মোহন-বাঁশি

সালটা ১৮৮৯। সদ্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে বেজেছে সিপাহী বিদ্রোহের দামামা। শহরের অলিতেগলিতে ছড়িয়ে পড়ছে আগুনের ছোঁয়াচ। ব্রিটিশ পুলিশও ছেড়ে কথা বলছে না। নির্বিচারে চলছে ধরপাকড়। এই উত্তপ্ত আবহে পরাধীন ভারতের রাজধানী বর্তমান কলকাতার বুকে জন্ম নিল মোহনবাগান ক্লাব। অদ্ভুতভাবে দিনটা ১৫ অগাস্ট। প্রতিষ্ঠাতার তালিকায় অন্যতম নাম বিশিষ্ট আইনজীবী ও পরবর্তীতে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি ভূপেন্দ্রনাথ বসুর। বসু পরিবার ছাড়াও নাম জুড়েছে মিত্র ও সেন পরিবারের। প্রথম সভাটি অনুষ্ঠিত হয় উত্তর শহরতলির ১৪ নম্বর, বলরাম ঘোষ স্ট্রিটে। সেক্রেটারি যতীন্দ্রনাথ বসু ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন বহু স্বনামধন্য মানুষ। শোনা যায় ক্লাব তৈরিতে শ্যামপুকুরের মহারাজ দূর্গাচরণ লাহা ও কোচবিহারের মহারাজ রাজেন্দ্র বাহাদুরও সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিলেন।

অধুনা মার্বেল প্যালেস ছিল শতাব্দীপ্রাচীন ক্লাবের প্রথম প্র্যাকটিস গ্রাউন্ড। বিত্তশালী মিত্র পরিবারের সম্পত্তি, পরবর্তীতে মোহনবাগান ভিলা নামেও পরিচিত হয়। শোনা যায়, ক্লাব হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর মোহনবাগান তার প্রথম ম্যাচ খেলেছিল ইডেন হিন্দু হস্টেলের বিরুদ্ধে। প্রথম এগারোয় গিরীন বসু, প্রমথনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মতো উল্লেখযোগ্য নাম। তবে সেখানেও মাঠ স্থায়ী ঠিকানা পায়নি। ১৮৯১ সাল নাগাদ আবার জায়গা বদল, এবার গন্তব্য শ্যামপুকুর মাঠ। লাহাবাবুর সহায়তায় ক্লাব স্থানান্তরিত হয়। বর্তমানে জায়গাটির নাম লাহা কলোনি। পরবর্তীতে, কলকাতা কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান হ্যারি লী স্থায়ী নিবাসের বিষয়ে উদ্যোগী হন। আরিয়ান্স ও বাগবাজার ক্লাবের সঙ্গে যৌথভাবে শ্যাম স্কোয়ারে যাত্রা শুরু করে মোহনবাগান ক্লাব।

১৯১১-র শিল্ডজয়ী মোহনবাগান দল

আরও পড়ুন: ফুটবল মাঠের প্রতিরোধ নতুন ইতিহাস তৈরি করে! লিখছেন রোদ্দুর মিত্র…

১৮৯৩-এ প্রথম টুর্নামেন্ট হিসেবে কোচবিহার কাপে অংশগ্রহণ। ১৯০৪-এ প্রথম ট্রফি জয়, কোচবিহার কাপ। তারপর ফিরে তাকাতে হয়নি আর। সেই বছরই গ্ল্যাডস্টোন কাপের ফাইনালে আইএফএ শিল্ডজয়ী ডালহৌসিকে ৬-১ গোলে হারিয়ে শিল্ড যেতে মোহনবাগান। ১৯০৬-’০৮ টানা তিনবার ট্রেডস কাপ জিতে নতুন রেকর্ড গড়ে সবুজ-মেরুন বাহিনী। ততকালীন ভারতবর্ষে আইএফএ শিল্ডের পরবর্তী সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ টুর্নামেন্ট ছিল ট্রেডস কাপ। ১৯০৭ এবং ১৯০৮ ধারাবাহিকভাবে সাফল্য আসে। গ্ল্যাডস্টোন ও কোচবিহার কাপ যেতে মোহনবাগান। যে কুঁড়ি ফুটেছিল কোনো এক অশান্ত সকালে, ধীরে ধীরে বিকশিত হয় শত পাপড়ি। ১৯০৯ সালে মোহনবাগান প্রথমবারের মতো লক্ষ্মীবিলাস কাপ জিতে নেয়। ক্লাব সচিব মেজর শৈলেন বসু ছিলেন ৪৯তম বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ও সর্বোচ্চ র‍্যাঙ্কিংয়ের ভারতীয় অফিসার। ক্লাব তৈরির পাশাপাশি দল গঠনেও তার ভূমিকা ছিল অসাধারণ। প্রথম ক্লাব তাঁবুর ব্যবস্থা তাঁর আমলেই সম্পূর্ণ হয়। সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি থেকে নতুন মাঠ তৈরি, সব দিকেই ছিল তাঁর প্রখর দৃষ্টি। ১৯০০ সালে, মোহনবাগান প্রেসিডেন্সি কলেজের অংশীদার হয় এবং কলকাতা ময়দানে যৌথভাবে একটি মাঠে অনুশীলন শুরু করে। তৎকালীন সদস্যদের জন্য সদস্য-মূল্য ছিল ৮ আনা ও ছাত্রদের জন্য ৪ আনা।

কিন্তু এতকিছুর পরেও ক্লাবপ্রাঙ্গণ তৈরির জন্য তহবিল যথেষ্ট ছিল না। কর্মকর্তাদের মধ্যে একটি সভায় এই প্রসঙ্গে আলোচনা শুরু হয়। বিশিষ্টদের মধ্যে যতীন্দ্রনাথ বসু, শৈলেন বসু, দ্বিজেন বসু, ভূপেন্দ্রনাথ মিত্র প্রমুখ প্রত্যেকেই উপস্থিত ছিলেন সভায়। ক্লাবহাউস নির্মাণের বিষয়ে প্রস্তাব করা হয়।

কিন্তু সেই বৈঠকে আর্থিক নিশ্চয়তার বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি তৎকালীন কর্মকর্তারা। তবুও অদ্ভুতভাবে কিছুদিনের মধ্যেই দ্রুততার সঙ্গে মোহনবাগান ময়দান প্রাঙ্গণে একটি ক্লাবহাউস নির্মাণ সম্পূর্ণ হয়। ক্লাবের আর্থিক রেকর্ড খুঁজলে এই খরচ বিষয়ক কোনও নথিরই উল্লেখ সেইসময় পাওয়া যায় না। দাতাদের নাম আজও অজানা। ১৯০৯ সালে মোহনবাগান প্রথম আইএফএ শিল্ডে অংশগ্রহণ করে, বাংলার কোনও ক্লাব হিসেবে যা ছিল অত্যন্ত গর্বের বিষয়। পরবর্তীতে ১৯১০ থেকে টানা তিন বছর ধারাবাহিকভাবে বেঙ্গল জিমখানা শিল্ড জিতে নেয় সবুজ-মেরুন বাহিনী।

তারপর আসে সেই ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ, ১৯১১। প্রবীণ সমর্থককুল যা শুনে আজও পুরনো চশমার কাঁচের গভীরে চকচকে চোখদুটো মুছে নেয়। রুদ্ধশ্বাস ধারাবিবরণীর মতো টুকরো টুকরো দৃশ্যপট। খেলা শেষ হওয়ার দু’মিনিট বাকি। শিবদাস ভাদুড়ীর পাস। অভিলাষের পায়ে বল। গোটা গ্যালারি শান্ত, নীরব, শব্দহীন। এই স্তব্ধতা প্রবল হর্ষের, দুঃসহ ভয়ংকর। তুচ্ছ ৫-৩-এর সাফল্য, নগণ্য আই লিগ জয়। যা প্রত্যক্ষ করেনি নবীন প্রজন্ম। বা করেছে হয়তো।

এই অগাস্ট মাসেই আরও একটা কলঙ্কিত দিন রয়েছে। ১৬ অগাস্ট, ১৯৮০। ঐতিহাসিক কলকাতা ডার্বি, ফিফার ‘ক্লাসিক রাইভালরি’-র তালিকায় নথিভুক্ত ময়দানি প্রতিদ্বন্দ্বীরা মাঠে নেমেছে। এগারো মিনিটের মাথায় বিদেশ বসুর সঙ্গে দিলীপ পালিতের ফাউল, রেফারির সিদ্ধান্তহীনতা দিয়ে শুরু হল দ্বন্দ্ব। যা গ্যালারি পেরিয়ে মাঠের বাইরে অবধি গড়াল। সেদিন ইডেন গার্ডেনস থেকে বাড়ি ফিরতে পারল না ১৬জন ফুটবল সমর্থক। রক্তাক্ত হয়ে ওঠে ফুটবল মাঠ।

এসেছিল আরেকবার। এই একবছর আগে। ১৮ অগাস্ট। সদ্য স্বাধীনতা ও প্রতিষ্ঠা দিবস অতিক্রান্ত। কিন্তু উত্তাল শহর যেন কিঞ্চিৎ বিষাদময়। সেদিনও বৃষ্টি পড়ছিল বেশ। ইস্টার্ন মেট্রোপলিটন বাইপাস, যুবভারতী সংলগ্ন সার্ভিস রোডে ভিড় বাড়ছে অজস্র কালো মাথার। আবারও যুদ্ধে নেমেছে সবুজ-মেরুন। চিরশত্রুরা সহযোদ্ধার ভূমিকায়। বৃহত্তর স্বার্থে। যেমন ছিল এগারোয়। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে খালি পায়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। র‍্যাডক্লিফ সাহেবের নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করে। ১১ জনের দলে মুছে গিয়েছিল ঘটি-বাঙাল ভেদাভেদ। রাষ্ট্রীয় লেঠেল মেপে নিচ্ছে বাঁকা চোখে। ব্রিটিশ হোক কি একবিংশ শতাব্দীর ভারত, শাসক ঔদ্ধত্য হজমে বরাবরই অনভ্যস্ত। তাই তো আজও টিফো নামে মায়ের ভাষায়, বঙ্গদেশে। আকাশে-বাতাসে অকাল বসন্তের ঘ্রাণ। নিজের বোনের মৃত শরীর বাড়াচ্ছে প্রতিরোধের আগুন। পতাকা কাঁধে কত যুবক-যুবতীর ভিড়। অশক্ত জীর্ণ শরীরে বৃদ্ধরা রাস্তায়। পালতোলা নৌকা বুকে স্লোগান তুলছে মুষ্টিবদ্ধ হাত। যে হাত একসময় বহন করেছে স্বাধীনতার মশাল। অসম যুদ্ধ। বিপক্ষ রাষ্ট্র কিংবা ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্ট। সম্বল সবুজ-মেরুন জার্সি আর একবুক আবেগ। ওই যে কাঁধ বাড়িয়ে দিচ্ছে শতসহস্র লাল-হলুদ কমরেড। পায়ে পায়ে বল এগোচ্ছে। অশান্ত সময়ে মুখ খুলছে অকুতোভয় প্রীতম, নির্দ্বিধায় মাঠে নামছে ক্যাপ্টেন শুভাশিস। বল এগচ্ছে তেকাঠির দিকে বাস্তিল অভিমুখে। বিজয়, শিবদাস খেলে নিচ্ছে ওয়ান টু।

স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে প্রথমবার এক হওয়া। সবুজ-মেরুনের কাঁধে লাল-হলুদ। প্রবল বৃষ্টি নামছে শহরের বুকে, বাষ্প জমছে চশমায়। ছিঁড়ে যাচ্ছে জাল। জিতে যাচ্ছে ফুটবল। জিতে যাচ্ছে শতাব্দীপ্রাচীন দুই ক্লাব। জিতে যাচ্ছে মোহনবাগান।