গণ ও গ্লানি
যে জনসমষ্টি একটু আগেই ব্রুটাসকে জয়ধ্বনি দিয়েছিল, সেই জনসমষ্টিই কিছুক্ষণের মধ্যে মার্ক অ্যান্টনির ভাষণে ব্রুটাসকে শত্রু বলে মেনেও নিয়েছিল। উইলিয়াম শেক্সপিয়রের বিখ্যাত নাটক ‘জুলিয়াস সিজার’-এর এই মোচড়টুকু বিবিধ রাষ্ট্রে বিভিন্ন সময়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। একদম সাম্প্রতিকে বাংলাদেশ সাক্ষী হয়ে রইল এই একইরকম গণউন্মাদনার, ইংরেজিতে যাকে ‘মবোক্রেসি’ বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
শরিফ ওসমান হাদি, ২০২৪-এর শেখ হাসিনার সরকার-বিরোধী অভ্যুত্থান, বাংলাদেশে যাকে জুলাই অভ্যুত্থান বলা হয়, তার অন্যতম কান্ডারীদের একজন। ওসমান হাদি জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকেই, মহম্মদ ইউনুসের অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনাধীন বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলেন ক্রমশ। তাঁর নেতৃত্বাধীন ‘ইনকিলাব মঞ্চ’ ২০২৪-এর জুলাইয়ে ঘটে যাওয়া গণহত্যার অভিযোগকে বারবার সামনে নিয়ে এসেছে। জুলাইয়ের সেই গণহত্যায় অভিযুক্তদের গ্রেফতারির দাবি নিয়ে বারবার সরব হয়েছেন হাদি, এবং ক্রমশ পা বাড়িয়েছেন নির্বাচনী রাজনীতির দিকে। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন সম্প্রতি ঘোষণা করেছে ১৩তম সাধারণ নির্বাচনের তারিখ। ২০২৬-এর ফেব্রুয়ারিতে হওয়ার কথা সেই নির্বাচন। এই নির্বাচনের প্রচারে আঁটঘাট বেঁধেই নেমেছিলেন ওসমান হাদি।
সংবাদমাধমের কাজ তো মানুষকে আখ্যানের খেলায় মজিয়ে রাখা নয়! পড়ুন: ‘চোখ-কান খোলা’ পর্ব ১৬
১২ ডিসেম্বর ঢাকার বিজয়নগরের বক্স কালভার্ট রোডের ডিএ টাওয়ারের পাশে, নির্বাচনী প্রচার চলাকালীন গুলিবিদ্ধ হন ওসমান হাদি। আরও একটি মত বলছে, ওসমান হাদি রিকশায় সওয়ার ছিলেন, আততায়ীরা মোটরবাইক নিয়ে তাঁকে ধাওয়া করে গুলি চালায়। ঘটনা যা-ই হোক, গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকার সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন ওসমান হাদি। ক্রমশ তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে শুরু করে, এবং অবশেষে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয় তাঁকে, চিকিৎসার জন্য। সেখানে ইনটেনসিভ কেয়ারে ছিলেন তিনি। ১৮ ডিসেম্বর তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়।
ঠিক তার অবধারিত পরেই খুলে যায় জ্বালামুখ। বাংলাদেশে ২০২৪-এর জুলাইয়ের পর থেকেই অশান্তির আগুন ধিকিধিকি জ্বলতে থাকে বিভিন্ন সময়ে। ওসমান হাদির মৃত্যু নতুন করে বাংলাদেশের গণক্ষোভকে উসকে দিল। ১৮ ডিসেম্বর রাতভর তাণ্ডব চলেছে বাংলাদেশ জুড়ে। গণহিংসার আগুনে খাক হয়ে গিয়েছে বাংলাদেশের বহু সংবাদমাধ্যমের দপ্তর। আক্রান্ত হয়েছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক নুরুল কবীর। ঘটনাচক্রে, হাসিনাবিরোধী অভ্যুত্থানে তাঁর ভূমিকা ছিল যথেষ্ট সক্রিয়। অন্য ধর্মাবলম্বীদের ওপর নিপীড়ন থেকে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ‘ছায়ানট’ ছারখার করা— ওপার বাংলায় অস্বস্তির খতিয়ান ক্রমে বেড়েই চলেছে। সংখ্যালঘু নাগরিকরা এই ধরনের গণক্ষোভের সহজ শিকার। অভিযোগ উঠছে, দীপু দাস নামে এক ব্যক্তি গণপিটুনিতে নিহত, তাঁকে জীবন্ত দগ্ধ করারও অভিযোগ উঠছে। সাম্প্রদায়িকতা সিঁধ কেটে ঢুকে পড়ছে অশান্তির অন্দরে। বাংলাদেশের দুই প্রবাসী নাগরিক এই হিংসায় মার্কিন মুলুক ও ফ্রান্স থেকে এই গণহিংসায় ইন্ধন দিচ্ছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে সমাজমাধ্যমে।
কোনও একটি ঘটনায় গণরোষ জেগে ওঠা, সেখান থেকে গণআন্দোলন গড়ে ওঠার ইতিহাস বিশ্বজুড়ে আদতে গৌরবময়। একুশ শতকে আরব বসন্ত থেকে এই গণভ্যুত্থানের নতুন ব্যাকরণ তৈরি হতে শুরু করে। শ্রীলঙ্কা থেকে সাম্প্রতিকের নেপাল হয়ে জেন জি আন্দোলনের ঢেউ পর্যন্ত, নানা কিসিমে বদলে গেছে রাজনৈতিক আন্দোলনের তরঙ্গ। কিন্তু আন্দোলন বা অভ্যুত্থানের সঙ্গে গণহিংস্রতার তফাত ছিল, আছে এবং থাকবে। বাংলাদেশ যা প্রত্যক্ষ করছে, তা ভাবনাহীন, আদর্শহীন ‘মব জাস্টিস’। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশাসনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যে-ঘটনা কাল থেকে ঘটে যাচ্ছে, তার সঙ্গে ওসমান হাদির মৃত্যুর প্রতিবাদ বা হত্যার বিচার চাওয়ার কোনও সম্পর্ক কি আদৌ আছে?
দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রীয় রাজনীতি জুড়ে জাতীয় শত্রুর নির্মাণ খুব পরিচিত একটি নীল নকশা। ভারতেও বিগত দশকজুড়ে, দেশের অন্তর্গত সমস্যাগুলিকে আড়াল করে জেগে থেকেছে দেশের শত্রু-শত্রু খেলার আফিম-আচ্ছন্নতা। অবশ্যই সন্ত্রাসী হামলা বা যুদ্ধ পরিস্থিতির বাস্তবতা স্বীকার্য, কিন্তু কথায়-কথায় সরকার-বিরোধী থেকে ‘পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল’-দের প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে চিহ্নিত করার যে সহজ অঙ্ক, তাতে ভারত অভ্যস্ত হয়েছে ধীরে-ধীরে। একই খেলা শুরু হয়েছে বাংলাদেশেও। বাস্তব-অবাস্তবের সীমা পেরিয়ে এ এক উত্তর সত্যর খেলা, যেখানে কথায়-কথায় বাংলাদেশে ভারতীয় ‘এজেন্ট’-এর জুজু দেখা যায়, এবং ভারত-বিরোধিতার সলতে পাকে। তাই ভারতীয় দূতাবাসের সামনেও কাল বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। ভারত সততই বাংলাদেশের রাজনীতির দাবার ছকে কোনওভাবে আছে কি না, তা বিচার করা এই মুসাবিদার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু যে-কোনও ঘটনায় প্রতিবেশী দেশকে প্রতিদ্বন্দ্বী করে দেশের সাধারণ জনগণকে খেপিয়ে তোলার ছক খুব অস্পষ্টও নয়, একথা বলাই যায়।
সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ঘটনা বিচ্ছিন্ন নয়। নেপালের আন্দোলনেও ‘মব’-এর ছায়া আমরা দেখেছি। হয়তো এই মুহূর্তে বিশ্বরাজনীতিতেই ‘মব’-কে উপেক্ষা করার জো নেই। একথা ঠিক, স্থিতাবস্থার ভাঙনপ্রক্রিয়া কোথাও না কোথাও শুরু হয়ে গেছে। পুরনো নিয়মতান্ত্রিকতায় একটু একটু করে চিড় ধরছেই। কিন্তু এর পরিণতি কী? এই বিশৃঙ্খলা কি সত্যিই আগলছাড়া, না এর পিছনে রয়েছে কোনও অদৃশ্য পুতুলনাচের ইতিকথা? কোনও স্বার্থান্বেষী নিয়ন্ত্রণই কি গণতন্ত্র বা দেশের শান্তি বজায় রাখার পরোয়া না করে মানুষকে রাশ নিজের হাতে তুলে নেওয়ার উসকানি দিচ্ছে?
এর উত্তর খুব সহজ নয়। তবে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি আবারও প্রমাণ করে দিচ্ছে, ‘গণ’ নামক ধারণাটিকে নিয়ে নতুন করে ভাবার প্রয়োজন আছে। রোষ যদি সত্যিই রাজনৈতিক হয়, তাহলে তার নির্দিষ্ট অভিমুখ তৈরি হতে বাধ্য। কিন্তু কেবলই বিভিন্ন বায়বীয় শত্রু খাড়া করে লক্ষ্যবিহীন গোলা নিক্ষেপ আদতে কোনও না কোনও রাজনৈতিক স্বার্থই চরিতার্থ করছে না তো? মানুষের হতাশা কীভাবে সহিংস হয়ে উঠতে পারে সমষ্টির মধ্যে, তার জলছাপ সমাজমাধ্যমেই স্পষ্ট হয় বিভিন্ন সময়। বাংলাদেশের রাজপথ-জনপথজুড়ে যা ঘটল বা ঘটে চলেছে, তা ওই উদ্দেশ্যহীন হিংস্র গণমানসেরই জীবন্ত প্রতিলিপি নয় কি? এই আপাত গণখেলার নেপথ্যে ক্ষমতার প্রশ্রয়ের গন্ধটা কিছুমাত্র কম সন্দেহজনক নয়।



