দুর্গাপুজো আসলে নবরাত্রি, তাই নিরামিষ! কালীপুজো তো দীপাবলিও, অতএব আমিষ নৈব নৈব চ! ছটপুজোয় কেন খোলা মাছ-মাংসের দোকান, ঝাঁপ ফেলো, চিচিং বনধ! এমন নানাবিধ ফতোয়া এখন আমরা অহোরাত্র দেখছি। অতএব, দেবদেবীর পুজো-অর্চনায় আমরা কী খাব, তার রূপরেখা একভাবে নির্ধারিত হয়ে চলেছে। কিন্তু দেবদেবীরা কী খান? তাঁদের কোন ভোগ অর্পণ করা হয় শাস্ত্রমতে? দেবতারা কি শাকাহারী? তাঁদের ভোজন কি সাত্ত্বিক, না তামসিক? সেসব বিষয়ে আমরা যে বেশ খানিকটা অন্ধকারে, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে পারে সোমব্রত সরকারের ‘ভোগের রান্না: ভারতীয় অধ্যাত্মবাদ ও খাদ্য সংস্কৃতি’ শীর্ষক বইটি। দেশজুড়ে উৎসবের মরশুম এখনও চলছে। এইসময়ে এই বইটি আরও খানিকটা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে তো বটেই।
বইটির প্রচ্ছদে (শিল্পী: সেঁজুতি বন্দ্যোপাধ্যায়) ভারতের একটি মানচিত্রর মধ্যে একটি ভোগের হাঁড়ি দৃশ্যমান। অর্থাৎ, ভারতজুড়ে ভোগের একটি স্বতন্ত্র মানচিত্র খুঁজে বের করার একটা প্রয়াস এই বইয়ের মধ্যে রয়েছে, তার আভাস প্রচ্ছদপট থেকেই স্পষ্ট। সূচি-তে কয়েকটি ভাগ রয়েছে, ফলমিষ্টির ভোগ, ভোগরাগ, লোকদেবতার ভোগ, কুটোভোগ, সেবাভোগ ও রান্নাবান্না। প্রতিটি বিভাগই নানাবিধ বিস্ময়ে ভরা। ‘ফলমিষ্টির ভোগ’-এর প্রথম অধ্যায়, ‘মিষ্টিভোগের কড়চা’ থেকে যেমন জানা যাচ্ছে, গুড় আগে ছিল ‘দলো চিনি’, বৌদ্ধ সন্ন্যাসী মারফত তা পৌঁছয় চিনে। চিনের সম্রাট তাই জং আখ চাষ করে নিয়ে এলেন ধবধবে সাদা চিনি। যা হোক, এই আখের গুড়ের মিষ্টি দেওয়া হত দেবতার ভোগে। দুধ ঘন করে ক্ষীর বানিয়ে তাতে চিনি দিয়ে সেই ভোগ তৈরি হত। ব্রাহ্মণ ঠাকুররা খেজুর বা তালগুড়ের মিষ্টি দিতে চাইতেন না ঠাকুরের ভোগে। আবার কোনও অধ্যায়ে লেখক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছেন নবদ্বীপের সোনার গৌরাঙ্গ বাড়ির ভোগের কথা। দোলের পর নিমাইচাঁদ গোস্বামী প্রভুর বাড়িতে ভোগ খেতে গিয়ে তাঁর শতাব্দীপেরনো বয়সি, অথচ, কর্মক্ষম, মায়ের হাতে তৈরি দশরকমের মিষ্টান্ন খাওয়ার গল্প করতে করতে, নিমাইচাঁদ গোস্বামীর কথাসূত্রেই লেখক ছুঁয়ে দেন, কীভাবে দোকানে দোকানে ‘সস্তার জনপ্রিয় ভোগের নৈবেদ্য’ তৈরি হচ্ছে ক্ষীরের বদলে ময়দার পুর দিয়ে। সেই প্রসঙ্গেই উঠে আসে বৃন্দাবনের ভোগ রান্নার ইতিহাস। বাংলার খাজা থেকে অমৃতিভোগের উৎস কি ‘চৈতন্যচরিতামৃত’-তে মিলবে? আভাস মেলে তারও। কোথাও আবার জানা যাচ্ছে বড়লাট ন্যাথানিয়েল কার্জন বর্ধমানে যখন এসেছিলেন রাজা বিজয়চাঁদ মহতাবকে ‘মহারাজা’ উপাধি দিতে, তখন বড়লাটের রসনা মেটাতে স্থানীয় কারিগর ভৈরবচন্দ্র নাগ তৈরি করলেন ‘সীতাভোগ’ ও ‘মিহিদানা’। কিন্তু ‘ম্লেচ্ছ আপ্যায়ন’-এর জন্য যে মিষ্টি তৈরি, তা কি দেবতার ভোগে যেতে পারে? বেঁকে বসলেন স্থানীয় বৈষ্ণবরা। বাঙালির চিরন্তন মিষ্টান্ন বাতিল হয়ে গেল দেবভোজ্য থেকে।

আরও পড়ুন : দুর্গাপুজোর সঙ্গে কীভাবে জড়িয়ে নেতাজির অন্তর্ধান? হদিশ মিলবে এই বইয়ে!
লিখছেন পারঙ্গমা সেন সাহা…
এসব তো গেল বাংলার কথা। ‘ভোগরাগ’ বিভাগের ‘বাট্টি চুরমা’ অধ্যায়ের শুরুতেই আরও একটি সূত্র আছে, যার সূত্র বাংলা সাহিত্যের অনুরাগী পাঠকদের কাছে অজানা নয় মোটেই। কারণ এই অধ্যায় রাজরাপ্পার ছিন্নমস্তা মন্দিরের ভোগের গল্প। ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’-এর সূত্রে রাজরাপ্পার কথা যাঁরা জানেন, এই অধ্যায়ে তাঁরা স্পষ্ট ধারণা পাবেন এই একটি এলাকা ও ওই বিশেষ মন্দিরটির উৎপত্তির ইতিহাস বিষয়ে। আবার গুজরাতের বহুচরা দেবীর অবস্থান ময়ূর আর কুক্কুট অথবা মোরগের মাঝে। বহুচরার বাহন মোরগ, ভোগে থাকে আটার পুরি ও গাওয়া ঘিয়ে ভাজা হালুয়া। দক্ষিণ ভারতে আবার প্রসিদ্ধ তুলো বড়ার ভোগ।
কিন্তু সত্যি সত্যি রোমহর্ষক ‘দুর্গা পুজোর ভোগ’ বা ‘আগমেশ্বরীর ভোগ’ শীর্ষক অধ্যায়গুলি। দুর্গাপুজোর ভোগে পাঁঠার মাংস, ইলিশ-রুইয়ের সহাবস্থান যেমন আছে, তেমনই আছে নরবলির ছমছমে ইতিহাসের আভাস। এখন নরবলির জায়গায় হুগলির জিরাটের মঠবাড়িতে চালের গুঁড়ো দিয়ে নরমূর্তি তৈরি করে তার বলি দেওয়া হয়, সঙ্গে প্রেতাত্মাকে আহ্বান জানানো হয় দুর্বাঘাস দিয়ে। আবার আগমেশ্বরীর ভোগের গল্প হাড়হিম করে দেওয়া,
“ঘোর কৃষ্ণবর্ণ কালী। শিব লম্বভাবে শুয়ে রয়েছেন। পতির বুকের ওপর ডান পা বাড়িয়ে আগমেশ্বরী মা দাঁড়িয়ে আছেন। চতুর্ভুজা মা। এক হাতে খড়্গ, এক হাতে নরমুণ্ড আর দুই হাতে পুষ্প ও বরাভয়। শান্তিপুরের আগমেশ্বরী কালী মূর্তিতে মায়ের কানের দুল হিসেবে দুটো বালককে ঝোলানো থাকে।
কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের নাতি রত্নগর্ভ মশাই পুজো করতে বসলেন সে বচ্ছর শান্তিপুরে পঞ্চমুণ্ডির আসনবেদিতে। সহায়ককারী শিষ্যের দুটি বছর ছয়েকের ছেলে। রত্নগর্ভ সার্বভৌম ছেলে দুটিকে নৈবেদ্য সাজানোর ভার দিয়ে অন্য কাজে চলে গেলেন। ফিরে এসে ছেলে দুটিকে দেখতে পেলেন না। নিজে পুজোয় বসলেন। পুজো শেষের পরও ছেলে দুটি ফিরছে না দেখে রত্নগর্ভ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। শিষ্যের ছেলে— গুরুদেবের পুজোর কাজ করবে বলে ছেলেদের এখানে রেখে যাওয়া— ফিরে যদি না পায় গুরু কী জবাব দেবেন! চিন্তার ভেতর আগমেশ্বরী মা প্রকট হলেন।
বললেন, ‘আমাকে নৈবেদ্য নিবেদন করা হয়নি। খাওয়া হয়নি আমার। ছেলেদের আমি গিলে নিয়েছি।’”
আবার বৌদ্ধ তান্ত্রিক দেবী বিমলাকে মার্কণ্ড মন্দিরের পুকুর থেকে মাছ ধরে এনে রান্না করে নিবেদন করা হয়।
এমন নানা জানা-অজানা ভোগবিবরণী নিয়ে ‘মান্দাস’ প্রকাশিত এই বইটি জ্ঞানের রসনা মিটিয়েছে অনেকটাই।




