‘খেলার ছলে ষষ্ঠীচরণ হাতি লোফেন যখন তখন,
দেহের ওজন উনিশটি মণ, শক্ত যেন লোহার গঠন’
সুকুমার রায়ের এই ষষ্ঠীচরণ বেনিয়াটোলায় সত্যি হাতি নিয়ে লোফালুফি করত কি না, জানা না গেলেও তার প্রায় বিশমনি দেহের লৌহসম দৃঢ়তা নেহাত উড়িয়ে দেওয়ার মতো ব্যাপার নয়!
নীরোগ স্বাস্থের অধিকারী হওয়ার তাগিদে শারীরিক সঞ্চালন এবং অভ্যাস যে অবশ্য প্রয়োজন, তা সভ্যতার আদিযুগে নিশ্চয় বুঝতে পেরেছিল অরণ্যচারী মানুষেরা। অবিশ্যি তার জন্য তাদের শারীরিক কসরত আলাদা করে খুব একটা করতে হয়নি, ব্যাবহারিক জীবনযাপনের দায়ে, দায়গ্রস্ত হয়ে তা পরিণত হয়েছিল অভ্যাসে।
কিছু খেলার উৎস, নিয়মকানুনের বৈশিষ্ট্য বিচার করলে বোঝা যায়, যে শুধু অবসর বিনোদনের জন্য নয়, জীবিকার্জন ও আত্মরক্ষার অঙ্গ হিসেবেও তা গণ্য হত। একটা সময়ে আদিম অরণ্যচারী মানুষ হিংস্র পশুর সঙ্গে লড়াই করে বাঁচত অথবা শিকার করে সংগ্রহ করত নিজের খাদ্য রসদ। পরে সেই পশু শিকার পরিণত হল বিনোদন বা এক ধরনের ‘হবি’-তে। কুস্তি, লাঠিখেলা, মুষ্টিযুদ্ধ, অসি বা তির চালনা, সাঁতার, নৌকা চালনা, দৌড়— এ-সবই এক সময়ে আত্মরক্ষার অঙ্গ হলেও, এখন তা পরিণত হয়েছে আকর্ষণীয় খেলায়।
আরও পড়ুন : সার্কাস দলকে স্বদেশি চেতনার প্রসারের কাজে ব্যবহার করতেন প্রিয়নাথ বোস? লিখছেন সৌরপ্রভ চট্টোপাধ্যায়
চতুরাজি, যার নবতম সংস্করণ দাবা, আসলে বাস্তব যুদ্ধক্ষেত্রের কৌশল নির্ভর একটি খেলা।
নিছক জীবনধারণের অঙ্গ থেকে বিনোদনের আঙ্গিকে উন্নিত হওয়ার এই বিষয়টি আদপে মানব-সভ্যতার এক সামাজিক বিবর্তন। মজার ব্যাপার হল, বাংলার ক্ষেত্রে এই রূপান্তরের বেশির ভাগটাই কিন্তু হয়েছে পল্লিসমাজের আঙিনায়, নগরকেন্দ্রিক খেলাধূলা অর্থাৎ ফুটবল, ক্রিকেট, টেনিস, হকি— ইত্যাদির সঙ্গে কোনওরকম সম্পর্ক না রেখেই। বিদেশাগত খেলা নগর থেকে গ্রামমুখী হয়েছে, সেখানে তার নিয়মের ঘটেছে সরলীকরণ। অথচ এর বিপরীতে, গাঁয়ের খেলা কিন্তু তত দ্রুত চলে আসেনি শহুরে চৌহদ্দির মাঝে। বলা ভাল, হয়তো-বা ঘণ্টা-মিনিট-সেকেন্ডে বাঁধা শহরের কেজো জীবনে লোকজ বা লৌকিক ক্রীড়ার সজীব ও সাবলীলতা সেভাবে দানা বাঁধেনি।
বাঙালির কলকাতাকেন্দ্রিক জীবন থেকে দূরে লৌকিক সংস্কার ও সংস্কৃতির ধারক-বাহক এইসব দেশজ খেলা আজও কিছু-কিছু থেকে গেছে আমাদের মন জুড়ে; ধূলায় মোড়া মাটির থেকে জন্ম নিয়ে তারা প্রজন্মান্তরে ‘বঙ্গ জীবনের অঙ্গ’ হয়ে রয়ে গেছে।
কোনওরকম সাজ-সরঞ্জামের বালাই নেই এসব খেলায়। লৌকিক উপকরণ বা সামগ্রী যেমন ইট, কাঠি, ঘুঁটি, কড়ি, বিচি, পাতা, পাথর, কাগজ, সুতো এইসবের ব্যবহার দেখা গেলেও শহুরে খেলার দামি পোশাক, জ্যাকেট, ব্যাট, বল, ম্যাট, টেবিল, নেট— এসবের প্রয়োজনীয়তা নেই সেখানে। নেই নিয়ম বা রুলবুকের কড়াকড়ি তার চলনে, পরিচালনে। শহুরে খেলার জনপ্রিয়তার পাশে সে-সব খেলা আজ হয়তো-বা খানিক ম্রিয়মাণ। তবু তারা আছে।
পাড়ায়-পাড়ায় একটা সময়ে অবসর বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে হাডুডু, ভোক্কা, বুড়ি-বসন্ত, বউছি, দাড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, খোখো প্রভৃতি খেলা হত; এগুলো মূলত দমের খেলা। নরম মাটিতে দাগ কেটে তৈরি করা কোর্টে চলত প্রতিযোগিতার লড়াই। দলবদ্ধ খেলা, তাই প্রতিপক্ষ একজন নয়, একটি দল। কোর্টের যুদ্ধক্ষেত্রে কখনও আক্রমণ, কখনও পশ্চাদ্ধাবন, কখনও শারীরিক স্পর্শ বা বলপ্রয়োগ করে জয় হাসিল করার তাগিদ।
দেশজ এইসব খেলা কিন্তু নারী-পুরুষকে আলাদা করেনি খেলোয়াড় হিসেবে । অর্থাৎ উভয়ই তাদের মনোরঞ্জনের জন্য অংশগ্রহণ করে এসেছে এ-সব খেলায়। দমের খেলা মূলত কবাডি। আমরা যে কবাডি দেখে অভ্যস্ত, অর্থাৎ দম টেনে একনাগাড়ে সুর করে ‘কবাডি-কবাডি’ আউড়াতে-আউড়াতে (যাকে বলে ‘গাওয়া’), প্রতিপক্ষের কোর্টে ঢুকে পড়ে, সার্জিকাল স্ট্রাইকের মতো কাউকে ছুঁয়ে দিয়ে আউট (‘মোর’) করে দ্রুত নিজের ঘরে ফিরে আসা, অঞ্চল ভেদে তার অনেকরকম স্টাইল আছে। প্রথমেই ‘গাওয়া’–র তারতম্য। কোর্ট না কেটে অনেক সময়ে ‘ছাড়া কবাডি’ খেলা হয়— যেখানে কোনও সীমারেখার বন্ধন থাকে না। যেটা থাকে, তা হল ছড়া বৈচিত্র্য। আজকাল ‘র্যাপ’ গানের মতোই ‘ব্রেথলেস’ হয়ে সে-সব ছড়া কাটতে হয় অতি দ্রুততায়। যেমন: ‘চি চাটকা আমের বোল, গাছে উঠি মারি শোল, শোলের কপালে ফোঁটা, খেঁড়ু মারি গোটা’ অথবা, ‘চুরে চুরে গাই, মধু কোথা পাই, মধুর গন্ধে ছুটে ছুটে যাই’ কিম্বা ‘হাডুডু পেয়ারা পাতা, দু’গালে দুই ছেঁড়া জুতা’— এরকম রকমারি!


কলকাতা শহর ও শহরতলিতে মেয়েরা যখন হাডুডু খেলত, তাদের মধ্যে প্রবণতা ছিল দম বন্ধ করে, ‘চু কিত কিত কিত’ একনাগাড়ে বলে যাওয়ার। খোখোও একটা সময়ে গ্রামে বা শহরতলিতে বেশ লোক জমানো একটা খেলা ছিল। বিকেল হলেই রেললাইনের মাঠ বরাবর খোখোর কোর্ট ঘিরে লোক সমাগম হত। লম্বা কোর্টের দু’দিকে দুটো খুঁটি— আর তার মাঝখানে লাইন করে একদল ‘চেসার’। অপর পক্ষ ‘রানার’। ‘খো’ পেলেই রানারের পিছনে ধাবমান চেসার। সাংঘাতিক রিফ্লেক্স এবং গতি নির্ভর খেলা খোখো। হালে কবাডি এবং খোখো— দুই-ই জাতে উঠেছে। পল্লিগ্রামের ধুলোমাখা খেলা এখন আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃত। আলো ঝলমল ইনডোর স্টেডিয়ামে তার উত্তরণ খানিক ধরা পড়ে অমিতাভ দাশগুপ্তের ‘খো খো’ কবিতার সেই মেয়ের জীবনেই—
‘মায়ের সঙ্গে ঠোঙা বানায়,
বিকেলে খেলে খো খো,
বনগাঁ থেকে বার্লিনে যায়,
সাধ্যি থাকে রোখো।
মেয়ের বাবা সকাল-সন্ধে
চৌমাথাতে হকার,
ছোট বোনটি ফাইভে পড়ে,
এখনও দাদা বেকার।
তবুও খো খো খেলুড়ে মেয়ে
লড়ছে এমন লড়াই
তাকে নিয়েই দেশসুদ্ধ
আমজনতার বড়াই।’
ডাংগুলি বা গুলি-ডান্ডা আজকাল আর খুব একটা দেখা যায় না। কিন্তু এটা আসলে ক্রিকেটের ঠাকুরদা বললে ভুল হবে না। অঞ্চলভেদে নাম ভিন্ন— বরিশালে ডাংবাড়ি, রংপুরে ভ্যাটাডান্ডি, ঢাকায় ফুত্তিবাড়ি, চব্বিশ পরগনায় ডাংগুটি— কিন্তু, খেলার নিয়ম মোটামুটি ভাবে একইরকম। একটা পটলাকৃতি কাঠের গুলির এক প্রান্তে দেড়-হাতি কাঠের ডান্ডা দিয়ে আঘাত করলেই সেটা যেই শূন্যে লাফিয়ে উঠবে, ঠিক সেই সময়ে সেটাকে ওই ডান্ডা মেরেই দূরে পাঠাতে হবে। যে-প্রান্তে দাঁড়িয়ে আঘাত করা হয়, সেখানে মাটিতে থাকে একটি ছোট গর্ত, যাকে বলা হয় ‘ফুলবাড়ি’ বা ‘পিল’— কেউ-কেউ উইকেটও বলে। পিল থেকে যত দূরে যাবে গুলি, তত বেশি পয়েন্ট। উড়ন্ত গুলি প্রতিপক্ষের হাতে জমা পড়লেই ক্যাচ এবং ড্যাংম্যান আউট। ডাংগুলির কাছাকাছি আরেকটি খেলা ‘চেঙ্গি ডান্ডি’— যা ঈদের নামাজের পরে খেলা হত গ্রামবাংলায়।
অলিতে-গলিতে ডাংগুলির সঙ্গে-সঙ্গেই এসে পড়ে ‘গুলি’ খেলার স্মৃতি। বাংলার বাইরে ‘কাঞ্ছা’ বা ‘মার্বেল’। রং-বেরং মার্বেল ডানহাতের মধ্যমার টিপে ঘায়েল করে, জিতে নিতে হত প্রতিপক্ষের গুলি। গুলিবাজদের মধ্যে যাদের টিপ ভাল হত তাদের একটা আলাদা ‘রেলা’ ছিল। বিজিতের গুলি পকেট বন্দি হয়ে চলে যেত বিজয়ীর কাছে।

মাটিতে ছক কেটে ‘বাঘবন্দি’ খেলা খুব জনপ্রিয়। দাবার মতো এটাও এক ধরনের আক্রমণ ও আত্মরক্ষার খেলা; তবে বত্রিশ ঘুঁটি নয়, কুড়ি ঘুঁটির। দুই যুযুধান পক্ষ কোনও সৈন্যবাহিনী নয়— বাঘ আর ঘুঁটি। এক প্রতিদ্বন্দ্বী বাঘের চাল দেয়, অপরজন ঘুঁটির। ঘুঁটির চালে বাঘ মরে না, তার আক্রমণের হাত থেকে আত্মরক্ষা করা যায়। দাবার মতো কিস্তিমাতের চাল দিতে-দিতে বাঘের চলন এক সময়ে বন্ধ হয়, অর্থাৎ সে বন্দি হয়; অন্যথায় বাঘ যদি সব ঘুঁটি খেয়ে নিতে পারে, তবে বাঘের জয়। শহরের ফুটপাতে ছক কেটে বাঘবন্দি খেলার রেওয়াজ ছিল এক সময়ে। মোবাইলের যুগে সে এখন নিজেই বন্দি। খুঁজলে হয়তো একখানা আস্ত অ্যাপসও পাওয়া যাবে সে-খেলার।
নীরোগ স্বাস্থের অধিকারী হওয়ার তাগিদে শারীরিক সঞ্চালন এবং অভ্যাস যে অবশ্য প্রয়োজন তা সভ্যতার আদিযুগে নিশ্চয় বুঝতে পেরেছিল অরণ্যচারী মানুষেরা। অবিশ্যি তার জন্য তাদের শারীরিক কসরত আলাদা করে খুব একটা করতে হয়নি, ব্যবহারিক জীবন যাপনের দায়ে, দায়গ্রস্ত হয়ে তা পরিণত হয়েছিল অভ্যাসে।
গ্রাম্য জীবনের দীর্ঘ অবকাশ যাপনের ক্ষেত্রে কিছু ঘরোয়া খেলা ছিল, যার মধ্যে কুমির-ডাঙা, চোর-পুলিশ, লুকোচুরি, রুমালচোর, কানামাছি, পিট্টু, এক্কাদোক্কা, এলাডিং-বেলাডিং, উপেন্টি বায়স্কোপ ছিল বহুল প্রচারিত। টেলিভিশনের পর্দা জুড়ে সাংসারিক কূটকচালি ভরা সিরিয়ালের মা-মাসি-দিদি-বউ-বউদিদের দৌরাত্ম্য তখনও শুরু হয়নি, ছেলেপুলেদের অবকাশের সময়টুকু নিংড়ে নিত এইসব লৌকিক খেলা। বারো ঘর এক উঠোন জুড়ে হারজিতের কলতান। যেটা লক্ষণীয়, বেশ কিছু খেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ছড়া ও গান। এক্কাদোক্কা, এলাডিং-বেলাডিং, উপেন্টি বায়স্কোপ— এই তিনটি খেলার ছড়া কালের সীমানা পেরিয়ে, কবেই হয়ে গেছে আইকনিক।
নদী-খাল-বিল-দিঘি-হাওরের দেশ— বাংলায় এক সময়ে যাতায়াতের অন্যতম প্রধান মাধ্যম ছিল নৌকা। নৌকার জনপ্রিয়তা থেকে নৌকাবাইচ জনপ্রিয় হয়েছে। লোকসংস্কৃতির পরতে-পরতে মিশে আছে মাঝি-মাল্লাদের গান— কখনও মন-উদাস-করা ভাটিয়ালি, কখনও-বা নৌকাবাইচের সারিগান।
‘বাইচ’ শব্দটি এসেছে ফারসি ‘বাজি’ থেকে যার অর্থ খেলা। আষাঢ়-শ্রাবণে বর্ষার জলে টইটম্বুর হয়ে যায় নদী-বিল। উৎসবে পার্বণে মানুষ জড়ো হয় নদীর দু’পারে। কাঁসর, শিঙে, ঢোল বাজিয়ে বা উলুধ্বনি দিয়ে তারা মাতিয়ে তোলে পরিবেশ। চল্লিশ থেকে ষাট হাত লম্বা নৌকাবাইচের নৌকা ‘সনগা নাও’গুলো সাজে কাগজ, কাপড় আর ফুলের মালায়; তারপর কুড়িটা বৈঠার টানে নদীর জল উত্তাল হয়, ‘হেইও-হেইও, মারো টান হেইও— চলে, চলে, চলে নাও, হেইও-হেইও হেইও— বদর-বদর রবে চল হেইও-হেইও, হো হো দেখ দেহি কেডা যায় আগে, বদর-বদর রবে ধইরা ফেল তারে— হেইও-হেইও, মারো টান হেইও’— রব ওঠে শ্রমধ্বনির— মিলিত কণ্ঠে, একতানে। যে-দল হেরে যায়, তার উদ্দেশ্যে বিজয়ী দল আওয়াজ তোলে, আজকালকার দিনে যাকে ‘প্যাঁক’ দেওয়া বলে! ‘ইঁন্দুর পর্যাছে ফাটকে, তোরা বিলাই ডাক দে’। শহুরে মানুষের গুটিকয়েক রোয়িং ক্লাব ঘিরে এখনও বেঁচে আছে, বাঙালির নৌকাবাইচের স্মৃতি। নোয়াখালি, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, চাঁদপুর বা এদিকে সুন্দরবন— এ-সব অঞ্চলের লোকজন লঞ্চ-স্টিমারের করিৎকর্মা সারেং। বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কের জেরে গড়ে উঠেছে, অসংখ্য ‘পোত’ বা বন্দর। এইসব বিবিধ প্রভাবের কারণে বাংলার লৌকিক ক্রীড়ার তালিকায় নৌকাবাইচের স্থান উপরে।


নৌকা চালনার পাশে-পাশে বাঙালি সাঁতার কেটেছে বহু যুগ ধরে। প্রাচীন চিত্র, সাহিত্য, পোড়া মাটির ফলক বহন করে তার সাক্ষ্য। আত্মরক্ষার হাতিয়ার হিসেবে স্থলপথের সঙ্গে জলপথ ব্যবহারের রীতি বহু প্রাচীন— আরকিমিডিসের প্লবতা বা নিউটন সাহেবের গতিসূত্র সমূহের তোয়াক্কা না করে স্রেফ নিজের দেহের স্বাভাবিক সহজাত প্রবৃত্তির বলে সাঁতার শিখেছে মানুষ। ক্রমশ তা হয়ে গেছে এক ধরনের অনৈচ্ছিক চলন বা ক্রিয়া (involuntary movement)। অবগাহন এবং গমনের সমান্তরালে শারীরিক ব্যায়াম এবং প্রতিযোগিতার অঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে সাঁতার। এক সময়ে নদীপারে অবস্থিত গ্রাম-জনপদে বসত নদী পারাপার বা দূরপাল্লা সাঁতার প্রতিযোগিতা। ভেঙে পড়ত গ্রামের মানুষ— কেউ প্রতিযোগী, কেউ-বা দর্শক। রবীন্দ্রনাথ-সহ বহু মনীষীই শুনিয়েছেন, তাঁদের সাঁতারের অভিজ্ঞতা। গল্পের পাতায় উঠে এসেছে ‘কোনি’ তার ক্ষিদ্দার হাত ধরে।
রামায়ণ-মহাভারতের কালে, ঘটনাক্রমের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে মল্লযুদ্ধ। পরিস্থিতির চাপে সম্মুখ সমরে, ভীম-জরাসন্ধ, রাবণ-বালি, শ্রীকৃষ্ণ-জাম্বুবান, অর্জুন-কর্ণ— এরকম অনেক রথী-মহারথীরাই মল্লযুদ্ধকে বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু, একান্ত দৈহিক শক্তিনির্ভর কুস্তি বা মল্লক্রীড়া পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীতেই প্রবেশ করেছে, বাঙালির ক্রীড়াঙ্গনে সে-প্রমাণ ইতিহাস দেয়; প্রধানত, জমিদারদের লেঠেল বাহিনীর দেশীয় সামন্ত-সেনাদের মধ্যে চল ছিল কুস্তি, লাঠিখেলা ইত্যাদির। পরবর্তীতে সাধারণের কাছে কুস্তি সমাদর পায়। কুস্তির আখড়ায়-আখড়ায় ঢাক, লেট, কুল্লা, টিব্বি, ট্যাং— এরকম সব প্যাঁচের অভ্যাস চলতে থাকে নিয়মিত। ঠাকুরবাড়িতে এক কানা পালোয়ানের কাছে কুস্তির পাঠ নেওয়ার কথা লিখে গেছেন খোদ রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’-র পাতায়। গোবর গোহর মতো কুস্তিগীর পেয়েছে বাংলা। নরেন্দ্রনাথ দত্তও ছিলেন কুস্তিতে পারদর্শী।

কিন্তু ক্রমশ শহুরে জীবন মজেছে জিম, ওয়ার্ক আউট ক্লাবের আধুনিকতায়। আট/নয়ের দশকেও, কলকাতা-সহ সারা বাংলায় শরীরচর্চা বা ব্যায়ামের যে -পরিবেশ ছিল, তার মধ্যে কোথাও ছিল এক দেশজ রূপের স্পর্শ। উত্তর, মধ্য এবং মফস্সল শহরে হাতে গোনা কিছু আখড়া বা ক্লাবের ব্যায়ামাগারে এখনও যে উদ্যমী কিছু মানুষ মজে থাকে শরীর গঠনের বাসনায় তারা হয়তো আজ আসলে স্লিম-ট্রিম জিমের সঙ্গে এক অসম মল্লযুদ্ধই করে চলেছে। ‘ডন-বৈঠক, মুগুর ভাজা, ডাম্বেল-বারবেলের দিন গিয়াছে’, লিখেছেন স্বপ্নময় চক্রবর্তী তাঁর ‘খুচরো কথা’-র পাতায়।
ইনডোর গেমসের ক্ষেত্রেও পুরনো বহু খেলা হারিয়ে গেছে। যেমন ব্যাগাটেলি, মনোপলি, চাইনিজ চেকার, লুডো (যার একটি বিশাল ডিজিটাল পুনরুজ্জীবন হয়েছে আজকাল) বা আমাদের প্রিয় সেই বুক ক্রিকেট। তবে, এসব কিছু ছাপিয়ে ছিল— ক্যারাম বোর্ড ঘিরে এক আসক্তিপূর্ণ বিনোদন। ক্লাবঘরের এক পাশে সিলিং থেকে ঝোলানো হলদে আলোর নীচে তার মায়াময় উপস্থিতি, সে এখনও বেঁচেবর্তে আছে পাড়ায়-পাড়ায়।


কালযাপনের কলে দেশীয় খেলা ক্রমশ হারিয়ে যেতে বসেছে; তাদের নিজস্ব নিয়ম, ব্যাকরণ, মন্ত্রসমেত। খেলা এবং কাজের ধর্ম আসলে পরস্পরবিরোধী। উভয়ের সঙ্গেই যদিও কিছু শারীরিক এবং মানসিক কার্যকলাপ জড়িত— প্রকৃতিগত ভাবে যদিও তারা ভিন্ন। কাজের ক্ষেত্রে আমাদের মেনে নিতে হয়, নিয়মের অধীনতা— পক্ষান্তরে, খেলার হাত ধরে ওড়ে ব্যক্তিগত স্বাধীন ইচ্ছার কেতন। বয়স বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে, জীবন ও জীবিকাকেন্দ্রিক কর্মব্যস্ততার কারণে, অবকাশ আরও বেশি মূল্যবান হয়ে ওঠে আমাদের কাছে। খেলার আনন্দ হারিয়ে যেতে বসে। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই আমাদের একবার চোখ পড়ে খোলা জানালার বাইরে। উপায় আর উপশম খুঁজি মানসিক স্বস্তির সবুজ প্রান্তরের প্রান্তে। গাছের মগডালে লটকে থাকা লাল ঘুড়িটা আবার উড়তে চায় নীল আকাশে। ভেতরের শিশুটা হাত-পা ছুড়তে থাকে। মনে পড়ে, সেই পুরনো গুরুবচন— ‘all work and no play makes Jack a dull boy, all play and no work makes Jack a mere toy!’
তথ্যঋণ: ‘বাঙালির খেলাধুলা’, শঙ্কর সেনগুপ্ত
‘সেইসব খেলাগুলো’, স্বপ্নময় চক্রবর্তী