উল্টো পুজো

ছোটবেলার পুজোর স্মৃতি অফুরান। যখন একটু উঁচু ক্লাসে উঠেছি, তখনকার একটা মজার অভিজ্ঞতা মনে পড়ে। তখনও তো থিমপুজো নেই, এত আলো নেই, এত আয়োজন নেই। সেসময় পুজো অনেক বেশি স্নিগ্ধ, অনেক ছোটখাটো, অনেকটা আপন। তখনও ‘প্যান্ডেল হপিং’ শুরু হয়নি। তবে, উত্তর কলকাতার ছেলেমেয়েরা একদিন দক্ষিণের দিকে যাবে, দক্ষিণের ছেলেমেয়েরা অনুমতি নিয়ে হয়তো একদিন সিমলেপাড়া, হেদুয়া বা হাতিবাগানে ঠাকুর দেখতে যাবে। আমাদের বাঙুর অ্যাভিনিউর পিনকোডে কলকাতা লেখা থাকলেও, আসলে তা প্রায় মফসসল। আমরা বন্ধুরা কোনওদিনই ওই কলকাতায় গিয়ে ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখার ঝোঁকটাতে অংশ নিইনি।

বরং আমাদের একটু অন্যরকম ইচ্ছে ছিল। এখন ভাবলে হয়তো ছেলেমানুষিই মনে হয়। তখন ক্লাস টেন হবে, সে-বয়সে হয়তো এমন হয়। আমাদের ইচ্ছে ছিল, আমরা একটু উল্টোদিকে উৎসব কাটাব। এমন জায়গায় যাব, যেখানে পুজোর চিহ্নমাত্র নেই। সেটা কোথায়? গ্রাম? না, তা মোটেই নয়। গ্রামের পুজোও তো দ্রষ্টব্য। আমরা কলকাতার মধ্যেই এমন জায়গায় যাব, যেখানে পুজোর নামগন্ধ থাকবে না। আমরা বেছে নিয়েছিলাম বাবুঘাট। বাঙুর অ্যাভিনিউ থেকে একটাই বাস। সেই বাস সকাল সকাল ধরে চলে যেতাম। কিন্তু পুজোর নামগন্ধ তো না চাইলেও থাকবে! শরতের আকাশ তো সর্বত্র! গঙ্গা আরেকটু নির্মল। এপারে, অর্থাৎ ধর্মতলা চত্বরে তো পুজো নেই। ওপার থেকে ভেসে আসছে ঢাকের শব্দ। ওইখানেই সপ্তমী বা অষ্টমীর একবেলা কাটিয়ে ওখানেই ঝুপড়িতে ভাত-মাছের ঝোল খেয়ে বাড়ি ফিরতাম।

আরও পড়ুন : পুজোর সময় ব্যাবসায়িক রঙ্গমঞ্চ বন্ধ থাকার সুযোগে আমাদের নাট্য উৎসবের শুরু!
পুজোর স্মৃতিচারণে রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত…

এমন জায়গায় যাব, যেখানে পুজোর চিহ্নমাত্র নেই। সেটা কোথায়? গ্রাম? না, তা মোটেই নয়। গ্রামের পুজোও তো দ্রষ্টব্য। আমরা কলকাতার মধ্যেই এমন জায়গায় যাব, যেখানে পুজোর নামগন্ধ থাকবে না। আমরা বেছে নিয়েছিলাম বাবুঘাট। বাঙুর অ্যাভিনিউ থেকে একটাই বাস। সেই বাস সকাল সকাল ধরে চলে যেতাম। কিন্তু পুজোর নামগন্ধ তো না চাইলেও থাকবে! শরতের আকাশ তো সর্বত্র!

আরও একটা ঝোঁক ছিল আমাদের। তা একটু সমাজতান্ত্রিক-ই বলা চলে। নতুন জামা পরব না। কেন? একটা যুক্তিও সাজালাম। কারণ কতজন তো নতুন জামা পায় না। তাদের সামনে ড্যাংড্যাং করে নতুন জামা পরতে হবে? বাড়ির লোক, আত্মীয়স্বজন রেগে গেল। কিন্তু আমরা বেশ তিন-চারবছর এই প্রথাটা চালিয়েছিলাম মনে পড়ে। এটাকে একটা প্রচারের দিকেই নিয়ে গিয়েছিলাম প্রায়! পরে বড় হয়ে বুঝেছি, পুজোয় জামাকাপড় বিক্রি হলে অর্থনীতিরই চাকা ঘোরে। মানুষের উপকারই হয়।

এছাড়া আমাদের পুজো কাটত পাড়াতেই। মণ্ডপে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা মারতে মারতে বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে। খাওয়ার সময় যাচ্ছে পেরিয়ে। ওটুকু ছাড় তখন ছিল। তাছাড়া ব্যাটবল নিয়ে সকালে খেলতেও যেতাম পুজোয়। এখন তো কোথাও আড্ডা মারতে গেলেও মনে হয়, এই বুঝি কোনও কোম্পানি স্পনসর করে দেবে। এত ছবি তোলার হিড়িকই বা তখন কোথায়? কিন্তু সময় তো পাল্টাবেই। তা নিয়ে আফসোস করে লাভ নেই।

তাছাড়া মনে পড়ে কিশোর বয়সে কিশোরী কাউকে দেখলেই মনে হত, এর জন্যই বুঝি পুজোমণ্ডপে আসা। তারপর তো বড় হয়েছি। পুজোর হুল্লোড়ের মধ্যে থাকব না ভেবেও যখন দেখতাম, হাতে-পায়ে ফোসকা পড়ে গেছে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাড়ি ফিরছে ছেলেমেয়েরা। বাবা-মা অপেক্ষায়। বড় হওয়ার পরেও বিচারক হওয়ার বিষম খেলাতেও অংশ নিয়েছি। সে আবার সাংঘাতিক ব্যাপার। সেই গল্প আপাতত মুলতবি থাক।