শব্দভেদী ক্রিকেট

Representative Image

অষ্টাদশী ফুলা সারেনকে চেনেন? এই ওপেনিং ব‍্যাটারের শট রবিবার পি সারা ওভালের ফাইনলেগ বাউন্ডারি পার করতেই, উচ্ছ্বাসে দু-হাত আকাশে ছুড়ে দিয়ে ভারতের জাতীয় পতাকা হাতে মাঠের বাইশ গজের দিকে দৌড় শুরু করলেন একঝাঁক তরুণী।


বিজ্ঞাপন

ঠিক যেমন গত ২ নভেম্বর নভি মুম্বইতে, দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার মুহূর্তে, মাঠে ছুটে গিয়েছিলেন শেফালি ভার্মা-ক্রান্তি গৌড়-স্নেহা রানারা। মুম্বই-এর ডি ওয়াই পাটিল স্টেডিয়ামের পর, এবার কলম্বোর পি সারাভানামুত্তু স্টেডিয়াম। মাত্র তিন সপ্তাহের ব‍্যবধানে দু-দুবার ক্রিকেট বিশ্বকাপ জিতল ভারতের মেয়েরা। হরমনপ্রীত কৌররা এই প্রথমবার পেলেন মহিলা ক্রিকেটের একদিনের বিশ্বকাপের স্বাদ। আর ফাইনালে নেপালকে পর্যুদস্ত করে দীপিকা টিসি-আনেখা দেবীদের হাতে উঠল দৃষ্টিহীন মহিলা ক্রিকেটের প্রথম টি-২০ বিশ্বকাপ। এ-প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য, এ-বছরের শুরুতে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে মেয়েদের অনূর্ধ্ব ১৯ টি-২০ বিশ্বকাপও জয় করেছিল ভারতের মেয়েরা, দ্বিতীয়বারের জন‍্য। 

আরও পড়ুন: সব পাওয়া কি আর স্কোরবোর্ডে লেখা থাকে? লিখছেন অর্পণ গুপ্ত…

তবে স্মৃতি মন্ধনা-রিচা ঘোষ-শ্রী চরণীদের ক্রিকেটের সঙ্গে, ফুলা-দীপিকাদের ক্রিকেটের তফাত অনেকটাই। ক্রিকেট বলতে স্বাভাবিকভাবে আমরা যা বুঝি, তা বহু অংশেই রিফ্লেক্স বা দৃষ্টিশক্তি নির্ভর। ব‍্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং— ক্রিকেটের তিন বিভাগেই খেলোয়াড়দের রিফ্লেক্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু ফুলা সারেন-সিমরনজিত কৌরদের ক্রিকেট আদতে— শব্দভেদী বাণ চালনার মতো! দৃষ্টিশক্তি নয়, শ্রবণশক্তি নির্ভর। সরঞ্জাম, নিয়মকানুনেরও কিছু ফারাক রয়েছে। এই খেলা হয়ে থাকে মূলত সাদা প্লাস্টিকের বলে, যার মধ‍্যে রয়েছে, ধাতব বিয়ারিং। সাধারণ ডিউস বলের থেকে যা অনেকটাই হালকা। এই বলে বাউন্স বিশেষ নেই, কিন্তু গড়ালেই শোনা যাবে ঝমঝম শব্দ। এই শ্রাব‍্য বল-ব‍্যবস্থা রপ্ত করার জন‍্য, খেলোয়াড়দের দীর্ঘক্ষণ নানা ধরনের অনুশীলন চালিয়ে যেতে হয়, যা তাদের মধ‍্যে এক বিশেষ অন্তর্দৃষ্টি সৃষ্টি করে; যে অন্তর্দৃষ্টি এই ক্রিকেটে দক্ষতার শীর্ষে নিয়ে যেতে পারে কোনও খেলোয়াড়কে।  

ফুলা সারেন

বোলিং এখানে আন্ডার-আর্ম, বোলারের হাত কখনওই কাঁধের ওপর উঠবে না। এই গড়ানো বলের শব্দ শুনেই, বলের লাইন পড়েন ব‍্যাটার ও উইকেটকিপাররা। এবং তারা শট নেওয়ার পর, সেই বলের শব্দই নির্দিষ্ট ফিল্ডারকে জানান দেয় যে, বল তার কতটা কাছে। উইকেটকিপার, বোলার-সহ ব‍্যাটের কাছে থাকা অন‍্যান‍্যরাও এই শব্দের গতি অনুধাবন করেই, চিৎকার করে বাউন্ডারিতে থাকা তাদের সহ-ফিল্ডারকে সজাগ করে দেন। গড়ানো বল বলে, ব‍্যাটারদের প‍্যাড পরতে হয় না,ব‍্যাটারদের স্টান্সও তাই কিঞ্চিৎ ভিন্নরকম। তবে উইকেটকিপাররা প‍্যাড পরেন।

বলের শব্দ, আর খেলোয়াড়দের চিৎকার এই ক্রিকেটের  চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। এই সমবেত শব্দ-তরঙ্গ মাঠকে সর্বদাই সরগরম রাখে। এই আন্ডার-আর্ম গড়ানো বলে উঁচু শট মারা যায়, তবে ওভারবাউন্ডারি হওয়া কঠিন। তাই মহিলাদের এই বিশেষ ক্রিকেটে চারের সংখ্যাই অনেক বেশি। ছক্কা হাঁকানো প্রায় অসম্ভব। আর বোল্ড বা রান আউটের তুলনায় ক‍্যাচ আউট সংখ‍্যায় অনেক কম। এর একটা কারণ, বল হাওয়ায় মারলে সেভাবে শব্দ হয় না, আর তাই ফিল্ডারের পক্ষে তা অনুধাবন করা কঠিন হয়ে পড়ে, বিশেষ করে আউটফিল্ডে। এছাড়া এলবিডব্লিউ, হিট-উইকেট, স্টাম্প আউট, হ‍্যান্ডলিং দ‍্য বল সহ নো, ওয়াইড, ওভারথ্রো সবই রয়েছে স্বাভাবিক ক্রিকেটের মতো। 

দলগঠন নিয়েও এই বিশেষ ক্রিকেটে কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। তিনটি বিভাগের খেলোয়াড়রা এই ধরনের ক্রিকেটের জন‍্য বিবেচিত হন। প্রথম বি-১ বিভাগের ক্রিকেটার, যারা সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীন। এরপর রয়েছে বি-২ বিভাগের খেলোয়াড়, যাদের দৃষ্টিশক্তি চার মিটার পর্যন্ত। আর তৃতীয় বি-৩ বিভাগের ক্রিকেটারদের দৃষ্টিশক্তি চার থেকে ছ’মিটারের মধ‍্যে সীমিত। বি-১ ব‍্যাটাররা নিরাপত্তা-জনিত কারণে রানার নিয়ে ব‍্যাট করার সুযোগ পেয়ে থাকেন। তাদের করা প্রতিটা রান দু’রান হিসেবে ধার্য হয়। শুরুতে আলোচিত ফুলা সারেন বা ভারতের অধিনায়ক দীপিকা টিসি, বা এই বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ স্কোরার পাকিস্তানের মেহরিন আলি— সবাই বি-৩ বিভাগের প্লেয়ার। শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ২৩০, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১৩৩-সহ মেহরিনের ব‍্যাট থেকে এসেছে মোট ৬০০-র ওপর রান।  কিন্তু কোনও দলে সর্বোচ্চ পাঁচজনের বেশি বি-৩ ক্রিকেটার রাখা যায় না, আবার চারজন বি-১ প্লেয়ার রাখাটা বাধ্যতামূলক। অর্থাৎ, ন‍্যূনতম দু’জন বি-২ ক্রিকেটার দলে থাকবেনই। এই হল এই বিশেষ ক্রিকেটের দলীয় রসায়ন। 

জয়ের উচ্ছ্বাস

মহিলাদের জন‍্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই বিশেষ ক্রিকেট শুরু হলে কবে থেকে? কবেই-বা এই ক্রিকেটের জন‍্য প্রথম ভারতীয় মহিলা দল গঠন করা হল? ভারতে এই বিশেষ ধরনের ক্রিকেট পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন ফর ব্লাইন্ড ইন ইন্ডিয়া বা সিএবিআই, যে-সংস্থা ২০১১ সালে স্থাপিত হয়। মাত্র কয়েকবছর আগে, ২০১৯ থেকে তারা একটি মহিলা জাতীয় দল তৈরি করার জন‍্য উদ‍্যোগী হন। পুরুষদের জাতীয় দল অবশ‍্য বহু আগে থেকেই ছিল। সেই অনুযায়ী শুরু হয় প্রতিভার অন্বেষণ।

দিল্লি-সহ কয়েকটি জায়গায় শুরু হয় এই ধরনের ক্রিকেটের প্রশিক্ষণ শিবির। দিল্লির ওই শিবির থেকেই ভারতীয় দলে উঠে এসেছেন, জম্মু ও কাশ্মীরের ব‍্যাটার আনেখা দেবী ঠাকুর। সদ‍্যসমাপ্ত বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জয় বড় ভূমিকা নেয় বি-২ বিভাগের ক্রিকেটার আনেখার ব‍্যাট। জম্মু ও কাশ্মীরের কাঠুয়া অঞ্চলের বছর কুড়ির মেয়ে আনেখা জন্মলগ্ন থেকেই আংশিক দৃষ্টিশক্তিহীন। তার কাকা, যিনিও একইরকম আংশিক দৃষ্টিশক্তিহীন, তাকে ইস্কুল পর্ব মেটার পর দিল্লির এই প্রশিক্ষণ শিবিরে নিয়ে আসেন। শুরুতে সমস্যা হলেও, ক্রমেই আনেখা এই শ্রাব‍্য বলব‍্যবস্থায় নিজেকে রপ্ত করে ফেলেন ও তার ব‍্যাটিং-টেকনিক কোচদের মুগ্ধ করে। দু’বছরের মধ‍্যেই, ভারতীয় দলের দরজা খুলে যায় কাশ্মীরি তরুণীর সামনে। আনেখার সহ-খেলোয়াড়, এই টিম ইন্ডিয়ার সেরা ফিল্ডার সুনীতা সারাথের ক্রিকেটে প্রবেশ আরও দেরিতে। কলেজ পাশ করে কিছুদিন চাকরির সন্ধানে ঘোরার পর, এক বন্ধুর পরামর্শে মধ‍্যপ্রদেশের এক ক্রিকেট প্রশিক্ষণ-শিবিরে যোগ দেন সুনীতা। দেরিতে শুরু করার জন‍্য, তিনি অতিরিক্ত অনুশীলন করতেন বোলিং-অলরাউন্ডার হিসেবে দলে মানিয়ে নেওয়ার জন‍্য। বছর ছাব্বিশের বি-২ বিভাগের ক্রিকেটার সুনীতা বিশ্বকাপ ফাইনালেও রানআউট করেছেন নেপালের দুই ব‍্যাটারকে। 

অধিনায়ক দীপিকা টিসি

মহিলাদের এই বিশেষ ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ইতিহাসও খুব সংক্ষিপ্ত। এই প্রথম, বহু কাঠখড় পুড়িয়ে মোট ছ’টি দেশকে নিয়ে বারোদিন ব‍্যাপী অনুষ্ঠিত হল টি-২০ বিশ্বকাপ। আয়োজক ভারত ও শ্রীলঙ্কা। আয়োজক দু’দেশ ছাড়াও, যোগ দেয় পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, নেপাল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। গ্রুপ-লিগের খেলাগুলো হয় দিল্লি ও বেঙ্গালুরুতে, আর সেমিফাইনাল ও ফাইনাল কলম্বোয়। পুরুষ বিভাগে অবশ‍্য ১৯৯৮ সাল থেকেই একদিনের ক্রিকেটের বিশ্বকাপ শুরু করে দিয়েছিল এই বিশেষ ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক নিয়ামক সংস্থা ‘ওয়ার্ল্ড ব্লাইন্ড ক্রিকেট কাউন্সিল’ বা ‘ডব্লিউবিসিসি’। ১৯৯৬ সালে স্থাপিত ‘ডব্লিউবিসিসি’-র সদর দফতর লন্ডনে। ২০১২ সালে হয়ে যায় দৃষ্টিহীন পুরুষদের টি-২০ বিশ্বকাপের উদ্বোধনী পর্বও।  

বলের শব্দ, আর খেলোয়াড়দের চিৎকার এই ক্রিকেটের  চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। এই সমবেত শব্দ-তরঙ্গ মাঠকে সর্বদাই সরগরম রাখে। এই আন্ডার-আর্ম গড়ানো বলে উঁচু শট মারা যায়, তবে ওভারবাউন্ডারি হওয়া কঠিন। তাই মহিলাদের এই বিশেষ ক্রিকেটে চারের সংখ্যাই অনেক বেশি।

আনেখা-সুনিতা সারাথে-করুণা কুমারীরা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর, সিএবিআই-এর মুখ‍্য অধিকর্তা জিকে মহান্তেশ জানান, ‘আমাদের মনে হয়েছিল আমরা আমাদের মেয়েদের প্রতি অবিচার করছি, এই বিশেষ ক্রিকেটে তাদের জন‍্য পুরুষদের সমমানের সুযোগ না করে দিয়ে। তাই মেয়েদের পরিকাঠামো ও দল গড়ার উদ‍্যোগ নেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিযোগিতা ও বিশ্বকাপ আয়োজনেরও চেষ্টা শুরু হয়।’ মহান্তেশ নিজেও এই বিশেষ ক্রিকেটে ভারতের পুরুষ দলের একজন প্রাক্তন সদস্য। দলগঠন পর্বের পর, ২০২৩-এ প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার আলো দেখেন দীপিকারা। ইবসা বিশ্ব গেমস-এ (ইন্টারন‍্যাশানাল ব্লাইন্ড স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশন দ্বারা পরিচালিত) অভিষেক লগ্নেই, বার্মিংহ‍্যামে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে সোনা জেতেন, ভারতের এই ‘বিশেষ ক্রিকেট দক্ষতা সম্পন্ন’ মেয়েরা। 

আনেখা দেবী ঠাকুর

এই বিশ্বকাপে ফেভারিট হিসেবে শুরু করেন দীপিকারা। দিল্লিতে উদ্বোধনী ম‍্যাচে শ্রীলঙ্কাকে দাপটে উড়িয়ে দেওয়া থেকে, ফাইনালে নেপাল ম‍্যাচ অবধি সেই ফর্মে কখনও ভাটার টান দেখা যায়নি। রাউন্ড রবিন লিগ ও নকআউট, দুই পর্ব মিলিয়ে টানা সাতটি ম‍্যাচ জেতে ভারত। যে-ফর্মের ধারাবাহিকতা হরমনপ্রীত কৌরের টিম বা ভারতের অনূর্ধ্ব উনিশ দলও দেখাতে পারেনি তাদের নির্দিষ্ট বিশ্বকাপ অভিযানে। কিন্তু একথা অনস্বীকার্য যে, শেফালি ভার্মা-দীপ্তি শর্মাদের থেকে অনেক বেশি চ‍্যালেঞ্জ-এর মোকাবিলা করে ক্রিকেট খেলে যেতে হয় দীপিকা-ফুলাদের। মেয়েদের এই বিশেষ ক্রিকেটের পরিকাঠামো, জনপ্রিয়তা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, নিজেদের গ্রামীণ পরিবারের সচ্ছলতার অভাব— সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে, এই বিশ্বজয় মনে করিয়ে দেয় সেই বিখ্যাত গানটির লাইন, ‘তু জিন্দা হেয় তো জিন্দেগি কে জিত পেয় ইয়েকিন কর…’

‘আমাদের টিমের প্রায় সব মেয়েই আসে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের গ্রামাঞ্চল থেকে। ভাষা ও সংস্কৃতি একটা বড় বাধা তো বটেই। এছাড়া বহু ক্ষেত্রে, এই মেয়েদের অভিভাবক বা শিক্ষকরা খেলা চালিয়ে যাওয়াকে সমর্থন করেন না; কারণ খেলার জন‍্য নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হয়।’ জানান টিম ইন্ডিয়ার ম‍্যানেজার শিকা শেট্টি। শিকার এই ষোল সদস‍্যের ভারতীয় দল হয়েছে, মোট ন’টি রাজ‍্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ক্রিকেটারদের সমাহারে। জম্মু ও কাশ্মীর, রাজস্থান, মধ‍্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক, ওড়িশা, অসম আর বিহার। টিমের ভাষা হিন্দি ও ভাঙা-ভাঙা ইংরেজি। তিনি আরও বলেন, ‘সব মেয়েদের এই খেলার জটিল নিয়ম কানুন বোঝানোও সময়সাপেক্ষ ব‍্যাপার। এত কিছু সত্ত্বেও ওরা গর্বের সঙ্গে ভারতীয় দলে খেলে চলেছে!’

নভি মুম্বাই-এ শেফালি ভার্মার মতোই, কলম্বোয় ব‍্যাটে-বলে অলরাউন্ড পারফরমেন্স করে, ফাইনালের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছেন ফুলা সারেন। ভারতীয় বোলারদের দাপটে নেপাল ১১৪ রানের বেশি তুলতে পারেনি নির্দিষ্ট কুড়ি ওভারে। ফুলা-যমুনা টুডুদের আঁটোসাঁটো বোলিং ও ফিল্ডিং-এর বিরুদ্ধে, মাত্র একটি বাউন্ডারি মারতে পারেন নেপালের ব‍্যাটাররা। এরপর শুরু থেকেই আগ্রাসী মেজাজে ব‍্যাট করে ১২ ওভার এক বলেই জয়ে নিশ্চিত করে ফেলেন দীপিকারা, মাত্র তিন উইকেট খুইয়ে। ফুলা অপরাজিত থাকেন ৪৪ রানে; বি-১ বিভাগের ব‍্যাটার করুণাকুমারীর অবদান ৪২। ঠিক একইরকম আগ্রাসী মেজাজে খেলে, সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়াকেও খড়কুটোর মতো উড়িয়ে দিয়েছিল ভারত। ওড়িশার আদিবাসী পরিবারের মেয়ে ফুলা, পাঁচ বছর বয়সে বাঁ-চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিল, তার মায়েরও কয়েকদিনের মধ‍্যে একই পরিণতি হয়। এরপর দৃষ্টিহীনদের স্কুলের এক শিক্ষক তাকে এই ক্রিকেটের সঙ্গে পরিচয় করান। কিছুদিনের মধ‍্যেই দক্ষতার জোরে জাতীয় কোচদের নজরে আসে ফুলা। কিন্তু প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটে, দলের সঙ্গে সফর করা এই টিনএজারের কাছে ছিল সমস্যাজনক; পরিবারকে রাজি করানো সহজ ছিল না। কিন্তু ফুলা লড়াই চালিয়ে যান; ভারতীয় দলের জার্সি পরে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলাটাই তার কাছে ট্রফির থেকেও যে বড় অনুপ্রেরণা। 

সিমু দাস

শৈশবে এক দুর্ঘটনায় দৃষ্টিশক্তি খোয়ানো দীপিকা টিসি-র বেড়ে ওঠা, কর্ণাটকের টুমকুরের গ্রামাঞ্চলে, এক কৃষক পরিবারে। বিশেষভাবে সক্ষমদের জন‍্য একটি স্কুলের শিক্ষকরা দীপিকাকে ক্রিকেটে খেলতে উৎসাহিত করেন। সময়ের সঙ্গে এই ক্রিকেটই তাকে জীবনে দিশা ও আত্মবিশ্বাস, দুটোই জোগায়। ফাইনাল জয়ের পর, সংবাদমাধ‍্যমকে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে আবেগ সম্বরণ করতে না পেরে, কেঁদে ফেলেন বিশ্বজয়ী ক‍্যাপ্টেন। 

‘আমার এবং পুরো টিমের কাছে একটা স্মরণীয় মুহূর্ত! আমরা কেউ ফাইনালের আগে রাতে ঘুমোতে পারিনি, এই ভাবনায় যে, বিশ্বকাপ নিয়ে দেশে ফিরতে পারলে কীরকম অভ‍্যর্ত্থনা পাব! টিমের ওপর পুরো বিশ্বাস ছিল আমার। ভেবে দেখুন, অন‍্যান‍্য দলগুলো আমাদের সঙ্গে খেলতে রীতিমতো ভয় পেত!’ ক‍্যাপ্টেনের কথায় হাততালিতে ফেটে পড়েন টিম ইন্ডিয়ার বাকি সদস‍্য ও উপস্থিত সমর্থকরা। দীপিকা আরও যোগ করেন যে, সদ‍্য মহিলা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন দলের জেমাইমা রডরিগেজ ও ভারতীয় টেস্ট দলের অধিনায়ক শুভমন গিলের সাহায্য ও সমর্থন পাওয়া তার দলের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল।  


বিশ্বকাপ জয়ের পর, সিএবিআই কর্তা জিকে মহান্তেশের চোখেও ছিল জল। মহিলাদের এই প্রথম বিশ্বকাপ আয়োজন সহজ ছিল না। প্রয়োজনীয় অর্থ একটা বড় সমস্যা তো ছিলই, প্রতিযোগিতার দু’সপ্তাহ আগে পর্যন্ত ছিল না কোনও স্পন্সরশিপ। অংশগ্রহণকারী ছ’টি দলকে রাজি করানোতেও ছিল সমস্যা। এদিকে প্রতিযোগিতা সংগঠনের বাজেট হয় ছ’কোটি টাকা। পরে কেন্দ্র ও রাজ‍্য সরকারগুলো পাশে দাঁড়ায়, একটি সরকারি ব‍্যাঙ্ক মূল পৃষ্ঠপোষক হতে রাজি হয়। কর্ণাটক রাজ‍্য সরকার এক কোটি টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। সামারান্থনাম ট্রাস্টও এগিয়ে আসে। এরকম কিছু পৃষ্ঠপোষক ও কর্পোরেট জগতও আগ্রহ দেখায়। খেলোয়াড়দের জন‍্য এখন ম‍্যাচ-ফি রয়েছে। তা নিতান্তই কম হওয়ায়, একটা স্টাইপেন্ড দেওয়া হয়, কারণ প্রায় সব প্লেয়ারই গরিব পরিবার থেকে আসেন। সাধারণ দর্শকদের থেকেও দারুণ সাড়া মিলেছে। ‘আরও বেশি দেশ মহিলা দল নামালে, এই ক্রিকেট আরও উচ্চতায় উঠবে।’ আশাবাদী শোনায় মহান্তেশকে।

প্রসারভারতীর প্ল‍্যাটফর্মে সরাসরি ম‍্যাচের সম্প্রচার করা হয়েছে, ভারতের সব ম‍্যাচ সরাসরি সম্প্রচার করেছে দূরদর্শনও। এছাড়া সিএবিআই-এর ইউটিউব চ‍্যানেল তো সব ম‍্যাচের লাইভ টেলিকাস্ট করেছেই। ম‍্যানেজার শিকা শেট্টিও, তার টিমের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রবল আশাবাদী। ‘এবার অভিভাবকদের চোখ খুলবে। আরও বেশি করে মেয়েরা এই ক্রিকেটের দিকে ঝুঁকবে আগামী দিনে। কারণ লাইভ ম‍্যাচ দেখে লোকে বুঝেছে যে, এই ক্রিকেট খেলেও একটা ভবিষ্যত আছে। 

অসমের নওগাঁও জেলার গ্রামের মেয়ে সিমু দাস, রাজস্থানের কোটার সিমরনজিতদের কাছে এই ক্রিকেটের গুরুত্ব অপরিসীম। ‘ক্রিকেটার হওয়ার আগে জীবন ছিল দুর্বিসহ। জন্মসূত্রে আমার দৃষ্টিহীনতা দেখে আমার বাবা আমাদের ছেড়ে চলে যায়! খেলে যা সামান্য উপার্জন করি, তা দিয়ে দরিদ্র মাকে একটা ছোট বাড়ি কিনতে সাহায্য করেছি।’ অনুশীলনে ব‍্যাট করতে যাওয়ার আগে জানান বি-১ বিভাগের ব‍্যাটার সিমু। সিমরনজিতকে ক্রিকেট দিয়েছে বাড়ি থেকে বেরিয়ে, অন‍্য শহরে গিয়ে খেলার সুযোগ। প্রাক্তন কাবাডি খেলোয়াড় তার বাবা তাকে খেলার ব‍্যাপারে উৎসাহ জোগাতেন। 

তবে দিল্লি এখনও বহুদূর। এই বিশেষ ক্রিকেটের পরিকাঠামো এখনও কৈশোরে। হাতেগোনা প্রশিক্ষণ শিবির, কমিউনিটি শিবির, দৃষ্টিহীনদের কিছু স্কুলের কিছু শিক্ষক ও ছোট শহরের কয়েকটি হোস্টেল; এর মধ‍্যেই সীমিত সুযোগ— প্রতিভা অন্বেষণ, প্রশিক্ষণ ও অনুশীলনের। যারা মনে করছেন, দীপিকাদের এই বিশ্বজয় হরমনপ্রীত কৌরদের জয়ের সমান গুরুত্বপূর্ণ, তাঁদের সৌজন্যে জানাই, দুটোর মধ‍্যে বাস্তবে রয়েছে আসমান-জমিন ফারাক; পারিশ্রমিকের নিরিখে, পুরস্কার আর ম‍্যাচ ফি-র নিরিখে।

দলের প্রস্তুতি পর্ব

ফুলা সারেন-সিমু দাসরা একটি আন্তর্জাতিক ম‍্যাচের জন‍্য ম‍্যাচ-ফি পেয়ে থাকেন মাত্র তিন হাজার টাকা। যখন স্মৃতি-জেমাইমারা ভারতের জার্সিতে একটি টি-২০ খেলে উপার্জন করেন তিন লক্ষ টাকা; একদিনের ম‍্যাচের জন‍্য পান ম‍্যাচ প্রতি ছ’লক্ষ টাকা করে। আর বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন‍্য পুরস্কার মূল‍্য হিসেবে আইসিসি থেকেই পেয়েছেন ৪০ কোটি টাকা। এছাড়াও বিসিসিআই তাদের পুরষ্কৃত করেছে ৫১ কোটি টাকা দিয়ে। সেখানে দীপিকা-গঙ্গা কদমদের বিশ্বজয়ের পুরষ্কার মূল‍্য মাত্র পাঁচ লক্ষ টাকা; তা যতই প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, বহু রাজ‍্যের মুখ‍্যমন্ত্রী, আইসিসি শীর্ষকর্তা এই মহিলা দলের বিশ্বজয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে সমাজমাধ‍্যমে প্রতিক্রিয়া জানান না কেন, জয়ের আর্থিক মূল‍্য যৎসামান‍্যই! অথচ অনুশীলন, প্রস্তুতিতে অবশ‍্য একইরকম ঘাম ঝরাতে হয় আনেখা-যমুনা টুডুদের!  সিএবিআই এখনও কোনও পুরস্কারমূল্য ঘোষণা করেনি। যদিও দু’টি বেসরকারি সংস্থা দলের প্রতি সদস্যকে যথাক্রমে এক লক্ষ ও পঁচিশ হাজার টাকা করে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। তাই দীপিকা-ফুলাদের এই বিশ্বকাপ অভিযান অনেকটাই মিতালি রাজ-ঝুলন গোস্বামীদের ২০০৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে রানার্স হওয়ার সঙ্গে তুলনীয়। যখন ম‍্যাচ প্রতি মিতালি-ঝুলনরা পেতেন মাত্র এক হাজার টাকা করে! 

দীপিকার নেতৃত্বে এই বিশ্বজয় নিঃসন্দেহে গ্রাম ভারতে বহু কৃষক ও আদিবাসী পরিবারের মেয়েদের শুধু এই বিশেষ ক্রিকেটেই নয়, সামগ্রিকভাবে ক্রীড়াঙ্গনের দিকে টেনে আনতে অনুপ্রাণিত করবে; আবার এই  বিশ্বজয় দেখিয়ে দিল এই তাদের বাস্তবিক অবস্থানও। মহিলাদের এই বিশেষ ক্রিকেট এদেশে এখনও ২০০৫ সালের মহিলা ক্রিকেটের পর্যায়ে পড়ে রয়েছে। তাই অনেকটা কণ্টকাকীর্ণ পথ ও লড়াই এখন সামনে পড়ে রয়েছে ফুলা সারেনদের জন‍্য।