আন্তরিক পর্যটনে
শেষ কিছুদিন ধরে, শান্তিনিকেতন গেলে চোখে পড়ত একটাই দৃশ্য— পর্যটকরা আশ্রমচত্বরের নানা জায়গায় উঁকিঝুঁকি মারছেন, দেখছেন কোনও গেট আদৌ খোলা রয়েছে কি না এবং খোলা থাকলে নিরাপত্তারক্ষীদের চোখ এড়িয়ে সামান্য ঢুকেই আগে নিয়ে নিচ্ছেন একটা ‘নিজস্বী’। বেড়াতে এসেছেন, তা-ও কীসের যেন অভাব। নিয়ন্ত্রিত চলাচলে সকলেরই মনখারাপ। সখেদ মন্তব্যও শোনা যেত, ‘এতদূর থেকে এলাম, সব জায়গায় তো ঢুকতেই দিচ্ছে না!’ মোদ্দা কথা, দাবি একটাই, আমরা এসেছি যখন, ছাড়ব না কিছুই! রবীন্দ্রনাথ কি বিশ্বভারতীর প্রাইভেট প্রপার্টি? আমরা কি পার্টি করি না ওঁকে নিয়ে ২৫ বৈশাখ কিংবা ২২ শ্রাবণে? বিপথে শ্রম দিয়ে আশ্রম ঘোরার যে-ঝামেলা, তা আমাদের পোহাতে হবে কেন!
তবে সুখবর একটা আসতে চলেছে শীঘ্রই। শোনা যাচ্ছে, বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ পরিকল্পনা নিয়েছে, পর্যটকরা যাতে আবার আশ্রমচত্বর, ছাতিমতলা, সংগীতভবন কিংবা কলাভবনের ভেতরে প্রবেশ করতে পারে। সে-সুযোগ ফিরিয়ে আনতে আলাপ-আলোচনা চলছে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ যা চাইতেন, দূর-দূরান্তের পর্যটকরা শান্তিনিকেতনে আসুক— সেই কথা মাথায় রেখেই দেশ-বিদেশের পর্যটকদের জন্য শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্য তুলে ধরতে চাইছে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ। ইউনেস্কো শান্তিনিকেতনকে বিশ্ব ঐতিহ্যক্ষেত্রের স্বীকৃতি দেওয়ার পর থেকেই নতুন করে হেরিটেজ ওয়াকের কথা ভাবা শুরু করেছেন আধিকারিকরা। কেউ-কেউ অবশ্য প্রশ্ন তুলেছেন, আশ্রমচত্বর যদি অবারিতদ্বার হয়ে ওঠে আগের মতো, পরিস্থিতি কি জটিল হয়ে উঠবে না? বিদেশের পর্যটক যত-না শান্তিনিকেতনে আসে, তার চেয়ে সারাবছর শান্তিনিকেতনে তো পর্যটক বলতে সেই বাঙালিরাই! আর কে না জানে, বাঙালিদের রবীন্দ্রনাথের প্রতি ‘ইশক’ থাকলেও, ‘রিস্ক’ও কিছু কম নেই! ভুলে গেলে চলবে কী করে, এই বাঙালিরাই রবীন্দ্রনাথের মরদেহ থেকে চুল-নখ-দাড়ি ছিঁড়ে নিতে উদ্যত হয়েছিল ১৯৪১ সালের ৭ অগাস্ট!
কাকে বলতে পারি ‘বিশ্বস্ত গাইড’? ১৯০১ সালে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠার সময় থেকে শুরু করলে রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের ইতিহাস ১২৬ বছরের। আমাদের জিজ্ঞাসা, যিনি ‘বিশ্বস্ত গাইড’, তাঁর এই সুদীর্ঘ ইতিহাসের নানাবিধ উল্লেখযোগ্য তথ্যাদি সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকবে তো? প্রভাতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় যে দু’জন আলাদা ব্যক্তি, পর্যটকদের কৌতূহলী জিজ্ঞাসায় তা তিনি ধরিয়ে দিতে পারবেন তো?
জানা যাচ্ছে, প্রাথমিকভাবে প্রায় ২০টি ঐতিহ্যবাহী স্থানকে চিহ্নিত করা হয়েছে। পর্যটকদের প্রবেশপথ ও বহির্গমন পথ কী হতে পারে এবং পাঠভবনে শিক্ষার পরিবেশে যাতে কোনওরকম বিঘ্ন না ঘটে, পর্যালোচনা চলছে তা নিয়েও। সব দিক বিবেচনা করে, আশা করা যায় অচিরেই এই পরিকল্পিত ভাবনার বাস্তবায়ন ঘটবে। একজন বা একাধিক ‘বিশ্বস্ত গাইড’ পর্যটকদের ঘুরিয়ে দেখাবেন। এখন প্রশ্ন হল, ‘বিশ্বস্ত গাইড’ বলতে আমরা ঠিক কী বুঝি? কাকে বলতে পারি ‘বিশ্বস্ত গাইড’? ১৯০১ সালে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠার সময় থেকে শুরু করলে রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের ইতিহাস ১২৬ বছরের। আমাদের জিজ্ঞাসা, যিনি ‘বিশ্বস্ত গাইড’, তাঁর এই সুদীর্ঘ ইতিহাসের নানাবিধ উল্লেখযোগ্য তথ্যাদি সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকবে তো? প্রভাতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় যে দু’জন আলাদা ব্যক্তি, পর্যটকদের কৌতূহলী জিজ্ঞাসায় তা তিনি ধরিয়ে দিতে পারবেন তো?
ভ্রমণকালে, দেখা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পর্যটকদের ভরসাস্থল হয়ে দাঁড়ান গাইডরা। নিজেদের সীমিত জ্ঞানের মধ্য দিয়েই তাঁরা আকৃষ্ট করতে সচেষ্ট হন পর্যটকদের। ইতিহাস বিকৃত হতে শুরু করে এই জায়গা থেকেই। বহুল প্রচারিত কোনও ঐতিহাসিক তথ্যকে তাঁরা মিলিয়ে দিতে চান তাঁদের বয়ানে, যাতে পর্যটক-মন বিস্মিত হয়ে ওঠে। সেই ইতিহাসের শরিক হতে পারছেন, এমন বোধ হয়। আমরা চাই না, শান্তিনিকেতনের ইতিহাসও একইভাবে বিকৃত হোক। কলাভবন-চত্বরে প্রবেশ করে কোনও পর্যটক যদি আগ্রহভরে জানতে চান, সত্যজিৎ রায় ছাত্রজীবনে কোন ঘরে থাকতেন, তাঁকে যেন সেই ঘরটি দেখিয়ে দেওয়া হয় আন্তরিকতার সঙ্গে। তালধ্বজ বাড়ির সামনে গিয়ে যেখানে, ‘এই সেই তালগাছ, যা দেখে কবিগুরু লিখেছিলেন ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে…’, দেখে নিন!’ বলে এখনকার গাইডের কাজ শেষ হয়ে যায়, আমরা চাই আমাদের ‘বিশ্বস্ত গাইড’ জনতার সামনে জানাক তেজেশচন্দ্র সেনের কথাও। যিনি এই তালধ্বজ বাড়িতে থাকতেন। একজন গাইডের কাজ কেবল দর্শনীয় স্থানের খুচরো কিছু তথ্য পরিবেশন করা নয়; যে-ইতিহাস প্রায়-বিস্মৃত, তাকে জাগিয়ে তোলাও তার কর্ত্যব্য। এভাবেই, কোনও পর্যটন, একইসঙ্গে জীবন্ত এবং আন্তরিক হয়ে উঠতে পারে। আমরা বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সেই আন্তরিক পর্যটনের আশায় রইলাম।