‘থাকি তখন কালিঘাটের কাছে। একদিন দেখি বেলা ১০টা হবে— শিবরাম উদিত হলেন, হাতে তাঁর একগুচ্ছ কাগজ অর্থাৎ ৮/৯ টি গল্পের পান্ডুলিপি। অনেক হাস্য কৌতুকের পর বললেন এইগুলো আপনার জন্য আনা। ছবি করে দিন। আমি বললাম বেশ তো রেখে যান করে রাখব। বললেন, মোটেই না। আজ দুপুরে এখানে খাওয়া ও অবস্থান। যাবার সময় এগুলি নিয়ে যাব। পকেট ফাঁকা গড়ের মাঠ। সেকি! আমি তো অবাক। কিন্তু বাধা দিয়ে শিবরামকে রোখা শক্ত। শেষে বললেন একটি মজার কথা। বললেন, কি জানেন, আমার গল্প হচ্ছে টোপ। আপনার ছবি হচ্ছে চার। চার ফেললে মাছ খাবেই। আমি এইমাত্র যাচ্ছি এম সি সরকারের কাছে। ওঁকে দিলেই উনি ড্রয়ার খুলে টাকা বের করবেন। ঝটতি কাজ হয়ে যাবে। আমি হাসতে হাসতে গল্প পড়ে ছবিগুলি করতে লাগলাম এবং সন্ধ্যার পূর্বেই ছবি ও পান্ডুলিপি ওঁর হাতে তুলে দিলাম। শিবরামের লেখা ও আমার ছবি সম্বন্ধে অচ্ছেদ্যতাহেতু আমাদের সম্পর্ক এমনই গভীর হয়েছিল যে অনেকে ভাবতেন আমরা দুই ভাই।…কলকাতার বাইরে সুদূর পুরী কিম্বা দিল্লিতেও দেখেছি ছোটো পাঠকের দল একরাশ সঙ্কোচ নিয়ে প্রশ্ন করেছে, ‘আচ্ছা, আপনাদের মধ্যে কে বড়?’ আমিও উত্তর দিয়েছি। বলো তো লরেল হার্ডি দুই ভাই ছিল না পরশুরাম নারদ দুই ভাই ? আমরা তেমনি জন্মসূত্রে না হলেও বলতে পারো আত্মার আত্মীয়তাসূত্রে যুক্ত। (আজকাল ; রবিবাসর, ১৩ই ডিসেম্বর, ১৯৮৭)
‘একবার বলেছিলাম, কোন ফটো নেই আপনার? আপনার প্রথম পুরুষে লেখা গল্পে সেটা থেকে ছবি করে দেব। শিবরাম বললেন, না, আমার কোন ফটো নেই। কি হবে ফটো দিয়ে? আপনার ছবিতেই আমি থাকব— তারপর গলাটা খাটো করে বললেন, তাহলে আর বুড়ো হব না, বুঝলেন।’ (রেখায় লেখায় শৈল চক্রবর্তী; বিশ্বদেব গঙ্গোপাধ্যায় ; শৈল চক্রবর্তী সমগ্র)
লেখায় শিবরাম ও রেখায় শৈল। এই কম্বিনেশনকে বাঙালি আজও মনে রেখেছে। দুজনেই স্ব-স্ব ক্ষেত্রে দুর্ধর্ষ। সাদা শার্ট, ধুতির কোঁচা লুটিয়ে পড়া, ঘাড় অবধি চুল, যার সরু একগোছা মুখের পাশে ঝুলে পড়েছে ঢুলু-ঢুলু চোখ… শিবরাম চক্রবর্তীকে যে কী অপূর্ব দক্ষতায় জীবন্ত করে তুলতে পারতেন শ্রীশৈল বা শৈল চক্রবর্তী! আর মজার মাণিকজোড় দুই ভাই হর্ষবর্ধন আর গোবর্ধন। গায়ে কালো, বিরাট এক কোট, একমাথা কোঁকড়া চুল ও ঝুপো গোঁফের হর্ষবর্ধন আর অবিন্যস্ত চুলের ভ্যাবাচ্যাকা চেহারার রোগা গোবর্ধন। এঁদের নিয়ে যে অসংখ্য মজার সিচুয়েশন ফুটিয়ে তুলেছিলেন শৈলবাবু, তা আজ সবকিছু ছাপিয়ে মানুষের মনে রয়ে গেছে। শিবরামের পাশাপাশি নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের টেনিদা সিরিজেরও অনেক ছবিও শৈলবাবুর আঁকা। পটলডাঙার টেনিদাকে চোঙা প্যান্ট এবং ধুতি-শার্ট দুটোই পরিয়েছিলেন তিনি।

শৈলনারায়ণ চক্রবর্তী (৯. ২. ১৯০৯-১৪. ১০. ১৯৮৯) জন্মেছিলেন হাওড়া জেলার আন্দুল মৌরি পল্লিগ্রামে। নিজের গ্ৰামের স্কুলেই পড়েছেন শৈল চক্রবর্তী। ১৯২৮-এ ম্যাট্রিক পাশ করার পর ১৯৩১ সালে কলকাতার সিটি কলেজ থেকে বি এস সি পাশ করেন তিনি, গণিতে অনার্সসহ। পড়াশোনা শেষ করে বাড়িতে প্রসাধন তৈরির একটা ছোট কারখানা বানিয়ে সাবান, আলতা, সিঁদুর তৈরি করে বাড়ি-বাড়ি বিক্রি করতেন প্রথমদিকে। কিন্তু সে ব্যবসা চলেনি। গ্রাম থেকে কলকাতায় আসার পর তিনি উঠেছিলেন বেনেটোলার এক মেসে। পরে শ্যামবাজারের কৃষ্ণরাম বসু স্ট্রিটের এক ভাড়াবাড়িতে আস্তানা হল। উপার্জনের তাগিদে সিনেমার স্লাইড আঁকায় হয়ে উঠেছিলেন সিদ্ধহস্ত। (সিনেমার বুকলেটেও রয়ে গেছে তাঁর কাজের প্রচুর নিদর্শন।) কালীঘাটে যোগেশ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে টেমপেরা, ওয়াশ ইত্যাদি ছবি আঁকার কৌশল আয়ত্ত্ব করেছেন। এছাড়া প্লাস্টার অব প্যারিসে মনীষীদের আবক্ষ প্রতিরূপ ফুটিয়ে তোলায় ছিল তার অনায়াস দক্ষতা।
শৈশবের প্রিয় পত্রিকা ‘সন্দেশ’-এ ১৯৩৫ সালে বের হল তাঁর প্রথম অলংকরণ। ১৪৩০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর প্রথম কমিক্স ‘বাজি বিভ্রাট’। ওই বছরেই সন্দেশের পাতায় বেরোয় ‘ভাগ্যিস’ নামে এক পাতার কমিক্স। (পরবর্তীকালে আর কোনও কমিক্স ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় তিনি আঁকেননি।)
শৈল চক্রবর্তীর শিল্পীজীবনের অন্যতম স্মরণীয় ঘটনাটি ঘটে ১৯৪০ সাল নাগাদ, যখন শারদীয় আনন্দবাজার পত্রিকায় তাঁর অলংকরণে সজ্জিত হয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘ল্যাবরেটরি’ গল্পটি আত্মপ্রকাশ করে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ শৈলবাবুর ছবি দেখে অনুমোদন দিলে, তবেই কর্তৃপক্ষ তা ছাপতে উদ্যোগী হন। এরপর রবীন্দ্রনাথের আরও একটি গল্প ‘প্রগতিসংহার’-এর অলংকরণ করেন তিনি। উল্লেখ্য, ১৮ মে ১৯৪১ ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’য় তরুণ সত্যজিৎ রায়ের প্রথম গল্প ‘Abstraction’ এর অলংকরণ করেন শৈল চক্রবর্তী। প্রায় ওই সময়েই শৈলবাবুর প্রথম রাজনৈতিক কার্টুন প্রকাশিত হয় ‘দীপালী’ পত্রিকায়। কার্টুনে ছিল প্রাক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন পরিস্থিতির তির্যক চিত্রায়ন। নববধূর বেশে স্ট্যালিন বরবেশী হিটলারকে (যিনি পোল্যান্ডের মানচিত্রের ওপর চেপে বসে আছেন) বলছেন, একটু সরে বস।

চারের দশক থেকেই বাংলা প্রকাশনার জগতে তিনি রীতিমতো পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর হাতে অলংকৃত হয়েছে তারাশঙ্কর, মাণিক, শৈলজানন্দ, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্রের মতো সাহিত্যিকদের গল্প ও উপন্যাস। অলংকরণ করতে গিয়ে নিজের স্টাইলকেও বহুবার পালটেছেন তিনি। নিব, তুলি সহযোগে সরু মোটা নানা রেখার পরিক্রমা আমাদের মুগ্ধ করেছে।
পাঁচ, ছয় ও সাতের দশকে শৈল চক্রবর্তী পুরোদমে কাজ করেছেন। ‘যুগান্তর’, ‘বসুমতী’, ‘নবকল্লোল’, ‘অচলপত্র’, ‘দেশ’, ‘বঙ্গশ্রী’, ‘শিশুসাথী’, ‘সচিত্র ভারত’, ‘যষ্টিমধু’, ‘টেক্কা’— এইসব পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর যে সব ব্যঙ্গচিত্র তা মূলতঃ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের মজার মুহুর্ত বা ঘটনাকে উপজীব্য করেই। তবে সিরিয়াস কার্টুনও কি নেই?



একটি কার্টুনে দেখা যায়, ভবিষ্যৎ পশ্চিমবঙ্গের একটি পূর্বাভাস, যেখানে এক গবেষক দাঁড়িয়ে রয়েছেন, আর তার সামনে একটি সমাধিপ্রস্তরে লেখা রয়েছে,‘একদা এখানে বাঙ্গালী নামে একটি জাতি বাস করত।’
সাম্প্রদায়িকতা নিয়েও তাঁর আঁকা কার্টুন রয়েছে। ‘Divide and Rule’ কার্টুনটি তো অসাধারণ! যা পরাধীন ভারতের সাহেব শাসকদের আক্রমণ করে আঁকা হয়েছিল। ভারতে সাম্প্রদায়িকতার চেহারা নিয়ে ১৯৪৮ সাল নাগাদ লেখা আর ছবি সাজিয়ে ‘Confessions of Mr. Communalism’ নামে একটি বই প্রকাশ করেছিলেন তিনি। এটিই তাঁর একমাত্র ইংরেজি বই। (এর থেকে সাতটি ছবি নিয়ে একটি সংকলনও প্রকাশ হয়েছে সাম্প্রতিককালে। প্রকাশক; মনফকিরা)


(শৈল চক্রবর্তীকে নিয়ে বড় আকারে ডকুমেন্টশনের কাজ শুরু হয় ২০০৩ সালে। বিশ্বদেব গঙ্গোপাধ্যায়ের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় বের হয় ‘রঙ্গ ব্যঙ্গ রসিকেষু’ পত্রিকার শৈল চক্রবর্তী সংখ্যা। এর আগে ‘কিঞ্জল’ পত্রিকা তাঁকে নিয়ে একটি বিশেষ সংখ্যা করেছিল।)
কার্টুন আঁকার সঙ্গে-সঙ্গেই হাস্যরসাত্মক অলংকরণেও তিনি অদ্বিতীয় হয়ে উঠেছিলেন। শিবরামের মজার গল্প তাঁর ছবি ছাড়া ভাবাই যেত না। দৈনিক বসুমতীর রবিবারের পাতায় শিবরাম চক্রবর্তীর কলম ‘বাঁকা চোখে’তে তাঁর কার্টুন ছিল পত্রিকার বড় আকর্ষণ। পাঁচ ও ছয়ের দশকে ‘দেব সাহিত্য কুটির’ থেকে প্রকাশিত যাবতীয় গল্পের বই ও পূজাবার্ষিকীগুলো একেবারে মাতিয়ে রাখতেন তিনি। সাতের দশকের প্রারম্ভে কার্টুনচর্চায় ভাঁটা পড়লেও ১৯৮৬ সালে সুকুমার রায়চৌধুরী ‘কার্টুন’ (পরে ‘সরস কার্টুন’) পত্রিকা প্রকাশ করা শুরু করলে, সেই পত্রিকায় তাঁর বেশ কিছু কার্টুন ও সরস নাটিকা প্রকাশ হয়েছিল।


প্রথাগত আঁকা না শিখলেও, শৈল চক্রবর্তী ড্রয়িংটা এত সুন্দর জানতেন যে, তাতে যেমন একটা ভীষন ফ্লেক্সিবল ব্যাপার থাকত, আবার ব্যঙ্গাত্মক ভাবের সঙ্গে সরল আর দিশি মেজাজটাও থাকত অটুট। প্রখ্যাত ব্যঙ্গচিত্রকার ও অলংকরণশিল্পী দেবাশীষ দেবের লেখায়, “১৯৫০ এর দশকের শেষ দিকে শিবরামের একটা গল্পসংগ্ৰহ বেরিয়েছিল— ‘হিপ হিপ হুররে’— বাবা কিনে দিয়েছিল। খুবই ছোট তখন আমি— এত মজার সব গল্প যে পড়ে পড়ে প্রায় মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল আর পাতায় পাতায় শৈলবাবুর ইলাস্ট্রেশনগুলোর তো একবারে প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। এত বছর ধরে দেশবিদেশের কত অজস্র শিল্পীর কমিক ইলাস্ট্রেশন তো দেখলাম কিন্তু শৈল চক্রবর্তী আমার কাছে পুরনো হল কই।…” “‘হিপ হিপ হুররে’ বইটাতে ছিল ‘আমার ব্যাঘ্রপ্রাপ্তি’ বলে যে গল্প, তার পাতাজোড়া রঙিন ছবিটার কথাই ধরা যাক— এখানে দেখা যায় পেল্লায় একটা বাঘ হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে আর যুবক শিবরাম ঝুঁকে পড়ে তার গায়ে হাত বুলিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে ঘুমোচ্ছে কিনা— এই বাঘটাকে আঁকতে গিয়ে এমন আহ্লাদীভাব এনেছিলেন শৈলদা যে আজও আমার ছবিটা দেখলেই মনে হয়— আহা, শিবরামের জায়গায় আমি থাকলে বাঘটাকে কি সুন্দর আদর করতে পারতাম।”
স্বয়ং সত্যজিৎ রায় ছিলেন তাঁর গুণমুগ্ধ। ‘খুড়ো, ভাইপো ও দুদাড়ি’ স্ট্রিপ কার্টুনের স্রষ্টা দীপক চক্রবর্তী, যিনি পরবর্তীকালে বাংলা সিনেমার অন্যতম জনপ্রিয় নায়ক চিরঞ্জিত হিসেবে খ্যাতিলাভ করেন, তিনি লিখছেন, ‘তখন আমি বাংলা চলচ্চিত্রের নায়ক হয়ে উঠিনি। সবে তাঁর কাছে অবজারভার হিসেবে কাজ দেখি। বাবা সন্দেশের জন্য প্রায়ই ছবি অথবা গল্প দিতেন। আর তার মাধ্যমটা ছিলাম আমি। সত্যজিৎ বাবুর সঙ্গে বাবার তখনও মুখোমুখি আলাপ হয়নি। মানিকদা প্রায়ই বলতেন একদিন তোমাদের বাড়িতে যাব তোমার বাবার সঙ্গে আলাপ করতে। একদিন বাবাই বললেন চল আমি যাই। বাবাকে নিয়ে এলাম মানিকদার বাড়ি। বাবাকে হাত ধরে মানিকদা নিয়ে এলে নিজের ঘরে। স্ত্রীকে ডাকলেন। ছেলেকে ডাকলেন। মানিকদা বলছেন, আমি তখন ছোট ছেলে, দেখতাম কাকার (সুবিনয় রায়) কাছে আপনি সন্দেশের জন্য ফুল পেজ রঙিন ছবি দিয়ে যেতেন। আপনি দরজা দিয়ে বার হলেই আমি ছুটে গিয়ে ওই ছবিটা তুলে দেখতাম। আপনার ছবির উপর ট্রেসিং পেপার রেখে আমি লাইন ড্রয়িং প্র্যাকটিস করতাম। আমার হাতের লাইনস তৈরি হয়েছে আপনার ছবি দেখে।” (আনন্দবাজার অনলাইন, ৮ জুলাই, ২০১৭)
অনুজপ্রতীম কার্টুনিষ্ট অমল চক্রবর্তী, শৈল চক্রবর্তীকে তাঁর কার্টুনশিক্ষার গুরু বলে স্বীকার করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘অচলপত্র কাগজের সম্পাদক দীপ্তেন্দ্রকুমার সান্যাল আমাকে শৈলবাবুর সঙ্গে দেখা করতে বলেন। আমি ওঁর কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে নিয়ে সোজা চলে যাই শৈলবাবুর সদানন্দ রোডের বাড়িতে। ভাবতেই পারিনি আমার স্বপ্নের শিল্পী শৈল চক্রবর্তীকে এত কাছ থেকে দেখতে পাব। তিনি আমার ছবি/কার্টুন দেখলেন এবং বাড়িতে মাঝে-মাঝেই যেতে বললেন। তিনি আমার আঁকায় ভুলচুকগুলো শুধরে দিতেন। সেই শুরু। তারপর থেকে আমি নিয়মিত তাঁর বাড়িতে যেতাম এবং ক্রমশই ওনার পরিবারের একজন হয়ে উঠলাম।”
“আজও যখন ক্লান্ত হয়ে অন্যমনস্ক হয়ে যাই, কাজ করতে ভাল লাগে না, তখন হঠাৎ মনে হয় কাঁধে হাত রেখে তিনি বলছেন থেমে যেও না অমল,…এই দেখ আমি তোমার সঙ্গেই আছি। এগিয়ে চলো।” (শ্রীশৈল; শৈল চক্রবর্তী সমগ্ৰ)।
২০২৩-এ অমল চক্রবর্তীর চলা শেষ হয়ে আসার সঙ্গে-সঙ্গে সেই উত্তরাধিকার বহন করার মত আর কেউই রইলেন না।
‘লিটল ডাকু’ শৈল চক্রবর্তীর অন্যতম স্ট্রীপ কার্টুন। “এলিয়াস নাম দিয়ে আমিই প্রথম বাচ্চাদের স্ট্রিপ আঁকি। ডাকু একটি অত্যন্ত প্রিয়দর্শন, বুদ্ধিমান, মৌলিক চিন্তাশক্তিসম্পন্ন ছেলে। সে অনিষ্টকারী ছিল না।’ (রেখায় লোক হাসানোর ক্ষমতা; শৈল চক্রবর্তী: শৈল চক্রবর্তী সমগ্ৰ)
‘হাঁদা-ভোঁদা’, ‘নন্টে-ফন্টে’র উত্তরসূরী ছোট ছেলে ‘ডাকু’র নানা মজার কাণ্ডকারখানা দেখলে ‘হেনরি’ বা ‘গাবলু’ / ‘গুণধর’, বাড ব্লেকের ‘টাইগার’, হ্যাঙ্ক কেচামের ‘ডেনিস দ্য মেনেস’ বা শুলৎসের ‘পিনাটস’-এর কথা মনে পড়ে যায়। তবে সবচেয়ে মনে পড়ে নরম্যান থেলওয়েলের ‘চিকো’ (chicko) স্ট্রীপটার কথা।
পুত্র চিরঞ্জিত চক্রবর্তীর কথায়, “‘লিটল ডাকু’ এত জনপ্রিয় হয়েছিল যে, অমৃতবাজারে টানা ষোলো বছর ধরে বেরিয়েছে। যদিও দুটোই অবশ্য ইংরেজিতে বেরোত। লিটল ডাকুর সঙ্গে আমার একটা মিল আছে জানেন। আমার কপালে চুল যেমন হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকত, ডাকুরও তাই। বাবা বলতেন, সেই মুখ আর চুল নাকি আমার চেহারা দেখে আঁকা। এ জন্য ছোটবেলায় আমাকে ‘ডাকু’ বলে ডাকত সকলে। বাবা ছিলেন প্রকৃতি রসিক। আর সে রসবোধ জারিত হয়েছিল কার্টুনে। বিভিন্ন মানুষের কথা, হাসি, অঙ্গভঙ্গি নকল করে আমাদের হাসাতেন অনায়াসে।”
ডাকুর পরে ডাকুর আদলেই ছোটকু ও বৈজুকে তৈরি করেছিলেন। সি এল টি-র প্রতিষ্ঠাতা সমর মুখোপাধ্যায় পরে শৈলবাবুর অনুমতি ও সাহায্যে ডাকুকে নিয়ে একটি নাটক লিখে ফেলেন, যা সি এল টি-র ক্ষুদে কুশীলবরা মঞ্চস্থ করে। সিধু ও টুটু নামের দুই ভাইবোনকে নিয়ে কমিক্সগুলি অবশ্য সংখ্যায় খুব বেশি নয়।
শৈল চক্রবর্তীর দারুণ মজার চিত্রকাহিনীগুলির অন্যতম হল, ‘গোয়েন্দা গদাই’, ‘ডমরু চরিত’, ‘কুম্ভীর বিভ্রাট’, ‘স্বদেশী কোম্পানি ও ভিকু ডাক্তার’, ‘ম্যাজিসিয়ান ডাকু’।
শৈল চক্রবর্তী মানেই মজার ছবি, হাসির কমিক্স এই প্রচলিত ধারণার বাইরেও বেশ কিছু বাস্তবধর্মী কমিকস তিনি করেছেন। সেখানে তিনি বিদেশি রিয়েলিস্টিক স্টাইলটা সযত্নে পরিহার করে নিজস্ব ঘরানায় ছবিগুলি এঁকেছেন। (‘পৃথিবীর দুর্ধর্ষতম জলদস্যু’, ‘পিয়ারী দ্য লাভেবল টাইগ্ৰেস’, ‘উত্তুঙ্গ শিখর’, ‘সিন্ধবাদ ও তার দুঃসাহসিক ভ্রমণ কাহিনী’, ‘রাইটার্স অভিযান নিয়ে’ ‘স্বাধীনতা সংগ্ৰামে বাংলার রক্তে লেখা একটি কাহিনী’, ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে’ ‘পূবের আকাশ লাল’)
সাহিত্যক্ষেত্রে অলংকরণ শিল্পী রূপে প্রসিদ্ধ হবার পরে শৈল চক্রবর্তী বাংলা শিশুসাহিত্যেও পরিচিতি পেয়েছিলেন নিজের প্রতিভায়। নিজের বই নিজেই অলংকরণ করতেন তিনি, প্রচ্ছদও তাঁর নিজের আঁকা। প্রকাশকরা সরাসরি চিত্রিত পাণ্ডুলিপি পেয়ে যেতেন। শিশুসাহিত্যকে দীর্ঘদিন ধরে রেখায় ও লেখায় সমৃদ্ধ করেছিলেন তিনি, গল্প লিখে, ছড়া লিখে, ছবি এঁকে, ছবিতে গল্প বা কমিক্স পরিবেশন করে। লিখেছেন রূপকথা ধর্মী গল্প, জীবজন্তুর গল্প, নাটক, ভূতের গল্প।
‘যুগান্তর’ কাগজে বিজ্ঞানভিত্তিক সরস লেখা লিখে তাঁর লেখালেখির সূত্রপাত। ক্রমে লেখার পরিধি ও বিষয়বৈচিত্র্য বেড়েছে। মজাদার কিছু কল্পবিজ্ঞানভিত্তিক গল্পের মাধ্যমে প্রফেসর বুদ্ধিধরকে এনেছিলেন আমাদের কাছে। খেয়ালী সাদাসিধে বুদ্ধিধরের চেহারায় প্রফেসর শঙ্কুর একটা আদল আছে। শৈল চক্রবর্তীর সৃষ্টির আরেকটি দিক হল ক্যালিগ্ৰাফি। অসংখ্য হেডপিসে যার নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে।
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ভাবনায় শৈল চক্রবর্তী এঁকেছিলেন ‘কলিকাতা পৌরসংস্থা’র লোগো। (পরবর্তীকালে ‘কলিকাতা’ যখন ‘কলকাতা’ হল, তখন মূল ভাবনাকে অক্ষুন্ন রেখে সেই লোগোটি এঁকে দেন সুযোগ্য পুত্র চিরঞ্জিত চক্রবর্তী যা আজও বর্তমান।)

প্রসঙ্গত, রেবতীভূষণ ঘোষের মতোই শৈল চক্রবর্তীও শংকর পিল্লাইয়ের আহ্বানে দিল্লির চিলড্রেন বুক ট্রাষ্টে যোগ দেন, কিন্তু ওপরওয়ালাদের সঙ্গে তাঁর প্রতিভার দার্শনিক সংঘাত ও রুচিবিরুদ্ধ কাজে অনিচ্ছার কারণে দিল্লির পাততাড়ি গুটিয়ে ফিরে আসতে হয়। এছাড়া দিল্লির অতিরিক্ত ঠান্ডাও তাঁর স্বাস্থ্যের পক্ষে অনুকূল ছিল না। একসময়ে তিনি বেঙ্গল গভর্নমেন্টের ডাইরেক্টরেট অব পাবলিক ইনফরমেশন বিভাগের আর্টিস্ট হিসাবে কাজ করেছেন। কলকাতা দূরদর্শনে সেই সুবর্ণযুগে শৈল চক্রবর্তী ‘চিচিং ফাঁক’-এ আঁকা শেখানোর অনেক অনুষ্ঠান করেছিলেন। এছাড়া পাপেট ও ম্যারিওনেট ( string puppet ) নিয়ে নানা মজার নাটিকাও অনুষ্ঠান করেছিলেন। আমি নিজেই তা আগ্ৰহভরে দেখতাম। সেই মনোরম স্মৃতি ভোলা যায় না।
চিরঞ্জিত চক্রবর্তীর স্মৃতিচারণায়, “আমি বাবার হাত ধরে কলকাতায় আমেরিকান বিল বেয়ার্ড বা চেকোস্লোভাকিয়ান মাষ্টার ওবরাৎসভের অসাধারণ পাপেট দেখে মুগ্ধ হয়েছি। কিন্তু শৈল চক্রবর্তী বা আমার বাবা শুরু করেছিলেন অনেক আগে। তাঁর তৈরি ‘মিত্তিরমশায়’ ১৯৫৬ সালে পেপিয়ার মেশি পদ্ধতিতে তৈরী প্রথম গ্লাভ পাপেট হেড। যাকে ভারতের আধুনিক পাপেট্রির প্রথম পুতুল বলা হয় এবং সেই অর্থে হয়ত শৈল চক্রবর্তীকে আধুনিক পাপেটের ‘জনক’ বলা যেতে পারে। আমাদের বাড়ি তখন ঢাকুরিয়ায়। আমাদের ভাইবোনেদের ও তাদের খুদে বন্ধুদের মনোরঞ্জনের জন্য (অবশ্য নিজের শৈল্পিক তাগিদ তো বটেই) বাবা পাপেট বানাতেন। একটা ছোট টেবিলে স্টেজ বানিয়ে তার ওপর নিজেরা পুতুল নাচাতাম আমরা। তারপর আস্তে-আস্তে ‘পুতুল রঙ্গম’ তৈরি হল। বেথুন কলেজ, রামকৃষ্ণ মিশন, মহাজাতি সদনের মত বহু জায়গায় শো করেছিলাম আমরা। ‘নকুড় বাঘা’, ‘হসন্তপুরের রাজা’ আরও দারুন দারুন সব গল্প। প্রখ্যাত সুরকার প্রবীর মজুমদার ও নামকরা অভিনেতা শিল্পীরা মিলে রং সঙ্গীতে আনন্দের ধারা বইত। বাবা গ্লাভ পাপেট, রড পাপেট, স্ট্রিং পাপেট সবরকম পাপেটই তৈরি করেছিলেন। তার এই প্রয়াস অবশ্য পরিবারের সবাইকে নিয়েই প্রধানত সংগঠিত হত। মানে আমাদের ভাইবোনদের নিয়ে।” (শৈল চক্রবর্তী ও আধুনিক পাপেট্রি ; শৈল চক্রবর্তী সমগ্ৰ)
১৯৫১ সালে ভারতের প্রথম আ্যানিমেশন ছবি ‘মিচকে পটাশ’-এর পশ্চাৎপট অঙ্কনের দায়িত্ব এসে পড়েছিল শৈল চক্রবর্তীর ওপর। পরবর্তীকালে ‘shadow puppet’ পদ্ধতিতে ‘Useful Giant’ নামে একটি আ্যনিমেশন ছবিও নির্মাণ করেছিলেন তিনি। সেখানে স্টিম ইঞ্জিনের বাষ্পশক্তিকে উপকারী দৈত্যের সঙ্গে তুলনা করে, অজয় বলে একটি ছেলেকে নায়ক করে ছবিটা নির্মিত হয়েছিল। রাজ্য সরকারের সহায়তায় তৈরি করেছিলেন কার্টুন ছবি ‘চ্যাঙা ব্যাঙা’। ১৯৫২ সালে চৌরঙ্গি টেরাসে তাঁর প্রথম একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।
‘মানুষ এল কোথা থেকে’ ও ‘ছোটদের ক্রাফট’ বই দুটির জন্য শৈল চক্রবর্তী রাষ্ট্রীয় পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭৯ সালে আন্তর্জাতিক শিশুবর্ষে একাডেমী অব ফাইন আর্টসে তাঁর যে একক প্রদর্শনী হয়েছিল তাতে দেখা গিয়েছিল রূপকথার কল্পনা ও ভাবের বর্ণিল জগতের চিত্ররূপময় এক অভিব্যক্তি। এছাড়া ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো (১৯৭৪) ও যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সিতে তাঁর একক প্রদর্শনী হয়। বিদেশে এই প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন তাঁর সুযোগ্যা প্রবাসিনী কন্যারা।

আসলে শিশুদের মনের জগতকে ধরার এক অক্লান্ত প্রয়াস তাঁর মধ্যে দেখা যেত। স্বচিত্রিত অজস্র ছড়া তিনি লিখেছেন, ছোটদের নানা পত্রপত্রিকায় তা ছড়িয়ে আছে। ‘আয়রে আয় টিয়ে’, ‘নোটন নোটন পায়রাগুলি’, ‘ছড়ার দেশে টুলটুলি’, ‘ছবি ছড়ায় ঝিলমিল’, ‘বেজায় হাসি’, ‘ভালবাসি পোষা জীব’— এসব বই পড়লে এক নরম বর্ণময় জগৎ ধরা দেয়। তাঁর নিজের স্মৃতিচারণায়, “আমার বেশ মনে আছে, কত আর ৪/৫ বছর বয়স হবে। একটা প্রাইমারি স্কুলে পড়তে যাচ্ছি। রাস্তাটার পাশে পড়ত একটা ডোবা, তাতে শালুক ফুল ফুটেছে। পাড়ে লম্বা ডাঁটায় ঘাসফুলের ওপর উড়ে বেড়াচ্ছে প্রজাপতি। আকাশের সাদা মেঘের চলচ্ছবি জলের ওপর ভাসছে, কানে আসছে পাখির ডাক। ব্যাঙ লাফানো শব্দ— কি মজাই না লাগত। মনটা যেন হারিয়ে যেত। দাঁড়িয়ে যেতাম কিছুক্ষণ। কিন্তু স্কুলে গিয়েই দিদিমণির বকুনি, এত দেরী হল কেন? আধঘন্টা নাকি লেট। ঘড়ির সঙ্গে তো তখন পরিচয়ই নেই। সে যে কি এক কড়া মেজাজের বস্তু তার হদিস কি পেয়েছি তখন !”
“একটা সুন্দর কথা বলেছেন শিশুতাত্ত্বিক জে পিয়ার্স। তিনি বলেছেন, শৈশবটা আমাদের যেন একটা রণক্ষেত্র। দুটো শক্তির সংঘর্ষ চলে তখন। একদিকে প্রকৃতিদেবী জৈবিক ধর্মের অনুশাসনে শিশুকে চালিত করতে চান। আর অন্যদিকে বাইরে থেকে আক্রমণ করেন অত্যাগ্ৰহশীল অভিভাবক ও তাঁর সমাজপরিবেশ। দুপক্ষের টানাটানির শিকার হতে হয় শিশুকে। একটু লক্ষ্য করলেই তুমি এই সংঘর্ষের ছবি পাবে।” ( শিশু বিচিন্তা, শৈশবটা যেন রণক্ষেত্র, শৈল চক্রবর্তী, শৈল চক্রবর্তী সমগ্ৰ)
আসলে শিশুদের মনের জগতকে ধরার এক অক্লান্ত প্রয়াস তাঁর মধ্যে দেখা যেত। স্বচিত্রিত অজস্র ছড়া তিনি লিখেছেন, ছোটদের নানা পত্রপত্রিকায় তা ছড়িয়ে আছে। ‘আয়রে আয় টিয়ে’, ‘নোটন নোটন পায়রাগুলি’, ‘ছড়ার দেশে টুলটুলি’, ‘ছবি ছড়ায় ঝিলমিল’, ‘বেজায় হাসি’, ‘ভালবাসি পোষা জীব’— এসব বই পড়লে এক নরম বর্ণময় জগৎ ধরা দেয়।
১৯৪০ সালে উত্তর কলকাতা ছেড়ে শৈল চক্রবর্তী বাড়ি ভাড়া নেন দক্ষিণ কলকাতার কালীঘাটের সদানন্দ রোডে। (কালীঘাটের বাড়িতে থাকাকালীন স্বাধীনতা সংগ্ৰামকে বিষয় করে ৩৮টি পোস্টারধর্মী ছবি জলরংয়ে তিনি আঁকেন, যা নিয়ে স্থানীয় ক্লাব একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করে।) ১৯৫০-৫১ সালে ঢাকুরিয়ার কালীবাড়ি রোডে নিজের বাড়িতে সংসার স্থানান্তকরণ করেন তিনি। সে-বাড়ি তৈরির সময়ে প্রখর রোদেও ছাতা মাথায় দিয়ে মিস্ত্রিদের কাজ তদারক করেছেন। ফ্রিল্যান্সিং করেই জীবিকা অর্জন করেছেন এবং কলকাতার বুকে দুটি বাড়ি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই অসাধারণ শিল্পী তাঁর ছেলেমেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখতেন, তাঁদের খেলা ও অবসরের সঙ্গী হতেন ও তাদের দক্ষতাকে উৎসাহ দেবার কাজটি তিনি আদর্শ পিতার মতই করে যেতেন।
‘কার্টুনদল’ এর সদস্য, শৈল চক্রবর্তীর পুত্র ও বিজ্ঞাপন জগতের কৃতী ব্যক্তিত্ব অমিতাভ চক্রবর্তীর কাছে শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর বাবাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ। দুঃখের বিষয়, এই বছরেই (২০২৫) অমিতাভদার অকালপ্রয়াণ ঘটেছে।
শৈল চক্রবর্তীর আরেক পুত্র শৈবাল চক্রবর্তীর লেখায়, “শিল্পীর চেহারা নিয়ে জন্মেছিলেন এবং শিল্পচর্চায় জীবন কাটিয়ে গেছেন। এটা ছিল বাবার আনন্দ। তাঁর মুখেই শুনেছি, ‘যা হতে চেয়েছিলাম আমি তা হতে পেরেছি, আর আমার কোন দুঃখ নেই।’ তা বলে মানুষ হিসেবে তাঁর কোন খুঁত কি অপূর্ণতা ছিল না? এখন যখন তিনি চোখের সামনে নেই, যখন মোহমুক্ত হয়ে তাঁকে দেখার পূর্ণ সুযোগ উপস্থিত তখন তাঁর কথা ভাবতে গেলে সব মিলিয়েই তিনি দেখা দিতে চান। …বাবার স্বভাবে কোমলতার সঙ্গে একটু অকরুণ দার্ঢ্য ছিল বলে মনে হয়, যেটা তাঁর শিল্পীসুলভ সূক্ষ প্রকৃতির সঙ্গে মিশ খেত না।… এই কঠোরতা অবশ্য বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমে আসে এবং আমরা যাঁরা তাঁর প্রথম বয়সের সন্তান তাঁরা তাঁর এই পুরুষ প্রকৃতির মুখোমুখি হয়েছি বেশি এবং অবাক হয়েছি ভেবে, যাঁর তুলির টানে এমন কোমলতা, ব্যঙ্গচিত্রে এত ঔজ্জ্বল্য, হিউমারের ঝিলিক তাঁর প্রকৃতিতে এমন ক্ষমাহীনতা কি করে মিশে থাকে। তবে সে উত্তরটাও পেয়েছি তাঁর বা কোন ভাল শিল্পীর ছবির দিকে তাকিয়ে। চিত্রকরের প্যালেটে লাল, কমলা রং যেমন থাকে, তেমনি থাকে কালো ও বেগুনি। নীল আকাশের নীচে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে যে পাহাড় তার রং ধূসর। মেঘ যত পেলব, পাথর ততই কর্কশ। একটি শান্ত প্রসন্ন শরৎকালের সকাল যেমন সত্যি, কালবৈশাখীর ঝড়ে বিক্ষুব্ধ বৈশাখের সন্ধ্যাও তেমনি সত্যি। সব রং নিয়েই ছবি। মানুষও তাই। বাবাও তেমনই ছিলেন। পুরোপুরি একজন মানুষ। উচ্চতা যতখানি, দোষেগুণে ঠিক ততটাই সম্পূর্ণ মানুষ একজন।” (মানুষ শৈল চক্রবর্তী: শৈল চক্রবর্তী সমগ্ৰ)
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: বিশ্বদেব গঙ্গোপাধ্যায়
তথ্যসূত্র:
বিষয় কার্টুন, শৈল চক্রবর্তী সংখ্যা, সম্পাদক: বিশ্বদেব গঙ্গোপাধ্যায়, ২০০৩
শৈল চক্রবর্তী সমগ্ৰ ১, সম্পাদনা: বিশ্বদেব গঙ্গোপাধ্যায়, লালমাটি, বইমেলা ২০১৬
শৈল চক্রবর্তী অমনিবাস, সম্পাদনা: ব্রতীন দে, মন্দাক্রান্তা, ডিসেম্বর ২০০৯
কার্টুন: শ্রী শৈল চক্রবর্ত্তী, কারিগর , বইমেলা ২০১৬