মোবাইলের অ্যালার্মটা বেজেই চলছিল বিকট স্বরে ও সুরে। ঘুম ভাঙতেই তড়াক করে উঠে পড়ল অদিশ। ফোনটা তুলে সময় দেখল সে। যাক, এমন কিছু দেরি হয়নি; কিন্তু ঘর প্রায় অন্ধকার, আধখোলা জানলাটা দিয়ে বৃষ্টির ছাট এসে গায়ে লাগছে, কম্পিউটার স্ক্রিনের আলো ঠিকরে পড়েছে বিছানায়; কিছুটা ভিজে গেছে বিছানার একপাশ। প্রায়দিনের মতোই কম্পিউটারটা শাট-ডাউন না করে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। তোশকের নীচে সযত্নে রাখা জামা আর প্যান্টটা ঠিক আছে কিনা একবার দেখে নিল সে; যাক ভেজেনি! আজ ইন্টারভিউ আছে চাকরির।
বাইরে আকাশ কালো করে অবিরাম ধারায় নিম্নচাপের বৃষ্টিপাত চলছে। ঘর-সংলগ্ন ছাদে বৃষ্টিভেজা সকালের ঘ্রাণ নিতে বের হল সে। আরও কয়েক মিনিট কিছুটা অসহায়ের মতো, কিছুটা ইচ্ছাকৃত ভাবে বৃষ্টিতে ভিজে স্নান করে নিল। কাল খবরের কাগজে পড়েছিল, একটা নিম্নচাপ ঢুকছে গাঙ্গেয় বঙ্গে অন্ধ্র-ওড়িশা হয়ে। পেছন থেকে ভেসে এল, একটা লোকাল ট্রেনের হর্ন মেরে ধীর গতিতে চলে যাওয়ার শব্দ। সে যে বাড়ির ছাদের একমাত্র ঘরে বাস করে, তা রেললাইন সংলগ্ন। ছাদ দিয়ে পেছন দিকে তাকালেই চোখে পড়বে পাঁচিল, তারপর রেল-বস্তির ঘরের সারি, আর তারপরই লাইন।
আরও পড়ুন: দীপান্বিতা রায়ের গল্প ‘বন্ধ ঘরের প্রজেক্ট’
কিছুক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো ভেজার পর তার মনে পড়ল তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নেওয়ার কথা। ঠিক ১১ টায় পৌঁছতে হবে ক্যামাক স্ট্রীট। এই বৃষ্টির দিনে যেতে সময় এবং গাড়ি ভাড়া দুটোই বেশি লাগবে। ছাদের এক কোণে বাথরুমের দিকে এগোল সে।
শার্ট-প্যান্ট পরে, কাঁধে ঝোলাব্যাগ আর মুখে মাস্ক লাগিয়ে সবে নীচে নেমেছে সে, ওমনি “এই অদিশ শুনে যাও একটু বাবা…” বলে হাঁক পাড়লেন চৌধুরীদা। “আরে তুমিও চৌধুরী, আমিও… তাই কিনা আমার ঘরে ফেলে গিয়েছে!” চৌধুরীদা এগিয়ে দিলেন একটা রেজিস্ট্রি চিঠির খাম। আর-একটু গায়ে পড়ে আদিখ্যেতা দেখানোর হাসি হাসলেন।
তাড়াতাড়ি খামটা নিয়ে পিঠের ব্যাগে ফেলে অটো স্ট্যান্ডের দিকে হাঁটা লাগাল অদিশ। পেছন থেকে চৌধুরীদার গলা ভেসে এল, “প্রেম-টেম করছ না তো, আজকাল কি প্রেমপত্র রেজিস্ট্রি পোস্টে আসে? ওই মরীচিকার পেছনে গেলে কিন্তু…”
লোকটা নেহাতই সেকেলে ধরনের। আর-একটু বাজে রকমের কৌতূহলী টাইপ। নাহলে জানত, আজকাল প্রেমপত্র ডাকে নয়, ই-মেইলে আসে; মুহূর্তের মধ্যে। যাইহোক, অটোয় চেপে একটা সিগারেট ধরাল সে। আজ তার দুটো ইন্টারভিউ; প্রথমটা একটা প্রাইমারি স্কুলে, দ্বিতীয়টা একটা প্রকাশনার অফিসে। দুটোই ইন্টারনেট থেকে গত সপ্তাহে অ্যাপ্লাই করেছে, তবে প্রথমটায় এই দুর্যোগের দিনে সে আর যাবে না। অটোটা রাস্তার খানাখন্দে জমা জল এড়িয়ে এঁকেবেঁকে চলছে। জলের ছাট এসে তার হাতের সিগারেটটা প্রায় ভিজিয়ে দিয়েছে। বড় রাস্তার মুখে এসে অটোটা সিগনালে দাঁড়াল, একটা কাকভিজে কিশোর তার দিকে একটা ধূপের প্যাকেট এগিয়ে দিল রাস্তা থেকে। ভিজে যাওয়া ধূপের প্যাকেট দেখে সে অবাক হল, কিন্তু আর এসব বসে দেখার সময় নেই। লাফিয়ে নেমে ভাড়া চুকিয়ে, ছাতা খুলে সে দৌড় দিল বড় রাস্তা পার হয়ে বাস ধরতে।
অদিশ রসায়নে স্নাতক। পরিচিত রুবিদার সখের ইস্কুলে পড়ানো ছাড়া, সম্বল বলতে চারটে টিউশনি। তাতে শহরে পাঁচহাজার টাকা বাড়িভাড়া গুনে, ছ’-সাতশ টাকা ইলেক্ট্রিক বিল দিয়ে, যাতায়াত খরচ ও মোবাইল-ইন্টারনেটের রিচার্জের মূল্য চুকিয়ে, প্রায়দিনই সে অর্ধভুক্ত থাকে। তার বাবা-মা দু’জনই প্রয়াত। হ্যাঁ, একজন দিদিও ছিল বাল্যকালে, কিন্তু সে প্রাইমারি স্কুল পেরোনোর আগেই চলে গিয়েছে সেরিব্রাল ম্যালেরিয়াতে। তখন অবশ্য এসব রোগের নামই জানত না সে, আর একটু বড় হয়ে বাবার কাছে শোনে।
বাসে জানলার ধারের সিটে বসে, পকেট থেকে মোবাইলটা বের করল অদিশ। ভিজে গিয়েছে, কিন্তু দিব্যি জেগে আছে। বছর পাঁচেকের পুরনো সেট, আধুনিক মোবাইল হলে যেত এতক্ষণে। সে স্নাতক হওয়ার পর তার এক সম্পর্কীয় মামা উপহার দেয় এই মোবাইলটা। “সায়েন্সে অনার্স গ্র্যাজুয়েট ভাল কথা, কিন্তু এই বাজারে এমএসসিটা যদি করে নিতে পারিস, তাহলে…” এমএসসিতে ভর্তি হতেই পারত সে, কিন্তু শহরে থেকে পড়ার খরচ আর টানতে পারত না।
এত অবধি পড়ে যদি কেউ মনে করেন যে অদিশ খুব দুঃখে আছে, কোনওক্রমে একটা ভাল চাকরি পাওয়া তার চাই স্বচ্ছল জীবনযাপন করতে, তাহলে তিনি মস্ত ভুল করবেন। অদিশ আছে তার নিজের জগতে, তার স্বকীয় ছন্দে, স্বকীয় গতিতে ও স্বকীয় মননশীলতায়। যা বাস্তব জগতের সাধারণ দর্শনের থেকে খানিক আলাদা। কলকাতায় তার একমাত্র আত্মীয় ওই তুতো মামার ভাষায় “ওহ্ তুই বড্ড ক্যাজুয়াল, একটু সিন্সিয়রলি নে জীবনটাকে, দেখবি অনেক ওপরে চলে গেছিস…” এটা অবশ্য নিছকই এক কর্পোরেট এক্সিকিউটিভের দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে উড়িয়ে দেয় সে। সে কোথাও ক্যাজুয়াল, আবার কোনও-কোনও বিষয়ে খুব সিন্সিয়রও…
যাই হোক, এখন এটা-সেটা ভাবতে-ভাবতে অদিশ টেরই পায়নি যে, তার পাশে একটা ভিজে মেয়ে এসে বসেছে। ভিজে বলতে সে বৃষ্টিতে প্রায় সম্পূর্ণ ভিজে গেছে। আড়চোখে সে মেয়েটিকে দেখতে যাবে, তখন মেয়েটি আচমকাই কথা বলে উঠল। “আচ্ছা ক্যামাক স্ট্রীটে অজন্তা হাউসটা কোথায় বলতে পারেন?” অদিশ কিছুটা অবাক হল; সেও একই গন্তব্যে যাচ্ছে। তবে সেটা চেপে গিয়ে বলল, “মোড়ে নেমে বাঁদিকে কিছুটা সোজা যেতে হবে।” এর থেকে বেশি সে নিজেও ঠিক বুঝতে পারেনি কাল রাতে গুগুল ম্যাপ দেখে। মেয়েটি যেন উৎসাহ পেল আর একটু। সে অদিশকে অবাক করে দিয়ে বলল, “আসলে আমার একটা ইন্টারভিউ আছে জানেন ওই বিল্ডিংইয়ে, একটা পত্রিকার অফিসে।” এবার অদিশের সত্যি অবাক হবার পালা! সে এতটাও ভাবেনি। স্বয়ং কম্পিটিটর যাত্রাপথে তার পাশের সিটের সহযাত্রী!
কাকতালীয়। তার বন্ধু সৌরদীপ শুনলে, ‘রিয়েল লাইফ-প্রোবাবিলিটি’ নিয়ে লেকচার দিয়ে দিত খানিক, ভেবে হাসল অদিশ। বাস চলছে বেশ গতিতে, রাস্তার জমা জল আশেপাশে ছলকে দিতে-দিতে। কন্ডাক্টর হাঁক পেড়ে চলেছে স্টপেজের নাম ধরে-ধরে। পাশে বসা সহযাত্রীটি মুখে রুমাল চাপা দিয়ে হাঁচল বার দু’য়েক। তারপর তার দিকে ফিরে, একটু মৃদু হেসে বলল, “আই অ্যাম সরি”। যন্ত্রের মতো না হেসেই সে প্রত্যুত্তর দিল “ইটস ওকে”। তারপর ভদ্রতাবসত একটু হাসলও। মেয়েটি নিশ্চিত নার্ভাসনেসে ভুগছে, না হলে এত কথা বলত না! হয়তো এক্কেবারে নভিস, না হলে, আগবাড়িয়ে নিজের ইন্টারভিউয়ের কথা বলার কী প্রয়োজন! কিন্তু নিজের গন্তব্য নিয়ে খাপ খুলল না সে।
এবার আড়চোখে মেয়েটিকে যতটা দেখা যায় ততোটাই দেখে নিল সে। মুখশ্রীটা সুন্দর, কিছুটা আলগা চুল পড়ে মুখের সামান্য অংশ ঢাকা পড়েছে, যার জন্য মেয়েটিকে বেশ রহস্যময়ী লাগছে। এবার অদিশের মাথায় একটা বুদ্ধি খেলল; সে কন্ডাক্টরকে ডেকে দু’টি টিকিট কাটল, তারপর একটা মেয়েটার হাতে দিয়ে দিল। “ওহ, থ্যাঙ্কস”, একটু অবাক হওয়ার ভাব করল সে। “আমি রশ্মি…”, স্বাভাবিক গলায় বলল সে। “অদিশ, আপনারই মতো চাকরি-প্রত্যাশী”। রশ্মি একটু হাসল তার অকপট উত্তর শুনে। হয়তো মনে-মনে দু’জনের মধ্যে একটা মিল খুঁজে পেল। এক্ষেত্রে কীরকম আচরণ হওয়া স্বাভাবিক? সহযোগী না প্রতিযোগী, ভাবছিল অদিশ, তখনই বৃষ্টির ঝাপটা এসে রশ্মির গায়ে পড়ল, সে এক ঝটকায় কিছুটা অদিশের দিকে সরে এল। তার শরীর হয়ে অদিশের গায়েও লাগল খানিক বৃষ্টির জল।
“এরকম রোমান্টিক আবহে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাওয়াটা একটা লাইফ-টাইম এক্সপিরিয়েন্স, বলুন?” সাহসী হয়ে বলেই ফেলল অদিশ।
“হুম, তাই হয়তো; যদি না…”, বাক্য শেষ না করেই থেমে যায় রশ্মি। বাস ইতিমধ্যেই মেডিকাল কলেজ পেরিয়ে চাঁদনির দিকে ছুটছে। অদিশ অহেতুক প্রশ্ন করে না, তবে মেয়েটির আচমকা চুপ করে যাওয়া তাকে ভাবায়; হয়তো কোনও সমস্যায় পড়েছে।
“আমি একটা প্রাইমারি স্কুলে পড়াই; এ-ধরনের পত্রিকার কাজে একদম নভিস”। অদিশ আর রশ্মি এখন একটা পাক্ষিক পত্রিকার অফিসে পাশাপাশি সোফায় বসে। ভেতরে কাঁচের ঘরে বসে সম্পাদিকা একজনের ইন্টারভিউ নিচ্ছেন। লিফ্টে ওঠার সময়ে রশ্মি জানতে পারে, এই চাকরির ব্যাপারে অদিশ তার প্রতিযোগী।
“আপনার যদি আগে হয়ে যায়, তাহলে আমার জন্য অপেক্ষা করবেন?” রশ্মির দাবিতে অদিশ কিঞ্চিৎ অবাক হয়। বোঝে মেয়েটি একটু নার্ভাস। কয়েক সেকেন্ড নীরবতার পর সে বলে, “এই বিল্ডিংয়ের উলটোদিকের আমগাছটার নীচে ওয়েট করব।” রশ্মি যেন আস্থা পায়, “থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ। আমারও আগে হয় গেলে ওখানেই অপেক্ষা করব, গাছটা যদিও দেখিনি”। তার কথা শেষ হওয়ার আগেই “রশ্মি রায়” বলে ডাক দেন পিওন। অদিশ আলতো গলায় বলে “অল দ্য বেস্ট।”
এখন ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়ছে; রাস্তা ভিজে, কোথাও কাদা প্যাচপ্যাচে। অদিশ ইন্টারভিউ পর্ব মিটিয়ে, ফুটপাথে পা দিয়ে দেখে রশ্মি উলটো দিকের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে, তারই নির্দিষ্ট করা গাছটার নীচে। কেন সে বৃষ্টির মধ্যে একজন অপিরিচিত যুবকের জন্য দাঁড়িয়ে, তা রশ্মি নিজেও ঠিক বুঝতে পারে না। কিন্তু মন ও শরীরের মধ্যে এক আলোড়ন অনুভব করে সে, যাতে তার পরিচিত-অপিরিচিতের ভেদরেখা সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়। অদিশ জানেই না যে, তাকে কতটা খুঁটিয়ে নিরীক্ষণ করেছে রশ্মি; সেই বাসটা যখন সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউয়ে ছিল তখন থেকে, এবং এখনও করে চলেছে। অদিশ আগে ফুটপাথের দোকান থেকে সিগারেট কিনে ধরায়, তারপর রাস্তা পেরিয়ে রশ্মির মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ায়। “এই রে, জিজ্ঞেস করা হল না, চলে?” হাতের সিগারেটটার দিকে ইঙ্গিত করে বলে অদিশ।
“না, এখন মুড নেই। তবে আপনি স্বচ্ছন্দে খেতে পারেন। কেমন হল?”
“কেমন আবার? একগাদা প্রশ্ন; নাড়ি-নক্ষত্র জেনে নিল; আর মনে হল, মোবাইল, কনভিনিয়েন্স, সর্বসাকুল্যে সাড়ে সাত হাজারের বেশি দেবে না; সপ্তায় পাঁচদিন ফুলটাইম কাজ সত্ত্বেও।”
“তবুও আপনি চাকরিটা পেলে নিয়ে নিন। চাকরি তো!” একটু কাতর শোনায় রশ্মির গলা।
অদিশ প্রশ্নটা এড়িয়ে যায়। “আপনার কেমন হল? আপনি পেলে নেবেন কি?”
“আমার হওয়া কঠিন। বললাম না, এই পেশায় আমি একদম ফ্রেশার! আমার বাংলা ডিটিপি অত ভাল না” স্বাভাবিকভাবেই বলে রশ্মি।
“তা আমিই বা কোন হরিদাস পাল এই লাইনের? চালিয়েছি তো কয়েকটা মামুলি লিটল ম্যাগ; চলুন চা খাওয়া যাক।”
“আমি খাওয়াব কিন্তু”; জোর গলায় বলে রশ্মি। অদিশ দেখে রশ্মির নার্ভাস ভাব একেবারে উধাও এই কয়েক মিনিটে। সে আপত্তি না করে ফুটপাথের ধারে একটা চায়ের দোকানের দিকে এগোয়। দোকানের একপাশে ফাঁকা বেঞ্চ পাতা। “আমি কিন্তু লিকার”, বলে অদিশ।
“আচ্ছা, নো প্রবলেম; তবে আমি লাল-চা খেতে পারিনা। বড্ড তেঁতো লাগে! বেঞ্চটা ভিজে নয় তো?”
“না না, দিব্যি বসতে পারেন”; আশ্বস্ত করে অদিশ। রশ্মি অদিশের পাশে বসে বলে “দুটো বাদাম বিস্কুট বলি?”
“আমারটা একটু পরে। চায়ের সঙ্গে সিগারেটটাই শেষ করি”। মৃদু হেসে বলে অদিশ।
“তা করুন। আমি কিন্তু চায়ের সঙ্গেই বিস্কুট নিচ্ছি”, কাঁচের বয়াম খুলে একটা বাদাম বিস্কুট তুলে নেয় রশ্মি। দোকানের বয়স্ক ব্যক্তি চা এগিয়ে দেন। ধূমায়িত চায়ে ফুঁ দিতে-দিতে রশ্মি বলে, “আমার কথাটার উত্তর দিলেন না আপনি।”
“কোন কথাটা বলুন তো?”
‘মানে, আপনি চাকরিটা নিয়ে নিন। একটু কম মাইনের হলেও চাকরি তো”। অদিশ বেশ অবাক হয়। অজান্তেই প্রশ্ন করে ফেলে “আপনি এত ইনসিস্ট করছেন কেন বলুন তো?” কয়েক সেকেন্ড দু’জনেই নীরব থাকে। তারপর অদিশ হেসে বলে, “আপনার প্রশ্ন শুনে মনে হচ্ছে, যেন সংসার পাতবেন আমার সঙ্গে?” রশ্মি মুখ তুলে অদিশের দিকে তাকায়। তারপর অদিশকে সম্পূর্ণ বুরবক বানিয়ে দিয়ে মৃদু হেসে বলে “যদি তাই করতে যাই, আপত্তি আছে আপনার?” এরপর কয়েক সেকেন্ড নীরবতা।
অদীশ এবার মুখ খোলে, “আপনাকে এতক্ষণ বেশ নার্ভাসটাইপ মনে হচ্ছিল; এখন দেখছি এক্কেবারে প্র্যাক্টিকাল জোকের মুডে…!”
“বাস্তবতা আমাকে নার্ভাস করেছে খানিক ঠিকই, তবে আমি নার্ভাসটাইপ নই!” বেশ দৃঢ় কন্ঠে প্রতিবাদ করে রশ্মি। “আর কোনও জোক নয়, আমি প্র্যাক্টিকালি ভবিষ্যতটাকে নির্মাণ করতে চাইছি!”
হো-হো করে হেসে ফেলে অদীশ। “এটাকে আপনি ভবিষ্যৎ নির্মাণ বলছেন? কল্পনাপ্রবণ মানতেই হবে! গল্পটল্প লেখেন নাকি? ঠিক করে বলুন তো…”
অদিশ একটু থেমে বলে, “আচ্ছা, এক মিনিটের জন্য মেনে মিলাম আপনার প্রোপোজাল বা রসিকতা, যাই করে থাকুন না কেন! কোনও অজানা পৃথিবীতে ঝাঁপ দিতে চাইছেন, তার সম্পর্কে আপনার ন্যূনতম ধারণা আছে?”
“না নেই। আমার কাছে তা একটা বন্ধ দরজার অপরদিক বা একটা জানলার পর্দায় ঢাকা বহির্জগতের মতো! যতক্ষণ না দরজাটা খুলছে, বা পর্দাটা সরিয়ে দেখতে পাচ্ছি সেই জগতটাকে, ততক্ষণ তা অজানা”। স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দেয় রশ্মি। মেয়েটির এই সোজাসাপ্টা জবাব অদিশকে কিছুটা নাড়া দেয়। তবে তা আড়াল করে সে আরও জানতে চায়, “আপনার সমস্যার উৎসটা কী? আপনি যে কোনও প্রবলেমে পড়েছেন, তা বুঝতে পারছি”। তারপর মুখটা রশ্মির মুখের কাছে নিয়ে গিয়ে বলে, “আপনি যে সাহিত্যপ্রেমী বা কল্পনাপ্রবণ, তা বুঝলাম, নাহলে…!”
রশ্মি কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকে। তারপর বেশ জোরের সঙ্গে বলে, “প্রথমত, আমি রসিকতা করিনি। তবে আপনার ওই ভুল ধারণা হওয়াটা স্বাভাবিক; দ্বিতীয় পর্যবেক্ষণটা ঠিক। হ্যাঁ, আমি খুবই জটিল একটা সমস্যায় পড়েছি”।
অদিশ নীরব শ্রোতা। সে আরও শুনতে আগ্রহী। এই মেঘলা দিনে, এক মেঘলা মেয়ের আবির্ভাব হয়েছে তার জীবনে, অনেকটা আকাশে আচমকা বিদ্যুত চমকানোর মতোই।
অদিশকে চুপ করে থাকতে দেখে রশ্মি বলেই চলে, “দেখুন, আমার বাবা-মা দুজনেই প্রয়াত। দাদা-বৌদি ও বছর সাতেকের ভাইঝির সঙ্গে থাকি। ওরা আমার একটা বিয়ে ঠিক করে; পাত্রপক্ষ দেখে-টেখে পছন্দ করে, দিনক্ষণ ঠিক হওয়ার পর এমন ডিমান্ড শুরু করে, যা সম্পূর্ণ আমাদের সামর্থ্যর বাইরে”। এবার অদিশ কথা বলে ওঠে। “তো করবেন না ওরকম পরিবারে বিয়ে। চুকেবুকে গেল। বাংলাদেশে কি সৎপাত্রের অভাব, এত সুচাকুরে ছেলে?”
“আমার জন্য আছে, অদিশ। সুচাকুরে ছেলেদের খবর জানিনা; কিন্তু ভাইজিটা বড় হচ্ছে, আমাকে নিয়ে দাদা-বৌদির অসহিষ্ণুতা আর অস্থিরতা দুটোই বাড়ছে, বেশ বুঝতে পারি”। এটা বলে রশ্মি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, আড়চোখে অদিশের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করে, একটু সময়ও দেয় অদিশকে কিছু বলার জন্য। কিন্তু অদিশ চুপ করেই অপেক্ষা করে, রশ্মির পুরো কথাটা শোনার জন্য। রশ্মি আবার বলতে থাকে, “আমি এই কমপ্লিকেশন থেকে বেরোতে চাই, অদিশ, এমন একটা জায়গা, যেখানে ভালবাসা আছে, মুক্ত বাতাস আছে, স্বাধীনতা আছে”। অদিশ এখনও নীরব, সে সিগারেটে একটা লম্বা টান দেয়।
“আপনি কিছু বলছেন না যে?” অদিশের মুখের দিকে তাকিয়ে জানতে চায় রশ্মি।
“কী বলব বুঝতে পারছি না! কাল রাত্তির থেকে স্রেফ ইন্টারভিউ আর চাকরির অফারের কথা ভেবেছি। এমন প্রশ্ন ফেস করতে হবে, তা তো…”
এবার রশ্মির চুপ করে অপেক্ষার পালা। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টির ছাট এসে লাগছে তাদের দু’জনেরই গায়ে, ভিজিয়ে দিচ্ছে দোকানের বেঞ্চগুলোকে।
“আমার জন্য আছে, অদিশ। সুচাকুরে ছেলেদের খবর জানিনা; কিন্তু ভাইজিটা বড় হচ্ছে, আমাকে নিয়ে দাদা-বৌদির অসহিষ্ণুতা আর অস্থিরতা দুটোই বাড়ছে, বেশ বুঝতে পারি”। এটা বলে রশ্মি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, আড়চোখে অদিশের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করে, একটু সময়ও দেয় অদিশকে কিছু বলার জন্য।
“আর এক রাউন্ড চা বলি, কী বিস্কুট খাবেন? বাদাম?” রশ্মি নীরবে ঘাড় নাড়ে। অদিশ আর একটা গোল্ডফ্লেক নিয়ে ধরায়। রশ্মির কানে-কানে বলে, “এখনও কিছুক্ষণ বসতে হবে মনে হচ্ছে তো, তাই কিছু জিনিস নেওয়া ভাল”। রশ্মি চুপ করে শোনে।
অদিশ ছাতাটা খুলে আড়াআড়িভাবে ধরে। “একটু সরে আসুন এদিকে”। অদিশের কথা শুনে রশ্মি কয়েক ইঞ্চি সরে আসে অদিশের দিকে। আর আড়াআড়িভাবে ধরা কালো ছাতাটা দু’জনকে বৃষ্টির জল আর রাস্তার দিক থেকে আড়াল করে।
২
“নাম মনি, জোরে বৃষ্টি আসছে”! কাঁধের ওপর বসা বছর সাড়ে ছয়েকের মঞ্জিলকে বলে অদিশ। “মাথায় জল লাগলে আবার তোর সর্দি হবে; ইস্কুল কামাই, তোর নতুন আন্টি কিন্তু খুব স্ট্রিক্ট”। মঞ্জিল এতক্ষণ কাঁধে জাঁকিয়ে বসে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যাচ্ছিল; এখন নতুন আন্টির নাম শুনতেই অদিশর কাঁধে দু’হাতের ভার দিয়ে ঝুলে পড়ে, সুরসুর করে নেমে পড়ার উপক্রম করল। অদিশ ধমকে ওঠে, “আবার পাকামো!” মঞ্জিল ততক্ষণে একটা আড়াই ফুটের লাফ দিয়ে রাস্তায় ল্যান্ড করে ফেলেছে; এবং টাল সামলাতে না পেরে হাঁটু আর হাতের ওপর ভর দিয়ে মাটিতে পড়ে গিয়েছে। যদিও অদিশকে সামান্য সুযোগ না দিয়েই সেকেন্ডের ভগ্নাংশে সে উঠে দাঁড়ায়; হালকা চোটকে নস্যাৎ করে নিজেই দু’হাত দিয়ে হাঁটুর ধুলো ঝাড়তে থাকে। “কেন তোকে বেশি পাকা বলি বল তো!” এবার রেগে ওঠে অদিশ। “মা থাকলে দিত তোকে!” বলেই তার মনে হয় শেষাংশটা না বললেই ভাল হত। সে ঝুঁকে পড়ে মঞ্জিলের হাঁটু পরীক্ষা করে। “একটু তর সয় না, না?”
“তুমি তো বললে তাড়াতাড়ি নেমে পড়তে, বৃষ্টি আসছে বলে”। মঞ্জিল স্বপক্ষে যুক্তি দেয়।
“দুটো হাঁটুই ছড়েছে, বাড়ি গিয়ে কিছু একটা লাগিয়ে নিতে হবে। হ্যাঁরে, তোর লাগে-টাগে না?” মঞ্জিলের মুখে এবার বর্ষার ফুলের মতো হাসি ফুটে উঠল। “নাঃ এবার একদমই লাগে নি!”
মাতৃহীন ক্লাস ওয়ানের ছাত্র মঞ্জিলকে ইস্কুল থেকে বাড়ি নিয়ে ফিরছিল অদিশ। এমনি দিনে স্কুলের পর থাকে ক্রেশ। তারপর অদিশের তাকে নিতে প্রায় সাড়ে সাতটা বেজে যায়। ক্রেশের জন্যই এই স্কুলে ক্লাস ওয়ানে মঞ্জিলকে ভর্তি করেছে অদিশ। আজ মঞ্জিলের ক্লাস-টিচার একবার ডেকে পাঠিয়েছিলেন মঞ্জিলের বাবাকে, ছাত্রের একটা বিশেষ সমস্যা নিয়ে আলোচনা করার জন্য। এই প্রথম অদিশ এই শিক্ষিকার মুখোমুখি হলেন।
“আপনিই মঞ্জিলের বাবা?” যুবতী মহিলা, বেশ ফ্যাশনেবল। “আসুন এই ঘরটায় বসা যাক”। একটা ছোট ওয়েটিং রুমের মতো ঘরে অদিশকে নিয়ে যান মহিলা। সামনে বসে বলেন, “এমনি সব ঠিক আছে। তবে একটা বিষয় আপনাকে জানানোর দরকার মনে হল। ও মাঝে-মাঝেই হারিয়ে যায় নিজের জগতে, attention deficiency-তে ভোগে। বহু সময়ে ওকে দেখা গেছে ক্লাস চলাকালীন জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতে”। তারপর একটু থেমে মহিলা যোগ করেন, “এমনিতে কিন্তু ও বেশ মিশুকে। কিন্তু মা নেই, একাকিত্বে ভোগাটা স্বাভাবিক ওর ক্ষেত্রে”। অদিশ পুরোটা শুনে সহমত পোষণ করে। মহিলা এবার শেষ করেন, “দেখুন কীকরে এটা কাটানো যায়। সামনে অনেকটা সময় রয়েছে। আচ্ছা, আমাকে একটা টিচার্স মিটিং অ্যাটেন্ড করতে হবে, চলি, নমস্কার”। অদিশও প্রতি-নমস্কার জানিয়ে উঠে পড়ে। সে মনে-মনে ঠিক করে, আজই দুটো মনমতো গল্পের বই কিনবে মঞ্জিলের জন্য। তারপর গল্প শোনানোর ফাঁকে মঞ্জিলকে জিজ্ঞেস করবে বিষয়টা নিয়ে। দেখা যাক, মঞ্জিল কী বলে, সেটাই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ!
এই সময়ে রশ্মির অভাব আরেকবার অনুভব করে অদিশ। ঠিক আট বছর আগে, এরকমই এক বর্ষা-বিঘ্নিত দিনে তার জীবনে এসেছিল রশ্মি। আচমকা কোনও পূর্বাভাস ছাড়াই; প্রথম মুখোমুখি সাক্ষাতে, এক বৃষ্টি-ভেজা দুপুরে, একটা কালো ছাতার আড়ালে, অদিশের হাতে প্রথমবার হাত রেখে রশ্মি বলেছিল, “তুমি খুব স্পর্শকাতর, অদিশ। এটা আমার অনুভূতি, কোনও যুক্তিযুক্ত বোধ নয়। ঠিক যেমনটা আমি…” কথা শেষ করেনি রশ্মি। তারপর তাদের বিয়ে, তার সেই চিলেকোঠার ঘরে বাড়ির মালিককে হাতে-পায়ে ধরে রাজি করিয়ে তাদের সংসার পাতা, দু’জনে একসঙ্গে চাকরিতে বেরোনো। মাস-দুয়েক পর বেতলা ফরেস্টে হানিমুনের কয়েকদিন ছিল স্বপ্নের মতো। এর কয়েকমাস বাদেই মঞ্জিলের আগমন রশ্মির গর্ভে। ছেলে জন্মানোর ছ’মাস বাদে অনেক বাছ-বিচারের পর মঞ্জিল নামটা রশ্মিই ঠিক করে। অদিশ ঠাট্টা করে বলত, “থাকো তো একটা দু’কামরার ভাড়া-বাড়িতে, ছেলের নাম দিচ্ছ মঞ্জিল!”
ততদিনে ওই চিলেকোঠার ঘর ছেড়ে একটা দু’কামরার ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে তারা। রশ্মিরই পছন্দ অনুসারে। সেই নতুন বাড়িতেই মঞ্জিলের বেড়ে ওঠা; মায়ের সঙ্গে, পরে মাকে ছাড়াই।
শুধুই বাড়িই নয়, চাকরিও বদলে অদিশ তখন একটা নতুন পত্রিকায় সাবএডিটর পদে যোগ দিয়েছে। বেশিরভাগ সময়েই কাটে অফিসে। রশ্মিই তখন প্রায় মঞ্জিলের পূর্ণ দায়িত্বে। ওই দু’কামরার নতুন ফ্ল্যাট আর মঞ্জিলের আবির্ভাব রশ্মিকে প্রাসাদসম সুখানুভূতি দিয়েছিল। সে তখনও সেই পুরনো পত্রিকায় রিপোর্টার হিসেবে কর্মরত, দুপুরে কোনওক্রমে একবার বাড়ি ফিরে শিশু মঞ্জিলকে কিছুক্ষণ সামলে আবার বেরিয়ে যায়। এই পত্রিকার কাজে চাপ কম, মাইনেও ছিল কম। রশ্মি সবদিক সামলে নিতে পেরেছিল তাদের বাড়ির মালিকের স্ত্রী সায়নীদির জন্য। বছর চল্লিশেকের নিঃসন্তান এই গৃহবধূ তাদের অনুপস্থিতিতে মঞ্জিলের সব দায়িত্ব হাসিমুখে নিয়ে নিতেন। আজও, মঞ্জিলের জন্য রশ্মির অভাব পূরণের করতে অদিশ অনেকটাই নির্ভর করে তাদের মালিক পত্নীর ওপর। ইস্কুল থেকে যে-সমস্যাটা জানতে পেরেছে সে, তা নিয়েও একমাত্র সায়নীদির সঙ্গেই আলোচনা করার ইচ্ছে আছে তার। সায়নীই তাকে জানিয়েছিল মঞ্জিলের ছবি আঁকা ও গল্প শোনার ঝোঁকের কথা। অদিশের কাছেও “বাবা একটা ভূতের গল্প বল” বা “মজার গল্প বল” মার্কা আবদার প্রায়ই করে মঞ্জিল। অধিকাংশ সময়েই কাজের চাপে বাবার পক্ষে তা রাখা সম্ভব হত না! তাই আজ সে মনস্থির করে ফেলেছে, দুটো গল্পের বই কিনেই বাড়ি ফিরবে।
আবার রশ্মির কথা মনে পড়ে অদিশের। প্রায় কোনও পূর্ব-পরিকল্পনা ছাড়াই তাদের রেজিস্ট্রি বিয়ের পর, নানা সমস্যা সামলে চলছিল তাদের সংসার। মঞ্জিলের আবির্ভাব তাতে নতুন প্রাণের সঞ্চার করে। অদিশের নতুন চাকরি, তাদের নতুন বাড়িতে স্থানান্তরিত হওয়া, শান্তিনিকেতন থেকে কিনে আনা রশ্মির নতুন সাধের ড্রেসিংটেবিল, সায়নীদি’র সঙ্গে আত্মীয়তা; সব মিলিয়ে যেন নতুন ছন্দে বইতে থাকে জীবন। অদিশ টেরই পায়নি কখন রশ্মি আর সায়নীদির ছত্রছায়ায় মঞ্জিলের তিন বছরের জন্মদিন এসে গেছে! মঞ্জিল কথা বলছে, আধো-আধো থেকে বেশ পরিস্কার; “আমার একটা খেলনা ট্রাম চাই”। হাঁটি-হাঁটি, পা-পা শেষে দৌড়তে শুরু করেছে। ‘মণিকে’ পাড়ারই একটা মন্টেসরিতে ভর্তিও করে দিয়েছে রশ্মি ও সায়নীদি। “ওরে, ট্রাম তো প্রায় উঠেই গেল, ওই একটা-দুটোই আছে যা তুই দেখিস। আর কি খেলনা ট্রাম পাব? তোকে বরং একটা ট্রেন কিনে দেব ।” মঞ্জিলকে শান্ত করেন সায়নীদি।
হঠাৎ অতিমারি ধাক্কা মারল জীবনে। দেশজোড়া, শহরজোড়া লকডাউন। বহু মানুষের মৃত্যুসংবাদ আকাশে-বাতাসে ভাসছে। শুধু অদিশ-রশ্মি-সায়নীরাই নয়, সমগ্র সমাজ বিভ্রান্ত, জনজীবন ব্যহত। লকডাউনে অদিশ-রশ্মিকে মাঝেমাঝে বেরোতে হত, লকডাউন শিথিল হওয়ায় রশ্মিকেও প্রায়ই বেরোতে হত রিপোর্টিং-এ। কোনও আগামনী বার্তা ছাড়াই এসেছিল রশ্মি, তেমনই কোনও পূর্বাভাস ছাড়াই অদিশ-মঞ্জিল, তাদের সুখদুঃখের সংসার ছেড়ে চিরবিদায় নিল সে। অসংখ্য মানুষের সঙ্গে তাকেও ছিনিয়ে নিয়ে গেল করোনা-ভাইরাস। মঞ্জিলের চতুর্থ জন্মদিনের একমাস আগে।
“বাবা, এটা কি শুনছ?” মাঝেমাঝেই ব্যাটবল খেলা থামিয়ে জানতে চায় মঞ্জিল। অদিশ কানে হেডফোন গুঁজে একটা গান শোনে প্রায়ই। “ভরা বাদর, মাহ ভাদর, শূন্য মন্দির মোর…” ব্রজবুলি ভাষায় বিদ্যাপতির কথা, রশিদ খানের কন্ঠ আর রবি ঠাকুরের সুর। গানটা তার মধ্যে বাজতেই থাকে। “ঝঞ্জা ঘন গরজন্তি সন্ততি/ ভুবন ভরি বরিখন্তিয়া/ কান্ত পাহুন, বিরহ দারুণ/ সঘনে খরশর হান্তিয়া…”
অদিশ ভয়ঙ্কর ভেঙে পড়েছিল; কয়েকমাস রীতিমতো ডিপ্রেশনে চলে যায়। দু’চোখে অন্ধকার দেখে, এমনকী শিশুপুত্রকেও অবহেলা করতে শুরু করে। তার গুটিকয়েক বন্ধু, কলিগ এবং সায়নীদি পাশে না দাঁড়ালে, কী যে হত সে-সময়ে…
মঞ্জিল কিছুদিনের মধ্যেই ছন্দ ফিরে পায়। শুধু মাঝেমাঝে মায়ের শূন্য ড্রেসিংটেবিল, পড়ে থাকা প্রসাধনী ও বইগুলোর দিকে ফ্যাফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত। অদিশের এক বছরেরও বেশি সময় লাগে সামলে উঠতে। সবথেকে অসহায় লাগত, যখন শিশু মঞ্জিল মায়ের সন্ধান করত।
‘তুমি ওই গানটাই খালি শোন কেন বাবা?’
“কুলিশ শত-শত পাত-মোদিত, ময়ূর নাচত মাতিয়া/ মত্ত দাদুরী, ডাকে ডাহুকী, ফাটি যাওত ছাতিয়া/ তিমির দিঘভরি, ঘোর যামিনী, অথির বিজুরিক পাঁতিয়া/ বিদ্যাপতি কহে, কৈছে গোঙায়বি,/ হরি বিনে দিন রাতিয়া…” অদিশ গুনগুন করে গাইতে-গাইতে বলে, “এই গানটায় মা আছে বাবা, তুই বড় হ, বুঝতে পারবি”। অদিশ এই বৃষ্টিভেজা শহরের রাস্তায় রশ্মিকে যেন মাঝেমধ্যেই দেখতে পায়! ক্লাস ওয়ানের মঞ্জিল ঠিক বুঝতে পারে না, মা কীকরে গানের মধ্যে থাকতে পারে। সে আনমনা হয়ে আবার ব্যাটবলে মন দেয়।
৩
বড় রাস্তার শেষ প্রান্তে একটা বইয়ের দোকান। রশ্মি এখান থেকে ছোট গল্প, কবিতার নানা বই কিনে আনত। বৃষ্টি আসছে বেশ জোরে, অদিশ ব্যাগ থেকে ছাতা বের করে খোলে, তারপর মঞ্জিলকে আর-একটু কাছে টেনে নেয়। “চল, তোকে দুটো দারুণ গল্পের বই কিনে দেব। গল্পগুলো শুনলে, তুই এক দূর দেশে চলে যাবি”, বলে সে বইয়ের দোকানের দিকে পা বাড়ায়। মঞ্জিলও বেশ উৎসাহ পায়।
“‘আম-আঁটির ভেঁপু’ আছে? আর ‘ইশপস্ ফেবল’?” অদিশের কথায় কাউন্টারের ব্যক্তি শোকেসে বই খুঁজতে শুরু করেন। ‘আম-আঁটির-ভেঁপু’ সহজেই বের করে টেবিলে ফেলেন। মঞ্জিল ছোঁ মেরে তার বুক সমান টেবিল থেকে বইটা তুলে নিয়ে বিস্ময়-ভরে প্রচ্ছদের দিকে চেয়ে থাকে। দোকানি দ্বিতীয় বইটি খুঁজছেন একটু দূরের শোকেসে। এইসময়ে একটা ঘটনা ঘটে যায়।
“আরে, রশ্মি”, অদিশ ফুটপাথে দিকে ছুটে যায়। ফুটপাথ দিয়ে একটি যুবতী মেয়ে, পরনে জিন্স ও কুর্তি, একটা গোলাপি ছাতা নিয়ে যাচ্ছিল। একটু পেছনে, তার দুই পুরুষ সঙ্গী নিজেদের মধ্যে কিছু আলোচনারত।
“উফ, আবার সেই লোকটা! পাগল না কি আপনি মশাই বলুন তো? আগেরদিন, categorically I mentioned, যে আমি রশ্মি-টশ্মি নই! হাতটা ছাড়ুন বলছি…” মেয়েটি অদিশের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে, কাতর দৃষ্টিতে নিজের দুই পুরুষসঙ্গীর দিকে তাকায়। “এর কথাই বলছিলাম সেদিন তোমাদের”…মহা বিক্রমে দুই যুবক ঝাঁপিয়ে পড়ে অদিশের ওপর। ধাক্কা মেরে তাকে রাস্তায় ফেলে দেয়। মহিলাকেন্দ্রিক ঝামেলা দেখে সহজেই আশপাশ থেকে কয়েকজন জড়ো হয়ে যায়। “কী হয়েছে দিদি?”, “মেয়ের গায়ে হাত দিয়েছে?” গোছের মন্তব্য শোনা যায়। যুবতীটিও অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে ও হাত তুলে “ঠিক আছে, দাদা এখন” বলে শান্ত করার চেষ্টা করে পরিস্থিতি। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে কিছু লোক ‘মজা’ পেয়ে যায়। এ-ক্ষেত্রেও এক হকার গোছের যুবক কোথা থেকে উদয় হয়ে, মাটিতে পড়ে থাকা অদিশের মুখে সপাটে এক ঘুঁষি মারে। ছোট্ট মঞ্জিল বুঝতে পারে না ঠিক কী হয়েছে; সে বই ফেলে “বাবা, বাবা” বলে অস্ফুটে চিৎকার করে ছুটে আসে রাস্তায়, বৃষ্টির মধ্যে, আক্রান্ত অদিশের কাছে। তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে। “ছেলে হয়ে গেছে তাও কী পুরকি, দেখ!…”, আরও একটা ধাক্কা সজোরে অদিশের বুকে মারে এক যুবক। মঞ্জিলের সাহায্যে অদিশ কোনওক্রমে উঠে দাঁড়ায়। তার ঠোঁটের পাশ দিয়ে চুঁইয়ে পড়ে ক্ষীণ রক্তধারা। মঞ্জিলের চোখ দিয়ে, গাল গড়িয়ে অবিরত পড়তে থাকে জল; সে তার বাবাকে প্রাণপনে জড়িয়ে ধরে থাকে।
ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী