গানের রামকিঙ্কর

Representative Image

শান্তিদেব ঘোষের প্রয়াণ ১৯৯৯ সালের ১ ডিসেম্বর। আর আমি বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে অধ্যাপনার কাজে যোগ দিয়েছি ১৯৯৯ সালে। সেদিক থেকে দেখলে, শান্তিদেবের সঙ্গে ইহজগতে আমার যোগাযোগ হতেই পারত। কিন্তু তা যে হয়নি, সেটা আজ আর আমার কাছে বড় কথা নয়। কারণ জীবনের একটা সময়ে আমি তাঁকে গভীরভাবে পেয়েছি। মানে, বাইরের জগতে চেনা-পরিচয় বলতে যা বোঝায়, তার থেকে আলাদা করে। এবং সেটা সম্ভব হয়েছে, রবীন্দ্রনাথের গান সম্পর্কে আমার এক ধরনের অতৃপ্তির জন্য।


ছোট বয়স থেকে কিছু মানুষের মতো আমিও অনেকের গানের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গান যত্ন করেই গেয়েছি, শুনেছি। কিন্তু একটা সময়ে যখন ভাবছি, রবীন্দ্রনাথের গান ঠিক কেমন হবে বা কেমন হওয়া উচিত, অনেকটা যেন তখনই, তা পেলাম শান্তিদেবের কাছে। এবং এই প্রথম, রবীন্দ্রগান স্পর্শ করে দেখলাম; হাত দিয়ে ছুঁয়ে-ছুঁয়ে দেখা যাকে বলে। আসলে শান্তিদেব তো গান করতেন না, গানের মূর্তি গড়তেন। সেদিক থেকে যতটা-না গায়ক, তার থেকেও বলা চলে কারিগর। গান গাওয়া যে একটা ভাস্কর্য বা স্থাপত্য নির্মাণ, সেটা ওঁকে শুনলে বেশ বোঝা যায়। সেখানে উঁচু-নীচু, খোঁচ-খাঁজ, সোজা-বাঁকা কত কী স্পষ্ট। আর এই নির্মাণের মধ্যে রয়েছে একটা অসম্ভব গতিময়তা, ইংরেজিতে বললে ‘ডায়নামিজম’। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘সংগীত ভাবকে গতিদান করে।’ কথার মধ্যে যে-ভাব, সেই ভাবকে গতি দিতে গেলে, গানের কথার ভেতরে গানের সংগীতকেও জোরালোভাবে এবং সঠিকভাবে ধরতে হবে। এটা শান্তিদেব চমৎকার পারতেন। গানের একটা লাইনের কোথায় কতটা ধাক্কা দিলে লাইনটা কতদূর এগোবে, সেটা দারুণ বুঝতেন। আর সেটাই ওঁর গাওয়ার মধ্যে একটা গতি এবং একটা শক্তি সঞ্চার করে। আমরা অনেকেই গানের কথাটা গাই। কিন্তু শান্তিদেব গানের কথা এবং সংগীত একসঙ্গে দুটোই গাইতে পারতেন; যেটা অনেকটাই রবীন্দ্রনাথের গাওয়ার সঙ্গে মেলে। এবং সেটা এতটাই যে, শান্তিদেবের গাওয়া কোনও সময়ে রবীন্দ্রনাথের গাওয়া বলে ভুল হতেই পারে।

আরও পড়ুন: ধর্মীয় অনুষঙ্গ থেকে মুক্ত করে, শান্তিনিকেতনের উৎসবকে নান্দনিক উৎকর্ষে পৌঁছে দিয়েছিলেন ক্ষিতিমোহন সেন লিখছেন। মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়…


তবে এঁদের গাওয়ায় পুরনো দিনের গায়কির কিছু মুদ্রা বা ‘ম্যানারিজম’ও হয়তো আছে। রবীন্দ্রনাথের গানের গোড়ার চেহারা বুঝতে গেলে, সেগুলো বাদ দেওয়া যাবে না। সত্যি বলতে এখন, বেশ পরিষ্কার বুঝতে পারি যে, উনিশ শতকের বাংলা গানের হালচাল ধরতে না পারলে, রবীন্দ্রনাথের গানের চেহারা-চরিত্রটা ধরতে পারা মুশকিল। রবীন্দ্রনাথ সেকালের গানের সঙ্গে কতটা লগ্ন রইলেন, কোথায়ই-বা সরতে চাইলেন, কী গান তৈরি করলেন, সেটা বোঝার বিষয়। এবং মনে হয়, শান্তিদেব বিষয়টা ভালই বুঝেছিলেন। শুধু তাঁর গান শুনে নয়, গান নিয়ে তাঁর লেখা পড়েও তা মনে হয়েছে। এবং এভাবেই রবীন্দ্রনাথের গান তিনি যেমন দেখতে পেয়েছেন, সেটা গেয়ে আমাদের দেখাতেও পেরেছেন।

শান্তিদেব ঘোষ

আরেকটা বিষয় হল, শিল্পসংগীতে ‘ক্রুড এলিমেন্ট’ বা মোটা ধরনের উপাদান যেটা। পুরনো দিনের অনেকের গানেই এটা যেমন রয়েছে, শান্তিদেবের গাওয়াতেও আছে। তাঁর গাওয়াতে আমাদের মাটিঘেঁষা গানবাজনা থেকেও তা কিছুটা এসে থাকতে পারে। এবং সেদিক থেকে তাঁর গাওয়া পরবর্তীদের মতো অত মসৃণ নয়, হয়তো সকলের কাছে ততটা গ্রহণযোগ্যও নয়। কিন্তু শিল্পে এই উপাদানের গুরুত্ব তো অস্বীকার করা যাবে না! পণ্ডিত রবিশঙ্কর একবার তাঁর শিষ্যপ্রতিম তেজেন্দ্রনারায়ণকে দিয়ে একটা কাজ করাতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘তোমরা এখন খুব ভাল বাজাও, কিন্তু পুরনো দিনের লোকেরা তো এত ভাল বাজাতেন না।’ এই ভাল বাজানো বা না-বাজানো কথাটার ভেতরে যেটা নিহিত, তা হল ওই ‘ক্রুড এলিমেন্ট’ থাকা বা না-থাকা।


এইভাবে শান্তিদেব রবীন্দ্রনাথের গানের যে-চেহারাটা রূপ দিলেন, রবীন্দ্রসংগীতের জগতে তা একেবারেই আলাদা; যদিও রবীন্দ্রনাথের গাওয়া থেকে তা খুব দূরে নয়। বিশেষ করে, ওই যে রবীন্দ্রনাথের গানে কথার পাশে সংগীতের দিকটা, সেটা আর কেউ শান্তিদেবের মতো গানের ভেতর থেকে নিংড়ে আনতে পারলেন কি? এমনকী তার গাওয়ার ভেতরে যাবতীয় যে-নাটক, তাও কিন্তু উঠে আসছে ওই সংগীত থেকেই। সুরের গভীরে যে-নাটক থাকে, শুধু সেটাই তিনি সহজভাবে তুলে এনেছেন মাত্র। কোথাও কথার ওপরে আলাদা করে কোনো নাটক চাপাননি।

আসলে শান্তিদেব রবীন্দ্রসংগীতকে শুধু রবীন্দ্রসংগীত হিসেবে দেখেননি, দেখেছেন সংগীতের একটা সমগ্রতার জায়গা থেকে। রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে তাঁর আলোচনায় যতটা সংগীত পেয়েছি, আর খুব বেশি কারো লেখায় পেয়েছি বলে মনে করতে পারি না। আমাদের আলোচনায় রবীন্দ্রনাথের গান মানে প্রায় সবটাই রবীন্দ্রনাথের গানের কথা। আর ওই সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখতে পেরেছেন বলেই রবীন্দ্রগানের যন্ত্রানুষঙ্গের প্রশ্নে তিনি যেমন খোলামেলা, তেমনি রাবীন্দ্রিকতার প্রশ্নেও। একালে যাঁরা প্রচলিত ছকের বাইরে রবীন্দ্রনাথের গানকে আনতে চাইছেন, ওঁর গাওয়ার ভেতরে— ভাবনার ভেতরে তাঁরা অনেক রাস্তা পাবেন হয়তো।

শান্তিদেব ঘোষ


তবে শান্তিদেবের গাওয়ার কথা তুললেই একটা জিনিস লক্ষ করেছি, অনেকেই ‘শান্তিদা তো নাচ করতেন’ বা ‘শান্তিদা বাউলাঙ্গের গানই ভাল গাইতেন’ বলে— পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চান। কিন্তু এটুকু ওঁর সম্পর্কে কোনও মূল্যায়ন নয়। ওঁর গানের রস পেতে হলে, আমাদের অনেককেই হয়তো গান শোনার যে অভ্যস্ত কান, সেটা একটু বদলাতে হবে, গান শোনার প্রচলিত সংস্কার থেকে একটু সরে আসতে হবে বা নিজেকে একটু প্রস্তুত করতে হবে। অবশ্য অনেককে খুব সরাসরিও ওঁর গানে ঢুকে যেতে দেখেছি।

শান্তিদেব রবীন্দ্রনাথের গানের যে-চেহারাটা রূপ দিলেন, রবীন্দ্রসংগীতের জগতে তা একেবারেই আলাদা; যদিও রবীন্দ্রনাথের গাওয়া থেকে তা খুব দূরে নয়। বিশেষ করে, ওই যে রবীন্দ্রনাথের গানে কথার পাশে সংগীতের দিকটা, সেটা আর কেউ শান্তিদেবের মতো গানের ভেতর থেকে নিংড়ে আনতে পারলেন কি?

ছোট বয়সে বেতারে ওঁর গলায় ‘আলো আমার আলো ওগো’ যখন শুনেছি— হয়তো ওঁর গান সেটাই প্রথম শোনা— এখন বলতে লজ্জা লাগে, একটু কেমন কেমনই যেন লেগেছিল। তবে বাবা যে প্রায়ই ওঁর মতো করে ‘না রে না রে ভয় করব না’ গেয়ে শোনাতেন, তা কিন্তু খারাপ লাগত না। সেখান থেকেই বোধহয় ওঁর গাওয়ার দিকে আমার নজরটা ঘুরেছিল। এমনকী ওই ‘আলো আমার আলো ওগো’ শোনার স্মৃতিও কিন্তু কোনওদিন আমার পিছু ছাড়েনি। এখন রেকর্ডে সেই গান শুনলে বুঝতে পারি, ওই ডায়নামিজম কাকে বলে।

আর এভাবেই পরে ওঁর গাওয়ার সঙ্গে, ভাবনার সঙ্গে যত ঘনিষ্ঠ হয়েছি, ততই রবীন্দ্রনাথের গানের অবয়ব— গানের ভাস্কর্য আমার চোখের সামনে ফুটে উঠেছে। এবং এই ঘনিষ্ঠতার জোরে এখন এমনও বলতে পারি যে— রবীন্দ্রনাথের গান সব থেকে ভাল বুঝেছিলেন শান্তিদেব, আর শান্তিদেবের গাওয়া সবথেকে ভাল বুঝেছি বোধকরি আমিই।