সম্প্রতি ইরানে ইজরায়েলের ধারাবাহিক আক্রমণ নিয়ে যখন সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) কড়া ভাষায় নিন্দা জানাল, তখন দেখা গেল ভারত তাতে সই করল না। এই সিদ্ধান্তে অনেকেই অবাক, কারণ ভারতের এই অবস্থান দেখিয়ে দিল, ইউরেশিয়া অঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক জোটের ভেতরে ফাটল ধরতে শুরু করেছে।
এই হামলার প্রেক্ষিতে, যখন ইজরায়েল, ইরানের সেনা ও পারমাণবিক ঘাঁটিগুলিতে আক্রমণ চালায়, তখন চিন, রাশিয়া, কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান-সহ এসসিও-র বাকি সদস্য দেশগুলো শান্তির বার্তা দেয় এবং ইজরায়েলের আগ্রাসনের বিরোধিতা করে। অথচ ভারত, যার একদিকে ইজরায়েলের সঙ্গে বহু কোটি টাকার প্রতিরক্ষা চুক্তি আছে, আর অন্যদিকে ইরানের সঙ্গে দীর্ঘদিনের তেল ও পরিকাঠামো-ভিত্তিক সম্পর্ক রয়েছে, তারা নিরপেক্ষ থাকার পথ নেয়!
আরও পড়ুন: শরণার্থী শিবিরেও নিরাপদ হতে পারেন না যে উদ্বাস্তুরা তাঁদের সুদিন কবে আসবে?
লিখছেন অর্ক ভাদুড়ী…
২০২৪ সালের গাজা যুদ্ধ চলাকালীন, ‘আল জাজিরা’ সংবাদ মাধ্যমের একটি রিপোর্টে উঠে আসে, ভারত ইজরায়েলকে রকেট ও বিস্ফোরক পাঠিয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে এসসিও-র নিন্দা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া ভারতের পক্ষে কার্যত ইরান-বিরোধী অবস্থান নেওয়ারই নামান্তর।
এই ঘটনার ঠিক আগের দিন, জাতিসংঘে (ইউএন জেনারেল অ্যাসেম্বলি) গাজায় তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি চেয়ে একটি প্রস্তাবে ভোট হয়। সেখানে ভারত আবারও ভোটদানে বিরত থাকে। ফলে আন্তর্জাতিক মহলে একটা বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ে— ভারত আদতে কার পাশে?
এই অবস্থানে অনেকেই বুঝে নিচ্ছেন, ভারত আমেরিকার সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতেই এই কৌশল নিচ্ছে। বিশেষ করে যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও হুমকি দিয়েছেন যে, ভারতীয় পণ্যের ওপর ২৭ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক চাপাতে পারেন, তখন নয়াদিল্লির মাথায় নতুন করে হিসেব কষা শুরু হয়েছে।
একদিকে যদি থাকে চিন-রাশিয়া-ইরান জোট, অন্যদিকে ভারত-আমেরিকা-ইজরায়েল-এর ক্রমশ দৃঢ় হওয়া সম্পর্ক— এই দুইয়ের টানাপোড়েনে ভারসাম্য রাখা ভারতের পক্ষে সত্যিই কঠিন।
এখানে বড় প্রশ্ন উঠছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী-র নেতৃত্বাধীন সরকার কি ভুলে গেছে যে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ইরান ছিল ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম তেল রপ্তানিকারক দেশ? ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অফ অ্যাকশন (জেসিপিওএ) থেকে আমেরিকাকে সরিয়ে নেন, তখন থেকেই ইরানের ওপর ফের নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়, আর ভারত তেল আমদানি বন্ধ করে দেয়।
ভারতের বর্তমান পররাষ্ট্রনীতি, বিশেষত ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন ইস্যুতে, দু-দিক বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করছে— যা অনেকেই মনে করেন দেশের দক্ষিণপন্থী, হিন্দুত্ববাদী জনতার মন পাওয়ার চেষ্টা। আসলে স্বাধীনতার পর জওহরলাল নেহরু-র সময় থেকেই ভারত প্যালেস্টাইনের পক্ষে ছিল। উপনিবেশ বিরোধী মনোভাব থেকে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও)-কে সমর্থন করত ভারত। ১৯৫০ সালে ইজরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও, ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক শুরু হয় অনেক পরে—১৯৯২ সালে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর, ভারতের অর্থনৈতিক খোলনলচে বদলের সময়।


এই সময়ে আমেরিকা ভারতের কাছে হয়ে ওঠে একটা নতুন কৌশলগত ভরসা। চিন-পাকিস্তান মোকাবিলায়, আর সিলিকন ভ্যালি-এর মাধ্যমে বিনিয়োগ টানার দিক থেকেও আমেরিকা ছিল বড় উৎসাহদাতা। এর সূত্র ধরেই ইজরায়েল-এর সঙ্গে সম্পর্ক গভীর হয়—কারণ ইজরায়েলকে ধরেই আমেরিকার সঙ্গে সংযোগ গড়ে তোলা সহজতর হয়।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রক যদিও বলে থাকে তারা নিরপেক্ষ, কিন্তু বাস্তবে গাজা যুদ্ধের সময়ে জাতিসংঘের এমন সব প্রস্তাবে ভোট দিয়েছে, যেখানে হামাস-এর বিরুদ্ধে তীব্র ভাষা থাকলেও, ইজরায়েলের আক্রমণ নিয়ে কিছু বলা হয়নি। এটা আবার প্রমাণ করে দিয়েছে যে নয়াদিল্লি এখন আরও স্পষ্টভাবে পশ্চিমাপন্থী।
এদিকে, ইজরায়েলের সঙ্গে ভারতের প্রতিরক্ষা সম্পর্কও সময়ের সঙ্গে বেড়েছে। রাফায়েল অ্যাডভান্সড ডিফেন্স সিস্টেমস-এর সঙ্গে বারাক ৮ মিসাইল প্রজেক্ট, এলবিট সিস্টেমস-এর সঙ্গে জোড়া উদ্যোগ— সব মিলিয়ে বার্ষিক প্রতিরক্ষা বাণিজ্য ১০ বিলিয়ন ডলারের গণ্ডি ছাড়িয়ে গেছে। এই সম্পর্ক শুধু কূটনৈতিক বা সামরিক নয়, আদর্শগত মিলও স্পষ্ট। লিকুদ পার্টি-র বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)-র নরেন্দ্র মোদী, দুই নেতাই নিজ-নিজ দেশে জাতীয়তাবাদী, ধর্মনির্ভর রাজনীতির মুখ।
৭ অক্টোবর, ২০২৪-এ হামাসের হামলার পরে ভারত একেবারে সোজাসুজি ইজরায়েলের পাশে দাঁড়ায়। সেই সঙ্গে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলির একটা বড় একটা অংশ— যেমন রিপাবলিক টিভি, টাইমস নাও, এবং অনেক প্রভাবশালী সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার— তাদের অবস্থানও খোলাখুলি ইজরায়েলপন্থী।
এমনকী, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রক ঘোষণা করে, ভারত এক লক্ষ শ্রমিক ইজরায়েলে পাঠাতে আগ্রহী। যেখানে যুদ্ধ চলছে, সেখানে এত বিপুল সংখ্যক ভারতীয় পাঠানোর ঘোষণা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
ইজরায়েল অনেক হিন্দুত্ববাদীর চোখে এক ‘আদর্শ রাষ্ট্র’— একটা এমন রাষ্ট্র যারা ইসলামের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে থাকে, প্রযুক্তিতে উন্নত, কিন্তু ঐতিহ্যও ধরে রেখেছে। অনেক হিন্দুত্ববাদী নেতাই, যেমন মোহন ভাগবত বা যোগী আদিত্যনাথ, প্রায়শই এক ‘হিন্দু ইজরায়েল’ গঠনের কল্পনার কথা বলেন। এই দু-দেশের ইতিহাসের দিক থেকেও মিল রয়েছে— ভারত ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হয়, আর ইজরায়েল রাষ্ট্র গঠিত হয় ১৯৪৮ সালে। দুই দেশই বহু শতক ধরে রাজনৈতিক শক্তিহীনতার শিকার ছিল, তারপর নিজস্ব রাষ্ট্র গড়ে তুলেছে।
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে যেমন জাপানকে অনেকে এশীয় জাতীয়তাবাদী অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে দেখতেন— তেমনই আজকের অনেক হিন্দু জাতীয়তাবাদী ইজরায়েলকেও সেই রকম ‘এথনো-স্টেট’ হিসেবে দেখেন।
এই ভূ-রাজনীতির বাঁকে, একটা অদ্ভুত ও ভয়ংকর সমীকরণ তৈরি হয়েছে—দক্ষিণ এশিয়ার উগ্র হিন্দু সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস), শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী সংগঠন বোদু বালা সেনা, এবং মায়ানমারের ৯৬৯ মুভমেন্ট—তারা মিলে ‘হিন্দু-বৌদ্ধ শান্তি অঞ্চল’ গড়ার ডাক দিয়েছে। এই জোটের পেছনে অস্ত্র সরবরাহকারী হিসেবে ইজরায়েলকেও সন্দেহ করা হচ্ছে।
২০১৪ সালে ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, এই জোট নিয়ে তখনও আন্তর্জাতিক মহলের সেভাবে নজর ছিল না। কিন্তু এখন এসব জোট, অস্ত্র, বাণিজ্য এবং ধর্মনির্ভর রাজনীতি— একসঙ্গে মিলে একটা আশঙ্কাজনক দিশা দেখাচ্ছে।
রাম মাধব, যিনি সে-সময়ে আরএসএস-এর মুখপাত্র ছিলেন, তাঁর ফেসবুক এবং টুইটারে অভিনন্দনবার্তাও দেওয়া হয়েছিল এই বৌদ্ধ সন্ত্রাসী সংগঠনটিকে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে এই অরাজকতা সৃষ্টিকারী সংগঠনগুলির সঙ্গে আরএসএস-এর সংযোগের গভীরতা, অবশ্যই ইজরায়েলের কাছ থেকে অজস্র অস্ত্র কেনার প্রেক্ষিতে বুঝতে সাহায্য করবে।
আজ যখন ব্রিকস-এর মতো সংগঠনগুলি ডলারের বিকল্প মুদ্রা খুঁজছে, যখন জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি ফ্রানচেস্কা আলবানিজে গাজার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে লিখছেন ‘এই গণহত্যা একটি স্বাধীন সার্বভৌম ভূমির ঔপনিবেশিক বিমোচন’, সোজা ভাষায় বললে ‘কলোনিয়াল জিনোসাইড’— তখনও উপনিবেশের সহযোগী হয়ে থাকা সংঘের নেতা-কর্মীরা ভারতের বিদেশনীতির উপনিবেশ-বিরোধী উত্তরাধিকারকে নিজেদের হিন্দুত্বের ছকে ফেলে কলুষিত করছেন। বোঝাই যাচ্ছে, ভারত স্পষ্টভাবে মার্কিন ঘরানার রাজনীতিকে অনুসরণ করছে।
ইরানের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক হামলা ও পারমাণবিক যুদ্ধের সলতে পাকানোর পরিস্থিতির মধ্যেই কার্যত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর মধ্যস্থতায়, ঘোষণা হল সংঘর্ষ-বিরতি। এই নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নানাবিধ তর্কাতর্কির মধ্যে একটা জিনিস স্পষ্ট হয়ে উঠছে— ভূ-রাজনীতির কিছু মৌলিক সমীকরণ এখন নতুন ভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। ইউক্রেনের রাষ্ট্রপ্রধান ভলোদিমির জেলেনস্কি যেমন সরাসরি মার্কিন রাষ্ট্রের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, তেমনই ভারতের ভূমিকা এই নতুন বিশ্ব-পরিস্থিতিতে কীভাবে নির্ধারিত হয়, সেটিও আগামী দিনের গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণের বিষয়।