বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি কবিতাকে আমি পূর্ণভাবে পেয়েছিলাম শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের দেশ-গাঁয়ে। বলছি বিস্তারে।
জীবন তো সবসময়ে বিভূতিভূষণের দিনলিপির রঙে ছাপানো নয়; সেখানে হরেকরকম মার, নানারকম ভয়। ক্লাস এইট-নাইন থেকেই বুঝতে পারতাম একটা কাজ দরকার। উপার্জন দরকার। ইস্কুল শেষ, কলেজ শেষ যেন বাড়িতে ভাত বয়ে আনে। টিউশনি করতাম। ভোরবেলা সাইকেলে চেপে পড়াতে যেতাম দূরে-দূরে। ছাত্ররা আমাকে কেউ ভয় পেত না তেমন। পড়ানো শেষে ছোট ছেলেমেয়েরা আমবারুণী মেলার আম কুড়িয়ে রাখত। উচ্চমাধ্যমিকের পর অন্য বিষয় নিয়ে পূর্বস্থলী কলেজে ভর্তি হওয়া, জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রাস্তা, কিন্তু এ আমার মনের বিপক্ষের পড়াশোনা। বদলে নিলাম বিষয়। বাংলা পড়ব বলে ভর্তি হলাম কাটোয়া কলেজে। আরও দু-একটা টিউশনি বাড়ালাম। সাইকেলে চেপে একঘণ্টা পথ একলা কলেজ যেতাম। ওই পথটুকু আমার একলাপথ, ওই পথটুকু আমার অপু-পথ।
তেড়ে বাংলা কবিতা পড়ছি। চোখের সামনে খালি গলায় মাস্টারমশাই রবীন্দ্রনাথের গান গাইছেন। ভেতরে ঢুকছে। সাইকেলের পথে ভাবতে-ভাবতে চলেছি। বুঁদ হয়ে, নেশা করেছি যেন। মাথার ভেতরে মধু ক্ষরিত হচ্ছে। গৌতমবাবু ‘পথের পাঁচালী’ পড়াতে গিয়ে বল্লাল সেনের কথা বলছিলেন, কুলীন প্রথার কথা। তারপর হঠাৎ দেখালেন দুর্গার প্রতদিনের খাবার তালিকা, অপুরও। বৈষম্য। খানিক জানালার দিকে তাকিয়ে মন্ত্রের মতো একটি কবিতা বললেন—
অন্নদেবতা / বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
অন্ন বাক্য অন্ন প্রাণ অন্নই চেতনা
অন্ন ধ্বনি অন্ন মন্ত্র অন্ন আরাধনা,
অন্ন চিন্তা অন্ন গান অন্নই কবিতা
অন্ন অগ্নি বায়ু জল নক্ষত্র সবিতা,
অন্ন আলো অন্ন জ্যোতি সর্বধর্মসার
অন্ন আদি অন্ন অন্ত অন্নই ওঙ্কার,
সে অন্নে যে বিষ দেয় কিংবা তাকে কাড়ে
ধ্বংস করো, ধ্বংস করো, ধ্বংস করো তারে
ভাত চেতনার রূপ ধরে আসছে, ভাত শিল্প হয়ে আসছে, ভাত প্রকৃতি হয়ে যাচ্ছে, চোখের সামনে খুলে যাচ্ছে মাইল-মাইল ধানের খেত। সমস্ত নিরন্ন মানুষের মুখের দীপ্ত শ্লোগান এই কবিতা। মহাভারতে দ্রৌপদীর অন্ন না ফুরানো সেই পাত্রের অতল গর্ভ থেকে যেন বেরিয়ে এসেছে কবিতাটি। ভাতকে নিয়ে লেখা আস্ত একটি কবিতা। এমন তো শুনিনি আগে। যেন পুজো হচ্ছে। আমাদের পরিবারে দীর্ঘদিন ভাতের অভাবে খুদ ও আমড়াসেদ্ধ একমাত্র খাবার ছিল। গর্ভে বসে এই খাবারই খেয়েছি আমি। তাই তো এখন ভাতের পাতে ভাত পঞ্চভূত ও পশুপাখিকে নিবেদন করে তারপর খাওয়া। কিন্তু তখনো বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের এই কবিতাকে আমি সম্পূর্ণ করে পাইনি।
আরও বছর কয়েক পর ক্যানিং লোকালে চেপে ঘুটিয়ারী শরীফ নেমে হোমরা অঞ্চলে সপ্তাহখানেক গিয়ে থাকা। সেই প্রথম নিজের ভুবন ছেড়ে বাড়ির বাইরে পা। সারাদিনমান একটা বিশেষ কাজে থাকা। জনাদশেক মিলে। মাটির রং, জলের রং, মুখের ভাষা সব অন্যরকম। চন্দনেশ্বর, পিয়ালী সব কাছ থেকে দেখলাম। আগে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখায় পড়েছি। যে-বাড়িতে থাকতাম, রাত্রিটুকু তাদের বাড়ি লাগোয়া কবর। কেয়াফুলগাছ জ্যোৎস্নায় ঝমঝম করে। অল্প একটু চাঁদ ওঠে শব্দ না করে।
আড়াইদিন সেখানে পরোটা ও মুড়ি চিবিয়ে দিন কাটিয়েছি গুঙিয়ে, ভাতহীন নিজেকে তখন প্রেত মনে হচ্ছে। কাজ সেরে, রাতে ফিরে বাঁশপাতার মতন রোগা সেই চাচির কাছে তখন ভাত চাইলাম সকাতরে। ভাত দিল। পাঁকাল মাছের ঝোল। লেবুর আচার। ভাত খেয়ে থালা ধুচ্ছি গাছের গুঁড়ি বাঁধানো পুকুরজলে। আলো ঝমকম করছে। মনে পড়ল, অন্নদেবতা কবিতাটি। আমি দু-আঁজলায় জল নিয়ে জল-তর্পণ করলাম অন্নদেবতার উদ্দেশে। কবিতাটি সম্পূর্ণ হয়ে এল জীবনে।

খুব দৈন্যের দিন এখন। রাতও। চারপাশে অস্থিরতা। যুবতী চাঁদ চাল চুরি করছে মাঝরাতে। কাজ নেই, ভাত নেই, স্বাস্থ্য নেই, সুন্দর নেই। স্বপ্নগুলো ধিকিধিকি। চাবি মেরে কে বা কারা ছেড়ে দিয়েছে, চলেছি। অশিক্ষার মেলা, অসুন্দরের মোচ্ছব। কিন্তু তাতে রঙিন রাঙতা জড়ানো। এই চকচকে মড়ক-উৎসবে আত্মহত্যা না করে, স্নায়ু শান্ত রেখে বেঁচে থাকা মুশকিল। তখন কিছু-কিছু কবিতার কাছে মাথা ধুতে যাই। গানের ঝরনাতলায় দাঁড়াই। মাটির পুতুল গড়ি। তেমন একটি কবিতা বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা।
মানুষ / বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
তার ঘর পুড়ে গেছে
অকাল অনলে,
তার মন ভেসে গেছে
প্রলয়ের জলে।
তবু সে এখনও মুখ
দেখে চমকায়,
এখনও সে মাটি পেলে
প্রতিমা বানায়।
ঘর চাইতে গিয়ে নিজস্ব বাসভূমি পুড়ে ভস্ম হয়ে গেল। মানচিত্রের ওপারে রইল ছিন্ন বাড়িঘর। স্বজন ও পড়শিদের মুখ মনে নেই একেবারে। জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবু একটি মানুষের মুখের গড়নে চমকজ্বরা বয় গায়ে। আমার দিদির মতন মুখ, আমার হারানো দাদার মুখ, কুপিয়ে-কুপিয়ে মেরে ফেলা আমার প্রিয় বন্ধুর মুখের অবিকল। একবার আকাশের নীলে তাকাই, একবার মাটিতে,আগুনে ছাই না হয়ে গিয়ে আগুনের ব্যবহার শিখি।
প্রতিমা আমিও বানাই। হাজার বছরের বাংলা কবিতার প্রতিমা। আপনমনে নিজের মতো। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা রোজ রোজ পড়ি না। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও প্রতিদিন পড়ি না। নজরুল নিয়ম করে পড়ি না। সুকান্ত ভট্টাচার্য নিয়মিত আসে না পাঠভুবনে। কিন্তু যখন পড়ি, হাতে সত্যিকথার আঁচ এসে লাগে। আপোষহীন শিরদাঁড়া সোজা রাখা কবিতা সব। মাথা নত করতে বারণ করে। থুতনি ধরে আর-একটু উঁচু করে দেয়।
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা বেঁচে থাকার কবিতা। রোদে-জলে ভিজেও যে-প্রাণ নষ্ট না হয়ে ধান ফলায়, যে-প্রাণ জলাশয় থেকে শুষুনি শাক তোলে, যে-প্রাণ কারখানায় প্রতিদিন শ্রমের অন্ন ঘরে তোলে, যে-প্রাণ ফুটপাতে বসে থেকে ছোট ছেলেমেয়ের মুখে তুলে দেয় স্বপ্নধারা, তাদের কথকতা এইসব কবিতা। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার মুখ নীল বিষমাখা তিরে বন্ধ করে দিলেও সে জোরে চিৎকার করে জানায় রাজা ও সিংহাসনের মরচে ধরা ক্ষয়রোগ। এইসব কবিতার মরণ নেই। গুপ্তসমিতির সংকেত দেওয়া হাতচিঠির মতো আগুনরঙা এর হৃদয়।
ধীরে-ধীরে বুঝি এখন, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রামকিঙ্কর বেইজ, ঋত্বিক ঘটক, জর্জ বিশ্বাস, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে একান্ত নিজেদের মনে হয়। বিড়ি খাওয়ার অবসরে পাশে বসা যায়। দু-দণ্ড কথা বলা যায়। কবিতার এক-একটি বিচ্ছিন্ন পংক্তি আমাকে আশ্চর্য সব নেশা দেয়, ছবির পর ছবি, দেখার দৃষ্টি। পুরো কবিতা ভুলে একটি লাইন বুকের কাছের হয়ে থাকে।
‘কেয়াফুলটি ঘুমিয়ে আছে বিষধরের বুকে’
এই লাইন আমাকে আশ্চর্য এক ছবি দেয়। যা শুধু আমার। আপনাদের আজ বলি। লোহার বাসরঘরে বেহুলা, লখিন্দরকে ভাত রেঁধে খাইয়েছে। আকাশ মনসামঙ্গল পুথির মতন। সাপ এসে ছোবল দিয়ে গেছে লখাইকে। কান্না, চিৎকার, হুড়োহুড়ি। ভোর হয়ে আসছে। বিয়ের রাতেই বিধবা বেহুলা। ওঁর শাড়ির আঁচলে জাঁতি দিয়ে কাটা সাপের ল্যাজ। বিষ ঢেলে ক্লান্ত সাপ এবার ধীরে-ধীরে গিয়ে গ্রামের বুনোঝোপে মেয়েলি কেয়াফুলের কাছে। ঝিমঝিম সুগন্ধের সেই ফুল সাপের বুকে মাথা রেখে ঘুম আনছে।
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা আমার কাছে আগুনের স্বরলিপি আর এমন ছবি দেখার নিজস্ব জানালা।