বিজয় রথ

Representative Image

বাঁ-পায়ের বুলেট শটে দক্ষিণ কোরিয়ার জাল কাঁপিয়ে দিয়ে ছুটে আসছেন এক শিখ যুবক, আর তাঁকে ঘিরে উচ্ছ্বাস বাকি দশজন ভারতীয়র। যুবকটির কপালে ব‍্যান্ডেজ, কিন্তু মাথায় পাগড়ি নেই। এক লাখ দর্শক ভর্তি গ‍্যালারিতে তখন যাকে বলে পিন-ড্রপ সাইলেন্স। তবু এক কোণ থাকে ভারতের গোলের পর চিৎকার ভেসে এল। একদল যুবক সেখানে ভারতের হয়ে গলা ফাটাচ্ছেন, তাদের হাতে অবশ্য পাকিস্তানের পতাকা!

১৯৬২-র ৪ সেপ্টেম্বর। জাকার্তা এশিয়ান গেমসের ফুটবল ফাইনালে দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে সংগ্রামে নেমেছে চুনী গোস্বামীর নেতৃত্বাধীন ভারতীয় দল। কুড়ি মিনিটের মধ‍্যেই দু’গোলের লিড নিয়ে ফেলেছে ভারত। দ্বিতীয় গোলের নায়ক ওই শিখ যুবকটির নাম জার্নেল সিং। স্টপার জার্নেল গ্রুপ লিগের থাইল‍্যান্ড ম‍্যাচে গুরুতর আহত হওয়ার পর, তাঁকে উইথড্রয়াল সেন্টার-ফরোয়ার্ড হিসেবে খেলাচ্ছেন কোচ রহিম সাহেব। এই ভূমিকায় সেমিফাইনালেও দক্ষিণ ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে গোল করেছিলেন তিনি। ফাইনালে জার্নেলের গোলের  তিন মিনিট আগেই প্রথম গোলটি করেছেন রাইট উইঙ্গার প্রদীপ ব‍্যানার্জি। পিকে নামেই যিনি ভারতের ফুটবলে বিখ্যাত। এই দক্ষিণ কোরিয়ার কাছেই প্রতিযোগিতার প্রথম ম‍্যাচে দু’গোলে হেরে গিয়েছিল ভারত। এই দক্ষিণ কোরিয়াই ভারতের কাছে অনতিক্রম‍্য হার্ডল; চার বছর আগে টোকিও এশিয়াডের সেমিফাইনালে এই দক্ষিণ কোরিয়ার কাছেই বড় ব‍্যবধানে হারতে হয়েছিল পিকে-বলরামদের! পরপর দু’বার এএফসি-এশিয়া কাপ চ‍্যাম্পিয়ন ওই কোরিয় দলকে হারানোর স্বাদ ওই ফাইনালের আগে পর্যন্ত একবারও পায়নি রহিম সাহেবের টিম। চাপ আরও বেড়ে যায় তার আগের দিনই ভারত হকি ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে ০-২ গোলে হেরে বসায়; সেইসঙ্গে বড় চোট পেয়েছিলেন হকি-অধিনায়ক চরঞ্জিত সিং! এহেন আবহে, দর্শনীয় সেনায়ান-মেইন স্টেডিয়ামে সেদিন ফাইনালের শুরু থেকেই ঝড় তুলতে দেখা গেল পিকে-চুনী-বলরামদের। এবং এই চূড়ান্ত পরীক্ষার দিন তাঁরা পাশে পেলেন আগেরদিনের ওই সোনাজয়ী পাক হকি তারকাদেরই! ভারতের গোলের পর গ‍্যালারিতে উপস্থিত গুটিকয়েক ভারতীয়কে বাদ দিলে একমাত্র উল্লাস করতে দেখা গিয়েছিল ওই পাক হকি দলের সদস‍্যদেরই! প্রথমার্ধেই ম‍্যাচ প্রায় পকেটে পুরে ফেলল ভারত। 

আরও পড়ুন: ফুটবল মাঠের প্রতিরোধ নতুন ইতিহাস তৈরি করে! লিখছেন রোদ্দুর মিত্র…

কিন্তু শুধু কোরিয়ানদের মাঠের রেকর্ডই নয়, মাঠের বাইরে এক জটিল ও প্রতিকূল পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় এই ফাইনাল ম‍্যাচটা বিশেষ চ‍্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছিল রহিম সাহেবের দলের কাছে। যার মূল কারণ ছিল আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্কের জটিলতায় নিহিত। স্থানীয় ইন্দোনেশীয়দের মধ‍্যে তখন ভারত-বিদ্বেষী মানসিকতা তুঙ্গে। পরিস্থিতি এমনই হয়েছিল যে, দলের লাক্সারি টিম বাস থেকেও ভারতীয় দলের প্রতীক চিহ্ন মুছে ফেলতে হয়েছিল। শিখ ফুটবলার জার্নেল সিংকে মাথার পাগড়ি খুলে ফেলতে হয়েছিল, কখনও বা টিম বাসের মাটিতে বসে যাত্রা করতে হত, ভারতীয় পরিচয় লুকিয়ে রাখার জন‍্য। অন‍্যান‍্য ভারতীয় অ্যাথলিটদেরও একইভাবে পরিচয় গোপন করে গেমস ভিলেজে চলাফেরা করতে হয়েছিল। যদিও ভারতীয়রা বিভিন্ন খেলায় পদক জিতেই চলেছিল।

কেন ও কীভাবে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল? আয়োজক দেশ ইন্দোনেশিয়ার সরকার সেবার ইজরায়েল ও তাইওয়ানের প্রতিযোগীদের ভিসা দেয় নি। সংশ্লিষ্ট দু’টি দেশই আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির(আইওসি-র) কাছে সরাসরি অভিযোগ জানায়। আইওসি ও এশিয়ান গেমস ফেডারেশনের নিয়ম অনুসারে অলিম্পিক সংস্থার সদস‍্য দেশের প্রতিযোগীদের গেমসে অংশগ্রহণের জন‍্য ভিসা দেওয়া বাধ‍্যতামূলক; এবং তাইওয়ান ও ইজরায়েল দুটি দেশই আইওসি ও এশিয়ান গেমস ফেডারেশনের সদস‍্য। মূলত চিন ও আরব দেশগুলোর চাপে ইন্দোনেশিয়া সরকার এই দুই দেশের অ্যাথলিটদের ভিসা দেয় নি। তাইওয়ান ও ইজরায়েলের অভিযোগ খতিয়ে দেখে নিয়ম ভাঙার জন‍্য ওয়েটলিফ্টিং, অ্যাথলেটিক্স সহ কিছু আন্তর্জাতিক ক্রীড়া সংস্থা এই জাকার্তা এশিয়াডকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে। অর্থাৎ, সংশ্লিষ্ট খেলাগুলোর ইভেন্টে এই গেমসের কোনও রেকর্ডকেই মান‍্যতা দেওয়া হবে না। আইওসি ও সমর্থন তুলে নিতে চায় গেমসের ওপর থেকে। এই পরিস্থিতিতে এশিয়ান গেমস ফেডারেশনের সহ সভাপতি ও আইওসি-র সদস্য গুরু দত্ত সোধিঁ গেমসকে বাঁচানোর জন‍্য প্রস্তাব করেছিলেন যে, এই গেমসকে চতুর্থ এশিয়ান গেমস না বলে, স্রেফ জাকার্তা গেমস হিসেবে ধার্য করা হোক। সোধিঁর এই প্রস্তাব গেমস ফেডারেশনে পাশ হয়ে গেলেও, আগুনে ঘি পড়ল ইন্দোনেশীয়দের মধ‍্যে; স্থানীয় সংবাদপত্রগুলোর সোধিঁ-বিরোধী রিপোর্ট এই উত্তাপ আরও বাড়িয়ে দেয়। ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের অফিস আক্রান্ত হয়, সোধিঁও ইন্দোনেশিয়া ছেড়ে পালাতে বাধ‍্য হন। বিভিন্ন খেলার ইভেন্টে ভারতীয় প্রতিযোগীরা ও দলগুলো স্থানীয়দের নিয়মিত টিকা-টিপ্পনী ও বিদ্রুপের মুখে পড়ে। যদিও ভারতীয় প্রতিযোগীরা ব‍্যক্তিগত ও দলগত বিভাগ মিলিয়ে এরই মধ‍্যে এগারোটি সোনা ও তেরোটি রুপো জিতেছিলেন। যারমধ‍্যে শেষটি আসে অন্তিম দিনে ফুটবল ফাইনাল জেতার মাধ‍্যমে। (এছাড়াও ভারতের ঝোলায় এসেছিল দশটি ব্রোঞ্জ পদক) তাই দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে ফাইনাল খেলার আগে চুনী গোস্বামী-পিকেরা জানতেন, শুধু প্রবল প্রতিপক্ষ কোরিয়া নয়, স্থানীয় এক লাখ দর্শকের বিদ্রুপের সঙ্গেও তাঁদের লড়াই করতে হবে, সোনা জয়ের লক্ষ্যে! সেরকম মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই মাঠে নেমেছিলেন জার্নেল-ফ্রাঙ্কোরা; অধিনায়ক চুনীর সঙ্গে পরামর্শ করে রহিম সাহেব ম‍্যাচের কৌশলও ঠিক করেছিলেন সেই অনুযায়ী।

 ২

আরও একটা চ‍্যালেঞ্জ নিয়ে সেবার জাকার্তা গিয়েছিল রহিম সাহেবের দল। দেশের বিদেশি মুদ্রা ভান্ডারের অবস্থা শোচনীয় হওয়ায় চতুর্থ এশিয়াডে ফুটবল দল পাঠাতেই চাননি তদানীন্তন অর্থমন্ত্রী মোরারজি দেশাই। তার আগের দুটো এশিয়ান-গেমসে ফুটবল টিম খালি হাতে ফেরত আসায় অর্থমন্ত্রীর ধারণা হয় ফুটবলে পদক আসার কোনও সম্ভাবনাই নেই। ভারতের ফুটবলে তখন থ্রি-মাস্কেটিয়ার্স–অর্থাৎ চুনী-পি কে-বলরামদের যুগ চলছে। তাঁদের স্বপক্ষে যুক্তি ছিল, ১৯৬০’রোম অলিম্পিকের দুরন্ত পারফরমেন্সের আতস কাঁচে ফেলে দেখল, এটাই সোনা জয়ের সুবর্ণ সুযোগ। বহু বিশেষজ্ঞই মনে করতেন ভারতীয় দল সর্বকালের সেরা ফুটবল খেলেছিল রোমে! এই অচলাবস্থা কাটাতে এগিয়ে আসেন পোড়খাওয়া রাজনীনিবিদ অতুল‍্য ঘোষ, যিনি তখন আইএফএ সভাপতিও ছিলেন। অতুল‍্যবাবু সরাসরি প্রধানমন্ত্রী নেহরুর কাছে গিয়ে দরবার করে তাঁর সম্মতি আদায় করেন, ও প্রধানমন্ত্রীর মাধ‍্যমেই মোরারজি দেশাইকে রাজি করান এই বলে যে, জাকার্তা যাওয়ার জন‍্য রহিম সাহেবের টিম পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে, এই পরিস্থিতিতে টিম না পাঠালে সমগ্র এশিয়ার চোখে ভারত হেও হয়ে যাবে। অবশেষে সবুজ সংকেত মেলায় পূর্ণশক্তির দল নিয়ে ১৫ অগাস্ট স্বাধীনতা দিবসের দিন জাকার্তা উড়ে গেলেন রহিম সাহেব। কোচ রহিম সাহেব সহ চুনী-বলরাম থেকে নবাগত প্রদ‍্যোত বর্মণ-প্রশান্ত সিনহা-ত্রিলোক সিংদের কাছে এই ফাইনালটা জেতা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রোম অলিম্পিকের দল নির্বাচনে তাঁর ও বেচু দত্তরায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে তারা রহিম-পুত্র হাকিম সহ দুজন ‘অযোগ্য’ ফুটবলারকে টিমে রেখেছিলেন। এজন্য রহিম সাহেবের খুব বদনামও হয়েছিল। অনেক বিশেষজ্ঞই এই দল নির্বাচনে স্তম্ভিত হয়েছিলেন, ও মনে করতেন সেই সময়ের দেশের সেরা গোলকিপার সনৎ শেঠ, টপ ফর্মের ইনম‍্যান রহমতুল্লাহ ও হাফব‍্যাক মলয় লাহিড়ীকে দেশে ফেলে রেখে না গেলে ইন্ডিয়া টিম রোমে আরও বড় সাফল‍্য পেতে পারত! 

যাইহোক, সব বিতর্কে জল ঢেলে, গ্রুপের শেষ ম‍্যাচে শক্তিশালী জাপানকে ২-০ তে আর সেমিফাইনালে দক্ষিণ ভিয়েতনামকে ৩-২ এ হারিয়ে জাকার্তায় ফাইনালে চলে যায় রহিম সাহেবের টিম।

চুনী-পিকে-বলরাম

ফাইনালে দলের কম্বিনেশন ঠিক করা নিয়েও সৃষ্টি হল এক জটিল পরিস্থিতি। ভারতের মূল শক্তি ছিল থ্রি-মাস্কেটিয়ার্স সমন্বিত ফরোয়ার্ড লাইন; আর কোচ রহিমের বাড়তি সম্পদ রিজার্ভ বেঞ্চে প্রশান্ত সিনহা-প্রদ‍্যোত বর্মণ-অরুময় নৈগমদের মতো একঝাঁক তরুণ তুর্কির উপস্থিতি।

ভারতীয় কোচের প্রিয় গোলকিপার ছিলেন ছ’ফুট চার-ইঞ্চি উচ্চতার থঙ্গরাজ; রহিম সাহেব আদর করে যাকে ‘রাজা’ বলে ডাকতেন। যেমন পিকে-কে তিনি ডাকতেন ‘ওস্তাদ’ বলে, আর চুনীকে বলতেন ‘প্রিন্স’! তাঁর হাত ধরেই এদেশের ফুটবল পেয়েছিল আধুনিকতার স্পর্শ। আগের ট্রেনারদের দীর্ঘ ক্লান্তিকর শারীরিক সক্ষমতার অনুশীলন পদ্ধতি থেকে বের করে এনে রোম অলিম্পিকের আগে থেকেই ফেরেঙ্ক পুসকাসের হাঙ্গেরির সিস্টেমে দলকে অনুশীলন করাতে শুরু করেছিলেন ভারতের হায়দ্রাবাদী কোচ। টিমকে রপ্ত করিয়েছিলেন তিন ব‍্যাক সিস্টেম, চালু করেছিলেন উইথড্রয়াল সেন্টার ফরোয়ার্ড রাখা। ৫৪’র বিশ্বকাপে পুসকাস-ককসিস-হিদেকুটির হাঙ্গেরি ফুটবল মুগ্ধ করেছিল সমগ্র বিশ্বকে; তাদের স্টাইলে প্রভাবিত হয়েছিলেন রহিম সাহেবও। কিন্তু রোম অলিম্পিকে পেরু ম‍্যাচ সহ বহু আন্তর্জাতিক ম‍্যাচে ভারতের হারের পেছনে অনেকেই দেখেছিলেন কোচ রহিমের প্রিয় ‘রাজার’ হাত। জাকার্তায় গিয়ে ফ্লুতে আক্রান্ত হওয়ায় থঙ্গরাজ কোনও ম‍্যাচই খেলতে পারলেন না।  পরিবর্ত প্রদ‍্যোত বর্মণ বারের নীচে দুর্ভেদ‍্য হয়ে উঠলেন। চুনী থেকে পিকে, সবাই মনে করতেন, জাপান ম‍্যাচে বর্মণ অনবদ‍্য পারফরমেন্স না করলে ভারত ফাইনাল অবধি উঠে আসতে পারত না। কিন্তু ফাইনালের আগে থঙ্গরাজ ফিট হয়ে উঠলেন। 

ডানদিকে জার্নেল সিং

আরও একটা সমস্যা ছিল জার্নেল সিং-এর চোট! থাইল্যান্ড ম‍্যাচে তাঁর কপাল ফেটে যাওয়ার পর অরুণ ঘোষকে রাইটব‍্যাক থেকে স্টপারে নিয়ে আসেন রহিম সাহেব। গ্রুপে পরপর তিনদিন খেলতে হওয়ায় কেউ চোট পেলে সারিয়ে তোলার সময় ছিল না! কিন্তু সেমিফাইনালে জার্নেলকে উইথড্রয়াল সেন্টার ফরোয়ার্ডের ভূমিকায় মাঠে নামিয়ে দেয় ভারতের থিঙ্কট‍্যাঙ্ক। কপালে দশটি স্টিচ সহ ব‍্যান্ডেজ নিয়ে দক্ষিণ ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে জার্নেলের করা গোলই ২-২ করে ম‍্যাচে ফিরিয়েছিলেন ভারতকে; পরে চুনী গোস্বামীর অনবদ‍্য লব দেশকে জয়সূচক গোলটি এনে দিয়েছিল। এইরকম গুরুত্বপূর্ণ ম‍্যাচে জার্নেল সিং-এর মতো দলের এক স্তম্ভকে বাদ দিয়ে টিম নামানো ঠিক হবে না বলে মনে করল ভারতের টিম-ম‍্যানেজমেন্ট। জার্নেলের স্টেপিং ভাল, দু’পায়ে সমান শুটিং দক্ষতা; তাই ফাইনালেও তাঁকে একই অনভ্যস্ত ভূমিকায় রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। জার্নেল ছাড়াও জাপান ম‍্যাচে চোট পেয়ে ছিটকে গিয়েছিলেন মাঝমাঠের প্রাণভোমরা রামবাহাদুর। তবে দুরন্ত খেলে সেমিফাইনালে সেই শূন‍্যস্থানও পূরণ করে দিয়েছিলেন আরেক তরুণ বঙ্গসন্তান— প্রশান্ত সিনহা। 

রহিম সাহেব

রোম অলিম্পিকে হাঙ্গেরির তারকা সেন্টার-ফরোয়ার্ড ফ্লোরিয়ান অ্যালবার্টকে রুখে দেওয়ার পর ডিফেন্ডার জার্নেলের ফুটবল-শৈলী নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছিল ইউরোপের সংবাদমাধ্যমে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য, এই অ্যালবার্টই পরে ৬২’র বিশ্বকাপে যুগ্মভাবে সর্বোচ্চ গোলদাতা হন ও ৬৭’তে ইউরোপের সেরা ফুটবলার সম্মানে ভূষিত হন। সেইথেকেই জার্নেল হয়ে গিয়েছিলেন রহিম সাহেবের টিমের অপরিহার্য এক স্তম্ভ!

ভারতের মূল শক্তি ছিল থ্রি-মাস্কেটিয়ার্স সমন্বিত ফরোয়ার্ড লাইন; আর কোচ রহিমের বাড়তি সম্পদ রিজার্ভ বেঞ্চে প্রশান্ত সিনহা-প্রদ‍্যোত বর্মণ-অরুময় নৈগমদের মতো একঝাঁক তরুণ তুর্কির উপস্থিতি।

পায়ের একটি নখ উড়ে যাওয়া সত্ত্বেও খেললেন তরুণ লেফট ব‍্যাক ত্রিলোক সিং। কিন্তু গোলে দুরন্ত ফর্মে থাকা বর্মণকে বসিয়ে সেই থঙ্গরাজকেই নামিয়ে দিলেন ভারতীয় কোচ। রহিম সাহেবের এই সিদ্ধান্তের পেছনে কাজ করেছিল ইন্দোনেশিয়ায় ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের অনুরোধ। যিনি বলেছিলেন ওদেশের ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের মধ‍্যে থঙ্গরাজের বিশেষ জনপ্রিয়তা রয়েছে, তাই তাঁকে খেলালে ভারত কিছুটা সমর্থন পেতে পারে। ফাইনালের চূড়ান্ত একাদশ ছিল এইরকম–গোল-থঙ্গরাজ, ডিফেন্স-চন্দ্রশেখর, অরুণ ঘোষ ও ত্রিলোক সিং; হাফ- প্রশান্ত সিনহা ও ফ্রাঙ্কো; ফরোয়ার্ড- পিকে, ইউসুফ খান, জার্নেল, চুনী ও বলরাম। কিন্তু টিম-ইন্ডিয়ার কোচের এই সিদ্ধান্ত পুরোপুরি ঠিক ছিল এ কথা বলা যায় না। দক্ষিণ কোরিয়া ম‍্যাচের শেষ মিনিট অবধি মরণপণ লড়াই চালিয়ে যায়, ও থঙ্গরাজের ভুলেই শেষবাঁশি বাজার পাঁচ মিনিট আগে একটি গোল শোধ করে ভারতের স্নায়ুর চাপ বাড়িয়ে দেয়! তার বহু আগেই মাথার ব‍্যান্ডেজ খুলে পড়েছে, কপালের ক্ষতস্থান দিয়ে চুঁইয়ে পড়ছে রক্ত, তবু লড়ে গেলেন জার্নেল। লড়ে গেলেন অরুণ ঘোষ-চন্দ্রশেখর-ত্রিলোক সিং-ফ্রাঙ্কো সহ পুরো টিম ইন্ডিয়াও! 

অবশেষে রেফারির শেষ বাঁশি বেজে উঠল। আর তারপর যা ঘটল তা বর্তমান প্রজন্মের কাছে এক সারিয়েল দৃশ‍্য মনে হতে পারে! 

 নিস্তব্ধ হয়ে যাওয়া স্টেডিয়ামে পুরো ভারতীয় দল সেদিন ‘গোল্ড মেডেল অউর জাকার্তা’ গানের তালে-তালে উচ্ছ্বাসে মেতে উঠল! জাকার্তা গেমসে ভারতের হয়ে প্রথম স্বর্ণ পদকটি জিতে এই স্লোগানটি রচনা করেছিলেন কুস্তিগীর মালোয়া। চুনী গোস্বামীর দল সেটিকে নিজেদের উদ্বুদ্ধ করার জন‍্য থিম সং বানিয়ে ফেলেছিল। সেন্টারব‍্যাক অরুণ ঘোষ স্মৃতিচারণা করে বলেছেন যে, একজন স্থানীয়ও সাহস করে সেদিন ভারতীয় দলকে শুভেচ্ছা জানাতে এগিয়ে আসেননি! তাঁদের সঙ্গে গলা মিলিয়েছিলেন স্টেডিয়ামে উপস্থিত হাতে গোনা আর কিছু ভারতীয়। আর বলরাম-অরুণ ঘোষ-চন্দ্রশেখরদের প্রবল হাততালি দিয়ে বাহবা জানালেন পাক হকি দলের তারকারা! ভারতীয় ফুটবলের এই ঐতিহাসিক দিনে তাঁরা কেন সমর্থন করেছিল? কারণ সোধিঁর ওই প্রস্তাবের পর শুধু ভারতীয় নয়, সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের অ্যাথলিটরাই ওই স্থানীয়দের রোষাণলের মুখে পড়েছিলেন। বিশেষ করে পাঞ্জাবের প্রতিযোগী ও ক্রীড়াবিদরা। ভারত-পাক কেউই বাদ যাননি! তাই ফুটবল ফাইনালে ভারতের প্রতি পাকিস্তানীদের এই সহমর্মিতা। দেশভাগের পর থেকেই টেস্ট ক্রিকেট ও হকির জন‍্য ক্রীড়াঙ্গনে ভারত-পাক রেষারেষি অন‍্য পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে বহু সময়; সেখানে জাকার্তার এই ফুটবল ফাইনালে চুনী-পিকে-জার্নেলদের সোনা জয়ের পর পাক তারকাদের এই উচ্ছ্বাস নিঃসন্দেহে এক ব‍্যতিক্রমী দৃশ্য হিসেবে ইতিহাসে রয়ে যাবে। 

সোনা জয়ের পর ভারতীয় ফুটবলারদের উচ্ছ্বাস

দ্বিতীয় ও শেষবারের জন‍্য ফুটবলে এশিয়া জয় করেছিল ভারত। জয়ের পর আবেগপ্রবণ হয়ে পড়তে দেখা গিয়েছিল ইস্পাত-কঠিন রহিম সাহেবকেও; ফাইনালের আগে যিনি ফুটবলারদের বলেছিলেন ‘আজ দেশকে ও আমাকে তোমরা একটা তোফা দাও’! সোনাজয়ের পর তাঁর পক্ষ থেকে একমাত্র তোফা— একটি রিস্টওয়াচ গেল দ্বিতীয় গোলকিপার প্রদ‍্যোত বর্মণের ঠিকানায়; সঙ্গে ছোট্ট বার্তা— ‘ব্লেস ইউ মাই সান’। ফাইনালে বর্মণের প্রতি চরম অবিচারের সাক্ষ‍্যই বহন করে চলেছে না কি এই হাতঘড়িটি?

জাকার্তাই প্রবাদপ্রতিম কোচের শেষ বড় টুর্নামেন্ট। পরের বছরই ক‍্যান্সারে আক্রান্ত হলেন তিনি, ও কিছুদিনের মধ‍্যেই প্রয়াত হন। পিকে-র চোট ও বলরামের অসুস্থতার জন‍্য ভেঙে গেল ‘থ্রি-মাস্কেটিয়ার্স’ সমন্বয়ও! আর তারপর থেকেই ধীরে-ধীরে অস্তমিত হতে থাকে ভারতীয় ফুটবল। রহিম সাহেবের কোচিংয়ে এই দলটিই ছিল পারফরমেন্সের বিচারে সর্বকালের সেরা ভারতীয় দল। এরপর আর কোনওদিন অলিম্পিকের মূল পর্বে পৌঁছতে পারেনি ভারত; চুনী গোস্বামীর নেতৃত্বে ’৬৪-তে ইজরায়েলে চার-দেশীয় এশিয়া কাপে রানার্স হয় পিকে-বলরামহীন ভারতীয় দল। ১৯৭০ ব‍্যাঙ্কক এশিয়ান গেমসে সৈয়দ নঈমুদ্দিনের নেতৃত্বে ব্রোঞ্জ জিতলেও, এশিয়াড-ফাইনালও রয়ে গিয়েছে অধরা মাধুরী! চুনী-জার্নেল-পিকে-বলরাম-প্রদ‍্যোত বর্মণের মতো ওই দলের বহু তারকাই আজ প্রয়াত। 

অনুশীলনে জুনিয়রদের তাতাচ্ছেন জার্নেল

পরবর্তীতে বহু বিদেশি কোচ এসেছেন গিয়েছেন, কিন্তু ভারতীয় ফুটবল সেই তিমিরেই রয়ে গিয়েছে। কখনও এক পা এগোলেও, দু’পা পিছিয়েছে। আইএসএল-এর মতো চোখ ধাঁধানো বেসরকারি লিগ চালু করেছে ফেডারেশন, কিন্তু আন্তর্জাতিক পর্যায়ের কোনও সাফল‍্যই না থাকায় ফিফা ক্রমতালিকায় অবনমন অব‍্যাহত। পরপর বিশ্বকাপ খেলে দক্ষিণ কোরিয়া-জাপান এখন এশীয় ফুটবলে দৈত্যের মতো শক্তি, এর মধ‍্যে কোরিয়া তো বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে অবধি খেলে ফেলেছে। তাই আজকের প্রজন্মের পক্ষে কল্পনা করাই কঠিন যে, তেষট্টি বছর আগে পিকে-জার্নেল-বলরামদের গোলে ভারত হারাতো দক্ষিণ কোরিয়া-জাপানের মতো টিমকে; চুনী গোস্বামীদের গলায় শোভা পেত এশীয় সেরার পদক! আর ভারতের ওই সোনা জয়কে সোচ্চার সমর্থন জানাচ্ছেন পাকিস্তান হকির তারকারা…