১
আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী আমার বাবা
আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী আমার মা
কারণ জন্মই তো মৃত্যুর কারণ
এই যে এখন মরে যাচ্ছি, ঝমঝম করে বৃষ্টি
পড়ছে
চারদিকে লোডশেডিং
ঘরের ভিতর কুল-কুল করে জল ঢুকে আসছে
কালো রঙের জল…
মরে যাওয়ার জন্য এর চেয়ে ভাল আবহ
আর কি হতে পারে বলো
আমার মায়ের ছবি দেওয়াল থেকে খসে পড়ল এ-সময়ে
জেগে উঠল বাবার ছ-ফুটের বিশাল কাঠামো,
আমায় ঠেলা মেরে বাবা বলল, যা…
তাড়াতাড়ি যা… চলে যাওয়ার আগে মায়ের
কাছে গিয়ে একবার ক্ষমা চেয়ে নে।
২
বেলা আর বয়ে চলে যাবে না, সে এইবার থামবে—
একটা হার্ট অ্যাটাক, কিংবা ছোট্ট একটা অ্যাক্সিডেন্টে
সব তো শেষ হয়ে যেতে পারে, ভাবতাম
সাধারণ কামনায় আমিও প্রার্থনা করতাম, বার বার, বেশি ভুগিয়ো না, আমায়, হে…
আমার মা হুট করে মরে গিয়েছিল আট বছর আগে
অথচ মা কোনওদিন বিশ্বাস করেনি যে মরে যাবে
বাবা তো আরওই নয়
তার গলায় ক্যানসার ধরা পড়ার পরও নয়
মৃত্যু আসবে না তার কাছে, এমনই ভাবত সে
বাবার চোখদুটো খুব মনে পড়ছে
বেঁচে থাকার উদ্দীপনা, ঘনঘোর
মায়ের চোখে তবুও একটা ছায়া থাকত,
মা ছিল ম্যাচিওরড, বাবা তো শিশুই, তাই
মনে করত, কত কিছুই হতে পারে, ঘটে যেতে পারে যাহা-তাহা,
কেউ আবার মরে নাকি আহা…
মৃত্যুর রাতে বাবার সামনে যাইনি কিছুতেই, জানতাম আর
কিছু করা যাবে না, শেষ রক্ষার সময় শেষ হয়ে গেছে…
ওগো শোনো, শুনতে পাচ্ছ কি, আর্টিফিশিয়াল ইন্টালিজেন্স তোমায়
বলছি,
এবার তোমরা কবিতা লেখো, অনেক-অনেক লেখো, আমায় মা-বাবার কাছে
চলে যেতে হবে…
৩
কেউ রেপ করছে, কেউ খুনখারাপি,
অনেকেই চুরি করছে, কেউ শুধুই বিরক্ত করে যাচ্ছে
কেউ যুদ্ধ করছে, ‘জয় বাংলা’য় চিৎকার করছে, বাংলা খাচ্ছে,
‘বাঘ’ দেখাচ্ছে, কেউ শ্রীরাম-শ্রীরাম করতে করতে
রাম খাচ্ছে,
আবার কেউ এক ছুট্টে গিয়ে কারওর বিচি
ফাটিয়ে দিচ্ছে এক লাথি মেরে
কেউ লাল পতাকা ওড়াচ্ছে, পতাকার নীচে দাঁড়িয়ে অনেকেই বলছে
এত পতাকা কেন, কত মানুষই তো ন্যাংটো… পতাকা
দিয়ে পোশাক বানাও না…
‘ফ্রকটা নেবে? জামা দুটো?’ বলতে-বলতে কেউ-কেউ
পতাকা চিবুচ্ছে… গরু নাকি
আর আমি?
এব্বাবা, আমি… সুইসাইড করছি! উফ…
৪
শোনো, জীবনে কিছুই করতে পারিনি আমি। আর পারবও না।
অনেক কিছু চেষ্টা করেছি যদিও। কিন্তু প্রতিটা চেষ্টাই দুঃসহভাবে
ব্যর্থ হয়েছে। ভেবেছিলাম লেখালিখি করে বেশ কেউকেটা হব, কিন্তু লেখার জগৎ
আমাকে রিক্ত করেছে, সব রক্ত ঘাম হয়ে গেছে, ভেবেছিলাম সংবাদমাধ্যমে
নিজেকে উজাড় করে দেব।
দেখলাম বহু বছর কাজ করবার পর, আমিই উজাড়—।
সব সময়ে
একটা ঝাঁকুনি বোধ করি, ডাক্তার দেখিয়েছি, বড়-বড় মনোবিজ্ঞানী,
লাভ হয়নি। ভেবেছিলাম ব্যবসাপাতি করে আর্থিক সমৃদ্ধি, বা নিদেনপক্ষে
নিরাপত্তা…
হয়নি, কিছুই হয়নি। তাই আমি মৃত্যুর কথা ভেবেছি। মরে গেলেও আমি আর
বেঁচে থাকব না।
৫
আমার জীবন কি রিলস হয়ে যাবে
আগে তো আমার জীবন ছিল রিলকে?
এতটা পথ পেরিয়ে আসতে সময় লাগল কত
জানি না তো।
আমি যে অন্ত্যমিলের খোঁজ করেছিলাম দিল দিয়ে
ভালবেসেছিলাম, সেক্স করে করে হাঁপিয়ে গিয়েছিলাম
এখন মেনোপজ হয়ে গেছে
তোমরা আমার স্মরণে রিলকে পড়বে—
আমার হৃদয়কে ডাকবে ইশারায়, বোলও
প্লিজ তোমাদের ধুলো-ভেজা পিয়ানো বাজিয়ে বোলও, ওহ্ লাভ…
ওহ্ লাভ… ওহ্…
৬
দূরে ওই পুকুরের উপর পড়ে আছে মৃত্যুর ছায়া
তাকে ঘিরে রয়েছে অনেকগুলি গাছ ও পাথর…
তাকে ঘিরে রয়েছে দুটো কি তিনটে খয়েরি বাড়ি
বাড়ির পিছনে ধানের জমিতে ধান নেই
ফসলের গোড়াগুলি জন্তুর দাঁত হয়ে জেগে আছে
ওইখানে ক্যারাম বোর্ড পেতে
খেলছে মেয়েরা, ছেলেরা…
ক্যারমের শব্দে পুকুরের ছায়া কেঁপে যাচ্ছে
মনে হচ্ছে যেন একটু হেসে উঠছে সে
ছায়াটা মৃত্যুর— এ ঘোর উপমা… আসলে কে না জানে মৃত্যুর কোনও
ছায়া নেই, কারণ তার কোনও দেহ নেই—
আজ আমার বাবা মারা গেছে
তার দেহ এই তো… ছ-ফুটের দেহ
এক কেজি-র কিছু বেশি ওজনের ব্রেন, একটা রুই মাছের ওজনমাত্র,
খেলছে ওই জলে
স্থলে, ঘোড়া হয়ে ছুটছে মাঠে— তামাটে অন্তরিক্ষে,
তার নির্ভেজাল ছুট, বড্ড হাঁপ ধরে গেছে—
৭
সক্কলেই মরে যাবে যখন আগে আর পরে,
তখন কারও আর আয়ু প্রত্যাশা করি না।
একমাত্র আমার মেয়ে ছাড়া
এ-ব্যাপারে আমি স্বার্থপর হয়ে থাকি
আমি চাই আমার মেয়ে যেন কোনওদিন দেহহীন না হয়ে যায়
মৃত্যু শব্দটা ওর ক্ষেত্রে ব্যবহার করাটাও তো পাপ
মেয়ে যেন বেশি বড়ও না হয় এমনকী এও আমার আকাঙ্ক্ষা
বোকা-বোকা… যেমন এখন আছে, থাক না তেমন
থাক না…
চারপাশের সব গাছ, সমস্ত পাথর, নলকূপ, ভাইরাল ভিডিয়ো,
পোকা আর টোকা… বড় হতে-হতে মরে যাক না
এমনকী আমি…
কিন্তু থাক না আমার মেয়ে এই পৃথিবীতে চিরদিন বেঁচে…
ওহ্, ওই তো একটা পাখি এ-সময়ে এসে
বসে পড়ল এই লেখার উপরে
তার পর উড়ে গেল…
একটা ছোট ডাক, সরল শিহরন তার রেখে গেল
এই তো হ্যান্ডমেড কাগজের উপর এক পাশে
তা রাখা…
এর নামই কি মৃত্যু?
কী?
৮
আমি সত্যি কথাই আর বাঁচতে চাই না
অনেক তো হল এ-জীবনে আর কী হবে বলো বেঁচে থেকে
সামান্য টাকাপয়সা কমানো তো হল,
হল যৌনতা, সংসারে স্বজন হারানোও…
তা হলে কীভাবে মরে যাব আমি
রেললাইনে কি গলা দেব, না কি বিষ খেয়ে…
না কি গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ব বল…
ইউটিউবে লাইভ করতে-করতেও হতে পারে আমার আত্মহত্যা
নতুন স্টাইল হয়েছে এটা, অনেকেই বেছে নিচ্ছে এমন
দুরন্ত পথ… নিজেকে শেষ করে দেওয়া, কিন্তু প্রবল পপুলার হয়ে…
এই যে পাশে এক বিশাল বাড়ি উঠছে,
সেই নির্মীয়মাণ বাড়ির সাত কি আট তলা থেকে
ঝাঁপ কেটেও তো মরে যাওয়া যায়
যায় না কি…
হা… হা… হা… আহ্… শোনো… তোমাদের সঙ্গে একটু জোক করছি গো,
এপ্রিলের ৭ তারিখ সন্ধ্যা সাতটায় ওই নির্মীয়মাণ বাড়ির সাত তলা থেকে
ঝাঁপ কেটেই আমার মৃত্যু হয়েছে
হাসপাতালে নিয়ে যাওযার সুযোগও দিইনি পড়শিদের, একবার স্পট ডেড,
আর একটা কথা,
মৃত্যুর পরেও কবিতা, গল্প, উপন্যাস… লেখা যায়
কিংবা গ্রাফিক্স, সিনেমা, নাটক… করা যায়…
তাই তোমরা যারা ক্রিয়েটিভ, তারা চিন্তা কোরো না,
মৃত্যুর গান গাইতে দ্বিধা কোরো না এতটুকুও?
৯
‘ম্যাঙ্গো’ মানে এত দিন ছিল আম
এখন শব্দটা পুরো বাংলা,
ধর্ষক, যে-শব্দ বুকের ভিতরটা কাঁপায়…
‘ম্যাঙ্গো’-রা বড়ই জঙ্ঘম, তারা সিঙ্ঘমের থেকে
গায়ের হলুদ পেয়েছে
কেশর পেয়েছে
তারা সন্ধেবেলা মুখে একটা বিশাল হাসি ঝুলিয়ে
হাতির পিঠে চড়ে বেরিয়ে পড়ে…
তাদের হাতে রয়েছে সহজ-সরল, সাত চড়ে রা না-কাড়া সুতোর গোছ দিয়ে
তৈরি নানা বর্ণ কাপড়
ধর্ষণের পর তারা সেইটা বিছিয়ে দেয় নাছোড় মরদেহে
ওদিকে তখন মন্দিরে-মসজিদে
গির্জায়… শয্যায় ও শিয়রে
দেবদ্বিজেরা গা টেপাটেপি করে
তারা ফোন করে একে অপরকে, ওয়্যাটসঅ্যাপ কেঁপে ওঠে
ফেসবুক দুলে ওঠে
তার পর, দরোজা বন্ধ করে, মোবাইল অফ করে,
ল্যাপটপকে নৌকো বানিয়ে ড্রেনের জলপথে
চালিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে পাড়া, গ্রাম
ও জঙ্গল…
১০
বন্যার মধ্যে আমার মৃতদেহ ভাসিয়ে দিয়ো তোমরা
আর ফুঁ দিয়ো কিংবা হারিয়ে যাওয়া পাখনা দিয়ে
দিয়ো বাতাসের মতো কিছু…
আমাকে তো এগিয়ে যেতে হবে,
এই জল, বাড়িতে জল, রাস্তায়— রিক্সার চাকাগুলো
জলে ডুবে গেছে
তবুও আমার দেহ তো ভেসে থাকবেই,
কারণ তাতে প্রাণের ওজন
নেই।
কিন্তু এই লোকালিটি, সেমি সাগরের, জীবনের সুরুয়া
তার ভিতরে ভাসমান দেহ, বেমানান,
তুমি, সেই ছোটবেলার সাইকেল থেকে নেমে,
ওড়নাটা স্তনের স্রোতে উপর দিয়ে হাত রাখলে
এই তো আমার বুকে—
আমাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে এসেছ, দেখছি একাই, তুমি বড় একা—
আর আমি বুঝতে পারছি, জীবনে যা পাইনি–
মৃত্যুর পর তো পেলাম, আহা তোমাকে…



