ঋতুদা: লেন্সের ওপারে

Rituparno Ghosh

ঋতুদার সঙ্গে প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের সিনেমায় কাজ করি, ‘হীরের আংটি’-তে; সে-ছবির মূল সিনেমাটোগ্রাফার ছিলেন গিরিশ পাধিয়ার, আমি ওঁর কোম্পানিতে কাজ করতাম, সেই সূত্রে এই ছবিতে কাজ করেছিলাম ক্যামেরা অপারেটর হিসেবে। তবে, ‘হীরের আংটি’ই ওঁর সঙ্গে আমার প্রথম কাজ নয়, আগেও বেশ কয়েকটি বিজ্ঞাপনী ছবিতে কাজ করেছি, মূলত ক্যামেরা অপারেটর হিসেবেই; সে নয়ের দশকের আগের কথা, ঋতুদা তখন ‘রেসপন্স’-এ কাজ করতেন।

‘হীরের আংটি’র পর ওঁর সঙ্গে আমার কাজ ‘অসুখ’ ছবিতে, সেই ছবির মূল সিনেমাটোগ্রাফার ছিলেন অভীকদা, অভীক মুখোপাধ্যায়; আমি ক্যামেরা অপারেটর হিসেবেই কাজ করেছিলাম। এরপর, অভীকদা যে-ক’টি ছবিতে সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করেছিলেন, প্রতিটির সঙ্গেই যুক্ত ছিলাম আমি, এমনকী ঋতুদার শেষ ছবি, ‘সত্যান্বেষী’তেও কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম।

‘অসুখ’ ছবির সেটে ঋতুপর্ণ, সঙ্গে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, দেবশ্রী রায় ও সোহাগ সেন

এতগুলো ছবির মধ্যে সব ছবিই আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ ও কাছের, তাও কিছু ছবি, সেগুলি নির্মাণের মুহূর্ত মনে ছাপ ফেলে যায় এবং সেটা এ-কারণেই ছাপ ফেলে, তার সঙ্গে একজন পরিচালক হিসেবে ঋতুদার সৃষ্টিশীল মনন ও নির্মাণের মুহূর্তগুলো জড়িয়ে। একটা সামগ্রিক প্রোডাকশন যে এত গোছানো হতে পারে তা ঋতুদাকে যে সামনে থেকে কাজ করতে দেখেনি, তার পক্ষে আন্দাজ করা মুশকিল; স্ক্রিপ্ট রিডিং থেকে শুরু করে, সেট-এর মধ্যে নির্দেশনা সবটাই ছিল বিশেষ, মাঝে-মাঝে মনে হত, ঋতুদার স্ক্রিপ্ট রিডিং পর্বটাই যেন একটা গোটা ছবি, সেটাকে কেউ ক্যামেরায় ধরে রাখলে, একটা চমৎকার সিনেমা হতে পারত; ঋতুদা যখন পড়তেন, গোটা দৃশ্যটা স্পষ্ট হত চোখের সামনে, অভিনেতা-অভিনেত্রীকে নিজে প্রায়শই অভিনয় করে বুঝিয়ে দিতেন সম্পূর্ণ দৃশ্যটা।

‘ঋতু ড্রামা ও পজ দারুণ বুঝত’ সুদেষ্ণা রায়ের কলমে পড়ুন : ব্যাকস্টেজ পর্ব ১০

মনে পড়ছে, ‘অন্তরমহল’ ছবির একটা সেট-এ, অন্দরদৃশ্যে (মশারির ভেতর)— ঋতুদা বুঝিয়ে দিলেন, ভেতরটা এবং বাইরেটা কেমন দেখতে হবে, কোনও টেকনিকাল টার্ম ছাড়াই।  শুধু ওঁর ভাষার স্বচ্ছ ব্যাবহার এবং ‘নিজে কী চাইছেন’ এটুকু স্পষ্ট ভাবে বলার জন্য আমরা খুব সহজেই আলো সাজিয়ে, ক্যামেরা নির্দিষ্ট অবস্থানে বসিয়ে ফেলতে পারলাম।

‘চোখের বালি’ আমার খুবই কাছের, সেই ছবিতে বিশেষ একটি ফিল্টার (Tobacco Filter) ব্যবহার করে শুট করা হয়; যেহেতু ছবিটা অতীতের একটা বিশেষ সময়ের কথা বলে, (periodical)— সেই মুডটা ধরবার জন্যই এই ফিল্টারের ব্যবহার করেছিলেন অভীকদা; ‘চোখের বালি’র একদম প্রথম দৃশ্যে, যেখানে একদল এয়োস্ত্রী উলু দিতে-দিতে জল সইতে যাচ্ছিলেন— সেই দৃশ্য শুট করার আগে ঋতুদা আর অভীকদা মৌখিক আলোচনা করে বুঝিয়ে দিলেন। কী আশ্চর্য, ক্যামেরা সেই নির্দেশ অনুযায়ী নির্দিষ্ট অবস্থানে বসিয়ে, আলো ঠিক করার পর দেখা গেল, ঠিক যে-ভাবে ঋতুদা মুখে বলেছিলেন, এবং সেটা শুনে আমরা যা কল্পনা করে ছিলাম— তারই যেন প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠল। ঋতুদার ন্যারেশন করার ক্ষমতা এতটাই স্বচ্ছ ছিল।

আমার তো সেই অর্থে, আর্ট কলেজ-এর ব্যাকগ্রাউন্ড নেই, বা সেই অর্থে ফিল্ম স্কুলিং বলতে যা বোঝানো হয়, তাও নেই; ঋতুদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ঋতুদা, ফ্রেমিং কীভাবে বুঝব? ঋতুদা বলেছিলেন, তুই কমিক্স-এর বই পড়, টিনটিন, বেতাল — যা ইচ্ছে; সেগুলো মন দিয়ে অনুসরণ কর; তাহলেই আলোর সেন্স, (SP- Standerd Play), (EP- Extended Play)— এগুলো সহজে বুঝে যাবি।  

আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ঋতুদার ইউনিটে প্রত্যেকের কাজ ছিল নির্দিষ্ট, সবাইকে আলাদা-আলাদা করে খুব স্বচ্ছভাবে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতেন। পাশাপাশি, সেট-এ যে ছেলেটি চা দেন এবং সেট-এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষটি, সবার কাছে ওঁর গুরুত্ব ছিল সমান। সর্বোপরি প্রত্যেককেই আলাদা নামে চিনতেন, যেন একটা যৌথ পরিবার। ঋতুদার সেটে ছবির কাজ মানেই যেন সেই পরিবারের এক উৎসব।           

ঋতুদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ঋতুদা, ফ্রেমিং কীভাবে বুঝব? ঋতুদা বলেছিলেন, তুই কমিক্স-এর বই পড়, টিনটিন, বেতাল — যা ইচ্ছে; সেগুলো মন দিয়ে অনুসরণ কর; তাহলেই আলোর সেন্স, (SP- Standerd Play), (EP- Extended Play)— এগুলো সহজে বুঝে যাবি।  

ঋতুদার অধিকাংশ ছবিতে, অভীকদার সহকারী হিসেবে কাজ করলেও, একবার আমার সুযোগ হয়েছিল, স্বতন্ত্র ভাবে, ওঁর সঙ্গে ‘DOP’ হিসেবে একটি ছবিতে কাজ করার; ছবিটির নাম, ‘২০ মালতীবালা লেন’।

সময়টা ২০০৭ সাল, ‘খেলা’ ছবিটির শুটিং চলছে, ‘চালসা’য়; তখনই ঠিক হল, ‘২০ মালতীবালা লেন’ ছবিটি করা হবে; কিন্তু অভীকদার ডেট পাওয়া গেল না; অভীকদাই ঋতুদাকে বললেন, ক্যামেরার জন্য আমাকে নেওয়ার কথা;—সর্বোপরি আমারও একটা নিজস্ব কাজ শুরু হবে ঋতুদার সঙ্গে, সবমিলিয়ে ভালই; কিন্তু আমি মূলত সেলুলয়েডেই শুট  করতে সে-সময়ে স্বচ্ছন্দ ছিলাম, ঋতুদাকে বললাম সে-কথা, ঋতুদা বললেন, সেলুলোয়েডে শ্যুট করলে তো বাজেট অনেক বেড়ে যাবে, টেলিফিল্ম-এর জন্য অত বাজেট বাড়াবেন নাকি প্রযোজনা সংস্থা! আমিও জানালাম, সেলুলয়েডে শুট না করলে, আমার পক্ষেও করা সম্ভব নয়; তখন, বুম্বাদা সহায় হলেন, বললেন, শুট সেলুলয়েডেই হবে, তার জন্য অতিরিক্ত যা টাকা লাগবে, আমি দেব। ‘জি’ তখন আলফা বাংলা— তাঁরাই প্রযোজনা করেছিলেন ছবিটি। খুব ভুল না করলে, বাংলায় ওইটিই টেলিফিল্ম হিসেবে শেষ সেলুলয়েডে শুট করা ছবি।

ঋতুদার সঙ্গে স্মৃতির মুহূর্ত ফিরে দেখতে-গেলে, তা সংখ্যার হিসেবে অনেক; কতবার এমনিই ডেকে নিতেন বাড়িতে; ভাইয়ের মতো স্নেহ করতেন; বড় অসময়ে চলে গেলেন ঋতুদা। মনে আছে তখন ‘সত্যান্বেষী’র শুটিং সবে শেষ হয়েছে, আমি অন্য একটা ছবির কাজে শান্তিনিকেতন গেছি, ঋতুদা বললেন, আসার সময় ‘বনলক্ষ্মী’র ঘি নিয়ে আসিস! তা আর দেওয়া হল না, আগেই চলে গেলেন ঋতুদা।

বাংলা সিনেমার জগতে এত লেখাপড়া করা পরিচালকের সংখ্যা বিরল, অনেকেই আছেন, তাঁরা যথেষ্ট গুণী; কিন্তু ঋতুদার অভাব কোনওদিন পূরণ হওয়ার নয়।