলে, ছবি গান গায়। অবাক হয়ে চেয়ে থাকত সেই ছেলেমানুষটা। 

    পুনঃপ্রকাশ
    মূল বানান অপরিবর্তিত

    পর্ব ২

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook