রবি ঘোষ এমন এক বিস্ময়, যিনি কমেডি অভিনয়ে এক আশ্চর্য গভীরতা এবং দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এলেন। সেই অভিনয় যেমন দর্শককে হাসাবে, তেমনই অভ্যন্তরীণ স্তরে সংবেদনশীল দর্শককে সেই চরিত্রের অসহায়তা নাড়া দেবে। রবি ঘোষের অভিনয়-ক্ষমতার এই অসামান্য ব্যাপ্তি তাঁর অভিনীত এক একটি চরিত্রকে এতটাই জীবন্ত করে তুলেছে যে, প্রতিটি দর্শক তার নিজস্ব রুচিভেদে সেসব চরিত্রের সঙ্গে নিজের মতো করে একাত্ম হয়ে উঠতে পারে।
কমেডি দৃশ্যের মধ্যেই একটা সুপ্ত ট্র্যাজেডি থাকে। কমিক চরিত্রের বিপন্নতার এক তির্যক পরিবেশন দর্শকের কাছে মজার হয়ে ওঠে। অত্যন্ত উচ্চমানের অভিনেতারাই সেই পরিবেশন সফল করতে পারেন। রবি ঘোষ তেমনই এক বিরল গোত্রের অভিনেতা।
‘ধন্যি মেয়ে’-র পুরুতমশাই তোতলা ভটচায্ চরিত্রে রবি ঘোষের অভিনয় এক অপার বিস্ময়। সামন্ততান্ত্রিক সমাজের শিকার এক দেনার দায়ে জর্জরিত পুরুতমশাই, যাকে ভিটেমাটি রক্ষা করতে, কী না করতে হচ্ছে– এমনকী নামাবলি ছেড়ে হাফপ্যান্ট পরে হুইসল মুখে নিয়ে রেফারি হওয়া থেকেও রেহাই নেই। টস করার সময়ে দুই দলের ক্যাপ্টেন হ্যান্ডশেক করতে গেলে রেফারির আশীর্বাদ করা কেউ কোনওদিন ভুলতে পারবে না। শেষে বারো গোল খেয়ে জমিদারের ধমকের সামনে পুরুতমশাইয়ের কান্না যেমন দর্শককে হাসাবে, তেমনই আবার অন্য স্তরে চরিত্রের চূড়ান্ত অসহায়তায় তার প্রতি করুণা হবে। আবার সেই পুরুতই শেষ অবলম্বন হিসেবে যখনই বগলা আর মনসার বিয়ে দেওয়ার সুযোগ পায়, তখন সে জার্সি আর হাফপ্যান্ট ছাড়ার কথা মাথায় তুলে তার ওপরেই একটা নামাবলি চাপিয়ে মন্ত্রের রেকর্ড চালিয়ে বিয়ে দিতে বসে পড়ে। তার অসহায়তা এমনই চূড়ান্ত পর্যায়ে যে, বিয়ের মন্ত্র আর শ্রাদ্ধের মন্ত্রের তফাৎ তখন তার কানে পৌঁছচ্ছে না। দেনাদায়গ্রস্থ বাঙালি সমাজের ট্র্যাজিক অবস্থানের এক অসামান্য কমিক উপস্থাপনায় রবি ঘোষের তোতলা ভটচায্ অমর হয়ে থাকল।
আরও পড়ুন: একরকমের চরিত্র বিকাশ রায়ের অভিনেতা সত্তার ক্ষতিই করেছে আসলে? লিখছেন সুপ্রিয় রায়…

আবার ‘জন-অরণ্য’-র নটবর মিত্তির চরিত্রে রবি ঘোষ উপস্থাপন করলেন হয়তো তাঁর সবচেয়ে ব্যতিক্রমী অভিনয়ের ধরন। পুঁজিবাদের বিকাশে যেখানে আদর্শের নিত্য নতুন অবক্ষয়ের চেহারা দেখা যাচ্ছে, সেখানে টিকে থাকার চেষ্টায় কী না করতে হচ্ছে একজন পাবলিক রিলেশন এজেন্টকে। এখানে রবি ঘোষের সংলাপ বলার ধরন যেমন প্রত্যক্ষ, তেমনই অভিনীত চরিত্রের জটিলতার অনেকগুলি স্তর তিনি মেলে ধরলেন। সোমনাথের মরালিটিকে ভাঙার চেষ্টার মধ্যে চরিত্রটির শয়তানির থেকে অনেক গুণ বেশি প্রকাশ পায় সোমনাথের প্রতি তার সংবেদনশীলতা। নটবর সোমনাথের মতো এমন অনেক কেস এর আগে হ্যান্ডেল করেছে। সে জানে, এই দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজে যেখানে প্রকৃত শিক্ষার মূল্য ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে, সেখানে এই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত যুবসমাজকে টিকে থাকতে গেলে ‘মরালিটি’ নামক ‘কুসংস্কার’-কে বিসর্জন দিতেই হবে। সোমনাথের সঙ্গে সেসব কথোপকথন এতটাই স্বাভাবিকভাবে নটবর মিত্তির চালাতে থাকে, যা সোমনাথকে পদে পদে বিস্মিত করে। আবার দেহব্যবসায়ী এক স্ত্রী আর এক বিধবা মায়ের সঙ্গে নটবরের কথোপকথন এতটাই স্বাভাবিক, যেন রোজের কোনও অফিসে দুই কর্মচারীর দৈনন্দিন কাজের স্টেটাস আপডেট। আবার প্রথম স্ত্রীর মাতাল স্বামী যখন হঠাৎ করে এসে সব প্ল্যানের বারোটা বাজিয়ে দেয় তখন আবার সেই টিকে থাকার প্রশ্নে এক দালালের বিপন্নতা। এক অত্যন্ত সূক্ষ্ম সিরিয়াস অভিনয়ের মধ্যে কমেডির এক হালকা মেজাজ পরিবেশিত হল, যা একজন বিরাট মাপের অভিনেতা ছাড়া আর কখনও সম্ভব নয়। এখানেই রবি ঘোষ অবিস্মরণীয়।
রবি ঘোষের মতো মহান অভিনেতার প্রতিভা মহান পরিচালকদের হাতেই যেন পূর্ণতা পেত। সত্যজিৎ রায়ের বাঘা এবং একের পর এক আইকনিক চরিত্র, তপন সিংহর কালজয়ী ধনঞ্জয় তার উদাহরণ। ধনঞ্জয়ের চরিত্রের এমন সিরিয়াস কমেডি অভিনয়, যেন এক নতুন অভিনয় স্কুলিং-এর সূচনা করল। এত সূক্ষ্ম এই চরিত্রের চলন যে, একটু এদিক-ওদিক হলেই আবার সেটা ভাঁড়ামি হয়ে দাঁড়াত। কিন্তু এখানেও আবার রবি ঘোষের সেই অসামান্য পরিমিতিবোধ।

তপন সিংহ-র ‘নির্জন সৈকতে’ ছবিতে পুরীর পাণ্ডার চরিত্রে রবি ঘোষের অভিনয় কে ভুলতে পারে? ট্রেনে বিধবাদের ঝগড়ার মাঝে তাঁর পান চিবুতে চিবুতে অনিল চ্যাটার্জির দিকে স্রেফ তাকিয়ে থাকা যেন সমস্ত লাইমলাইট তার দিকে কেড়ে নেয়। তারপর আলু বলে কচু খাওয়ানোর সেই অসামান্য দৃশ্য। ডায়লগ ছাড়া যত অভিব্যক্তি-প্রবণ দৃশ্য হয়, রবি ঘোষ যেন আরও বেশি ক্ষুরধার হয়ে ওঠেন। বড় বড় সুপারস্টাররা তাঁর সঙ্গে সেসব দৃশ্য করতে ভয় পেতেন বলে শোনা যায়।
এরপর বলতে হয় আরেক মহান পরিচালক তরুণ মজুমদারের ‘ঠগিনী’ ছবির কথা। এই ছবিতে রবি ঘোষ-অভিনীত বঙ্কু এক অসামান্য সিরিয়াস চরিত্র। সেই টিকে থাকার জন্য পরিচয় গোপন করে জীবনধারণ, যেখানে লোক ঠকানো এক নিত্যনৈমিত্তিক পেশা। কিন্তু এই চরিত্র দেখে দর্শকের চোখ ভিজে হয়ে ওঠে। মেলোড্রামার দৃশ্যে কী অসামান্য কন্ট্রোল! কমেডি অভিনেতারা যখন এমন সিরিয়াস চরিত্র পান, তাঁরা যেন ভয়ংকর হৃদয়স্পর্শী হয়ে ওঠেন।
রবি ঘোষের মতো মহান অভিনেতার প্রতিভা মহান পরিচালকদের হাতেই যেন পূর্ণতা পেত। সত্যজিৎ রায়ের বাঘা এবং একের পর এক আইকনিক চরিত্র, তপন সিংহর কালজয়ী ধনঞ্জয় তার উদাহরণ। ধনঞ্জয়ের চরিত্রের এমন সিরিয়াস কমেডি অভিনয়, যেন এক নতুন অভিনয় স্কুলিং-এর সূচনা করল। এত সূক্ষ্ম এই চরিত্রের চলন যে, একটু এদিক-ওদিক হলেই আবার সেই ভাঁড়ামি হয়ে দাঁড়াত। কিন্তু এখানেও আবার সেই রবি ঘোষের অসামান্য পরিমিতিবোধ।
বের্টোল্ট ব্রেখট নিজের সৃষ্ট এপিক অভিনয়-পদ্ধতি সম্পর্কে লিখেছিলেন:
‘অভিনেতা অভিনেয় চরিত্রে নিজেকে রূপান্তরিত হতে দেন না। তিনি এই চরিত্রগুলি প্রদর্শন করছেন মাত্র। তিনি তাদের কথাগুলিকে যথাসাধ্য সত্যভাবে পুনরুচ্চারণ করেন; নিজ ক্ষমতা ও মনুষ্যজ্ঞান অনুযায়ী তিনি তাদের কার্যকলাপকে উপস্থিত করেন। কিন্তু তিনি কখনওই নিজেকে (এবং অন্যদের) একথা বোঝানোর চেষ্টা করেন না যে তিনি সম্পূর্ণভাবে চরিত্রে রূপান্তরিত হয়েছেন।’
নাট্যাচার্য গিরিশ ঘোষ বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ এক নট অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি সম্পর্কে লিখেছেন:
‘অভিনয়কালে অর্ধেন্দু যেন সকলকে বলিতেন— আমি অর্ধেন্দু‚ যে অংশ দেখিতে চাও তা এইরূপ‚ যেন দর্শকের সংগে পরামর্শ করিয়া কার্য হইতেছে। কিন্তু দর্শক যাহা দেখিতে চান‚ তাহাও ঠিক দেখিতেন এবং সংগে সংগে অর্ধেন্দুকেও দেখিতেন।’
গিরিশ আরও লিখেছেন—
‘নট মনকে যেন দুই খন্ড করিয়া অভিনয় করেন। একখন্ডে মন নিজ ভূমিকায় তন্ময়‚ অপর খন্ড সাক্ষীরূপে দেখে যে তন্ময়ত্ব ঠিক হইতেছে কিনা‚ নাটকে কথা ভুল হইতেছে কিনা‚ প্রতিযোগী অভিনেতা ঠিক চলিতেছে কিনা‚ যদি সে তাহার ভূমিকা ভুলিয়া থাকে‚ তবে তাহার প্রত্যুত্তর উপযোগী হইবে কিনা‚ রংগালয়ের শেষ সীমা পর্যন্ত দর্শক শুনিতে পাইতেছে কিনা।’
এ-বিষয়েই উৎপল দত্ত তাঁর ‘গিরিশ মানস’-এ লিখেছেন—
‘ব্রেখটের এপিক অভিনয়ধারার এটাই অভিপ্রেত লক্ষ— অভিনেতা অভিনেয় চরিত্রের সংগে একাত্ম না হয়ে‚ চরিত্রের ব্যাখ্যাকার ও বিশ্লেষক হিসেবে মঞ্চে অবতরণ করেন।’
উৎপল দত্তর শিষ্য রবি ঘোষ যেন এই ভাবধারার সফল প্রয়োগের এক উৎকৃষ্টতম উদাহরণ। তাঁর অভিনীত প্রতিটি কালজয়ী চরিত্রের অন্তরালে যেন তিনি রবি ঘোষ হয়েই, ব্যাখ্যাকার এবং বিশ্লেষক হিসেবে দর্শকের মনে এক স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন।



