‘এই বুড়ো গাছের পাতায় পাতায়, সবুজ কিন্তু আজও মাতায়, সুঠাম ডালে’
গাছ বলতে খুব স্যাঁতস্যাঁতে সবুজ মানুষ। বৃষ্টি কমে গেলে কাছে দাঁড়ালে ওপর থেকে টুপটাপ। গায়ে নিই। একটা গন্ধ, সবুজ গন্ধ।
লিও মেসির জন্মদিন নিয়ে বলতে গেলে ওই গাছটার কথা মনে পড়ে। ছেলেটার লা মাসিয়া, বামন অবতার, কাটানোর ভেতর, পড়ে যাওয়ার ভেতর, উঠে দাঁড়ানোর ভেতর মাতাল বাঁশি বাঁশি আর বাঁশি, আঃ, শুধু ওই গাছটার কথা মনে পড়ে। বৃষ্টি থেমে গেলে দাঁড়াব। বৃষ্টি পড়লে, আর খুব কড়কড় মেঘ করলে সরে আসব, যদি আগুন জ্বলে, যদি গাছ-মানুষ-সবুজ প্যাগান কৃষ্টির মতো আত্মহননে মেতে যায়, এই বয়সে, এই মধ্য-চল্লিশে সেই ফুটবল, সেই আগুন, সেই দহন নিতে পারব না আর। আর তাছাড়া উঠতেবসতে কোমরে খুব কষ্ট হয়, বুকটা সামান্য নড়ে ওঠে, অটোর খোঁচা খাওয়া ব্যান্ডেড-কপাল আর স্যাঁতস্যাঁতে কাদাজল পেরিয়ে দেখি এক ভিখিরি তরুণ রাস্তায় বিস্কুট কুড়িয়ে পেয়ে খেতে গিয়েও দিয়ে ফেলে ওর ফ্রক-ইজেরের ছোট বোনটাকে।
আরও পড়ুন : লিভারপুলের জয় যেভাবে হয়ে ওঠে শ্রমিক ঐক্যর স্মারক!
লিখছেন শ্রুতায়ু ভট্টাচার্য…
রিভার্স ক্রনোলজিতে ন্যু ক্যাম্পে সেল্টা ডি ভিগো ম্যাচ। পেনাল্টিটা না মেরে পাশে দাঁড়ানো লুই সুয়ারেজকে মারতে দেয় লিও মেসি। সুয়ারেজ জালে ঢোকায়। দিনটা ক্যালেন্ডারে ফেব্রুয়ারির চোদ্দ তারিখ হয়ে হার্ট সাইনের মতো সাইনু অরিকুলার নোড হয়ে যায়।
মনে হয়, যতই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ আসুক, লিও-স্মৃতি ভালবাসা শব্দটাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোবে। প্যারালাল ইউনিভার্সে আয়লান কুর্দি ঘুম থেকে জেগে উঠে সেই শব্দকেই খেলনার বল ভেবে সমুদ্র থেকে দূরে গিয়ে জোরসে মারবে, উদ্বাস্তু শিবির থেকে ছিটকে আসবে আরও কয়েকটা কাউন্টার বল। লুই সুয়ারেজ সতীর্থকে জড়িয়ে ধরে বলবে— থ্যাঙ্কস, থ্যাঙ্কস মেট…
জন্মদিনে কী এসে যায়? একটা গোলাপি ড্রেসে দুটো ফ্রিকিকের উল্লাস, সামনে ছাব্বিশ ছাব্বিশ ছাব্বিশ, বাইশের লেট ডিসেম্বরের শান্তি পারাবার, তারপর মৃত্যুচেতনার আক্ষরিক পায়ের শব্দ— কোনটা আগে আসবে, কোনটা পরে? লিও মেসি এর মধ্যে যদি খেলা ছেড়ে দেয়, যদি শেষ ম্যাচটা দেখার আগেই একটা ছোট্ট বাক্সের ভেতর শেষ ইচ্ছেয় দফন হই, পুড়িয়ো না, পুড়িয়ো না, আমায় যেন পুড়িয়ো না, তারপর চুল্লির ভেতরে জোর করে শরীরটাকে ঠেসে দেবে একটা সাদা-নীল জার্সির কালো একহারা ছেলে, জার্সির পেছনে ‘মেসি’— ডানদিকে চুল্লির দেওয়ালে ‘মৃতের সঙ্গে দু-জনের বেশি ঢুকবেন না’।
আমার এইসব কল্পিত, নিশ্চিত না থাকার মাঝে লিও মেসির জন্মদিন কোথায়?

ওই যে, লুই এনরিকের পাশে দাঁড়িয়ে জানা পতাকাটা পুঁতছে, অ্যানে সেক্সটনের কবিতায় ‘মৃত্যু এক বিষণ্ণ হাড়’, হাড়ে কর্কটের ভেতর বছর নয়ের জানা, চলে যাওয়ার দিন লিও মেসির চোখে বর্ণহীন কী যেন একটা তরল, ড্রপলেট, টিটো ভিলানোভা হয়ে ২৫ নভেম্বরে দিয়েগোর ডিভান পর্যন্ত গিয়ে ফিরে এসে গ্র্যান্ডমা সেলিয়ার পালকের বিছানায়। মেক্সিকো ম্যাচে গোলের পর পাবলো আইমার ওই একই তরল গলায় মাখেন, ঠোঁটে মাখেন, পাশে দাঁড়ানো স্যার স্কালোনি শীতলতায় দীক্ষা নেন, শান্ত হতে হবে, আমাদের আরও শান্ত হতে হবে। নাথান একে-র দু-পায়ের ফাঁক দিয়ে নাহুয়েল মলিনার দিকে বাড়ানো অশ্রুরেখা ড্রোন শটে রোজারিও নদীর মতো লাগে। সময় এগয়। মন্টিয়েল শেষ শটটা মারতে যায়। পিটার ড্রুরি বলেন, ‘দ্য লোনলি ওয়াক’। লিও মেসি বলে— গ্র্যান্ডমা, এই দিনটা আমার হতে পারে। স্যাঁতস্যাঁতে জুনের কলকাতার লোকাল ট্রেনে নামতে গিয়ে পিছলে পড়তে পড়তেও কোনওমতে সামলে ওঠা তরুণ লজেন্সওলা জাদুবাস্তবের মতো হাসে, হুগো লরিসের ডানদিক দিয়ে বল জালে ঢোকে, লিও মেসি হাত ছড়িয়ে কাঁদে। লিয়ান্দ্রো পারাদেস জড়িয়ে ধরে বলে— ‘উই ডিড ইট, উই ডিড ইট মেট …’

একটা নীল জার্সিতে ট্রফির খুব কাছ দিয়ে হেঁটে যাওয়া লিও মেসি আমার কাছে পূর্ণতা পায়। ট্রফিটা, বিশ্বাসটা, টিকে থাকাটা আমার, একান্ত আমার মনে হয়। একুশ আসে। বাইশ আসে। কোথা থেকে কী হইয়া যায়, জামায় তিনটে তারা তিন জন্মের আলো পাঠায়, সেই আলোর সিঁড়িতে উঠতে উঠতে আরও সিঁড়ি, আরও সিঁড়ির পর আচমকা ক্রনিকলস অফ নার্নিয়ার ওয়ারড্রব— কেউ নেই, কিছু নেই, শুধু কিছু মৃত বল পড়ে আছে। একটা খেলা। দ্য মোস্ট বিউটিফুল গেম। ১৯৩৭, ক্রিসমাস। চেলসি ভার্সেস চার্লটন অ্যাথলেটিক ম্যাচ। গোলকিপার স্যাম বারট্রাম কুয়াশার মাঠে বাকি সঙ্গীদের জন্য অপেক্ষা করতে করতে একটা সময়ে দেখছে মাঠে সে একা। হুইসল নেই, সেলিব্রেশন নেই, শুধু কুয়াশা। কীভাবে কেউ ভুলে যেতে পারে, আমাকে, দ্য লাস্ট গার্ডকে? উরুগুয়ের ন্যাশনাল, ১৯১৮। আব্দন পোর্তে বাদ পড়ার পরের ম্যাচে চুটিয়ে খেলেন। সেলিব্রেশন। শেষ ট্রামে ক্লাব থেকে ফেরেন রাত একটার একা একটা হন্টিং গ্রান্দ পার্ক সেন্ট্রালে। তারপর মাথায় রিভলভার চালিয়ে বলেন, ‘বাস্টার্ড, টেক মি ইন ইওর টিম’।
লুই এনরিকের পাশে দাঁড়িয়ে জানা পতাকাটা পুঁতছে, অ্যানে সেক্সটনের কবিতায় ‘মৃত্যু এক বিষণ্ণ হাড়’, হাড়ে কর্কটের ভেতর বছর নয়ের জানা, চলে যাওয়ার দিন লিও মেসির চোখে বর্ণহীন কী যেন একটা তরল, ড্রপলেট, টিটো ভিলানোভা হয়ে ২৫ নভেম্বরে দিয়েগোর ডিভান পর্যন্ত গিয়ে ফিরে এসে গ্র্যান্ডমা সেলিয়ার পালকের বিছানায়। মেক্সিকো ম্যাচে গোলের পর পাবলো আইমার ওই একই তরল গলায় মাখেন, ঠোঁটে মাখেন, পাশে দাঁড়ানো স্যার স্কালোনি শীতলতায় দীক্ষা নেন, শান্ত হতে হবে, আমাদের আরও শান্ত হতে হবে।
এইসব গল্প লিও মেসি জানে না। লিও জানে, ওর পাশে সারাক্ষণ একটা লম্বা রোগা ছেলে, একটা অ্যাঞ্জেল কয়লা, উনুন আর মা’র সঙ্গে আপ-হিল সাইকেল ফেরত প্র্যাক্টিসের মেলানকোলিক স্মৃতি নিয়ে সলিলোকি করে, বারবার সলিলোকি করে— ‘ইন দ্য রেইন, ইন দ্য কোল্ড, ইন দ্য ডার্ক’। বলে, ট্রফিটা নিজের জন্য নয়, ওই দশ নম্বরকে দেব বলে লড়ছি। তারপর, তরুণ আলভারেজ, হারকিউলিস ম্যাকালিস্টার হয়ে একটা ম্যাজিক টাচ, পিটার ড্রুরি বলেন ‘ডিলাইটফুল’, সামনে স্রেফ ডেস্টিনি, হুগো লরিস আর ছেঁড়া জাল। তারপর, ২৪ জুন, ফেটেড ২৪ জুন ২০০৭-এর কোপায় মেক্সিকো ম্যাচের চিপ গোল মনে করাল, মনে করাল অসম্ভব খিটখিটে একটা মুখ, লিও মেসির আঠারো নম্বরের জার্সির পাশে উদ্ধত দশ নম্বর পরে মাঠ কাঁপানোর টাইম-স্পেস।
ট্রফি, কী অসম্ভব একটা ট্রফি ডিজার্ভ করত লোকটা! পেল না। বাদ গেল। গ্যালারিতে বসল। দল আলাদা হল। লিও মেসিকে খেলতে দেখলেন ডাইনিংয়ের টিভি সেটে। ‘আমায় ছেড়ে বুড়ো হলেন আমার সুজন’। কিচ্ছুটি না পেয়ে, জাস্ট কিছুই না পেয়ে গঞ্জালো মন্টিয়েলের শেষ শটের পর, চুয়াল্লিশ ছুঁয়ে জাপ্টে ধরল লিওকে। কেঁপে উঠল সাদা-নীলের ভেতর গর্বিত সান অফ মে। কেঁপে উঠল অ্যালবিসেলেস্তে।
উত্তরসূরির কাঁধে হাত রেখে, একটা আর্জেন্টাইন কুইলমাস বিয়ার খেতে খেতে বলল, ‘হ্যাপি বার্থডে মেট’। লিও মেসি বলল, ‘সেম টু ইউ, হুয়ান…’