বানানের বনিবনা

Representative Image

১৯৯৭ সালের ঘোর গ্রীষ্মের এক দুপুর— তখনও কলেজ স্ট্রিটে তপ্ত দুপুরে ট্রামলাইনের মাঝখানের পিচ গলে গিয়ে আমাদের স্যান্ডাক-চপ্পল রাস্তায় সেঁটে যেত। তেমনই গরমের দুপুরে কফি হাউসের দোতলার দোকান থেকে কিনে ফেললাম পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির ‘আকাদেমি বানান অভিধান’। আমার জীবনের প্রথম অভিধান নয়, তবে বানান অভিধান ওই প্রথম। কলেজে মাস্টারমশাইয়ের মুখে শুনে কিনেছিলাম, না কি ‘দেশ’ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে, তা আজ আর মনে নেই। তবে বইটি কিনে কাঁধের ঝোলায় ভরে কফি হাউসের একতলায় স্বপনের দোকানে একটা সিগারেট ধরিয়ে তুমুল রেলায় কলেজে ঢুকে, জনিদার ঘরের কাছে আধখাওয়া ক্যাপস্টান পায়ে দলে, পোর্টিকো পেরিয়ে লাইব্রেরির সামনের বেসিনে পা ঝুলিয়ে বসে বইটা খুললাম। প্রথম কী শব্দ দেখব ভেবে খুঁজতে গেলাম ‘শ্রীমতী’। বয়সের ধর্ম বলে একটা ব্যাপার আছে তো! কিন্তু সেই পাতায় গিয়ে আমার তো চোখ চড়কগাছ।


ততদিনে সুরমা ঘটকের বইয়ে সম্ভবত ঋত্বিকের লেখা চিঠিতে ওই শব্দটি ‘শ্রীমতি’ বানানে দেখে লিখেও ফেলেছি এক তরুণীকে। জানতামই না ওই বানানটা অমন হয় না। মুখটা কেমন বিস্বাদ হয়ে গেল। ঝোলায় বই ভরে দক্ষিণের লোকাল ট্রেন ধরে ঘরে ফিরে সে-রাতে অনেক উলটে-পালটে দেখলাম বইটা। প্রায় দুঃস্বপ্নের মতো বানানের ছড়াছড়ি— কখনও মনে হচ্ছে আমি ঠিক জানি, কখনও মনে হচ্ছে ভুল জানতাম— রোলার কোস্টার রাইডের মতো অভিজ্ঞতা। সবচেয়ে মুশকিল হল এটা বুঝতে পেরে যে, অভিধানে যুক্তির কোনও কাঠামোই খুঁজে পাচ্ছি না। অগত্যা তার কিছুদিন পর থেকে শরণ নিলাম আমার মাস্টারমশাই প্রশান্ত দাশগুপ্তের। প্রশান্তবাবু প্রাজ্ঞ মানুষ ছিলেন, আমার মনের মধ্যে প্রশ্নের তুবড়ি ফুটছে বুঝতে পেরে নিদান দিলেন রোজ একটি বা দুটি করে বানান প্রসঙ্গে আমার জিজ্ঞাস্য নিয়ে তাঁর কাছে যাওয়া যেতে পারে। এই ব্যবস্থা চলেছিল কয়েক মাস। তারপর আমার প্রাথমিক উত্তেজনাও স্তিমিত হয়ে এল, আর স্যারও ব্যস্ত হয়ে পড়লেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির বানান অভিধানের নতুন সংস্করণের কাজে।

আরও পড়ুন: পরীক্ষার খাতা দেখানো নিছক আনুষ্ঠানিকতা ছিল না বামনদেব চক্রবর্তীর কাছে! লিখছেন রূপক মিশ্র…

বাংলা আকাদেমির ‘বানান অভিধান’-এর প্রথম সংস্করণ তুমুল সংশোধনবাদী হলেও, কিছু ক্ষেত্রে ছিল নেহাতই ‘মজ্বিমপন্থী’। আমি যেমন তখন বুঝতে পারিনি কিছু-কিছু তৎসম শব্দের হ্রস্ব-দীর্ঘ স্বরচিহ্নের সমস্যা কাটাতে খামোখা কেন সংস্কৃত মূল শব্দটিকে দীর্ঘ স্বরান্ত বাংলা শব্দ ধরতে যাব। পরে অবিশ্যি এই সংকটমোচনে ব্যাখ্যাটা দিব্যি গৃহীত হয়ে গেল। প্রথম সংস্করণে সবচেয়ে তাক লাগানোর মতো মন্তব্য ছিল ‘বিদেশি শব্দ বিষয়ে, একটু পৃথক-ভাবে’ শীর্ষক অংশে। সেখানে লেখা হল— ‘st বর্ণগুচ্ছ বিশিষ্ট ইংরেজি শব্দে স্ট ব্যবহার করতে হবে’। কিন্তু তারপরেই নেমে এল আশ্চর্য এক সিদ্ধান্ত— ‘স্বাঙ্গীকৃত যেসব বিদেশি শব্দের উচ্চারণে ষ্ট হয় সেখানে এই বানান লেখা হোক: খ্রিষ্ট খ্রিষ্টান খ্রিষ্টাব্দ।’

দ্বিতীয় সংস্করণে বই আরও বড় হল। আরও বিদগ্ধ মানুষ যোগ দিলেন এই উদ্যোগে। ‘মুখবন্ধ’ অংশে বানানের নতুন নীতির প্রয়োজন কেন এবং কেন এই সিদ্ধান্তকে কর্তৃত্ববাদী বলা যাবে না, সে-কথাও বলা হল। হ্যাঁ, গ্রামশির ‘হেজিমনি’র কথাও আলটপকা এসেছিল সেখানে।

তবে আমরা জানলাম, বাংলা বানানে একটা নৈরাজ্যের ময়দান আছে। যেখানে কেউ কারুর কথা মানতে চায় না। এখন মনে হচ্ছে, বানানের একুশে আইনের চাইতে নৈরাজ্য নেহাত খারাপ নয়। বিশেষ করে পথেঘাটে নিরন্তর যখন শুনি আজকাল তো বাংলা বানানের কোনও মাথামুন্ডু নেই। যাঁরা বলেন, তাঁরা সকলেই যে বানান নিয়ে খুব ভাবিত এমন তো নয়! কিন্তু মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি গুরুত্বপূর্ণ অনেক ক্ষেত্রেই। বাংলা বানান নিয়ে যে বিরাট একটা বিপ্লব ঘটছে— সেটা বাংলা আকাদেমির ‘বানান অভিধান’ সে-সময়ে দিব্যি আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছিল।

তারপর দিন যায়, আমরা ভুল বানান লিখি, ছাপি— ঠিক বানানও লিখি। এমন সময়ে, ২০০১-এর ডিসেম্বর মাসে তৃতীয় সংস্করণ এল হাতে। সেখানে ভূমিকার প্রথম পাতাতেই লেখা হল— ‘আকাদেমির বানান-সমিতির সুপারিশ করা যে-বানানবিধি তার নতুন সংস্করণে কিছু কিছু সিদ্ধান্তের বদল ঘটেছে। তাতে পুরোনো বানান বর্জন করে এই নতুন বানানগুলি গৃহীত হয়েছে খ্রিস্ট, খ্রিস্টাব্দ, মাস্টার (আগে ষ্ট ছিল), ভাণ্ডার (আগে ন্ড ছিল), শানিত (আগে ণ ছিল), বন্দি, বন্দিনি (আগে বন্দী, বন্দিনী ছিল), দায়ী (responsible অর্থে-ও), ব্যাবহারিক, ব্যাবসায়িক (য-ফলায় আকার ছিল না)। কাহিনি-র এই বানানই এখন গ্রহণ করেছি, কারণ এটি তৎসম শব্দ নয়। এ ছাড়া ণ ও ন-এর বিষয়ে আমাদের বানানবিধির সূত্রে সামান্য সংযোজনের বিষয়টিও লক্ষণীয়।’

হা হতোস্মি! মাঝখানে যে চার-চারটে বছর কেটে গেল! নিজের মাথা থেকে কর্তামশাইয়ের ভূত তাড়াব কী করে। এতদিন নতুন শেখা ওইসব বানান হুবহু মেনে চলার চেষ্টা করে গেলাম যে! যেসব ছাত্রছাত্রীদের বাড়ি টিউশনি পড়াতে যেতাম তাদেরও শিখিয়েছি ওইসব বানান। অভিধান লোকে কেন কেনে? গবেষণা করার জন্যই শুধু, না কি চটজলদি দেখে নেওয়ার জন্যও! চটজলদি দেখে নিতে চান যাঁরা, তাঁরা হয়তো আগের কোনও একটা সংস্করণ কিনেছিলেন— এখন তাঁদের কী হবে? আর সরকারি প্রতিষ্ঠানের বানানবিধি যখন, তখন ইশকুলের কচি-কাঁচাদের অবস্থাটা কেমন দাঁড়াবে? প্রশ্নগুলো সহজ, কিন্তু উত্তর জানা নেই।

সর্বোপরি তৃতীয় সংস্করণের ভূমিকায় এটাও লেখা হল— ‘আশা করি আগের সংস্করণগুলোর মতো এটিও ‘প্রবল জনসমর্থন’ পাবে।’ তাই বলে ভাবা ঠিক হবে না যে এমন জন-মুখাপেক্ষী বানানবিধি এই প্রথম বাংলায় হল। মণীন্দ্রকুমারকে ঘোষকে লেখা ৫ জুলাই ১৯৩৩ সালের চিঠিতে রাজশেখর বসুও এরকম একটা আশ্চর্য পরমুখাপেক্ষী বিষয়ের উল্লেখ করেছেন। রাজশেখর লিখছেন— ‘… চলন্তিকা আরম্ভ করিবার পূর্ব্বে আমি বানানের পদ্ধতি নিরূপণের চেষ্টা করিয়াছিলাম। আমার উপায় এই।— কতকগুলি বাংলা শব্দের একটা ফৰ্দ্দ তৈয়ার করি। প্রায় চল্লিশ জন সুশিক্ষিত প্রবীণ ও নবীন লেখকের সহিত একে একে দেখা করি। আমি ফন্দ হইতে এক-একটি শব্দ পড়ি এবং শ্রোতাকে তাহা বানান করিতে বলি। প্রথমেই সতর্ক করিয়া দিয়াছিলাম— সঙ্গতি-অসঙ্গতির বিচার না করিয়া যে বানান মনে আসিবে তৎক্ষণাৎ বলিতে হইবে। আমার উদ্দেশ্য— লেখকের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি নির্দ্ধারণ এবং যে বানান অধিকতম ভোট পায় তাহা অবলম্বন করিয়া বানানের সাধারণ সূত্র গঠন। এই পরীক্ষার ফলে অনেক বানানের সামঞ্জস্য পাইয়াছিলাম, যথা ই-কারান্ত ও ঈ-কারান্ত শব্দের। কিন্তু কতকগুলি শব্দে, বিশেষতঃ যাহার মূল সংস্কৃত শব্দে ঊ বাণ আছে, এত অসামঞ্জস্য দেখা গেল যে ভোট দ্বারা সূত্র নির্ণয় সম্ভব হইল না। অগত্যা রবীন্দ্রনাথ ও যোগেশচন্দ্রের মত লইলাম।…’

বাংলা বানান সংস্কারের কাজের খতিয়ান নিতে গেলে কিন্তু অনেকদূর যেতে হবে। অন্ততপক্ষে ১৯২৫-এ প্রশান্তচন্দ্র মহালনবিশের সুপারিশ, ১৯৩৬-এ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানানরীতি। এদিকে পরের দিকে বাংলা সংবাদপত্র গোষ্ঠীগুলিরও কেউ-কেউ নিজেদের জন্য বিশেষ বানানবিধি চালু করেছে, বাংলা প্রকাশনায় ‘হাউস অফ ডিকশনারিজ’ বলে বিখ্যাত সাহিত্য সংসদ-ও একটি বানানবিধি তৈরি করেছেন। বাংলাদেশই বা এই মহতী কর্মযজ্ঞে পিছিয়ে থাকবে কেন? জামিল চৌধুরী তাঁর ‘শব্দসংকেত’ অভিধানের ভূমিকায় লিখেছেন— ‘বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের উদ্যোগে ৬-৮ কার্তিক ১৩৯৫ তারিখে (১৯৮৮ ইং) কুমিল্লায় অনুষ্ঠিত সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার পটভূমিতে পাঠ্যপুস্তকে বাংলা বানানের সমতাবিধানবিষয়ক জাতীয় কর্মশিবির এ প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তকে বাংলা বানানের একটি পূর্ণাঙ্গ সুপারিশমালা গৃহীত হয় এবং তার উপর ভিত্তি করে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ও অন্যান্যদের সম্পাদনায় একটি নির্দেশিকা প্রণীত হয়। এর পর ১৯৯২-এ ঢাকার বাংলা একাডেমিও প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম (১৯৯৮-এ পরিমার্জিত এবং ২০০০-এ পুনরায় সংশোধিত) প্রকাশ করে।’

পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির ‘আকাদেমি বানান অভিধান’ অনেকদিন বাজারে লভ্য নয়। ইদানীং যতরকমের বানানবিধি আছে, তার মধ্যে আমরা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করি সাহিত্য সংসদের ‘সংসদ বানান অভিধান’। আমার হাতের কাছে বইটির তৃতীয় সংস্করণটি (২০০৯) আছে— তাতে দুটি বানানের দিকে নজর দিতে চাইব— প্রথমটি হল ‘আঁতাত’ এবং দ্বিতীয়টি ‘বিদ্রূপ’। কিন্তু কী আশ্চর্য, ওই একই সংস্থার ২০০০ সালের পঞ্চম সংস্করণ ‘সংসদ বাংলা অভিধান’-এ শব্দ দুটি ছাপা আছে— ‘আঁতাঁত’ এবং ‘বিদ্রুপ’। আমি ২০১৮-র পঞ্চবিংশতিতম ‘মুদ্রণ’ দেখছি, তবে ২০০০-এর পর আর কোনও সংস্করণের উল্লেখ নেই প্রিন্টার্স লাইনে।

কিছুদিন আগে ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র ব্যবহারবিধি ‘কী লিখবেন কেন লিখবেন’ বইটির (১৯৯৬-এর দ্বিতীয় সংস্করণের ২০০০ সালের দ্বিতীয় মুদ্রণ) ‘প্রতিবর্ণীকরণ/লিপ্যন্তর’ অংশটায় চোখ বোলাতে গিয়ে দেখলাম সেখানে সংগত কারণেই মূলের উচ্চারণ যথাসম্ভব রক্ষা করাটাই প্রধান বিবেচ্য হয়েছে। সেক্ষেত্রে সংকটকালে ‘ধীরে চলো’ নীতি অবলম্বনের পরামর্শও দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছে ইংরেজি ভিন্ন বিদেশি ভাষার ব্যক্তি ও স্থাননামের ক্ষেত্রে— ‘ইংরেজি ভাষায় সে-সব নামের যে-উচ্চারণ আমরা পাই, বাংলা প্রতিবর্ণীকরণের সময়েও সেই উচ্চারণই আমরা অনুসরণ করব।’ আবার দক্ষিণ ভারতীয় ভাষার জন্য পৃথক একটি টোটকা বাতলে দেওয়া হয়েছিল— ‘দক্ষিণ-ভারতীয় স্থান-নাম ও ব্যক্তি-নামের প্রতিবর্ণীকরণের সময় অল্পবিস্তর অসুবিধা দেখা দেওয়া স্বাভাবিক; সে-ক্ষেত্রে সমস্যার নিরাকরণের জন্য দক্ষিণ-ভারতীয় সহকর্মীদের সাহায্য গ্রহণ সংগত হবে।’

উদাহরণ আরও বাড়তেই পারে কিন্তু আমাদের লক্ষ্য শুধু অসংগতি দেখানো নয়। বরং এটা বোঝার মানসিকতা তৈরি করা যে, অসংগতি থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এমনকী, যেসব উদাহরণ দেখানো হচ্ছে, তা হয়তো ইতোমধ্যেই সংশোধিত হয়েছে।

তবে মানুষ ভরসা করবে কীসে? আমার সংগ্রহের সংস্করণগুলো কেবল ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে বেঁচে থাকবে? আবারও বলতে হয়, প্রশ্নটা সহজ কিন্তু উত্তরটা অজানা।

বানানবিধি তৈরি করে দেওয়ার মধ্যে একটা কর্তৃত্ববাদ আছে তো বটেই। কেননা ভাষার সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক কেবলমাত্র কাজের নয়, মনস্তাত্ত্বিকও বটে। আমার এক শিক্ষক যেমন কয়েকটি অযৌক্তিক (আমার বিবেচনায়) বানান ইচ্ছে করে রাখেন ‘হরফ সৌন্দর্য’-র কথা বলে। আবার কিছু-কিছু শব্দের বানান নিয়ে অশেষ তর্ক চলতে পারে। কিন্তু আপনি ‘হল’ লিখবেন না ‘হলো’, ‘ক্ষেত’ লিখবেন না ‘খেত’— তা যদি আপনাকে চিন্তিত না করে, তাহলে আর বানান নিয়ে ভেবে লাভ নেই। আমার আরেকজন শিক্ষক অজয় গুপ্ত যেমন আমাকে লিখে জানিয়েছিলেন ‘আনত’ শব্দটাকে ‘আনত’ আর ‘আনতো’ দু’ক্ষেত্রে দু’রকম করে লিখলে কতটা সুবিধে। ‘কমল’ আর ‘কমলো’ শব্দদুটোকেও আলাদা করার পক্ষপাতী তিনি। আমি দেখেছি তাঁর ‘সংসদ বানান অভিধান’-এর ব্যক্তিগত সংযোজনের পাতায় এমন একটা তালিকা করা আছে।

বানানবিধি তৈরি করে দেওয়ার মধ্যে একটা কর্তৃত্ববাদ আছে তো বটেই। কেননা ভাষার সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক কেবলমাত্র কাজের নয়, মনস্তাত্ত্বিকও বটে। আমার এক শিক্ষক যেমন কয়েকটি অযৌক্তিক (আমার বিবেচনায়) বানান ইচ্ছে করে রাখেন ‘হরফ সৌন্দর্য’-র কথা বলে। আবার কিছু-কিছু শব্দের বানান নিয়ে অশেষ তর্ক চলতে পারে। কিন্তু আপনি ‘হল’ লিখবেন না ‘হলো’, ‘ক্ষেত’ লিখবেন না ‘খেত’— তা যদি আপনাকে চিন্তিত না করে, তাহলে আর বানান নিয়ে ভেবে লাভ নেই।

আমার ধারণা ভাষাকে যেমন বেড়া দেওয়া যায় না, একেবারে আকাঁড়া ভুল না হলে বানান নিয়েও তেমনই জুলুম চলে না। আবার অনেক সময়ে ভুল বানান যে গ্রাহ্যও হয়ে যায়, তা তো দুর্গাপুজোর সময়ে ‘সর্বজনীন’ আর ‘সার্বজনীন’ লেখা ব্যানার দেখে নিশ্চয় মালুম হয়েছে। ভাষার চেহারা যেমন আছে, তেমন মনও আছে। আর ভাষা ব্যবহারকারীর স্বাধীনতাও আছে। দেবেশ রায় একটা সভায় বলেছিলেন, ‘আমার মাতৃভাষা যদি আমায় বিকল্প বানান ব্যবহারের সুযোগ দেয়। তাহলে আমি তা নেব না কেন?’ কথাটায় আমি সহমত। কিন্তু এখানেও একটা বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ থাকা দরকার— একটা গোটা লেখাকে বা একটা আস্ত বইকে যেন রকমারি বিকল্প বানানে ভরিয়ে না ফেলি আমরা। তাহলে সে আবার বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড হবে।