‘আরেকটি প্রেমের গল্প’-তে যে ফোটোগ্রাফারের চরিত্রে যীশু সেনগুপ্ত অভিনয় করে, সেই চরিত্রটি আমারই আদলে গড়েছিল ঋতুদা; সে-গল্পে আসছি, প্রথমে পরিচয় পর্ব সারা যাক।
ঋতুদার সঙ্গে প্রথম আলাপ, ‘ঘোষ অ্যান্ড কোম্পানি’ শীর্ষক একটি টেলিভিশন টক শো-তে; ‘স্টার জলসা’-য় সম্প্রচারিত হত অনুষ্ঠানটি। একটি বিজ্ঞাপন সংস্থার হয়ে, শো-টিতে ঋতুদারই ছবি তুলতে গেছিলাম সেদিন; সালটা ২০১০।
বেশ মজার সেই মুহূর্ত, সকাল-সকাল ফ্লোরে গিয়ে দেখি, ঋতুদা মেক-আপ নিয়ে, পোশাক পরে এপিসোড শুটিংয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমি পরিচয় দিয়ে বললাম, ‘এপিসোড শুটিংয়ের আগেই কিছু ফোটোশুট করতে হবে এবং সেটার জন্য আমাকে কমপক্ষে দু’ঘণ্টা সময় দিতে হবে।’
আরও পড়ুন : অভিনয়ের সময় ক্যামেরা অনুসরণ করবে অভিনেতাকে, মনে করতেন ঋতুদা!
লিখছেন সৌমিক হালদার…
ঋতুদা জানাল, তার পক্ষে প্রথমার্ধেই এতটা সময় দেওয়া সম্ভব নয়। একমাত্র এপিসোড শুটিংয়ের শেষেই ফোটোশুট করতে পারব। কিন্তু সমস্যা হল, আমার যা পারিশ্রমিক সেদিন নির্ধারিত হয়েছিল, তাতে অতটা সময় অপেক্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। এদিকে, বিজ্ঞাপনের খসড়াটাও ঋতুদার ভীষণ অপছন্দ। সকলেই জানেন, বিজ্ঞাপনের জগতে ঋতুদার অবদান অনস্বীকার্য। ওর লেখা বহু বাংলা এবং ইংরেজি বিজ্ঞাপনের লাইন তামাম বাঙালির মননে আজও উজ্জ্বল। বিজ্ঞাপনের জগৎ থেকেই যার ছবি পরিচালনায় হাতেখড়ি— এমন একজন ব্যক্তিত্বের সঙ্গে কাজ করাটাও সে-সময়ে আমার কাছে খুবই আনন্দ এবং একই সঙ্গে চাপেরও।

বিজ্ঞাপনের খসড়া অপছন্দ হওয়াতে একটা বিরক্তির চিহ্ন ঋতুদার চোখে-মুখে প্রকাশ পাচ্ছিল, আর সেই পরিস্থিতিটা খুব স্বাভাবিকভাবেই, আমার কাছেও যথেষ্ট উদ্বেগের বিষয়। কোনও এক কারণে, ঋতুদা প্রথমার্ধেই ছবি তুলতে রাজি হল। শুরু করলাম আলো করা, একটা সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডের সামনে একটা সোফা, ঋতুদা এল।
নিজের ছবি তোলার ব্যাপারে ঋতুপর্ণ ঘোষ বরাবর ভীষণ খুঁতখুঁতে; আলো, ক্যামেরা-অ্যাঙ্গেল, শরীরের ভঙ্গি, মুখের আদল, সর্বোপরি চোখের ভাষা— সবই মনমতো হতে হবে। এদিকে, সেদিন ওর মেক-আপ এবং কস্টিউম— দুটোই আমার বেশ খারাপ লেগেছিল।

সোফাতে বসিয়ে প্রথমে টেস্ট শট নিই, ছবি ল্যাপটপের পর্দায় আসতেই, ভীষণ হতাশ হলাম। মনে হল, এবার ঋতুদা স্টুডিওর এত মানুষের সামনে নিজের সমস্ত বিরক্তি আমার ওপর উগরে দেবে। কোনও উপায় নেই দেখে সোজা ল্যাপটপ নিয়ে ওর কাছে গিয়ে, হতাশার সঙ্গে বললাম, ‘তোমাকে যতটা সুন্দর আমি দেখি, তার কিছুই আমি ধরতে পারিনি।’ ছবিটা দেখার পর কেন জানি না, ঋতুদা বেশ স্বাভাবিক স্বরে বলেছিল— ‘তুই কি চাইছিস বল।’ মুখে বিরক্তির ছাপ নেই, আছে স্মিত হাসি। আমি একটু সাহসে ভর করে, স্পষ্টই বললাম, ‘তোমার মেক-আপ নতুন করে করতে পারলে, ভাল হয়, আর জামাকাপড়ের বিকল্পও যদি কিছু দেখতে পারি।’ আবারও সেই স্বাভাবিক স্বরে ঋতুদা বলল, ‘অনেকটা সময় লাগবে রে বাবু, আমার এপিসোডটা শেষ হোক, তারপর তুই নিজে দাঁড়িয়ে মেক-আপ আর কস্টিউমটা দেখে নিবি; দেখিস, কাজটা অনেক ভাল হবে।’ আমি কিছুটা স্বস্তি পেলাম, একইসঙ্গে আমার ক্লায়েন্টও।

দিনের শেষে আমরা আবার নতুন করে শুরু করলাম। সারাদিনের মেক-আপ, কস্টিউমও বদলানো হল। কী উৎসাহ ঋতুদার! শুটিংয়ের ক্লান্তি উধাও। এবার ছবি তুলে আমি খুশি, ঋতুদাও। বুঝতে পারলাম, ঋতুদা শুধু অভিনেতার জন্য পরিচালকই নয়, সে-টিমের সবার থেকেই ভাল কাজ আদায় করে নিতে জানে।
সেদিন আমার সারা দিনের পারিশ্রমিক পেতেও কোনও অসুবিধা হয়নি।
সে-দিন ফোটোশুটের শেষে, অনেক গল্প হয়েছিল আমাদের এবং ‘নৌকাডুবি’-তে একটা চরিত্রে অভিনয়ের জন্য, আমায় মহলাতে ডেকছিল ঋতুদা। সেই ছবিতে আমার অভিনয় করা না হলেও শুটিং ফ্লোরে প্রবেশ অবাধ হয়েছিল।
সে-ও এক অন্য গল্প, ইউনিটের তো নিজস্ব একজন ফোটোগ্রাফার ছিলই, সেখানে আমি যে যাব, কোন হিসেবে? মানে আমার থাকা-খাওয়া— ইত্যাদি কোন হিসেবে দেখানো হবে প্রোডাকশন হাউজকে? আমি বলেছিলাম, ‘দেখো, আমি চেষ্টা করব, তুমি যখন ক্যামেরার পিছনে থাকো, তখন তোমার অ্যাকশন কী হয়, পাশাপাশি কোনও অভিনেতা-অভিনেত্রীকে যখন তুমি কিছু বোঝাচ্ছ, তোমার পাশাপাশি তাদের প্রতিক্রিয়া কী হচ্ছে? আবার এটাও দেখা যায়, যার যেটা স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া নয় তোমার ইউনিটে, তোমার ব্যক্তিত্বর প্রভাবে তার আচরণে বদল আসছে। আমি এই মুহূর্তগুলোই বিশেষ ভাবে ধরে রাখতে চাইছি।’ এই প্রোজেক্ট সামনে রেখেই বেনারস গিয়েছিলাম।
ঋতুদার এই সাজতে ভালবাসার ব্যাপারটা আমরা সবাই-ই বেশ উপভোগ করতাম। ‘চিত্রাঙ্গদা’-র শুটিংয়ে একদিন খুব সেজে সেটে এসে বলল, ‘দেখ কেমন লাগছে আমাকে’, আর সঙ্গে-সঙ্গে আমাদের মধ্যে থেকে আওয়াজ উঠল, ‘রেখা! রেখা!’। এর’ম করেই শুটিংয়ের দিনগুলো আনন্দে কেটে যেত আমাদের।
যথারীতি, নানা মুহূর্তর ছবি ফ্রেমবন্দি করলাম, তারপর সেইসব মুহূর্তের ছবিগুলো নিয়ে একটা মন্তাজ বানাই— খুব খুশি হয়েছিল ঋতুদা সেইটা দেখে, আনন্দে কেঁদে ফেলেছিল রীতিমতো। আমাকে বলেছিল, ও তো সবসময় ফ্রেমের পিছনে থাকে, নিজের আচরণ কী হচ্ছে, স্বাভাবিকভাবেই দেখতে পাচ্ছে না। আমি সেটা আয়নার মতো ধরেছি ওঁর সামনে! সবাইকে ডেকে-ডেকে দেখিয়েছিল ঋতুদা।
মন্তাজটির নামকরণ ঋতুদা নিজেই করেছিল, ‘আমার মনের ভিতরে’।
‘নৌকাডুবি’-তে আমি যে ভাবনা সামনে রেখে ছবি তুলেছিলাম, সেই চরিত্রকেই সামনে রেখে, ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’-তে ফোটোগ্রাফারের চরিত্রটি ঋতুদা লেখে। যীশু অভিনয় করেছিল চরিত্রটিতে, যীশুকে নির্দেশ দেওয়ার সময়, ঋতুদা বলে দিয়েছিল, আমার আচরণ, মুভমেন্টগুলো যেন ও ফলো করে। এছাড়া ‘চিত্রাঙ্গদা’-র মেকিংয়ের একটা ভিডিও বানিয়েছিলাম। ঋতুদার খুব পছন্দ হয়েছিল সেই কাজ।

ঋতুদা সাজতে যে ভালবাসত, সকলেই জানেন; ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’-তে লুক টেস্ট করার জন্য মাঝে-মধ্যেই আমি ঋতুদার ইন্দ্রাণী পার্কের বাড়িতে যেতাম, আর নানারকম লুকে অনেক ছবি তুলতাম। এরকমই একটা ছবি দেখে ঋতুদা বলল, ‘দেখ আমাকে কেমন রিনাদির (অপর্ণা সেন) মতো লাগছে না?’ ঋতুদার এই সাজতে ভালবাসার ব্যাপারটা আমরা সবাই-ই বেশ উপভোগ করতাম। ‘চিত্রাঙ্গদা’-র শুটিংয়ে একদিন খুব সেজে সেটে এসে বলল, ‘দেখ কেমন লাগছে আমাকে’, আর সঙ্গে-সঙ্গে আমাদের মধ্যে থেকে আওয়াজ উঠল, ‘রেখা! রেখা!’। এর’ম করেই শুটিংয়ের দিনগুলো আনন্দে কেটে যেত আমাদের।
সেদিন, আমরা কোনারক থেকে শুটিং শেষ করে, রাতের ট্রেন ধরব বলে পুরী স্টেশনে আসার পথে একটা মূর্তি তৈরির দোকানে ঢুকলাম, সবাই পছন্দমতো পাথরের মূর্তি বেছে নিল। ঋতুদাও বুদ্ধের একটা বড় আবক্ষ মূর্তি পছন্দ করে সেটাতে একটু সংশোধন করার জন্য শিল্পীকে কিছু নির্দেশ দিল। আমরা দর-দাম করে বুঝলাম যে, এগুলো আমাদের বাজেটের বাইরে, তাই আমরা কিছু না-কিনেই বিরত হলাম। আমাদের দেখে, ঋতুদাও মূর্তিটা না নিয়ে বেরিয়ে এসে বলেছিল, ‘দলের সবাই যখন লড়াই করে দাম কমাতে না পেরে, হেরে ফিরে এল, তখন আমি-ই বা কিনি কীভাবে, সবার হার, আমারও হার! কারণ আমিই পরিচালক, আমিই এই দলের নেতা।’
ঋতুদার মধ্যে টিম ওয়ার্ক-এর স্পিরিট ছিল, যা আজও আমাদের সবাইকে উদ্বুদ্ধ করে।