গত শতকের পাঁচের দশকের মাঝামাঝি সময়ে, ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিস বা গুপ্তচর বিভাগ, যাকে চলতি ভাষায় এমআই সিক্স বলা হয়, তাদের একটি ট্রেনিংয়ের অঙ্গ হিসেবে একজন তুখড় এজেন্টকে লুকিয়ে থাকতে বলা হয়েছিল— ওদেরই ভাড়া নিয়ে রাখা ‘সেফ হাউস’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়— এমন একটি ফ্ল্যাটে। যারা এমআই সিক্সে ‘রংরুট’, অর্থাৎ কিনা নতুন কাজে লেগেছে আর ট্রেনিং নিচ্ছে, তাদের একটি দলকে বলা হয়েছিল, ওই ফ্ল্যাট থেকে কোনওরকম ঝামেলা, গোলমাল বা লোক জানাজানি না-করে, ওই লুকিয়ে থাকা ব্যক্তিকে, যেন সে বিদেশি গুপ্তচর, গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসতে।
শিক্ষার্থী দলটি ঠিকঠাক অকুস্থলে পৌঁছেছিল বটে, কিন্তু গুনতিতে ভুল করে চলে গিয়েছিল নির্দিষ্ট ফ্লোর-এর ওপরের তলায়। যে ফ্ল্যাটে তাদের যাওয়ার কথা, তার ঠিক ওপরের ফ্ল্যাটের দরজা কায়দা করে খুলে তারা একটি লোককে পেয়ে তার ওপর চরবৃত্তির আরোপ দিতেই, তুমুল প্রতিবাদ করতে থাকে সেই লোকটি। তখন শিক্ষার্থী দলটি তাকে দিয়ে দোষ কবুল করানোর জন্য সদ্য শেখা কিছু প্রক্রিয়া ব্যবহার করে এবং অল্প সময়ের মধ্যেই লোকটি স্বীকার করে নেয় যে, মাত্র কয়েকদিন আগেই সে বেশ কিছু গয়নাগাটি চুরি করেছে। লোকটি আসলে ছিল একজন ‘জুয়েল থিফ’, তবে তেমন দাগী বোধহয় নয়। এমআই সিক্স যখন বুঝল, একজন অপরাধীকে তারা ধরে ফেলেছে, বেশ ফাঁপরে পড়তে হল তাদের। এই লোককে এই অবস্থায় পুলিশে দিতে গেলে অনেক বিপদ। এক তো জানাজানি হবে, এমআই সিক্স তালকানার মতো ভুল ফ্ল্যাটে চলে গিয়েছে। দ্বিতীয়ত, তাদের ‘সেফ হাউস’ আর ‘সেফ’ থাকবে না। খবরের কাগজের কল্যাণে সকলেই ওই ফ্ল্যাটের খবর জেনে যাবে। একটা বাড়ি বা ফ্ল্যাটকে ‘সেফ হাউস’ হিসেবে গড়ে তুলতে গুপ্তচর বিভাগকে বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হয়। ফলে বাধ্য হয়ে সিক্রেট সার্ভিসের যে বিভাগটি আন্তর্দেশীয় কাজকর্ম দেখাশোনা করে, তাদের, অর্থাৎ কিনা এমআই ফাইভ-কে ডাকতে হল। তাদের বড় অফিসাররা এসে পৌঁছে শেষ অবধি জুয়েল থিফকে ভয় দেখিয়ে দু-ঘণ্টা সময় দিয়ে ইংল্যন্ড ছেড়ে ইউরোপের অন্য কোনও দেশে সরে পড়ার সুযোগ দেয় আর লোক পাঠিয়ে ফ্ল্যাটের ভাঙা দরজা মেরামতের ব্যবস্থা করে।
আরও পড়ুন : হানি ট্র্যাপের আড়ালে কাজ করে কোন মনস্তত্ত্ব? লিখছেন আদিত্য ঘোষ…
এমআই সিক্সের ট্রেনিংয়ের সময়কার এই বিভ্রাটের ঘটনা জনসমক্ষে এসেছিল ১৯৮৮-তে। এমআই ফাইভ-এর অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর পিটার রাইটের কর্মজীবনের স্মৃতিচারণ ‘স্পাইক্যাচার’ বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর। ইংল্যান্ডের বাইরে অবশ্য বছরদুয়েক আগেই প্রকাশিত হয়েছিল বইটি। কিন্তু তারও আগে এমন ঘটনা একেবারে উল্টোভাবে কল্পনা করে ফেলেছিলেন এক ইংরেজ সাহিত্যিক। ফ্রেডরিক ফরসাইথ-এর ‘দ্য ফোর্থ প্রোটোকল’ উপন্যাসে দেখা গিয়েছিল, এক রত্নচোর ব্রিটিশ অ্যারিস্ট্রোক্র্যাসির সদস্য তথা উচ্চপদস্থ সরকারি আধিকারিকের ফ্ল্যাটে চুরি করতে গিয়ে গোপন ভল্টের ভেতর জড়োয়া নেকলেসের সঙ্গে রাখা এমন কিছু সরকারি নথির সন্ধান পায়, যেগুলি ওখানে থাকার কথা নয়। গয়নার সঙ্গে ওগুলিও নিয়ে যায় চোরটি। পরদিন কাগজগুলি খামে ভরে সেগুলি কোথায় পাওয়া গিয়েছে, তার ঠিকানা লিখে, এমআই ফাইভের অফিসে পাঠিয়ে দিয়েছিল দেশের প্রতি দায়িত্ববান চোরটি। সেই থেকে সন্ধান পাওয়া যায় এক রুশ গুপ্তচর চক্রের।
ফরসাইথের কল্পনার কোনও বাস্তব ভিত্তি থাকলেও তার কথা জানা না থাকায়, এই ঘটনাকে গল্প ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। কিন্তু ‘স্পাইক্যাচার’ পিটার রাইট, যিনি তার কর্মজীবনের সম্পূর্ণ ব্যয় করেছেন কাউন্টার-ইন্টেলিজেন্স, অর্থাৎ, ইংল্যান্ডে বিদেশি রাষ্ট্রের গুপ্তচরদের কাজ-কারবার প্রতিহত করার কাজে, স্মৃতিচারণে যা বলেছেন, সেগুলি কখনও মজাদার, কখনও রোমাঞ্চকর, কোনও ক্ষেত্রে হতাশাব্যঞ্জক হলেও, প্রতিটি সর্ব্বৈব সত্য ঘটনা।

রত্নচোর বা বার্গলারের মতো কারও খালি বাড়িতে ঢুকে চুরি না হলেও, আইনের চোখে বেআইনি কাজ করতে হত এমআই ফাইভের লোকেদের। পিটার রাইট নিজেও বহুবার শামিল হয়েছেন এমন অভিযানে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কয়েক বছর পরে ক্যাপিটালিস্ট-কমিউনিস্ট ঠান্ডা লড়াই যখন তুঙ্গে, তখন একবার সিপিজিবি-র গুপ্ত সদস্যদের ফাইলের সন্ধানে মেফেয়ার-এর অভিজাত এলাকায় এক অত্যন্ত ধনী ব্যক্তির বাড়ির তালা ভেঙে ঢুকে সেখানে লুকিয়ে রাখা প্রায় ৫৫,০০০ ফাইল রাতারাতি কপি করে, আবার যেমন-কে-তেমন রেখে বাড়ির অবস্থাও পূর্ববৎ করে সমস্ত ভাঙা তালা সারিয়ে এসেছিলেন একটি সপ্তাহান্তে।
সিপিজিবি, অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টি অফ গ্রেট ব্রিটেনের সদস্য ছিল মেফেয়ার-নিবাসী ওই ধনী ব্যক্তি। দেখা যাচ্ছে, কমিউনিস্ট হতে গেলেই যে সকলকে ‘প্রোলেতারিয়েৎ’ হতে হবে, ব্যাপারটা তেমন নয়। লন্ডনের মেফেয়ার অঞ্চলে যাদের বাসস্থান, তাদের বুর্জোয়া হিসেবেই ধরা উচিত। তবুও তেমন মানুষ সেই পাঁচের দশকেও ‘কমিউনিস্ট’ হতে পেরেছিল। মনে রাখতে হবে, তখনকার দিনে ল্যাপটপ, ডেস্কটপ, ডিজিটাল ক্যামেরা, স্ক্যানার কিছুই ছিল না। তাই ওই মেফেয়ার অঞ্চলেই, সাউথ অডলি স্ট্রিট আর কার্জন স্ট্রিটের সংযোগস্থলে অবস্থিত লেকনফিল্ড হাউসে এমআই ফাইভের দপ্তরে অনেকগুলি মাইক্রোফিল্ম তৈরির মেশিনের ব্যবস্থা করা হল, যখন খবর পাওয়া গেল, ওই বাড়ির মালিক তার পরিবার নিয়ে সপ্তাহান্তের ছুটি কাটাতে যাবে লেক ডিস্ট্রিক্টে। অত্যন্ত গোপনে ফ্ল্যাটের লক ভাঙা হল, ভাঙা হল ফাইলিং ক্যাবিনেটের তালা। তারপর ফাইলগুলি যেভাবে রয়েছে, তার ছবি তোলা হল পোলারয়েড ক্যামেরায়। এবার সাবধানে ফাইলগুলি সরিয়ে বান্ডিল করে নিয়ে যাওয়া হল লেকনফিল্ড হাউসে। সেগুলির মাইক্রোফিল্ম তোলা হলে আবার মেফেয়ারের ফ্ল্যাটে ফেরত নিয়ে গিয়ে পোলারয়েড ক্যামেরায় তোলা ছবি দেখে নিখুঁতভাবে আগের মতো সাজিয়ে ক্যাবিনেট আর ফ্ল্যাটের দরজার যে তালাগুলি ভাঙতে হয়েছিল, সেসব মেরামত করে ওদের ফ্ল্যাটে ঢোকার সমস্ত চিহ্ন মুছে ফেলতে হয়েছিল রবিবার রাতের মধ্যে।
ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টির গুপ্ত সদস্যদের অনেকে রাশিয়ার হয়ে চরবৃত্তি করত সেই সময়ে। ওই ফাইলে তাদের বিবরণ থাকায় এমআই ফাইভের প্রচুর সুবিধা হয়েছিল। সেই অভিযানে পাওয়া তথ্য আরও অনেক বছর কাজে লেগেছিল ব্রিটিশ গুপ্তচর বিভাগের।

বিভিন্ন দেশের এমব্যাসি প্রধানত সোভিয়েত রাশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপের রুশ প্রভাবান্বিত দেশগুলির এমব্যাসিতে এবং সিপিজিবি-র বিভিন্ন অফিসে মাইক্রোফোন লাগিয়ে কথা শোনার ব্যাপারটা ছিল ব্রিটিশ প্রতি-গুপ্তচর যাকে বলে কাউন্টার এস্পিওনেজ-এর এক বিশেষ অঙ্গ। অবশ্য মাইক্রোফোন বসানো যে খুব সহজ ব্যাপার ছিল, তা নয়। পিটার রাইট-এর বইতে এমন অনেক অভিযানের কথা বলা হয়েছে। অবশ্য সেগুলিতে এমআই ফাইভ বা এমআই সিক্স যে সবসময় সফল হয়েছিল, তাও বলা যায় না।
রাইট বলেছেন, এমন সুযোগ পাওয়ার জন্য তক্কে তক্কে থাকতে হত। ছয়ের দশকের কোনও সময়ে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছিল, বেইজওয়াটার রোডে রাশিয়ান কনসুলেটের পাশের বাড়িটি আপাদমস্তক সারানো হবে। লন্ডন শহরের ওইসব প্রাচীন বাড়ির দেওয়াল গায়ে লাগা। মাঝে কোনও ছাড় নেই। ডেকরেটরের লোকদের সঙ্গে মিশে এমআই ফাইভের দক্ষ এজেন্টরা ঢুকে পড়ল কনসুলেটের পাশের সেই বাড়িতে। দুই বাড়ির মধ্যবর্তী চওড়া দেওয়ালে ড্রিল করে তৈরি গর্তে ঢুকিয়ে দেওয়া হল ‘প্রোব মাইক্রোফোন’ নামক নতুন তৈরি একটি ছোট্ট বস্তু। সেটি রইল ওদিকের দেওয়ালের আধ ইঞ্চি ভেতরে। আর সেখানে করা হল ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটি ছিদ্র। তখন বেতারের যতটুকু উন্নতি, তাতে মাইক্রোফোনের সঙ্গে স্পিকারের যোগাযোগ করতে কেবল বা তার ব্যবহার করতে হত। এই অভিযানে বা এমন সব ক্ষেত্রেই কেবলটি লুকোতে হয়েছিল দেওয়ালের ভেতর। সেখান দিয়ে রাস্তা পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে টেলিফোনের তারের ভিড়ে মিশিয়ে দিতে অসুবিধা হয়নি। সেই তারগুলি নিয়ে যেতে হয়েছিল লেকনফিল্ড হাউস পর্যন্ত।
বিস্তর বুদ্ধি খাটিয়ে অনেক পরিকল্পনা করে সম্পন্ন করা এমন মেহনতের কাজটি অবশ্য ছয় মাসের বেশি কাজে লাগেনি। মাস-ছয়েক কাটতে না কাটতেই স্পিকারে কথার শব্দ বন্ধ হয়ে গেল। রাইট সাহেব তাঁর সহকর্মী আর ওপরওয়ালারা হতাশ হলেন বেশ। রাশিয়ান এমব্যাসিতে যাতায়াত আছে, এমন এক লোক, যাকে গুপ্তচরদের ভাষায় ‘মোল’, মানে ছুঁচো বলা হয়, তার কাছে জানা গেল ওই ঘরটির দেওয়াল রং করা হয়েছে। রঙের আস্তরণ পড়ে ‘পিনহোল’-এর মতো ছিদ্র বুজে গিয়েছে ভেবে, আবার পরিকল্পনা শুরু হল রাইট সাহেবদের অফিসে।
সেই মোতাবেক এক শীতল সন্ধ্যায় অফিস ছুটির পর রাইট সাহেব একজন এক্সপার্টকে সঙ্গে নিয়ে আবার পৌঁছলেন এমব্যাসির পাশের ওই বাড়িতে। বিস্তর সাবধানতার সঙ্গে দেওয়ালে আবার ড্রিল করে যাবতীয় ধুলো মেঝেতে পড়ার আগে সংগ্রহ করে বের করা হল তার আর মাইক্রোফোন। দেখা গেল, পিনহোলটি শুধু রং দিয়ে নয়, যেন সিরিঞ্জের মাধ্যমে ওর ভেতর কিছু ঢুকিয়ে বুজিয়ে দেওয়া হয়েছে। অতীব দক্ষতার সঙ্গে আবার সবকিছু ঠিক করে রেখে পিনহোল উন্মুক্ত করে ভোরের আগে ফিরে এসেছিলেন ওঁরা। দেখা গিয়েছিল, মাইক্রোফোন ঠিকঠাক কাজ করছে। কিন্তু অফিস চলাকালীন একটি মাত্র টাইপরাইটারের খটাখট আওয়াজ ছাড়া আর কোনও শব্দ ওই মাইক্রোফোনে ধরা পড়ছে না। মাসখানেক পর এমআই ফাইভের এর ‘মোল’ আবার ওই ঘরের ভেতর ঢোকার সুযোগ পেয়েছিল। তখন রাইট সাহেবরা জানতে পারেন, ওই ঘরের ওদিকের বিশেষ দেওয়ালটি এবং কিছু অংশ শব্দনিরোধক পার্টিশন লাগিয়ে আলাদা করে সেখানে একজন-মাত্র টাইপিস্টের বসার জায়গা করে দেওয়া হয়েছে।
মাইক্রোফোন বসিয়ে আড়ি পাতা, কারও ওপর নজর রাখা, পোস্টাল ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে ব্যবস্থা করে অন্যদের চিঠিপত্র লুকিয়ে পড়া বা কপি করা প্রভৃতি ছিল এমআই ফাইভের প্রধান কাজ। পিটার রাইট লিখেছেন, তাঁদের ফিল্ড এজেন্ট, অর্থাৎ পায়ে হেঁটে বা গাড়ি নিয়ে ঘুরে যারা বিদেশি এমব্যাসির লোকজন কিংবা অন্য সন্দেহভাজনদের ওপর নজর রাখত, তাদের গাড়ির জন্য পেট্রল বা কোনও পাবে বসতে হলে কত সময়ে কতখানি বিয়ার বা অন্য মদ কেনার জন্য খরচ করতে পারবে, তার জন্য নির্দিষ্ট সরকারি বরাদ্দ ছিল। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যেত, ওইটুকু বরাদ্দে কুলনো যাচ্ছে না। তাছাড়া যার ওপর নজর রাখা হচ্ছে, তার সন্দেহ এড়াতে অনুসরণকারী বদলাতে হত। তারও নির্দিষ্ট নিয়ম ছিল। তার ওপর ছিল কাজের সময় বা ডিউটি আওয়ার্সের ব্যাপার।
এমআই ফাইভ একবার মতলব এঁটেছিল ইংল্যন্ডের রুশ অ্যাম্বাস্যাডরকে রাষ্ট্রের তরফে এমন কিছু উপহার দেবে, সেটি অফিসের ডেস্কে সাজিয়ে না রেখে তিনি পারবেন না। সেই বস্তুটি তৈরি হবে, এমনভাবে যাতে, ঘরে উচ্চারিত যে কোনও শব্দ তার মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়ে মাইক্রোওয়েভ হিসেবে বিকীর্ণ হবে, আর ধরা পড়বে ইংরেজদের রাখা মাইক্রোফোনে। সেই সময়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এক সদস্য হেনরি কার্বির সঙ্গে খুব ভাল সম্পর্ক ছিল রুশ রাষ্ট্রদূতের। পরিকল্পনা হয়েছিল, তাঁর হাত দিয়েই উপহারখানা পাঠানোর। কিন্তু উপহার হিসেবে দেওয়া বস্তুটি কী হতে পারে— এমআই ফাইভের কর্তারা সেটাই ভেবে পাচ্ছিলেন না। তাই তাঁরা শরণাপন্ন হলেন ক্লপ উস্তিনভ-এর।

জার্মান বংশোদ্ভূত ক্লপ উস্তিনভ ছিলেন নাৎসিদের বিরোধী। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে এবং তার পরেও নিয়মিত কাজ করেছেন ব্রিটিশ গুপ্তচর বিভাগের হয়ে। তাঁর সঙ্গে রাশিয়ান কূটনীতিকদেরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ক্লপ-এর আর একটি পরিচয় হল, তিনি বিখ্যাত অভিনেতা পিটার উস্তিনভ-এর বাবা। কেনসিংটনে ক্লপের ফ্ল্যাটে গিয়ে একটু হকচকিয়ে গিয়েছিলেন পিটার রাইট। তাঁর আন্দাজ ছিল, গিয়ে দেখবেন এক অবসরপ্রাপ্ত নায়ককে। কিন্তু তখন বেশ বেহাল অবস্থা উস্তিনভ-এর। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে কোনও পেনশন দেয়নি। গ্রাসাচ্ছাদন হয় সংগ্রহের দুষ্প্রাপ্য বইপত্র বিক্রি করে। তবুও একটি ভদকার বোতল আর দু-খানা গ্লাস চলে এল অতিথি আপ্যায়নে। শুরু হল আলোচনা। রাইট-এর প্রশ্নের উত্তরে উস্তিনভ প্রথমেই বলে দিয়েছিলেন, রাশিয়ান রাষ্ট্রদূত বা এমব্যাসির অন্য অফিসারদের যা-ই দেওয়া হোক না কেন, ওরা পরদিনই সেগুলি বিক্রি করে দেবে। তবে লেনিনের মস্তক বা ক্রেমলিন প্রাসাদের রেপ্লিকা হলে আলাদা কথা। রাইট-এর কাজ লেনিনের মাথার মডেল দিয়ে হবে না। ওই কেশবিহীন নিটোল মাথার চকচকে টাকে শব্দ প্রতিফলিত হওয়া সম্ভব নয়। তাই অনেক আলোচনার পর ক্রেমলিন প্রাসাদের রেপ্লিকাই যখন সাব্যস্ত হওয়ার পথে, তার আগেই আলোচনা ঘুরে গিয়েছিল অন্যদিকে। ভদকা ততক্ষণে কাজ শুরু করে দিয়েছে। আর উস্তিনভ ওগরাতে শুরু করেছেন ব্রিটিশ সরকারের প্রতি তাঁর ক্ষোভ।
পিটার রাইট তাঁর স্মৃতিচারণে স্পষ্টভাবে বলেননি, তবে পাঁচের দশকে শুরু হয়ে আরও কয়েক দশক যাবৎ একে একে যে উচ্চপদস্থ ব্রিটিশ গুপ্তচরদের বিশ্বাসঘাতকতা এবং রাশিয়ায় পলায়নের ঘটনাগুলি ক্রমশ জনসমক্ষে এসে সিক্রেট সার্ভিসের মুখ কালিমালিপ্ত করছিল, সেগুলির পিছনে ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের তরফে তাদের হয়ে জান লড়িয়ে দেওয়া গুপ্তচরদের যথাযথ সম্মান এবং আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য না দেওয়াও যে একটা কারণ হতে পারে, তার আন্দাজ প্রতি পদক্ষেপে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন ‘স্পাইক্যাচার’-এর লেখক।
চর-জীবনের স্মৃতিচারণ করতে বসে নানা মজার ঘটনার কথাও রাইট শুনিয়েছেন। একবার হাঙ্গেরিয়ান এমব্যাসির পাশে একটি সেফ হাউসের ছাদে মাঝরাতে এরিয়াল বসাতে উঠেছিলেন রাইট নিজেই। উদ্দেশ্য ছিল, সোভিয়েত ব্লকের দেশের কূটনৈতিক কথাবার্তা আড়ি পেতে শোনা। কিন্তু এক প্রতিবেশী জানালা দিয়ে অত রাতে ছাদে লোক উঠতে দেখে চোর ভেবে পুলিশে ফোন করায় কয়েক মিনিটের মধ্যে সাইরেন বাজিয়ে পুলিশ চলে এসেছিল। তাদের বোঝাতে হয় যে, বাড়ির মালিকের নির্দেশে মেরামতের কাজকর্ম চলছে। ব্যাপারটা বিশ্বাস করাতে বা চাপা দিতে স্থানীয় স্পেশাল ব্রাঞ্চের একটা ফোন নম্বরও দিতে হয়েছিল।
লন্ডনের পোলিশ এমব্যাসির পাশের বাড়ি সাময়িকভাবে খালি থাকার খবর পেয়ে সেখানে ঢুকে দেওয়াল ফুঁড়ে মাইক্রোফোন বসানোর সময় রাইট সাহেব দলের সকলকে বাধ্য করেছিলেন জুতো খুলে, শুধু মোজা পরে চলাফেরা করতে, যাতে কাঠের মেঝেতে পায়ের শব্দ না হয়। কিন্তু তিনি নিজেই যখন কাঠের সিলিং-এর ভেতর তার বসাচ্ছিলেন, সিলিং থেকে একটি পাটাতন খুলে সশব্দে নিচে পড়ে। তবে ভাগ্যক্রমে সেই আওয়াজে সে রাতে পোল্যান্ডের এমব্যাসির বাড়িটির আশেপাশের বাড়ির কারও ঘুম ভাঙেনি।
কিম ফিলবি, গাই বার্জেস, ডোনাল্ড ম্যাকলিন এবং অ্যান্টনি ব্লান্ট-এর ডাবল এজেন্ট হিসেবে রাশিয়ানদের কাছে খবর পাচার করার ঘটনা এবং তাদের রাশিয়ায় পালিয়ে যাওয়ার সময়ে ব্রিটিশ গুপ্তচর দপ্তরে কেমন প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল, তার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় পিটার রাইট-এর স্মৃতিচারণে। ‘স্পাইক্যাচার’ যেহেতু ১৯৮৭-তে প্রথম প্রকাশিত, তাই ‘কেমব্রিজ ফাইভ’ নামে কুখ্যাত পাঁচ ডাবল এজেন্টের পঞ্চম জন কেয়ার্নক্রস-এর প্রসঙ্গ সেখানে উত্থাপিত হওয়ার সুযোগ ছিল না। কিন্তু পিটার রাইট তাঁর স্মৃতিচারণ জুড়ে পাঠককে আন্দাজ দিয়ে গিয়েছেন এমআই ফাইভ এবং সিক্সের ভেতর উচ্চপর্যায়ে এক বা একাধিক বিশ্বাসঘাতক থেকে যাওয়ার আশঙ্কার। রাইট সন্দেহ করতেন তাঁরই ওপরওয়ালা ডাইরেক্টর রজার হলিস রাশিয়ানদের খবর পাচার করেন। কিন্তু হলিস-কে ধরা যায়নি কখনও।

রাইট সাহেবের স্মৃতিচারণ যেমন কৌতূহলোদ্দীপক, তার মতোই আকর্ষণীয় ‘স্পাইক্যাচার’-এর প্রকাশনার ইতিহাস। সত্যি বলতে কী, এই বইটির প্রকাশ রুখতে ব্রিটেনের সরকারি তরফে যা করা হয়েছিল, কাউন্টার এস্পিওনেজের থেকে সেই প্রচেষ্টা বা রক্ষণ কিছু কম ছিল না। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর অস্ট্রেলিয়ার তাসমানিয়ায় চলে গিয়েছিলেন রাইট। বইটি সেখানেই লিখেছিলেন পল গ্রিন গ্রাস-এর সহায়তায়। ব্রিটিশ সরকারের টনক নড়ে সেই খবর পেতেই। তাদের পক্ষে আদালতে আবেদন করায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল ইংল্যান্ডে ওই বইয়ের প্রকাশনা আর বিক্রি বন্ধ করতে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া এবং পৃথিবীর অন্যান্য দেশে তো বটেই, এমনকী, স্কটল্যান্ডেও ওই বইটির প্রকাশনা বা বিক্রিতে বাধা পড়েনি। আদালতের আদেশ নিয়ে ব্রিটিশ প্রেসের ওপর ওই বইয়ের আলোচনা বন্ধ করতে ‘গ্যাগ অর্ডার’ নামে পরিচিত আদালতের আদেশ জারি করা হয় ইংল্যন্ডে। স্কটল্যান্ডে বিক্রি হওয়া বই কিন্তু নিয়মিত পাচার হত ইংল্যন্ডে। হয়তো আদালতের নিষেধাজ্ঞা বইটির চাহিদা বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করেছিল কিয়ৎ পরিমাণে। অনেক পরে ১৯৯৩-এ আমেরিকায় সিআইএ-র কর্মীদের মুখপত্র পত্রিকাতেও ‘স্পাইক্যাচার’-এর রিভিউ প্রকাশিত হয়েছিল। ব্রিটিশ সরকার মরিয়া হয়ে চেষ্টা করেছিল অস্ট্রেলিয়া এবং অন্যত্র বইটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে। সেই প্রচেষ্টা সফল হওয়া তো দূরের কথা, ১৯৮৮ সালে ইংল্যন্ডেও ‘স্পাইক্যাচার’-এর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে গিয়েছিল আদালতের আদেশে। অস্ট্রেলিয়ায় ব্রিটিশ সরকারের বইটির বিরুদ্ধে করা মামলায় পিটার রাইট, অর্থাৎ বিবাদীর পক্ষে উকিল হিসেবে দাঁড়িয়েছিলেন ম্যালকম টার্নবুল। পরবর্তীকালে তিনি অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। পিটার রাইট ইহলোক ত্যাগ করেন আইনি যুদ্ধে জেতার বছরসাতেক পর, ১৯৯৫-এর ২৬ এপ্রিল, ৭৯ বছর বয়সে। আর ২০০৮-এর হিসেব-মতো ‘স্পাইক্যাচার’ বিশ্বজুড়ে দুই মিলিয়নের কিছু বেশি কপি বিক্রি হয়েছিল।
১৯৯৫ সালে পিটার রাইট প্রয়াত হওয়ার আগে শুধু বই বিক্রির টাকাতেই মিলিওনেয়ারে পরিণত হয়েছিলেন। তাঁর জীবনাবসানের দু’দিন পর ‘দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ সংবাদপত্রে যে বলা হয়েছিল, একমাত্র কিম ফিলবি ছাড়া আর কোনও ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স বিভাগের অফিসার ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসকে তেমন আঘাত দিতে পারেনি, যা দিয়েছিলেন পিটার রাইট শুধুমাত্র একটি বই লিখে— সেই বক্তব্যও কিন্তু অস্বীকার করা যায় না।
টীকা: ‘স্পাইক্যাচার’। পিটার রাইট (১৯১৬-’৯৫) পল গ্রিনগ্রাস-এর সহায়তায়। প্রকাশক হাইনম্যান, অস্ট্রেলিয়া। প্রথম প্রকাশ জুলাই ১৯৮৭।