সময়টা সাতের দশক। বাংলার সমাজে তখন বহুস্তরীয় রূপান্তর ঘটছে। রাজনৈতিক উত্তাপ, শ্রেণি সংগ্রামের দাবি, যৌনতার নতুন ভাষা, শহরের অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, শিল্পী ও লেখকদের পরম্পরাগত চর্চার বাঁধ ভাঙার প্রয়াস— সবটাই সময়ের নিয়মে ঘটছে। সে-সময়ে কয়েকজন শিল্পীর কাছে কাজ বলতে শুধুই নান্দনিক চর্চা ছিল না, ছিল বরং সামাজিক জীবনের তীক্ষ্ণ প্রতিফলন। কলকাতায় সমরেশ বসু নিজের সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে মানুষের জীবনচর্চা, অনুভূতি, স্বাধীনতা এবং সমাজের ভেতরকার দ্বন্দ্ব নিয়ে লিখছেন। এবং শান্তিনিকেতনে সাধারণ মানুষের জীবনের একই দিকগুলো সমাজের সামনে আয়নার মতো তুলে ধরছেন শিল্পী রামকিঙ্কর বেইজ, তাঁর শিল্পকর্মের মাধ্যমে। তাঁরা দুজনেই তাঁদের কাজের মাধ্যমে আগামী কালের সংজ্ঞা গড়েছেন।
আজকে, ২০২৫ সালে, যখন সমরেশ বসুর একশো এক বছরের জন্মদিন উপলক্ষে লিখতে বসেছি, তখন নিজেকেই জিজ্ঞেস করছি— আমি কি তাঁর বৃহৎ সাহিত্যের, বা তাঁর বৃহত্তর জীবনের ব্যাখ্যা করতে চাই? সে-স্পর্ধা আমার নেই, সেই জ্ঞানের দাবিও আমি করছি না। আমি পেশায় একজন শিল্প-ইতিহাসবিদ এবং আরকাইভিস্ট। আমি যেমন শিল্প-ইতিহাসের চর্চা করি, তেমনই ইতিহাসের সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করি। সেই সূত্রে সমরেশ বসুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে তাঁকে নিয়ে একটি আর্কাইভ তৈরি করার সুযোগ এসে পড়ে বছর দুয়েক আগে। এই একশো বছর পরে একজন মানুষের জীবনের পড়ে থাকা কিছু টুকরো দিয়ে তাঁর জীবনী নির্মাণের প্রচেষ্টা। সমরেশ বলেছেন, ‘সাহিত্যের চেয়ে জীবন বড়’, তাই তাঁর সাহিত্যকে তাঁর জীবন দিয়ে বোঝার চেষ্টা করে চলেছি। এখানেই আমার সমরেশকে খোঁজা শুরু।
এই খোঁজা শুরু হয়েছিল অনেক ছোটবেলায়, বাড়িতে আলাদা করে সরিয়ে রাখা ‘দেশ’ পত্রিকার তাকে, যেখানে তখন মাসিক কিস্তিতে ‘দেখি নাই ফিরে’ প্রকাশিত হচ্ছে। সেখানেই আমার তিনজন মানুষের সঙ্গে প্রথম পরিচয়— সমরেশ, রামকিঙ্কর এবং বিকাশ। আজও অবাক হয়ে যাই এই ভেবে যে, তিনজন মানুষ কীভাবে একে অপরের জীবনকে চিত্রিত করছেন। সেই বিস্ময় থেকেই জীবন ও জীবনীর পার্থক্য নিয়ে ভাবতে আরম্ভ করি। আর্কাইভের জন্য সমরেশ বসুর জীবনী নির্মাণ করতে গিয়ে মনে হয়, তিনি কি রামকিঙ্করের শুধু জীবনীই লিখতে চেয়েছিলেন? না কি তিনি একজন মানুষের মাধ্যমে একটা জীবনধারা খুঁজছিলেন? ‘দেখি নাই ফিরে’ উপন্যাসের নামের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সমরেশ একটি চিঠিতে সাগরময় ঘোষকে লিখছেন যে রবীন্দ্রনাথ রামকিঙ্করকে বলেছিলেন, ‘তুই তোর মূর্তি আর ভাস্কর্য দিয়ে আমাদের সবখানে ভরে দে। একটা শেষ করবি আর সামনে এগিয়ে যাবি— সামনে।’ রামকিঙ্কর তাই আর ফিরে দেখেননি। একশো বছর পর আমি যখন এই দুটো মানুষের জীবন দেখি, রাস্তাঘাটে চলতে-ফিরতে তাদের শিল্পকর্মের চরিত্রগুলোর সম্মুখীন হই, তখন তাদের জীবনকে আজকের নিরিখেই দেখতে পাই। কোনও পুরনো সেকেলে সরল সমীকরণের মধ্যে দিয়ে নয়।


আমরা যখন কারও জীবনী পড়ি, তখন কি তা শুধু সেই মানুষটার জীবনকে চেনার বা জানার জন্য, না কি তাঁর জীবনকে ভিত্তি করে নিজের জীবনের ওঠাপড়ার গল্পগুলোকেও খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করি আমরা? আমি এই দুই শিল্পীর কাজের ভেতর একটি সূত্র খুব স্পষ্ট দেখি— শিল্পকে কেন্দ্র করে মানুষের জীবনের গল্প বলার চেষ্টা। রামকিঙ্করের শিল্পচর্চাকে কেন্দ্র করে, সমরেশ মানুষ রামকিঙ্করের গল্প বলেছেন। কারণ শিল্পচর্চার স্থান ও কাল থাকে, কিন্তু জীবনচর্চা এক নিরন্তর অনুসন্ধান।
‘দেখি নাই ফিরে’ শুধুই রামকিঙ্করের জীবনী নয়। প্রায় আট-ন’বছরের গবেষণার ফল এই উপন্যাস। শিল্পী রামকিঙ্করকে বোঝার জন্য এতটা সময় লাগে না, এই সময়টা সমরেশ দিয়েছিলেন মানুষ রামকিঙ্করকে সঠিকভাবে জানার জন্য, তাঁকে উপযুক্তভাবে ব্যক্ত করার জন্য। এই সন্ধানে নেমে সমরেশের নিজের বহুস্তরীয় ব্যক্তিত্ব হয়তো খুঁজে নিতে চেয়েছিলেন নতুন করে। জীবনী লেখা মানে শুধুই শিল্পীর সত্য লেখা নয়; জীবনী লেখা মানে তার সাথে নিজের অস্তিত্বের সম্পর্কও নিরীক্ষণ করা। রামকিঙ্করের জীবন তাঁর কাছে এক সমান্তরাল অনুসন্ধান— প্রাতিষ্ঠানিক এবং স্বকীয় সত্তা বজায় রেখে আর্টিস্টটিক অথরিটি কীভাবে গড়ে ওঠে? কীভাবেই-বা মানুষ রামকিঙ্কর থেকে যায় মাটির খুব কাছে?



মাইকেলেঞ্জেলোর জীবনী ‘দ্য অ্যাগনি অ্যান্ড এক্সটাসি’ আমাদের কাছে মানুষটির এক আইকনিক আকার নির্মাণ করে— সচরাচর যা আমাদের শেখায়, এই মানুষগুলো বৃহৎ, এদের দূর থেকে দেখতে হয়। আমরা তাই এদেরকে নিজেদের থেকে আলাদা করে বহু দূর থেকেই চিনি, অন্তর থেকে আর চেনা হয় না। কিন্তু সমরেশ যখন রামকিঙ্করের জীবনের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠভাবে পরিচয় করিয়ে দিলেন, তখন পরিষ্কার হল— শিল্প-ইতিহাসের আইকনগ্রাফিক গণ্ডির বাইরে, শিল্প-সমাজ-ব্যক্তির চলাচলের এক চালচিত্র।
জীবনী শুধু একজন মানুষের কালানুক্রমিক সময়রেখা সাজায় না। সমরেশ দেখিয়েছেন, জীবনী কীভাবে যাপন করা পারস্পরিক আখ্যান। সমরেশের সব উপন্যাসেই এই পারস্পরিক সত্যতা প্রবল। আর এই সত্যতার মধ্যেই তিনি নিজের গল্প খুঁজে পেতেন। সমরেশের দীর্ঘ গবেষণা পর্বের বেশ কিছু বর্ণনা থেকে আমরা জানতে পারি যে রামকিঙ্করের জীবনাখ্যান শুধু তাঁর সঙ্গে একক আলাপচারিতায় উঠে আসেনি, বরং তা তৈরি হয়েছে একাধিক মানুষের সম্মিলিত বর্ণনায়, একাধিক দৃষ্টিকোণ থেকে। এইভাবে সমরেশ রামকিঙ্করের জীবন এবং জীবনীকে একমুখী পর্যবেক্ষণ থেকে মুক্ত করেছেন। সমরেশের গবেষণা ঐতিহাসিক পত্র-পত্রিকা, ফাইলে বাঁধা কাগজের মধ্যে সীমিত থাকেনি। তিনি রামকিঙ্করের জীবনকে বিভিন্ন মানুষের চোখ দিয়ে দেখেছেন এবং ডকুমেন্ট করেছেন— ছাত্রছাত্রী, সহকর্মী, বন্ধুবান্ধব, যাঁরা শিল্পীকে কাছের থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। শুনেছি এই সাক্ষাৎকারগুলো সমরেশ রেকর্ড করতেন, বিস্তারিত নোট নিতেন, যার বেশির ভাগটাই আজ হারিয়ে গেছে। আজ যদি কোনও মন্ত্রবলে আবার সেই ওরাল ডকুমেনটেশনগুলি খুঁজে পাওয়া যায়, তাহলে হয়তো খুব সহজেই স্থাপন করা যাবে যে মানুষের জীবন, যা জীবনী আকারে থেকে যায়, তা শুধুই ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ বা প্রাতিষ্ঠানিক নৈতিকতার মধ্যে আবদ্ধ নয়— আর এইভাবেও সাহিত্যের চেয়ে জীবন বড় হয়ে ওঠে।
শিল্প-ইতিহাস চর্চা করতে-করতে এবং একইসঙ্গে একজন আরকাইভিস্ট হিসেবে কাজ করতে গিয়ে টের পেয়েছি— সময়ের একাল ও সেকাল, জীবন ও জীবনী, ইতিহাস ও স্মৃতি— এই সংজ্ঞাগুলো একে অপরের পরিপূরক, প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। এই নৈকট্যই সমরেশের সাহিত্যের নৈবেদ্য। তাঁর রচনা করা বেশির ভাগ চরিত্রদের সাথে একরকমের ইনটিমেট স্পেস তৈরি করেন, যেখানে সাহিত্য, কল্পনা, বাস্তব সবটাই প্রকৃত বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে।

জীবনী আমাদের একটি জরুরি সত্য শেখায়— শিল্পীকে বোঝার জন্য তাঁর শিল্পই যথেষ্ট নয়; তাঁর জীবনের প্রেক্ষাপটটি জানা বরং তার চেয়েও বেশি প্রয়োজনীয়। কারণ শিল্পীকে তৈরি করে তার পরিবেশ, তার পরিস্থিতি, তাঁর মানসিক গ্রন্থি এবং তাঁর গোপন আকাঙ্ক্ষা। শিল্প কখনও শুদ্ধ বা সরল নয়; শিল্প সর্বদাই যতটা ব্যক্তিগত, ততটাই সর্বজনীন। সমরেশ ঠিক যেভাবে রামকিঙ্করকে অনুসন্ধান করেছেন, তাঁর জীবনের একাধিক টুকরো দিয়ে তাঁর জীবনী সাজিয়েছেন, আমরাও যখন সমরেশ বসু ডিজিটাল আর্কাইভ নির্মাণ করতে শুরু করি, তখন আমরাও প্রায়ে একইরকম নিরন্তর অনুসন্ধানের তাগিদেই, এবং মানুষ সমরেশকে যত্ন করে গুছিয়ে রাখার প্রয়োজন থেকে কাজে হাত দিই। আজকে লিখতে বসে সমরেশ বসুর জীবনকে খোঁজার এই পারস্পরিক দৃষ্টিকোণগুলির সূত্র কেবল একত্রিত করলাম, আমাদের অনুসন্ধানের বিস্তার ক্রমশ প্রকাশ্য।
সমরেশ বসুর জীবন একশো এক বছর পূর্ণ করল। এই সময়ে তাঁর সাহিত্যকে নতুনভাবে পড়া প্রয়োজন, কারণ ব্যক্তি সমরেশকে নতুন করে চেনা জরুরি। ছোটবেলায় তাঁর সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে তাঁকে খোঁজার চেষ্টা করেছিলাম। বড় হয়ে তাঁর জীবনের মধ্যে দিয়ে তাঁর সাহিত্যের নাগাল পেতে চেষ্টা করছি। ‘দেখি নাই ফিরে’ উপন্যাসকে সূত্র ধরে ভাবার চেষ্টা করেছি— সমরেশ তাঁর জীবনের শেষপ্রান্তে নতুন করে মাঠে নামলেন মানুষ রামকিঙ্করকে অনুসন্ধান করতে এবং তাঁর গল্পটা নিপুণভাবে গুছিয়ে রাখতে। এই প্রয়োজন তাঁর নিজেকে খোঁজার ব্যক্তিগত তাড়না থেকেই। ‘দেখি নাই ফিরে’ উপন্যাসটি তিনি আর শেষ করে যেতে পারেননি, তাঁর অক্লান্ত খুঁজে বেড়ানোর প্রক্রিয়া শেষ হয়েছিল কি না জানি না, কিন্তু সমরেশের জীবন-অনুসন্ধান অন্তহীন।
ছবি সৌজন্য: সমরেশ বসু ডিজিটাল আর্কাইভ




