মরণোত্তর বিনয়

নির্বাচন কমিশন বলেছে, চূড়ান্ত ভোটারতালিকা ছাপার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত নবতিপর ভোটারদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে তারা রাখবে। বলা তো যায় না, এর মধ্যে যদি কেউ মারা যায়! বিনয় মজুমদার বেঁচে থাকলে বয়স হত একানব্বই। এবং কমিশন তাঁকে নজরে-নজরে রাখত। সে-সুযোগ বিনয় কমিশনকে দেননি। এমনকী, জীবৎকালে, সুস্থ চিত্তে, কারও কাছে অনুকম্পিত হয়ে থাকতেও তিনি পছন্দ করেননি।


একবার, ২০০৫ সালে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁর শরীর নিয়ে উদ্‌বেগ প্রকাশ করে। সেই উদ্‌বেগের উত্তরে নিজেকে ‘চণ্ডাল’-ঘোষণা-করা কবি তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীকে এক চিঠিতে জানিয়েছিলেন:

১। আমার বাঁ কান কালা গত ৩৫ বছর যাবৎ
২। আমার বাঁ চোখ কানা গত ৩৫ বছর যাবৎ
৩। অধিকাংশ দাঁত ভাঙা সেও বছর ১৫ যাবৎ
৪। আমার কোমরে বাত হয়েছে সেও বেশ কয়েক বছর যাবৎ
৫। আমি শুধু ডান চোখ দিয়ে দেখি।

এটুকু জানিয়ে শেষে লিখেছিলেন, ‘আপনি আমার জন্য উদ্‌বিগ্ন হবেন না। আমার বয়স এখন ৭১ বছর। বয়স অনুসারে আমি সুস্থই আছি।’

আরও পড়ুন: শক্তি চট্টোপাধ্যায় বিশ্বাস করতেন,অস্থিরতা না থাকলে কবিতা লেখা যায় না! লিখছেন জয়দীপ রাউত…

এই চিঠি লেখার মাত্র এক বছর পর ১১ ডিসেম্বর যিনি মারা যাবেন, যাঁর এত-এত শারীরিক সমস্যা ছিল, কেন তিনি লিখেছিলেন— ‘সুস্থই’ আছেন? তার কারণ, বিনয় ক্ষমতাবানদের চিনতেন। তিনি জানতেন, তাদের ক্ষমতা প্রদর্শনের নানা রূপের একটা— অন্যদের কিছু দিতে পারা। তাঁর একটি এক-পংক্তির কবিতা আছে: ‘আমি দেবতা মানে আমি তোমাকে অমুক জিনিসটি দেব।’ কারও কাছে কোনও কিছুর প্রার্থী যাতে না-হতে হয়, এই ছিল তাঁর একান্ত কামনা। ‘এখন দ্বিতীয় শৈশবে’, যে-বইটি কবির মৃত্যুর সাত বছর আগে ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত, সেই বইয়ের একটি কবিতায় বিনয় লিখেছেন— ‘এই চেনা/বিশ্বে আমি প্রাণহীন হয়ে যেতে চাই।/তবে আর ক্ষুধার বালাই/থাকবে না…।’ এটুকু লিখেছি, বাড়িতে সহসা এক পুরনো বন্ধুর আগমন। জানতে চাইল, কী লিখছি। লিখিত অংশটি আড়চোখে পড়ে তার স্বগতোক্তি: ‘সর্পিণী, বোঝোনি তুমি, দেহ কিনা, কার দেহ, প্রাণ।’

অঙ্কে আমার খুব ভয়। তার কারণ, সংখ্যাকে আমি ভয় পাই। ভয় পাই চিহ্নকেও। এরা সব পৃথক ভাষা। ভাত আমি বুঝি। অন্য শব্দের মতো ভাত শব্দটি বিমূর্ত হলেও ধোঁয়া-ওঠা ভাতের গন্ধ, স্বাদ, উপকারিতা, অভাব, প্রকারভেদ আমি জানি। কিন্তু ভাতকে X ধরে আমি এগোতে পারি না। প্রথম যৌবনে এরকম প্রবল অঙ্কভীতি নিয়েই বিনয় মজুমদারের কবিতায় প্রবেশের চেষ্টা আমি করেছিলাম। সে ছিল এক আশ্চর্য যাত্রা! আজও মনে পড়ে ‘অঘ্রানের অনুভূতিমালা’র ৪-সংখ্যক কবিতাটি:

এবং যে-কোনো শব্দ, ‘রমণী’ শব্দটি ধরো, নানা দেশে বিভিন্ন ভাষায়
আলাদা-আলাদা সব শব্দ দিয়ে ধ্বনি দিয়ে মুখ দিয়ে ব্যক্ত হয়ে থাকে,
তা-হলেও সে-সবের— সকল ধ্বনিরই কিন্তু একটিই অবয়ব মোটে…
কারণ যে-কোনো শব্দ— নিশা, বিভাবরী, রাত্রি, যামিনী, নিশীথ, শর্বরীর
ধ্বনি এত হলেও তা বিশ্বে মোটে একটিই আছে কোনো নেপথ্যজগতে।

যে-কেউ শিউরে উঠব সেই অবিনাশী নেপথ্যজগতের ইঙ্গিত পেয়ে, যে-জগতে হাজার-লক্ষ প্রতিশব্দের আদি মাতাগণ ভিন্ন-ভিন্ন কুলুঙ্গিতে অন্তরালবর্তিনী হয়ে আছেন। এই জগতের আবিষ্কারক কবি বিনয় মজুমদার।

বিনয় গণিত নিয়ে অনেক বছর চিন্তা করেছেন। বাঙালি পাঠক আমরা সেসব চিন্তাকে তাঁর পাগলামো বলেই জেনেছিলাম। অথচ সেসব ভাবনা তিনি নথিবদ্ধ করে ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে পাঠিয়েছেন সংরক্ষণের জন্য। ভেবেছেন ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে পাঠানোর কথাও। আমরা যেমন জানি— ওমর খৈয়াম একজন জগদ্বিখ্যাত কবি, তাঁর বিজ্ঞান-সাধনার বিরাট পর্বটি উহ্যই রেখে দিই; তেমনই বিনয় মজুমদারের গণিত আমাদের কাছে ছিল পাগলামোরই বহিঃপ্রকাশমাত্র। কেউ-কেউ বিনয়ের গণিত-প্রতিভা নিয়ে চর্চা করতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বিনয়ের গণিত-চিন্তার পাণ্ডুলিপি আর এদেশে নেই, যেগুলো নিয়ে এখানকার কোনো গণিতবিদ গবেষণা করতে পারবেন। ফলে এ-বিষয়টি অমীমাংসিতই থেকে গেল আপাতত। অথচ গণিত এবং কবিতা উভয়েরই সৌন্দর্য প্রকাশ পায় ছন্দ, যুক্তি এবং বিমূর্ততার মাধ্যমে। গণিতকে প্রায়শই ‘লজিকাল আইডিয়ার কবিতা’ বলা হয়ে থাকে, যেখানে গণিতের মতো সুনির্দিষ্ট রূপক এবং ছন্দের সঙ্গে খেলা করে কবিতা। উভয়ই বিমূর্ত ধারণা নিয়ে কাজ করে— গণিত সংখ্যা এবং সমীকরণের মাধ্যমে, কবিতা শব্দ এবং ছন্দের মাধ্যমে।

বিনয়ের কবিতায় গণিতের উল্লেখ প্রথম ‘অশ্বিনীতারা’ থেকে শুরু; যেখানে শূন্য, সমীকরণ এবং জ্যামিতিক রূপায়ণের মতো ধারণা জীবনের দার্শনিকতার সঙ্গে মিশে যেতে চেয়েছে। সাতের দশকে লেখা কবিতাগুলোতে গণিতকে ‘সাহিত্যের গতি’ হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলা সাহিত্যে বিনয় মজুমদারের কবিতায় ক্যালকুলাস, ভ্যারিয়েবল এবং জ্যামিতি সরাসরি ব্যবহৃত হয়েছে। তাঁর গণিত-প্রভাবিত কাব্যচিন্তা জীবনভর ধারাবাহিক ছিল, বিশেষ করে আটের দশক থেকে তাঁর গণিত আবিষ্কার এবং কবিতায় সেগুলোর প্রয়োগ আরও সুস্পষ্ট হয়। পরবর্তীকালে তাঁর গণিত উদ্ভাবন, যেমন ঘনমূল নির্ণয়ের পদ্ধতি, কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে। এক সাক্ষাৎকারে বিনয় জানিয়েছেন, ‘আমি লিখি, কারণ আমি বোঝাতে চাই যে তুমি আমার কাছে একটি সূত্র। তুমি A হলে, আমি B। আমার কবিতা আসলে এক ধরণের সায়েন্স রাইটিং।’

বিনয় মজুমদারের গ্রন্থসংখ্যা কত? উনতিরিশ? না কি তিরিশ? না কি আরও বেশি? তাঁর মৃত্যুর উনিশ বছর পরও স্পষ্ট করে বলা মুশকিল। অবশ্য তাতে কিছু যায়-আসে না। ‘ফিরে এসো, চাকা’ থেকে ‘অঘ্রানের অনুভূতিমালা’ হয়ে বহু-বহু কাব্যগ্রন্থ, বঞ্চনা পেরিয়ে এসেছেন তিনি। ‘এখন দ্বিতীয় শৈশবে’ বইয়ে তিনি লিখেছেন—

এই বৃদ্ধ বয়সে আমি
যতো যন্ত্রণাদায়ক অবস্থাতে
পড়ি, তাতে চোখে কিন্তু
জল আসে না। কোনো
কারণেই চোখে আমার
আর জল আসে না।

আর একটি ছোট্ট, নিঃশব্দ কবিতা এখানে দিই ‘একা একা কথা বলি’ কবিতাগ্রন্থ থেকে:

অগ্নিদেব একবার আমাকে বলেছিলেন
‘বিনয়, যদি কেউ বলে যে সে
আগুন জ্বালাতে পারে তবে আমি
সতর্ক হই। আমি আগুন, যে আমাকে
জ্বালাতে পারে, তবে সে আমার চাইতে
বেশি ক্ষমতাবান। সুতরাং সে আমাকে
জ্বালালেই আমি তাকে পুড়িয়ে মারি’।
’  

এতটা লিখলাম বটে, তবে বিনয় মজুমদার পড়া আমি ছেড়ে দিয়েছি। যাঁরা অমর, তাঁদের রচনাকর্ম আর পড়তে নেই! আকাশে, বাতাসে, গাছের পাতায়, নদীর স্রোতে, নিউরোনগুচ্ছে, অতিকায় ইঞ্জিনের ঘূর্ণনে ধ্বনিত হয় তাঁদের রচনাপত্র। মনোমণ্ডলের অ-ফাঁকা কোনও স্থানে জন্ম এই অমরতার, যেখানে গ্রহ-নক্ষত্র-ছায়াপথ এবং অন্যান্য খগোলীয় বস্তু অবস্থিত এবং চলাচল করে। বিনয় মজুমদার সেই স্থানেরই অমরতাপ্রাপ্ত এক কবি।