রিল-সাগরে…

People Watching Reel

একটা মারকাটারি গরমকালের দুপুর। একটা তেতে ওঠা নৈহাটি-মাঝেরহাট লোকাল। একটা ভীষণ ঘেমো লোক সোদপুর স্টেশন থেকে উঠল, আর ঢুকে পড়ল ইন্সটাগ্রামে। তারপর, রিলসাগরে ভাসতে-ভাসতে, ভদ্রলোক সহসা প্যালেস্তাইনে!

আগামি তিরিশ সেকেন্ডে, একজন শিশু খিদের কথা বলবে, রুটির কথা বলবে, মৃত ভাইয়ের কথা বলবে— আর ঠিক তখনই, স্মার্টফোনের স্ক্রিনে, জোম্যাটো বিজ্ঞাপন দেবে, মুরগীর ঠ্যাং, একবাটি চাউমিন, গাদা-গাদা পান্তুয়া।

এইবার সে কী করবে? এই ডিসটোপিয়ান রিয়েলিটিতে একা, ইনফাইনাইট একা হয়ে, বহুদিন পরে সহযাত্রীর দিকে মুখ তুলে চাইবে? না জোম্যাটোর বিজ্ঞাপন আরও পাঁচ সেকেন্ড চালিয়ে, অর্ডার করবে, একপ্লেট বিরিয়ানি কিংবা, একা চলন্ত ট্রেন থেকে ঝাঁপ দেবে?

আরও পড়ুন : আটাত্তরের বন্যা ছিল উদযাপনের, এখন জমা জল মানেই বিড়ম্বনা! লিখছেন পিনাকী ভট্টাচার্য…

সে আত্মহত্যা করবে না। করলে, এ-লেখা হয়ে উঠত, নেটফ্লিক্সের ‘ব্ল্যাক মিরর’ সিরিজের আস্ত একখানা এপিসোডের মতো। ভদ্রলোক জাস্ট স্ক্রল করতে থাকবে তারপর। সহযাত্রীর দিকে তাকিয়ে দেখবে না। ‘অ্যাই বাদাম, বাদাম’— ডাকে, সাড়াও দেবে না। শুধু স্ক্রল করবে। কারণ, স্ক্রল করলে হিমশীতল হাওয়া। পাকা আমের গন্ধ। শান্তিনিকেতনী রুমাল। স্ক্রল করলে, সভ্যতার গাঢ়তম বিষাদ থেকে মুক্তি। 

ট্রেনে উঠলে, হকারের হাঁক-ডাক ছাপিয়ে, এখন ভেসে আসে— রিলের পাঁচমিশালি শব্দ। যেন একবিংশ শতাব্দীতে, আমাদের সম্মিলিত চেতনার শব্দ! অবচেতনেরও। চলচ্চিত্রকার দিবাকর ব্যানার্জি একটি ছবি তৈরি করেছিলেন, ‘লাভ, সেক্স অউর ধোঁকা ২’। সে-ছবি বলেছিল, রিয়েলিটি থেকে, মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হতে-হতে, এই একেকটা ‘আমি’, মাংস-রক্ত-স্বপ্নের একেকটা ‘আমি’, রিয়েলিটিতেই একদিন উবে, অথবা মরে গিয়ে ঘোরতর জ্যান্ত হয়ে থাকবে মেটা-দুনিয়ায়। সেখানেই হাসবে, কাঁদবে, যৌনতা করবে। লোকাল ট্রেনে সহযাত্রীর সঙ্গে দুঃখ-কথা ভাগ করে নেবে।

‘লাভ, সেক্স অউর ধোঁকা ২’ ছবির পোস্টার

ফরাসি ইতিহাসবিদ এবং দার্শনিক মিশেল ফুকো বলছেন, ‘একটি হেটেরোটোপিয়ান স্পেসের উৎকৃষ্ট উদাহরণ হল ট্রেন’। এইবার প্রশ্ন হল, হেটেরোটোপিয়ান স্পেস কী? এমন একটি স্থান, যা প্রতিদিনের ঘ্যানঘ্যানে বাস্তবতার বাইরে। অথচ সমাজ-বহির্ভূত নয়। যে-স্থানে দাঁড়িয়ে, একজন ‘একক’ নিজের পারিপার্শ্বিককে প্রশ্ন করতে পারে, স্বল্পক্ষণের জন্যে হলেও যাবতীয় বাঁধন থেকে মুক্ত হয়। ‘অফ আদার স্পেসেস: ইউটোপিয়া অ্যান্ড হেটেরোটোপিয়া’ প্রবন্ধে মিশেল ফুকো লিখছেন, মানবিক সম্পর্কের অভূতপূর্ব সংমিশ্রণ একটি ট্রেন। কারণ ট্রেন হল সেই বস্তুটি, যার মাধ্যমে কেউ চলে যায়। কেউ ফিরে আসে। কেউ-বা আবার, এক স্থান থেকে অপর স্থানে পৌঁছয়। অথচ ট্রেন, চলতেই থাকে। নিরবধি। মানবিক সম্পর্কগুলোই আসলে ঘেঁটে ঘ। কারণ, একটা অনন্ত রিলসাগরে আমরা সকলেই ডুবুডুবু।

সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ ছবিটির কথা বলি। ১৯৬৬ সালে মুক্তি। সে-সময়ে ট্রেনের চরিত্র কেমন? অরিন্দম যখন নিজের ক্যুপে পৌঁছল, আমরা দেখলাম, সহযাত্রীদের মধ্যে একটি বাচ্চা মেয়ে, বই পড়ছে— ‘পথের পাঁচালি’। সিনেমা আরও এগোলে আমরা দেখি, প্রধান নারী-চরিত্র, অদিতি, একটি পত্রিকার পাতা উল্টোচ্ছে। ‘উল্টোরথ’।

‘উল্টোরথ’ পত্রিকার দৃশ্যত উল্লেখ পেয়েছি, মৃণাল সেনের ছবি ‘ইন্টারভিউ’-তে। ১৯৭১। বিখ্যাত ট্রামের দৃশ্য। যেখানে একজন ষাটোর্ধ্ব, ট্রামে যেতে-যেতে পড়ছিলেন সেই পত্রিকা। অন্যান্য সহযাত্রীরা, কেউ-কেউ, বইও পড়ছিলেন।

এরপরে ধরুন, যে-সময় চলচ্চিত্রকার রিচার্ড লিংকলেটার তৈরি করছিলেন, ‘বিফোর সানরাইজ’ ছবিটি। ১৯৯৫। তখনও দেখছি, সিনেমার নায়ক এবং নায়িকা— ট্রেনে বই পড়ছে। সহযাত্রীরা চোখ রেখেছেন সংবাদপত্রে।  

বই অথবা পত্রিকার রেফারেন্সে, সময়ের চরিত্র যেমন স্পষ্ট হয়! তেমন এও স্পষ্ট হয়, পাবলিক ট্রান্সপোর্টে বই পড়ার পরিসর। এ-কথা কখনোই বলতে চাইছি না যে, সন্ধে ৬-টা ৩৫-এর নৈহাটি লোকালে, অমন ফাটাফাটি ভিড়ে, কেউ বই খুলে বসুক।

সময় কাটানোর নিমিত্তে, শ্রেণিগত চরিত্র নির্বিশেষে, পাবলিক ট্রান্সপোর্টে বই অথবা সংবাদপত্রে চোখ বুলোনোর মানুষগুলো এখনও কন্সট্যান্ট! বিশেষত কোভিড-পরবর্তী সময়ে, গোল বেঁধেছে গরম-গরম শিঙারা আদান-প্রদানে, তাসের আড্ডায়। অথবা, দলবেঁধে ‘দো ঘুঁট মুঝে ভি পিলা দে শারাবি’-র আনন্দে। সারাদিনের ঘেমোক্লান্তি ছাপিয়ে যাওয়া যে আনন্দ!

ভদ্রলোক জাস্ট স্ক্রল করতে থাকবে তারপর। সহযাত্রীর দিকে তাকিয়ে দেখবে না। ‘অ্যাই বাদাম, বাদাম’— ডাকে, সাড়াও দেবে না। শুধু স্ক্রল করবে। কারণ, স্ক্রল করলে হিমশীতল হাওয়া। পাকা আমের গন্ধ। শান্তিনিকেতনী রুমাল। স্ক্রল করলে, সভ্যতার গাঢ়তম বিষাদ থেকে মুক্তি। 

হিউম্যান কমিউনিকেশন কিংবা, মানবিক সম্পর্কগুলোকে প্রতিস্থাপন করেছে ইন্সটাগ্রাম রিলস। অবকাশ মাত্রই, একা-একা স্ক্রল। যেন একের পৃথিবী, একবজ্ঞা ট্রেনে-বাসে যাতায়াত, আখেরে আমাদের ক্লান্ত করে, ক্লান্ত— ক্লান্ত করে। পুঁজিবাদ এমনই চেয়েছিল। যৌথতার প্রতিটি ধাপ একেবারে গুঁড়িয়ে দিতে। সামগ্রিকভাবেই বই পড়ার আকাঙ্খা ছিনিয়ে নিতে। মানুষ এখন একা। একাকী বাঁচতে-বাঁচতে, অচিরেই উন্মাদ। কী সহজে বিভ্রান্ত! অপতথ্যের ঝুলি খুলে, বুঝিয়ে দেওয়া যাচ্ছে, হিন্দু খাতরে মে হ্যায়। সম্পর্কের দেয়া-নেয়ায় আপাতত ইতি।

শঙ্খ ঘোষের একটি বইয়ের কথা বলি। ‘ইছামতীর মশা’। এই বইয়ের ‘ভ্রমণপথের মানুষজন’ শীর্ষক গদ্যে, শঙ্খ ঘোষ পাটনা থেকে বাসে চেপে রাজগির রওনা হয়েছেন। সহযাত্রীদের মধ্যে অধিকাংশই বিহারের বাসিন্দা।

শঙ্খ ঘোষ লিখছেন: ‘…বিহারের চালচলনের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের চালচলন কোথায় কতদূর আলাদা তার এক তুলনাভরা উত্তেজক বাগবিনিময় চলতে থাকে। আমাদের বাঙালিয়ানা টের পেয়ে ঠাট্টায়-ঠাট্টায় অস্থির করে তোলে বাসসুদ্ধ লোক পুরো সময় জুড়ে। এক-একজন নেমে যায়, উঠে আসে তার জায়গায় অন্যরা, ঘণ্টাতিনেক কেটে যায় ভালোই। বাইরের ধাবমান অন্ধকারের দিকে চোখ রেখে আমরা বলি: ‘আর একঘন্টার মধ্যেই রাজগির!’

‘রাজগির? একঘন্টা? বলেন কী, রাজগির তো এখনও বহু দূর!’
‘বহু? কত? কতক্ষণ লাগবে আর?’
‘সেকথা কে বলতে পারে। তবে এক ঘণ্টা নয়।’

‘সরকারি টাইমটেবিলে লেখা আছে আটটায় পৌঁছবে রাজগির।’

‘টাইমটেবিল? সরকার?’ বাস ভরাট করে সমবেত এক অট্টহাসি ওঠে। আমাদের দিকে প্রত্যক্ষ আঙুল তুলে একে অন্যকে বলতে থাকে: ‘শোন রে, শোন, এরা বলছে সরকার! সরকারের আবার টাইমটেবিল!’’

এই যে দুই সম্পূর্ণ পৃথক সংস্কৃতির মেলামেশায় দিব্যি তিনঘণ্টা কেটে গিয়েছিল, উপরি পাওনা হিসেবে ছিল ‘সরকারের আবার টাইমটেবিল’ এবং পরবর্তী অনিশ্চয়তা— তা নিশ্চয়ই এসেছিল কোনও মানবিক সম্পর্ক থেকেই। আসলে আমাদের দৃষ্টিগুলো, শব্দগুলো, স্পর্শগুলো কে যেন বর্গক্ষেত্রে পুরে দিয়েছে। কে সে? কোনও বিগ ব্রাদার? ট্রেনে আসে। বাসে যায়। কেবলই রিলসাগরে ভেসে যাই।

শেষ কবে, পাশের সিটে বসা লোকটিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,

‘দাদা, ভাল আছেন?’