পায়ের রূপকথা
আমাদের কৈশোরে লাইক (LIKE) ছিল। ওটুকুই। কারণ মোটেই তা সহজপ্রাপ্য ছিল না। আর, নাইক (NIKE)-ও ছিল। তবে পায়ের আবরণ তথা ফুটওয়্যার স্টেটমেন্ট হিসেবে নয়। বয়সোচিত শব্দ-খেলায়! তখন নবম শ্রেণি। সদ্য শিখছি সমাস, এক কথায় প্রকাশ। তার ঢেউ আছড়ে পড়েছিল NIKE-এর অর্থ-গড়ায়— N নাইন’স I ইন্টারনাল K ক্রশ E এগজামিনেশন; অর্থাৎ, হঠাৎ করে কোনও বিষয়ে নেওয়া ক্লাস টেস্ট। ক্লাস ইলেভেন। কৈশোর-যৌবনের বয়ঃসন্ধিকালে NIKE হয়ে গেল: নীতা (N) ইন্টারকানেক্টস (I) কমল (K) এফিসিয়েন্টলি (E)। এক বছর পরেই কলেজ। সেটা ১৯৯০। প্রাপ্তবয়স্ক হল NIKE: নীলাঞ্জনা ইন্টারকোর্সেস কাজল এক্সটারনালি! শেষোক্ত শব্দটাই রহস্যের ভরকেন্দ্র। আসলে তখনও কো-এড স্কুল খুব কমই ছিল। সেক্স এডুকেশনও জলচল হয়নি। ফলে বিষয়টা সম্পর্কে অনেকের অনেক ধারণাই ছিল অস্পষ্ট।
আসল কথায় আসি। গত শতকের নয়ের দশকে আমহার্স্ট স্ট্রিট সিটি, স্কটিশ চার্চ, সাউথ সিটি (গোলপার্ক), আশুতোষ কলেজের মতন ঈষৎ নাকউঁচু শিক্ষাসত্রে দু’চারজনের পায়ে শোভা পাচ্ছিল নাইক। অবশ্যই তারা ছিল পয়সাওয়ালা ঘরের সন্তান। এটা সেই সময়, যখন কলেজে আমাদের সহপাঠী জনৈকা দেবলীনা বেসরা-কে বলতে শুনেছিলাম, বাটা-নাইকের জুতো ওদের কাছে ভিন গ্রহের বস্তুর মতন। ও কিংবা ওর মতন প্রত্যন্ত অজ পাড়াগাঁ থেকে লড়াই করে যারা কলকাতার একটা ভাল কলেজে পড়ার স্বপ্ন নিয়ে কলকাতামুখী হত, তাদের কাছে এহেন পদাভরণ ছিল ‘মুনডরৈ পানৈহি’। সাঁওতালি ভাষায় যার মানে ইংরেজ জুতো। জীবনে একটু স্বাচ্ছন্দ্য— দু’বেলা দু’মুঠো ভাত, পরনে লজ্জানিবারণযোগ্য কাপড় আর অতি অবশ্যই শিক্ষাকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিল দেবলীনারা।
পঞ্চাশ বছরের শাসন কালেও পতিতাবৃত্তি নির্মূল করতে পারেননি ফিদেল কাস্ত্রো।গৌতম কুমার দে-র কলমে পড়ুন পাঠপুরাণ পর্ব : ৫
ওদের থেকে ঈষৎ ভাল ছিলাম আমরা, মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েরা। শহুরে মধ্যবিত্ত আমরাও জেনেবুঝে কখনও অজ্ঞানতাবশত পা গলিয়েছি তাদের বাড়িয়ে দেওয়া জুতোয়। প্রথমে শখের বশে টেস্ট করছি বলে ক্রমশ ধীরে কিন্তু অব্যর্থভাবে তাতে নিজেকে অভ্যস্ত করি আমরা। আর তারপর সেটাকেই অপরিহার্য করে তুলি জীবনচর্যায়। এভাবেই আজকে ‘নাইক’ ঠাঁই করে নিয়েছে জনগণমনে-জীবনে।

এই তো সেদিন, ১৯৭১-এ পথচলা শুরু নাইক-এর। নাইক যখন বাজারে পা রেখেছিল, সেটা কনভার্স (Converse), অ্যাডিডাস (Adidas), পুমা-র (Puma) যুগ। দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তারা প্রায় গোটা দুনিয়া। খেলার মাঠেও ভাগাভাগিটা ঘুরেফিরে সেই ক’জনের মধ্যেই। সেখানে নভিশ নাইক! বুঝতেই পারছেন, শুরুতে লাল কার্পেটে অভ্যর্থনা জানাবার মতন অবশিষ্ট ছিল না প্রায় কেউ-ই। সকল ভোক্তা, দর্শক আবিষ্ট ও মজে ছিল তৎকালীন জুতোর কারবারিদের শৈলীতে। ফলে নাইক শুরুতেই যে স্ট্র্যাটেজি নিয়েছিল, সেটার সঙ্গে কতকটা মিল ছিল চুম্বকবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বের। আকর্ষণের পূর্বে আবেশ হয়। কীরকম? গ্রন্থপ্রণেতার বয়ানেই শোনা যাক সেটা: ‘Nike won its place at the top of Sneaker Mount Olympus by continuing to push the pace of innovation. They pioneered a way to design sportswear by looking through the lens of an athlete, but for everyone, resulting in game-changing technology that enhanced sports performance and influenced the fashion landscape.’
প্রদীপের শিখার পিছনে থাকে তার সলতে পাকানোর ইতিহাস। নাইক হয়ে ওঠার নেপথ্যে ছিলেন বিল বাওয়ারম্যান। ১৯৪৮। আমেরিকার ওরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড-এর কোচ হিসেবে নিযুক্ত হলেন বিল। তিনি চারবার অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ন্যাশনাল কলেজিয়েট অ্যাথলেটিকস্ অ্যাসোসিয়েশন (NCAA) চ্যাম্পিয়নশিপ জেতেন। ২৮ জন অলিম্পিয়ানকে কোচিং করান বিল। বিলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, তিনি কেবল যন্ত্রের মতন কোচিং করানো কিংবা ফলাফল অর্জনেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। বরং তাঁর নজর বেশিরকমভাবে ছিল অ্যাথলিট কী পরে দৌড়াচ্ছেন সেদিকে। তাঁর ছাত্র কেনি মুর। দৌড়ানোর সময়ে তাঁর পা ভেঙে গেল। বিল মুরের জুতোর অটোপসি করালেন, যা সেই সময়ের বিচারে অভিনব ঘটনা মানতেই হবে। দেখলেন, প্রয়োজনীয় আর্ক সাপোর্টের অভাবই এই স্ট্রেস ফ্র্যাকচারের কারণ। উপায়? বিল নিজের হাতে বানালেন উন্নতমানের ট্র্যাক শু, যার ভিতরে সেট করলেন ইনার সোল। এই ঘটনা বিলকে ভাবিয়ে তুলল। তিনি পড়াশুনো করতে থাকলেন অ্যানাটমি থেকে জুতো তৈরির উপাদান, তৈরির ধরন ইত্যাদি বিষয়ে। জুতোর তলায় স্পাইকের অবস্থান বদলে, জুতো তৈরিতে সাপ ও মাছের চামড়া ব্যবহার করে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন।
বিল তাঁর চিন্তাভাবনার কথা সবিস্তারে জানান সেই সময়কার জুতো প্রস্তুতকারকদের। কিন্তু কেউই তাঁর কথায় বিশেষ কর্ণপাত করেন না। তবে বিলের কথা মনে ধরল তাঁরই প্রাক্তন ছাত্র মাঝারি পাল্লার দৌড়বীর ফিল নাইট-এর। অ্যাথলেটিকসে কোচিং করার সুবাদে জুতোর নকশা সম্পর্কিত বিলের ভাবনায় একটা আলাদা প্রেক্ষাপট ও দর্শন ছিল। এটাকে কাজে লাগাবেন ঠিক করলেন ফিল। বিল বাওয়ারম্যানকে তাঁর জুতো তৈরির উদ্যোগে মেন্টর, শিক্ষক, গাইড, গুরু হিসেবে স্বাগত জানালেন। সেই সঙ্গে তাঁকে ব্যবসার অংশীদার করলেন। জন্ম নিল ‘নাইক’। ব্যবসার স্বার্থেই উভয়ে তাঁদের ভাবনাকে প্রসারিত করলেন বাজার ধরতে। অচিরেই চ্যাম্পিয়ন-অলিম্পিয়ানদের অটোমেটিক চয়েস হয়ে উঠল নাইক। কারণ তাঁদের প্রত্যেকের জন্য কাস্টমাইজড জুতো তৈরি করল তারা। নাইক হয়ে উঠল খেলোয়াড়দের ইচ্ছেপূরণের অপরিহার্য হাতিয়ার আর তাঁদের ‘পায়ের স্বর’। স্বভাবতই ব্যাপারটার ব্যাপক প্রভাব পড়ল জনমানসে। মানুষের কাছে, নাইক-কে নিজের ভাবাতে সফল হল এই যৌথ উদ্যোগ।
বাওয়ারম্যানের বিখ্যাত উক্তি, ‘ইফ ইউ হ্যাভ আ বডি, ইউ আর অ্যান অ্যাথলিট’। একে সম্মান জানিয়ে এবং কথা রাখতে নাইক বাজারে আনল ‘নর্থ স্টার’। বাওয়ারম্যানের অ্যাপ্রোচের সঙ্গে নাইটের ভিশনের কোলাজে যেসব পাদুকা তৈরি হতে থাকল, তা অভাবনীয় জনসমর্থন পেল। সে-সময়ে আমেরিকায় উচ্চমানের দৌড়ের জুতো আসত জাপান থেকে। আর সেদেশের বেশিরভাগ স্নিকার কোম্পানি জুতো আমদানি করত ইউরোপ থেকে। নাইট এই ব্যাপারটাকেই তাঁর ব্যবসার মূলধন করবেন ঠিক করলেন। এজন্য দরকার ছিল আমেরিকাতে তার নিজস্ব চাহিদা অনুযায়ী এক্সক্লুসিভ ব্র্যান্ডের জুতো তৈরি ও বিক্রি করা। কিন্তু উৎপাদনের ব্যাপারটা রাতারাতি সম্ভব নয়। তাহলে উপায়? ধুরন্ধর নাইট গেলেন জাপানে। সেটা ১৯৬২। অ্যাথলিটদের উপযোগী মনোমতন জুতোর খোঁজ পেলেন জাপানের অনিতসুকা টাইগার-এ (Onitsuka Tiger)। এরপরেই বাওয়ারম্যান ও নাইট চালু করেন ব্লু রিবন স্পোর্টস— যা কিনা নাইকের অগ্রদূত। নতুন ব্র্যান্ডের এই জুতো তৈরির দায়িত্ব দিলেন ওনিতসুকাকে। পাশাপাশি জাপানি ব্র্যান্ডের জুতো নিষিদ্ধ হল আমেরিকার দৌড়বীরদের জন্য। উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত করতে বাওয়ারম্যান সম্পূর্ণ নতুন নকশা তৈরি করলেন নতুন ব্র্যান্ডের জুতোর জন্য। আর ওনিতসুকাকে ডিস্ট্রিবিউট করা থেকে অর্জিত অর্থ নাইট পুনরায় বিনিয়োগ করলেন স্বদেশে নতুন বিপণি খোলার কাজে।

ব্লু রিবনের ব্যবসা বাড়ছিল হু হু করে। সেই সঙ্গে বাড়ছিল দুই পার্টনারের টেনশন। কারণ ব্যবসার বাড়বাড়ন্ত সামাল দিতে প্রতিনিয়ত নতুন লোক নিয়োগ করতে হচ্ছিল, বাড়াতে হচ্ছিল নানান সুযোগসুবিধা। সর্বোপরি একটা বড় অংশের অর্থ ব্যয় হচ্ছিল স্টক বাড়ানোর জন্য। এদিকে পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ওনিতসুকা-ও মাল পাঠানোর ক্ষেত্রে ‘গো স্লো’ নীতি নিচ্ছিল। ব্যবসায় ক্রমাগত ‘রিস্ক’ বাড়ছিল ব্লু রিবন স্পোর্টস-এর নতুন নকশায় তৈরি জুতো উৎপাদনে ওনিতসুকার তরফে সংযমী মনোভাবের দরুন। নাইট-বাওয়ারম্যানের প্রস্তাব কার্যকর করাতেও পরোক্ষে অনীহা দেখাচ্ছিল জাপানি উৎপাদক সংস্থাটি। আসলে ওনিতসুকা দেরিতে হলেও বুঝতে পেরেছিল, প্রকৃত উৎপাদক হয়েও তারা ভোক্তার কাছে সরাসরি পৌঁছতে পারবে না কোনওদিনই, যদি এই ব্যবস্থা চলতেই থাকে। প্রোডাক্টের মুখ হয়ে থেকে যাচ্ছে মার্কিন কোম্পানি। তাছাড়া, নাইটরা যদি নিজেরাই জুতো বানাতে শুরু করে, সেদিন রাতারাতি মার্কিন মুলুক থেকে তাদের সেকেন্ডারি অস্তিত্বটুকুও মুছে যাবে। ফলে পুরো ব্যাপারটা মন থেকে মেনে নিতে পারছিল না ওনিতসুকা।
দুই সংস্থার মধ্যে তিক্ততা চরমে উঠল যখন, নাইটরা আবিষ্কার করলেন জাপানি কোম্পানিটি আমেরিকাতে অন্যভাবেও ডিস্ট্রিবিউশনের চেষ্টা করছে। এই ঘটনা ছিল উভয়ের মধ্যে হওয়া ব্লু রিবন সংক্রান্ত চুক্তির স্বার্থের পরিপন্থী। নিশ্চিতভাবে এতে ব্লু রিবনের একমাত্র পরিবেশক আর থাকবে না নাইটরা। জাপানি সংস্থার বিশ্বাসঘাতকতা নাইটকে বাধ্য করেছিল অন্য কিছু ভাবতে। আমেরিকান প্রবাদেই আছে, ‘In trade & commerce japaese are hard nut to crack.’ আর জাপানি প্রবাদ বলছে, অচেনা অর্থ আর আরামের চেয়ে স্বদেশি জুতোও ভাল। তা সে যাই হোক, এই সন্ধিক্ষণ থেকেই যাত্রা শুরু ‘নাইক’-এর।
প্রশ্ন জাগে, এহেন নামকরণের উৎস কী? নাইটের ব্যক্তিগত পছন্দ ছিল ‘ডাইমেনশন সিক্স’। নিজে যেহেতু মিউজিক্যাল ব্যান্ড ‘ফিফ্থ ডাইমেনশন’-এর ভক্ত ছিলেন, তাই অমন নাম রাখার কথা ভেবেছিলেন। প্রসঙ্গত, নতুন কোম্পানি খোলার আগে নাইট তাঁর গোটা টিমের সদস্যদের ডেকেছিলেন এক ঘরোয়া আলোচনায়। সেখানেই এক কর্মীর প্রস্তাবিত নাম ছিল ‘পেরিগ্রিন’। এক রকমের শিকারি পাখি। আরেকজন প্রস্তাব দেন শিকারি বিড়ালের নামে নাম রাখা হোক। এমনতরো ভাবার কারণ, সেই সময়কার অত্যন্ত জনপ্রিয় স্নিকার ব্র্যান্ড ‘পুমা’ নামটি। আমেরিকার বনবিড়াল বিশেষ।
নাম নিয়ে এই টানা-পড়েনের মাঝে দিশা দেখান ব্লু রিবনের বিশিষ্ট বিক্রয়-প্রতিনিধি জেফ জনসনের (ইনি পরে ‘নাইক’-এর প্রথম পূর্ণ সময়ের কর্মী হন) এক পর্যবেক্ষণ। ফ্লাইটে যাওয়ার সময়ে একটা পত্রিকা পড়ছিলেন। তাতে একটা লেখা ছিল Kleenex, Xerox-এর মতন সফল ব্র্যান্ডের নামরহস্য বিষয়ক। তাতেই এক জায়গায় ছিল, দুই সিলেবল বিশিষ্ট শব্দ যাতে Z, K, X-এর মতন অফবিট অক্ষর থাকে, সেই নামগুলি ভোক্তারা সহজে মনে রাখেন। এরই ফসল ‘Nike’। প্রাথমিকভাবে পছন্দ না হলেও নামটি মেনে নিতে সম্মত হন নাইট। কারণ এটাই ছিল প্রস্তাবিত বিবিধ নামগুলোর মধ্যে সেরা। তাছাড়া ‘নাইক’ হলেন জয়ের গ্রিক দেবী (গডেস অব ভিক্টরি), যার ডানা আছে। নামকরণের পর লোগো-পর্ব। রক্ষণশীল বাজেট এবং সময় স্বল্পতার কারণে লোগোর দায়িত্ব বড় কোনও সংস্থাকে দেননি নাইট। দিয়েছিলেন গ্রাফিক ডিজাইনের ছাত্র ক্যারোলিন ডেভিডসনকে। পোর্টল্যান্ড স্টেট ইউনিভার্সিটির ছাত্রটি এজন্য প্রাথমিকভাবে পেয়েছিলেন মাত্র ৩৫ ডলার। চূড়ান্ত ব্যাবসায়িক সাফল্যের মাঝেও মালিক নাইট ভোলেননি লোগোশিল্পীকে। ১৯৮৩ সালে যে-বছর ভারত ক্রিকেটে প্রথম বিশ্বকাপ জিতল, সে-বছর নাইকের প্রতিষ্ঠাতা ডেভিডসনকে নাইকের ৫০০টি শেয়ার-সহ একটি সোনার চেন (যাতে জুতোর আকারে হিরে ছিল) উপহার দেন। লোগো নকশার ইতিহাসে এটাই সম্ভবত বৃহত্তম সাম্মানিক! মার্কিং সম্পর্কে লেখকের বক্তব্য মনে রাখার মতন: ‘The marking is such a part of Nike culture that every new athlete that signs with the brand is tasked to draw their own version of the Swoosh. … Designer and Nike collaborator Virgil Abloh nodded to Davidson’s original Swoosh design on the cover of his book Something’s Off and the marking has been reversed on signature product for eccentric players, like Dennis Rodman’s Air Darwin sneaker. But the essence of the Swoosh remains in its simplicity, its elegance and the way it represents movement.’ (p21)
এর পরেই আছে নাইকের প্রথম ল্যান্ডমার্ক প্রযুক্তির কথা। বারবারা বাওয়ারম্যান বিয়েতে উপহার হিসেবে একটা ওঅফল আয়রন পান। কীভাবে সেটি হয়ে ওঠে সেই প্রযুক্তির উৎস, সে-কথাই সংক্ষেপে বলেছেন ‘নাইক’স ফার্স্ট ব্রেকথ্রু টেকনোলজি’ পর্বে। 1970s: Nike’s First Steps অধ্যায়ে রয়েছে নাইক এক্সিকিউটিভ Rob Strasser-এর (ওনিতসুকা টাইগারের সঙ্গে আইনি লড়াইয়ে ইনিই নাইকের হয়ে মামলা লড়েছিলেন) মিথসম দশটি বাণীর প্রসঙ্গ, যা আজও প্রতিষ্ঠান মনে রেখেছে। সংক্ষপে আছে নাইকের তিনটে সিগনেচার প্রোডাক্টের অতীত-কথা: Cortez, দ্য ওঅফল ট্রেইনার অ্যান্ড রেসার, তাইলউইন্ড। কোরটেক্স নামেই স্পষ্ট প্রতিদ্বন্দ্বী ব্র্যান্ডের প্রতি অশ্রদ্ধা! এটা যে কেবল ফ্যাশন ও স্টাইলের দুনিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ তা নয়, স্নিকার সংস্কৃতিতেও এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব অনস্বীকার্য। এর ক্যাজুয়াল আভিজাত্য, সারল্য, পরিচ্ছন্ন ‘লুক’ যাতে প্রতিভাত নাইকের নকশা-দর্শন— এত বছর পরেও এর জনপ্রিয়তার গোপন রেসিপি। এটাই নাইকের প্রথম পণ্য, যা খেলাধুলোর জগতের বাইরেও সাদরে গৃহীত হয়েছিল। ওঅফল আউটসোল বহন করছে নাইকের প্রথম নিজস্ব প্রযুক্তির ছোঁয়া। ওঅফল ট্রেইনার-এর প্রিমিয়াম সংস্করণ ওঅফল রেসার। ১৯৭৭ সালেই এর দাম ছিল ৩০ মার্কিন ডলার। ওঅফল রেসারের সীমিত সংস্করণও হয়েছে। এ হল নাইকের সৃজনশীল ক্যানভাস। তাইলউইন্ড-এ ব্যবহৃত এয়ার কুশনিং প্রযুক্তি স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে নাইকের ইতিহাসে।
আদি নাইক তাইলউইন্ড-কে বিশেষ মেকআপে লঞ্চ করা হয় নেটফ্লিক্স শো ‘স্ট্রেনজার থিংস’-এর সেলিব্রেশনে। দৌড়বীর স্টিভ প্রেফনটাইন (Steve Prefontaine) কেন নাইক আখ্যানে প্রাসঙ্গিক সে-কাহিনি জানতে হলে পড়তে হবে Steve Prefontaine: The Soul of Nike। ব্যর্থতা, সাফল্যের অপর পিঠ। নাইকের বেলায়ও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। লাভের অঙ্ক ১৯৭৩ সালে ২৮.৭ মিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ১৯৮৩-এ দাঁড়ায় ৮৬৭ মিলিয়ন ডলারে। সেখানে অব্যবহিত পরের বছরেই ক্ষতির সম্মুখীন হয় নাইক। কোম্পানির ইতিহাসে এই প্রথম! পরিস্থিতি মোকাবিলায় মস্ত বড় ঝুঁকি নেয় তারা, যা চমকে দিয়েছিল মার্কেটিংয়ের দুনিয়াকে। কিংবদন্তী বাস্কেটবলার মাইকেল জর্ডনের সঙ্গে বিশাল অঙ্কের চুক্তিতে আবদ্ধ হল নাইক। ব্র্যান্ড হয়ে উঠল পাওয়ার হাউস! টানা ১৪ বছর জর্ডন ব্যবহার করেন নাইকের প্রোডাক্ট। জুতোর ইতিহাসে এয়ার জর্ডন একটা ধ্রুপদী মাইলফলক। অজস্র বর্ণময় ছবি-সহ সে-আখ্যান বিবৃত হয়েছে বইতে রীতিমতো পপুলার ইতিহাস লেখকের দক্ষতায়।

অরিগন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্যবিদ্যায় মেজর টিঙ্কার হ্যাটফিল্ড (Tinker Hatfield)। গত শতকের সাতের দশকের শেষের দিকের কথা। সে-সময়ে নাইকের সহ-প্রতিষ্ঠাতা বিল বাওয়ারম্যানের অধীনে তিনি ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে প্রশিক্ষণও নেন। পরবর্তীকালে তিনি নাইকের একজন প্রথম সারির ফুটওয়্যার নকশাকার হয়ে ওঠেন। এই সাফল্যের নেপথ্যে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটানো তাঁর ছাত্রজীবন এবং সেখানে অর্জিত বিদ্যাশিক্ষা। এই ঘটনা মনে পড়ায় ওয়াটারলু যুদ্ধজয়ের রহস্য সম্পর্কে জয়ী ইংরেজ সেনাপতির সেই বিখ্যাত উক্তিকে: ‘Whatever success I have earned in the battlefield of waterloo is the learnings what I learnt at the school of Eton.’
আদি নাইক তাইলউইন্ড-কে বিশেষ মেকআপে লঞ্চ করা হয় নেটফ্লিক্স শো ‘স্ট্রেনজার থিংস’-এর সেলিব্রেশনে। দৌড়বীর স্টিভ প্রেফনটাইন (Steve Prefontaine) কেন নাইক আখ্যানে প্রাসঙ্গিক সে-কাহিনি জানতে হলে পড়তে হবে Steve Prefontaine: The Soul of Nike। ব্যর্থতা, সাফল্যের অপর পিঠ। নাইকের বেলায়ও এর ব্যত্যয় ঘটেনি।
ছ’টি ভাগে রয়েছে নাইকের সঙ্গে হার্টফিল্ডের ঘরসংসারের টুকরো সংলাপ। তাঁর স্মরণীয় অবদান: ১. ফ্রাঙ্ক রুডি-র মারকাটারি এয়ার কুশনিং প্রযুক্তি সহযোগে করা নকশায় তৈরি নাইক এয়ার ম্যাক্স ১; ২. নাইক এয়ার ম্যাক্স ৯০; ৩. নাইক এয়ার ম্যাক্স ১৮০; ৪. এয়ার ম্যাক্স ৯৫; ৫. এয়ার ম্যাক্স ৯৭। মার্কেটিংয়ে মাস্টার নাইক। ১৯৯৩ সালে NBA-এর খেলোয়াড় চার্লস বার্কলেকে দিয়ে একটা অ্যাড বানায় তারা। সেখানে তাঁর মুখে ছিল এই ডায়লগটি: ‘I Am not a Role Model. Parents and teachers should be role models’, যা প্রবাদপ্রতিম হয়ে গেছে। যদিও ৩০ সেকেন্ডের এই স্টেটমেন্ট নিয়ে বিতর্কের ঝড় বয়ে গেছিল প্রো-অ্যাথলিট এবং ক্রীড়া বিশেষজ্ঞদের মধ্যে। এই হয়ে ওঠার প্রেক্ষাপটটি এরকম: ১৯৯১ সালে খেলা চলাকালীন এক বর্ণবৈষম্যকামীর দিকে থুথু ছেটাতে গিয়ে অনিচ্ছাকৃতভাবে অষ্টম বর্ষীয়া এক বালিকাকে আঘাত করেন। শাস্তিস্বরূপ এক ম্যাচের জন্য বার্কলেকে সাসপেন্ড এবং ১০,০০০ ডলার জরিমানা করা হয়। নাইকের ‘জাস্ট ডু ইট’ স্লোগানটিও বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।
হিপ-হপ ফ্যাশনের ওপর নাইকের প্রভাব সম্পর্কে লেখকের অভিমত যথাযথ: ‘As the fusion of hip-hop and sneaker culture continued to take shape, Nike sneakers became increasingly visible on the feet of rappers.’ (p113) লন টেনিসের সঙ্গে নাইকের গাঁটছড়াটা ১৯৭২ সালের। রোমানিয়ার ইলি নাসতাসেকে সই করানোর মধ্য দিয়ে। নাইকের টেনিস স্পেশাল জুতোর মধ্যে আছে: উইম্বলডন (পরে নাম বদলে রাখা হয় নাইক টেনিস ক্লাসিক), ম্যাচ পয়েন্ট, Racquette। জন ম্যাকেনরো-র সিগনেচার মডেল ম্যাক অ্যাটাক (Mac Attack)। ম্যাকেনরো-র বদমেজাজি ব্যক্তিত্বের প্রতিফলন পাবেন এর নকশায়। লন টেনিসের ট্র্যাডিশনাল সাজসজ্জায় যে নিরাপদ সাদা-নির্ভর বর্ণবিন্যাস দেখতে অভ্যস্ত আমাদের চোখ সেই অবস্থান থেকে সরে এসেছে এর নকশা। তার জায়গায দর্শক দেখল হালকা রুপোলি ও কালোর কম্বিনেশন, যা এই বিদ্রোহোন্মুখ অবাধ্য চরিত্রের উপযুক্ত।
আঁদ্রে আগাসি, পিট সাম্প্রাস, সেরেনা উইলিয়ামস, নাওমি ওসাকা, রজার ফেডেরার, রাফায়েল নাদাল— প্রত্যেকের পারসোনালিটি প্যাটার্ন আলাদা। সেই অনুযায়ী তৈরি হয়েছিল তাঁদের জুতোর ডিজাইন। আরেকটা পদাবলি-সন্দেশ যা নাইক-সংস্কৃতিতে অমর হয়ে আছে, সেই নাইক ডাঙ্ক-এর গপ্পো অল্পকথায় না বলে থামতে পারছি না। ১৯৮৫ সালে বাজারে আসে এই মডেল। কলেজ টিমের শু হিসেবে এর নকশা করেন সুখ্যাত এয়ার জর্ডন ১ এবং এয়ারফোর্স ১-এর নকশাকার পিটার মুর। ফলে সে-সময়ে এর নাম রাখা হয়েছিল ‘কলেজ কালার হাই’। বিবিধ সাহসী রঙের ব্লকবিন্যাস, যা মানানসই ছিল NCAA বিশ্ববিদ্যালয় বাস্কেটবল দলের রঙের সঙ্গে। এই মডেলের ট্যাগলাইনটাও ছিল জুতসই। ‘Be True to Your School.’ কালক্রমে এটা হয়ে উঠল স্কেট শু। আর এখন তো স্ট্রিটওয়্যার আইকন! একটা মডেলের এহেন ব্যাবহারিক অভিযোজন ও অভিব্যক্তি সত্যিই বিস্ময়কর।
এই ভার্সেটাইল মডেলেরও আছে নানান সংস্করণ। যেমন সাদা-কালোয় ‘পান্ডা’ নাইক ডাঙ্ক, জেফ স্টেপল-এর নকশায় ‘Pigeon’ নাইক ডাঙ্ক SB, সীমিতস্য সীমিত বিরল ‘FLOM’ নাইক ডাঙ্ক হাই SB। ‘পিজিয়ন’ রিলিজের দিন তো নিউ ইয়র্কের রাস্তায় রীতিমতন খণ্ডযুদ্ধ বেধে গেছিল গুণগ্রাহীদের আগ্রহের আতিশয্যে। ‘FLOM’ তো সাদবি-র নিলামে উঠেছিল। দাম চড়েছিল ৬০,০০০ ডলারেরও বেশি। মাত্র ২৪ জোড়ার অস্তিত্ব জানা গেছে সারা দুনিয়াতে! আরেকটি কালেক্টরস মডেল ‘প্যারিস’ ডাঙ্ক (২০০৩)। তৈরিই হয়েছিল মাত্র ২০০ জোড়া। প্রত্যেক জোড়ার নকশা আলাদা। সেকেন্ড হ্যান্ড মার্কেটেই এর দাম এখন ২৫,০০০ ডলারের বেশি।
ব্যবসার পাশাপাশি সংগ্রাহকদের কথা মনে রেখে ২০২০ সালে কোভিড আবহের মধ্যেই নতুন উদ্যোগ নেয় নাইক। স্নিকারের নতুন স্কেট ভার্সানের জন্য নাইক চুক্তি করে অপ্রচলিত ধারায়। এর মধ্যে আছে বেন অ্যান্ড জেরি’স আইসক্রিম, সফ্ট ড্রিঙ্ক ব্র্যান্ড Jarriots। ট্র্যাভিস স্কট-এর মতন শিল্পীকে নকশার দায়িত্ব দিয়েছে। নাইকের ইতিবৃত্তে আরেক কিংবদন্তী বাস্কেটবল সুপারস্টার লেব্রন জেমস, যাঁর ডাকনাম ‘দ্য চোজেন ওয়ান’। ২০১৫ সালে তাঁর সঙ্গে আজীবন চুক্তি করে নাইক। অবিশ্বাস্য এক বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে! সর্বকালের অন্যতম সেরা এই ক্রীড়া-ব্যক্তিত্বের নামে কোম্পানির স্পোর্টস হাবের নামকরণ করা হয়েছে। কোম্পানির হেডকোয়ার্টারে এর উদ্বোধন হয়েছে ২০২১-এ।
নাইকের নিত্যনতুন উদ্যমের হদিশও দিয়েছেন লেখক, যা পড়লে চমকে যাবেন যে-কোনও পাঠক। Nike Shox, নাইক প্রেস্টো অ্যান্ড ফ্রি, নাইক ফ্লাইনিট-এর সম্পর্কে অনেক কথা আছে ‘প্রোডাক্ট ইনোভেশনস’ অধ্যায়ে। আছে দীর্ঘ মেয়াদে টিকে থাকার জন্য নাইকের নিরন্তর প্রয়াস ও কাজের কথা (ফ্লাইলেদার, Space Hippie, ISPA সিরিজ যার মুখপাত্র) যদিও তাতে মন ভরে না সংক্ষিপ্ততার কারণে। কোথাও থামতে হয়। স্বাভাবিক নিয়মে এই বইও শেষ হয়েছে একটা পর্যায়ে এসে। তবে এত সহজে তো শেষ হবার নয় নাইকের রূপকথা! নাইক সম্পর্কে যত জানা যায়, মনে হয় আরেকটু বেশি হলে ক্ষতি কী! আগাগোড়া ভাল, দামি কাগজে চমৎকার ছাপা। জুতসই রঙিন ছবিতে ভরপুর। বইয়ের ট্যাগলাইনে ‘ভিস্যুয়াল হিস্ট্রি’ কথাটা যথার্থই মানানসই। স্মার্ট প্রচ্ছদ এবং আকার বইটিকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। তবু কেউ যদি নাইকের ইতিহাস জানতে সত্যিই আগ্রহী হন, তবে আমার মতে তাঁর উচিত এই তিনটে বই আগে পড়ে নেওয়া: ফিল নাইটের স্মৃতিকথামূলক ‘শু ডগ’ (২০১৬); বাওয়ারম্যানের সহকর্মী ও প্রশিক্ষক কেনি মুরের ‘বাওয়ারম্যান অ্যান্ড দ্য মেন অব অরিগন: দ্য স্টোরি অব অরিগন’স লেজেন্ডারি কোচ অ্যান্ড নাইক’স কোফাউন্ডার’ (২০০৬); এবং, ম্যাট হার্টের ‘উইন অ্যাট অল কস্টস: ইনসাইড নাইক রানিং অ্যান্ড ইটস কালচার অব ডিসেপশন’। এরপরেও যদি আগ্রহে ক্লান্তি না এসে থাকে, তবেই এই বই পড়বেন। আর পড়বেন তাঁরাই, যাঁদের বড় বই পড়ার মতন ধৈর্য ও সময় দুটোই কম। এই বইকে পাঠক মনে রাখবে নাইক-এর মতোই তার উপস্থাপিত হওয়ার আভিজাত্য আর গতিময়তার জন্য। এক কথায়, সেমি কফি টেবল ও পপুলার হিস্ট্রির মাঝামাঝি একটা বই। তাই রেফারেন্স, ইনডেক্সের বালাইমুক্ত এ-কেতাব। ফলত কলেজ স্ট্রিটে ওয়ানওয়ার্ল্ডের বুক সেলফে প্রথম দর্শনেই ভাললাগার মায়ায় জড়িয়ে পড়েছিলাম। বোঝেনই তো, দুর্বল হৃদয়! টেনশন সওয়ার চেয়ে এড়ানোটাই শ্রেয় বিবেচনায় তৎক্ষনাৎ ওকে সাদরে নিয়ে এসেছিলুম আমার বই-ভবে…
বই: স্ট্রিট স্টাইল নাইক/ আ ভিস্যুয়াল হিস্ট্রি অফ দ্য আইকনিক ব্র্যান্ড
লেখক: গেরাল্ড ফ্লোরেস
সম্পাদনা: ফ্রাঙ্কি জোনস
নকশা: ক্লেয়ার মুন্ডে এবং আলেসান্দ্রো সুসিন
ছবি সংক্রান্ত গবেষণা: পল অ্যাশম্যান
প্রকাশক: স্টুডিয়ো প্রেস
প্রকাশকাল: ২০২৪
দাম: ১৩.৯৯ পাউন্ড
পৃষ্ঠা: ১৬০