ঋতু-বর্ণ

Rituparno Ghosh

ঋতুদা, অর্থাৎ ঋতুপর্ণ ঘোষের সঙ্গে প্রথম কাজ করার ফোনটা যেদিন পেয়েছিলাম, সেদিনটা আমার কাছে সবচেয়ে স্মরণীয় দিন। কত ফোনই তো পাই, কিন্তু মনে থাকে কি? ওই ফোনটা মনে আছে। রামরতনদা, ঋতুদার প্রোডাকশন ম্যানেজার ফোন করে বলেছিল, ‘গোরা, একটা কাজ আছে করবি? ঋতুদার প্রোজেক্টে তোকে স্টিল ফোটোগ্রাফি করতে হবে।’ বিস্ময়ের ঘোর তখনও কাটেনি, শুধু ভয়ে-ভয়ে বলেছিলাম, ‘হ্যাঁ, করব।’ আনন্দ যেমন হচ্ছিল, ভয়ও পেয়েছিলাম বিস্তর। মনে সংশয় ছিল, ঠিকমতো কাজ করতে পারব তো! উপরন্তু অত বড় একজন বিখ্যাত মানুষের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ! যাই হোক, ভয়ে-ভয়ে প্রথম দিন গেলাম, কাজ শুরু করলাম, মনিটরের সামনে ঋতুদা বসেছিল। কথা শুরু হল ‘গুড মর্নিং’ দিয়ে।

ঋতুপর্ণ ঘোষ-এর সঙ্গে বিশ্বনাথ আচার্য

আরও পড়ুন : ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘২০ মালতীবালা লেন’ই ছিল সেলুলয়েডে তোলা শেষ বাংলা টেলি-ছবি! লিখছেন গোপী ভগত

কাজ শুরু করার কিছুক্ষণ পর হঠাৎ ঋতুদা বলে উঠলেন, ‘গোরা, সরে দাঁড়াও! এটা জোন।’ আমি সঙ্গে-সঙ্গে সরে দাঁড়ালাম এবং মনে-মনে আনন্দ পেলাম এই ভেবে যে ঋতুদা আমার নামটা জেনে গেছে। তুচ্ছ ঘটনা, কিন্তু ভোলার উপায় কই! মনে আছে, মাঝে বোনের বিয়ের জন্য দু’দিন ছুটি নিয়েছিলাম। পরে, কাজে যেদিন জয়েন করলাম, ঋতুদা হঠাৎই মাথায় পাগড়ি-চোখে কাজল-কানে দুল পরে বলল, ‘গোরা আমার একটা ছবি তোলো।’ আমি তো তৎক্ষণাৎ রাজি। তবে অসুবিধে একটা ছিল। ঋতুদা যেখানে বসেছিল, সেখানে লাইট ছিল না বললেই হয়। কীরকম ম্লান, আঁধারি চারপাশ। থামিনি যদিও। ক্যাননের ৪৫০ ক্যামেরা দিয়ে ফ্ল্যাশ অন করে ঝপাঝপ কয়েকটা ছবি তুললাম। ছবি তুললে হবে কী, ঋতুদা রেগে অস্থির। বলল, ‘বোনের বিয়ের রেশ এখনও কাটেনি? ফ্ল্যাশ দিয়ে ছবি তোলা হচ্ছে! ফ্ল্যাশ ছাড়া তোলো।’ ভয়ে-ভয়ে লো-শাটারে ছবি তুললাম তারপর। দেখে বলল, ‘এটা বড় করে কালকে আনবি।’ বিপদে পড়লাম, কারণ ছবিটা ৬০০ আইএসও-তে তোলা ছিল। বেশি বড় করলে গ্রেন চলে আসত। বললাম, ‘দাদা, বেশি বড় হবে না, ৬/৮ হবে।’ ‘ঠিক আছে, তাই নিয়ে আসবি।’ তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে শান্ত হই।

মাঝে-মাঝেই অদ্ভুত সব খেয়াল চাপত ঋতুদার। একদিন টিফিনের ঘরে ঋতুদা বলল, ঝালমুড়ি খাব। প্রোডাকশন বলল, এনে দিচ্ছি। শেষে দেখা গেল, এক ঘণ্টা পরেও সেই ঝালমুড়ি আর এসে পৌঁছল না। ঋতুদার মেজাজ ততক্ষণে তিরিক্ষে। রেগেমেগে শুটিং প্যাক-আপ করে চলে গেল। সে কী হইহই-রইরই কাণ্ড! সামান্য মুড়িকে কেন্দ্র করে এত বড় একটা ঘটনা, ভাবা যায়! যদিও শেষে মুড়ি এল এবং শুটিং আবার চালু হল।

‘সত্যান্বেষী’ করার সময়ে ঋতুদা সেটে শট বোঝাচ্ছেন আর ঠিক সেই সময়েই আমি উলটোদিক থেকে ওঁর ছবি তুলছিলাম। ঋতুদা ভয়ানক রেগে যায়। হুকুম করেছিল, ‘যাও, বাইরে বেরিয়ে নিল ডাউন হয়ে বসে থাকো।’ আমি সেটের বাইরে বেরিয়ে চেয়ারে বসে আছি, হঠাৎ একজন এসে বলল, ‘কী রে, তুই চেয়ারে বসে আছিস! ঋতুদা আমায় দেখতে পাঠাল তুই নিল ডাউন হয়ে বসে আছিস কি না।’ ভয়ানক ঘাবড়ে গেছিলাম সেবার। ভেবেছিলাম ওসব কথার কথা। লোক পাঠিয়ে তদন্ত করে না কি কেউ! তারপর ঋতুদা নিজেই এল এক সময়ে। বলল, ‘আমি যখন শট বোঝাব, সামনে থাকবি না, বুঝলি!’ এরপর আমার আর এই ভুল হয়নি। টের পেয়েছিলাম, একজন আদ্যন্ত খুঁতখুঁতে-নিষ্ঠাবান পরিচালকের মন।

ভয়ানক ঘাবড়ে গেছিলাম সেবার। ভেবেছিলাম ওসব কথার কথা। লোক পাঠিয়ে তদন্ত করে না কি কেউ! তারপর ঋতুদা নিজেই এল এক সময়ে। বলল, ‘আমি যখন শট বোঝাব, সামনে থাকবি না, বুঝলি!’ এরপর আমার আর এই ভুল হয়নি। টের পেয়েছিলাম, একজন আদ্যন্ত খুঁতখুঁতে-নিষ্ঠাবান পরিচালকের মন।

আরও একটা ঘটনা এই সূত্রে মনে পড়ছে। বোলপুরে একবার শুটিঙের মাঝে গোটা ইউনিটকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে রেখে ঋতুদা লোকেশন দেখতে চলে গেছিল। একজন সহকারী পরিচালক যদিও পিছন-পিছন যায়নি, তা নয়! এরকমই খামখেয়ালি মানুষ ছিল ঋতুদা। তবে আজ মনে হয়, এসবের পরেও ঋতুদা ছিলেন খাঁটি মনের মানুষ। ওঁর সঙ্গে তিনটে প্রোজেক্টে কাজ করেছিলাম। রবীন্দ্রনাথের ওপর একটি তথ্যচিত্র ‘দ্য কিং অফ ডার্ক চেম্বার’, ‘সত্যান্বেষী’ ও ‘তাহার নামটি রঞ্জনা’ (টেলিভিশনের জন্য নির্মিত)। মাঝে-মাঝে আফশোস হয়, ঋতুদা বেঁচে থাকলে আরও কত কাজ একসঙ্গে করা যেত! একদিকে ঋতুদা যেমন ছিল বর্ণময় মানুষ; তেমনই পরিশ্রমী, একনিষ্ঠ। পরজন্ম বলে কিছু হয় কি না জানা নেই, তবু এখনও ভাবি, আবার যেন ঋতুদার সঙ্গে কাজ করতে পারি, আবার যেন শুনতে পারি, ‘আমি যখন শট বোঝাব, সামনে থাকবি না, বুঝলি!’