দ্রোহের নিশান মহাশ্বেতা

Article on Mahasweta Devi on her birth centenary

গত শতকের সত্তরের দশকে বাংলা সাহিত্যে ফের বাঁকচিহ্নের আবির্ভাব ঘটেছিল। এর অগ্রদূত হিসেবে যে-দুজন কুশীলব চিহ্নিত— তাঁরা গদ্যে মহাশ্বেতা দেবী এবং কাব্যে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। প্রথম বাক্যে ‘ফের’ শব্দটি প্রয়োগের কারণ, বাংলা কথাসাহিত্যে বঙ্কিম-রবীন্দ্র-শরৎচন্দ্রের প্রবল স্রোতের বিরুদ্ধে ‘কল্লোল’ পত্রিকাকে ঘিরে তৎকালের একদল তরুণ সাহিত্যিক দ্রোহের পতাকা তুলেছিলেন। প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্য সেনগুপ্ত, বুদ্ধদেব বসু বা মণীশ ঘটকরা ছিলেন অগ্রভাগে। তাঁদের পূর্বসূরিদের সাহিত্যে সাজানো-গোছানো মধ্যবিত্তের ভিড়, শ্রমিক-কৃষক-পথের ধুলোমাখা সাধারণ বা প্রান্তীয় নর-নারীরা অনুপস্থিত। তাই আকরণগত ভাবে এই বাংলা গল্প-উপন্যাসে ঘটনা ও চরিত্রে এসেছিল পরিবর্তন। শুধু কল্লোল-গোষ্ঠীভুক্ত লেখকদের কলমেই নয়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, জগদীশ গুপ্ত বা তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়দের কথাসাহিত্যেও এই পরিবর্তনের স্বাক্ষর দেখা যায়। হয়তো, তিরিশ-চল্লিশের দশকে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার ধারা, হিটলারের উত্থান, যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, গণনাট্য সংঘ ও প্রগতি লেখকসংঘের তীব্র গতিধারায় বাংলা সাহিত্যে এসেছিল নতুন স্রোত।

স্বাধীনতা ও দেশভাগের পর, ষাটের দশকের শুরুতেই দেখা দিয়েছিল দ্বিতীয় বদলবাঁকের প্রেরণা। তা ছিল মূলত প্রকরণগত দ্রোহ, বা ফর্ম-সর্বস্বতা। মার্কিন কবি অ্যালেন গিনসবার্গের প্রত্যক্ষ মদতে, এ-বাঁকসৃষ্টি মূলত কাব্যকে ঘিরে ঘুরপাক খেলেও, গদ্যে এসেছিল নতুন রীতির চমক। অর্থাৎ, গল্প-উপন্যাসে ‘কী বলব’ শুধু নয়, জোর দিতে হবে— ‘কীভাবে বলব’, তার উপরেও। ষাটের দশকের গোড়ায় গদ্যে বাঁকবদলের ডাক দিয়েছিলেন বিমল কর। দশকের মাঝামাঝি সমরেশ বসু ‘বিবর’, ‘প্রজাপতি’ লেখেন। বুদ্ধদেব বসু ‘রাত ভ’রে বৃষ্টি’ লিখে শ্লীল-অশ্লীল দ্বন্দ্বের ঝড় তুলে দেন। বিভিন্ন গল্পে বিষয়হীনতা এসে টুকরো-টুকরো দ্রোহের পতাকা সৃষ্টি করে। তবে ষাটের দশকে আন্দোলনগুলো যতই প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা প্রচার করুক, ঘুরিয়ে প্রতিষ্ঠানের প্রচার জুটেছিল অনেক বেশি। তা সত্ত্বেও, আন্দোলনগুলি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।

১৯৬৭ সালে নির্বাচনে টলোমলো যুক্তফ্রন্টের ক্ষমতায় বসা, উত্তরবাংলার নকশালবাড়িতে জমি আন্দোলন, এবং ১৯৬২ সালে প্রথম কমিউনিস্ট পার্টির ভাঙনের পর, ১৯৬৯ সালে দ্বিতীয় ভাঙনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ‘বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস’ স্লোগানে, বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ হয়েছিল। এই রক্তস্নাত বিপুল ক্ষয়-ক্ষতির মধ্যে দিয়ে, রাজনৈতিক বদল কী কী ঘটেছিল, আজ তা সকলেরই জ্ঞাত। কিন্তু মানুষের চেতনা, দৃষ্টিভঙ্গি ও ভাবজগতে যে প্রবল ট্রমা-র সৃষ্টি হয়েছিল, অস্বীকারের উপায় নেই। সাহিত্যে এই প্রবল আলোড়ন ধরে রাখার কাজ যাঁরা করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে বাংলা গদ্যসাহিত্যের নবকলেবরের কর্ণধার হয়ে উঠেছিলেন মহাশ্বেতা দেবী। এবং তাঁরই উৎসাহ সহযোগিতায়— এক ঝাঁক তরুণ গদ্যকার। যাঁরা আজ প্রবীণ, প্রাপ্তবয়স্ক ও বাংলার কথাসাহিত্যের অগ্রগণ্য লেখক।

মহাশ্বেতা বাংলা গদ্যে বিশেষ একটি ঘরানার সৃষ্টি করেছিলেন। তা কেবল আকরণগত বা নিছক প্রকরণগত নয়। মূলত, রাষ্ট্র ও ব্যক্তি-অধিকারের বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গিজাত। তাঁর লেখায় ছিল রাষ্ট্র সম্পর্কে এক বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি। মার্ক্স State-এর withering away-র কথা বলেছিলেন। গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শনেও রাষ্ট্রের বিপরীতে সমান-জীবনের অধিকারের কথা পাই। আদিবাসী ও প্রান্তীয়বর্গের কথা তারাশঙ্কর, সতীনাথ বা বিভূতিভূষণের সৃ্ষ্টিতেও এসেছে। সত্তরের দশকের নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মহাশ্বেতা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, আদিবাসী জীবনের লড়াকু সত্তাকে গল্প-উপন্যাসের ফোকাসে দাঁড় করালেন। তাই ‘অরণ্যের অধিকার বা ‘হাজার চুরাশির মা’ সময়ের জ্বলন্ত দলিল হয়ে উঠেছিল।

মহাশ্বেতাদির পিতৃকুল ও মাতৃকুল— উভয়ই ছিল বাংলা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ট্র্যাডিশনাল ধারক-বাহক। বাবা কল্লোলের লেখক মণীশ ঘটক, কাকা ঋত্বিক ঘটক, পারিবারিক এক বউদি ছিলেন বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত-শিল্পী গীতা ঘটক। মহাশ্বেতার মামা শঙ্খ চৌধুরী বিশিষ্ট শিল্পী এবং ললিতকলা একাডেমির এককালীন সভাপতি। মহাশ্বেতা বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন বিজন ভট্টাচার্যের সঙ্গে, যিনি গণনাট্য সংঘের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও ‘নবান্ন’ নাটক লেখা ও অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে বাংলা নাটকের পথেরই বদল ঘটিয়েছিলেন।

দ্রোহকালের টালমাটাল পটভূমিকায়, মহাশ্বেতা ভট্টাচার্য উপাধি ছেড়ে হলেন মহাশ্বেতা দেবী। ‘অরণ্যের অধিকার’ ও ‘হাজার চুরাশির মা’ উপন্যাস, ‘দ্রৌপদী’-‘স্তনদায়িনী’ প্রভৃতি ফিকশন লিখে গদ্যসাহিত্যের বাঁক ঘোরালেন এবং নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও সাহসের মন্ত্রে দীক্ষা দিলেন এক ঝাঁক তরুণ গদ্যকারদের— যারা আজ সত্তরের লেখক হিসেবে চিহ্নিত। এবং ‘বর্তিকা’ নামক পত্রিকাটির গুণগত বদল ঘটিয়ে, অনুজ লেখকদের প্রকাশের দরজা খুলে দিলেন।

আমরা লেখালিখির জগতে তাঁকে উল্লেখযোগ্য ভাবে পাই, মহাশ্বেতা ভট্টাচার্য যখন ধারাবাহিক ‘ঝাঁসির রাণী’ লেখেন। ঐতিহাসিক এই উপন্যাস লিখতে প্রবল ঝুঁকি নিতে হয়েছিল, টুকরো-টুকরো তাঁর মুখেই শুনেছি। সংসার ও শিশুপুত্রকে ত্যাগ করে, আর্থিক ঝুঁকি ও নিরাপত্তার ঝুঁকি নিয়ে, মাসের পর মাস তথ্যসংগ্রহে ঝাঁসি, গোয়ালিয়র অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়েছেন। মাত্র ২৬-২৭ বছর বয়স তখন। ‘ঝাঁসির রাণী’ থেকেই বোঝা যায়, তাঁর সাহিত্যগত দৃষ্টিভঙ্গিতে ইতিহাস, তথ্য ও ক্ষেত্র-গবেষণার গুরুত্ব কতখানি। আমরা, যারা সত্তর-আশির দশকে তাঁর সান্নিধ্যে আসি— আমাদের বারবার বলতেন, যে-যেখানে থাকি, সে-অঞ্চলের নানা আর্থ-সামাজিক ও ঐতিহাসিক ঘটনার তথ্য সংগ্রহে ক্ষেত্র-গবেষণায় জোর দিতে। পারিবারিক পত্রিকা ‘বর্তিকা’র সম্পাদনা যখন করতেন, নিয়মিত ক্ষেত্র-গবেষণার রিপোর্ট ছাপা পত্রিকাটিকে বিশেষ চরিত্র দিয়েছিল।

‘ঝাঁসির রাণী’র পর মহাশ্বেতা ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনের নানা সমস্যা-জটিল দিনগুলো পার করেছেন। মহাশ্বেতা ভট্টাচার্য নামে নিয়মিত উপন্যাস-গল্প লিখে গেলেও, পাঠকের আড়ালে পড়ে গেছিলেন। শোনা যায়, তখন প্রতিষ্ঠিত প্রকাশকও জুটত না। ‘ধানের শীষে শিশির’, ‘নটী’, ‘নীলবাক্স’ ইত্যাদি উপন্যাসগুলোর সমাদর বাঙালি পাঠক করেনি। ‘করুণা’ প্রকাশনীর প্রয়াত মালিকের মুখে শুনেছি, তখন মহাশ্বেতাদির প্রকাশক জুটত না; সদ্য-প্রতিষ্ঠিত করুণা প্রকাশনা সংস্থাই মহাশ্বেতাকে আশ্রয় দিয়েছিল। একের পর এক উপন্যাসগুলো করুণা প্রকাশ করেছিল। সেইসব উপন্যাসগুলোর সাহিত্যগত বা ঐতিহাসিক মূল্য আজ কতটুকু— বিচারে আমি অপারগ। তবে ষাটের দশকের মাঝামাঝি প্রকাশিত দুটি উপন্যাস আমার দৃষ্টিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমটি ‘আঁধার মানিক’ এবং দ্বিতীয়টি ‘কবি বন্দ্যঘটী গাঞির জীবন ও মৃত্যু’। সম্ভবত, কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর জীবনালম্বনে ঐতিহাসিক উপন্যাস।

ষাটের দশকের গোড়ায়, মহাশ্বেতা ভট্টাচার্যের বিবাহবিচ্ছেদ, বিজয়গড় কলেজে অধ্যাপনায় যুক্ত হওয়া, দ্বিতীয় বিবাহ, আবার কিছুকালের মধ্যে ভাঙন— এইসব ব্যক্তিগত টালমাটাল অবস্থায় তিনি ‘ভট্টাচার্য’ ছেড়ে ‘দেবী’ হলেন। পশ্চিমবঙ্গের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশও তখন টালমাটাল। ১৯৬২-র চিন-ভারত যুদ্ধ, কমিউনিস্ট পার্টি ভাগ, পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ, খাদ্য আন্দোলন এবং ’৬৭-তে বিশ বছরের টানা কংগ্রেস শাসন হটিয়ে যুক্তফ্রন্ট সরকার এবং নকশালবাড়ি আন্দোলনের সূত্রপাত এবং ভগ্ন কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে দ্বিতীয় ভাঙন, রাষ্ট্রপতি শাসন, ব্যক্তিহত্যা, জেল, রাষ্ট্রীয় হিংসা— লেখিকার জীবনের মতো পশ্চিমবাংলার সামাজিক জীবনে দেখা দিয়েছিল অস্থিরতা। সম্ভবত, এইসব তরঙ্গের আঘাতে আমাদের মধ্যযুগের ঐতিহাসিক সমাজ-জীবন নিয়ে লেখা ‘ক্রুদ্ধ’ পাঠকবৃন্দের তেমন নজরে আসেনি।

এরপর, দ্রোহকালের টালমাটাল পটভূমিকায়, মহাশ্বেতা ভট্টাচার্য উপাধি ছেড়ে হলেন মহাশ্বেতা দেবী। ‘অরণ্যের অধিকার’ ও ‘হাজার চুরাশির মা’ উপন্যাস, ‘দ্রৌপদী’-‘স্তনদায়িনী’ প্রভৃতি ফিকশন লিখে গদ্যসাহিত্যের বাঁক ঘোরালেন এবং নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও সাহসের মন্ত্রে দীক্ষা দিলেন একঝাঁক তরুণ গদ্যকারকে— যাঁরা আজ সত্তরের লেখক হিসেবে চিহ্নিত। এবং ‘বর্তিকা’ নামক পত্রিকাটির গুণগত বদল ঘটিয়ে, অনুজ লেখকদের প্রকাশের দরজা খুলে দিলেন। তারপর, বিহারের নকশাল আন্দোলন, পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় সরকার, জোতদার, ভূমিমালিকদের প্রাইভেট আর্মিদের সঙ্গে রক্তক্ষয়ের রোমাঞ্চকর ঘটনাসকল ক্রমে তাঁর সাহিত্যের বিষয় হয়ে উঠল। ‘চেট্টি মুণ্ডা ও তার তির’, ‘বিছন’, ‘বিশ একুশ’, ‘মাস্টার সাব’, ‘অক্লান্ত কৌরব’ প্রভৃতি ফিকশনগুলো লেখার সঙ্গে-সঙ্গে শবর-খেড়িয়া প্রভৃতি আদিবাসী সমাজের মধ্যেই দুর্বল ও অবহেলিত জনজাতিদের নিয়ে সংগঠন গড়ায় মন দিলেন। অর্থাৎ, সক্রিয় সমাজকর্মী (অ্যাকটিভিস্ট) হিসেবে বড় ভূমিকা গ্রহণ করলেন। তখন তৃতীয় বিশ্বে অ্যাকটিভিস্ট-লেখক হিসেবে লেখক-কবিদের মধ্যে বিশেষ একটি ঝোঁকের শুরু। নকশাল আন্দোলনে নিহত কবি শিল্পীদের স্মরণ করেও, বলা চলে, বাংলায় প্রধান লেখকদের মধ্যে মহাশ্বেতা দেবীই প্রথম সমাজকর্মী-লেখক।

তাঁর প্রায় সব লেখাই অখ্যাত পত্রিকা বা লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত। তিনি বুকে সাহস নিয়ে প্রমাণ করেছেন, প্রখ্যাত হতে গেলে বাণিজ্যিক পত্রিকার সহায়তা অপরিহার্য— এমন কোনও বাঁধাধরা নিয়ম নেই। তাই সত্তরের অধিকাংশ লেখকই লিটল ম্যাগাজিনে ভর করে সৃষ্টির কাজ করে গেছেন। তাঁর গল্প-উপন্যাস ভারতীয় অন্যান্য ভাষা এবং বিদেশি ভাষায় প্রচুর অনূদিত হয়েছে। তিনি জ্ঞানপীঠ-অকাদেমি থেকে ম্যাগসাইসাই পুরস্কারে ভূষিত। তিনিই শেষ বাঙালি লেখক, যাঁর একটি আন্তর্জাতিক ও সর্বভারতীয় পরিচিতি ছিল। আজ, কর্পোরেট-অর্থনীতি ও বিনোদনশিল্পের প্রাবল্যে মহাশ্বেতা দেবী কর্তৃপক্ষের নজরের বাইরে; কিন্তু করুণা-র কাউন্টারে আজও ‘অরণ্যের অধিকার’ বা ‘হাজার চুরাশির মা’-এর চাহিদা একদা জনমোহিনী লেখকদের তুলনায় বেশিই। তা কি দ্রোহ সম্পর্কে কিছু বলে না?