রামধনু, প্রেম, বিদ্রোহ
ইভোনা ইউকার ‘বিউটিফুল ইভিনিং, বিউটিফুল ডে’ ছবিটি নিয়ে আলোচনা করার আগে, যুগোস্লাভিয়ার ইতিহাস সামান্য হলেও জানা দরকার। এই যেমন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪১-এ জার্মানি, ইতালি ও হাঙ্গেরি— যুগপৎ যুগোস্লাভিয়ায় আক্রমণ চালায়। সে-সময়ে ইওসিপ ব্রোজ টিটোর নেতৃত্বে, যুগোস্লাভ পার্টিসানস দল প্রধান প্রতিপক্ষ হিসাবে উঠে দাঁড়ায়।
এরাই ১৯৪৫-এ নাৎসিদের হারিয়ে, ক্ষমতা দখল করে এবং সোশ্যালিস্ট যুগোস্লাভিয়ার জন্ম হয়। কমিউনিজমের একই মতাদর্শে বিশ্বাসী হলেও, যুগোস্লাভিয়ার টিটো এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের স্তালিনের মধ্যে বড়সড় মাত্রায় বিরোধ ঘটে এবং ১৯৪৮-এ যুগোস্লাভিয়া সোভিয়েতের ছত্রছায়া থেকে বেরিয়ে আসে। খেয়াল রাখতে হবে, যুগোস্লাভিয়ার কমিউনিস্ট শাসন কিন্তু সেই সময়ের নিরিখে বেশ অভিনব ছিল। টিটোর কমিউনিজম সোভিয়েতের কমিউনিজমের তুলনায় ছিল বেশি খোলামেলা। ঠান্ডা লড়াইয়ের সময়পর্বে, দুই গোলার্ধের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্কতে মোটামুটি নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পেরেছিলেন টিটো। আপাতভাবে নাগরিকরা সাময়িক সময়ের জন্য হলেও, পেয়েছিলেন স্বাধীনতার স্বাদ, মুক্ত অর্থনীতি এবং শিল্পায়ন।
কিন্তু, পোষা সাপও একদিন ছোবল মারতে চায়। যারা এককালে ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল, তারা পরবর্তীতে নিজেরাই হয়ে উঠল, ফ্যাসিজমের ধারক ও বাহক। বিশ্ববিদ্যালয়-পড়ুয়া একদল ছেলে, ১৯৪১ নাগাদ টিটোর পার্টিসানস দলের হয়ে যুদ্ধ লড়ে। যুদ্ধ শেষ হলে, তাদের ‘ওয়ার হিরো’ আখ্যা দেওয়া হয়। কিন্তু এরাই ১৯৫৭-তে এসে পার্টির নজরে হয়ে দাঁড়াল গণশত্রু। কারণ?
কারণ তাদের যৌন পরিচয়। লোভরো ও নেনাদ সেই কলেজবেলা থেকে একে অপরকে ভালবাসে এবং এই ১৯৫৭ অবধি একসঙ্গে আছে। লোভরোর পরিবার তাদের এই ভালবাসা ও একত্রে থাকা নিয়ে কখনও আপত্তি করেনি। তাদের আরও দুই বন্ধু স্টিভান ও ইভানও সমকামী। এই চারজন ১৯৪১-এ চরম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিল, যখন ওরা বুঝতে পারে, নাৎসি-শাসিত পাপেট ক্রোয়েশিয়ান সেনারা, বেছে-বেছে ইহুদি ও সার্বিয়ান শিক্ষার্থীদের আলাদা করছে। মূলত লোভরোর অসীম সাহস ও প্রতিবাদের কারণে, সেদিন সেনাদের দল নিজেদের সংকল্প চরিতার্থ করতে ব্যর্থ হয়।


ধূসরতার মধ্যে খুঁজে পাওয়া একখণ্ড সবুজ এই ছবির সম্পদ! পড়ুন: ‘ফিল্মফিরিস্তি’ ৪
এরপরের ইতিহাস পরিচালক আমাদের দেখাননি, তবে আভাসে জানিয়েছেন। আমরা বুঝতে পারি, লোভরো ও তার বন্ধুরা এরপর টিটোর তৈরি প্রধান বিরোধী দল পার্টিসানস-এ যোগ দেয় এবং সবলে নাৎসিদের বিরুদ্ধে লড়ে। পরবর্তীতে ওরা সিনেমা বানানোর সঙ্গে যুক্ত হয়।
লোভরো পরিচালক, আর নেনাদ লেখক। কমিউনিস্ট শাসকের ঠিক করে দেওয়া, প্রোপাগান্ডা ফিল্ম বানানোর ইউনিটে ওরা কাজ করে। আপাতভাবে স্বাধীন বলে মনে হবে ওদের, দিব্যি তো আছে, কিন্তু এক চুল এদিক-ওদিক হলে, কর্তৃপক্ষের র্যাডারে এসে যাবে। এভাবেই একদিন ওরা একচুল এদিক-ওদিক করে বসে এবং কর্তৃপক্ষের র্যাডারে চলেও আসে। সোজা আঙুলে ঘি তুলতে ব্যর্থ হয়ে, প্রশাসন থেকে পার্টির প্রতি আজীবন অনুগত থাকা এক ব্যক্তিকে নিয়োগ করা হয়। বলা হয়, তিনি ওই চার বন্ধুকে চোখে-চোখে রাখবেন এবং অসঙ্গতি দেখলে, হেডকোয়ার্টারে রিপোর্ট করবেন। সেই বৃদ্ধ লোকটির নাম এমির, প্রথমে প্রোপাগান্ডার প্রতি কট্টর বিশ্বাসী বলে মনে হলেও, তিনি ছবিটি এগোনোর সঙ্গে-সঙ্গে নিজেও বিবর্তিত হতে থাকেন। বাকি ছবিটা চার বন্ধুর করুণ পরিণতির দিকে যাত্রা নিয়ে।
ছবিটি সাদা-কালো, ফলে একনায়কতন্ত্রের বর্বরতার দৃশ্যগুলো তীক্ষ্ণভাবে চোখে ও মনে ধাক্কা মারে। কুখ্যাত ব্যারেন আইল্যান্ড, যাকে বলা হত যুগোস্লাভিয়ার আউশভিৎস, যেখানে বন্দি করে রাখা হত প্রতিবাদী লোকজনকে; চালানো হত অকথ্য অত্যাচার, সেখান থেকে মুক্তির একমাত্র উপায়— সমুদ্রে ঝাপ, নয়তো পুলিশের গুলি, সেই ব্যারেন আইল্যান্ড ছবিতে আসে আর দর্শকের মনের গভীরে জাকিয়ে বসে সে-সময়ের সন্ত্রাস। প্রধান চরিত্রদের প্যারানইয়া, আতঙ্ক, ব্যথার মুহূর্তগুলোয় দর্শককে প্রভাবিত করতে ছবিটি সক্ষম। বিশ্বযুদ্ধের সময়ে, ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে লড়াইরত ইতালির গেরিলা যুদ্ধবাজদের গাওয়া ‘বেলা চাও’, পাঁচের দশকে যুগোস্লাভিয়ার একদল মানুষের কাছে হয়ে ওঠে চরম বিপন্নতার মাঝেও— সমস্ত প্রতিরোধ ভেঙে, আশান্বিত হওয়ার প্রতীক।
মুশকিলটা হল, বক্তব্যকে তুলে ধরতে গিয়ে, ছবিটি ইভোনা ইউকা বানিয়েছেন বড্ড সোজাসাপ্টাভাবে এবং ব্যবহার করেছেন চিরাচরিত ন্যারেটিভ ট্রোপ, যা আমরা এর আগেও বহু ছবিতে বিভিন্নভাবে পেয়েছি। যেমন, কট্টরপন্থী ব্যক্তির ক্রমশ অন্য মতাদর্শের সঙ্গে পরিচিত হয়ে, নিজের মানসিকতায় বদল আনা, কিংবা গোপনে কারও সঙ্গে শারীরিক ও মানসিকভাবে সম্পর্কিত হয়ে, পরে প্রতারিত করা বা এরকম আরও কিছু ট্রোপ এই ছবিতেও আছে এবং তা বেশ সাধারণভাবেই ব্যবহৃত হয়েছে। ফলে, ছবিটা যতটা ভাল ও অভিনব হওয়ার সুযোগ ছিল, ততটা হতে পারেনি।

প্লটে বৈচিত্র্য কম, গল্প আবর্তিত হয়েছে একতরফা এবং যেহেতু ছবিটা ‘গল্প’ বলার চেষ্টা করছে এবং সেই চেষ্টা পর্দায় টের পাওয়া যাচ্ছে, তাই কোথাও গিয়ে দর্শকদের সঙ্গে কানেক্ট করার ক্ষেত্রে, একটা আড়াল থেকে যায়। ছবিতে কমিউনিস্ট যুগোস্লাভিয়াকে এমনভাবে দেখানো হয়েছে, যাতে কমিউনিস্ট সোভিয়েতের থেকে আলাদা করা সম্ভব না হয়, কিন্তু চারিত্রিক দিক থেকে— দুই রাষ্ট্রের কমিউনিজমে যে নানারকম তফাৎ ছিল, তার নিরপেক্ষ প্রকাশ ছবিতে নেই। সোজাসাপ্টাভাবে টিটোর যুগোস্লাভিয়ায় সমকামিতা খারাপ, ফলে এই চার সমকামী বন্ধু, কমিউনিস্টদের চোখে সমাজের রোগ, অতএব এদের উপড়ে বাদ দিয়ে দেওয়া হোক, মোটামুটি এই হল ছবিটির মূল উপজীব্য।
ক্রোয়েশিয়ার (এবং আংশিকভাবে মন্টিনিগ্রোর) ফিল্মমেকার ইভোনা ইউকা কেরিয়ারের শুরুতে বেশ কয়েকটি ছোট ছবি ও তথ্যচিত্র বানিয়েছেন। ২০০৬-এ বানানো ‘ফেসিং দ্য ডে’ তথ্যচিত্রটিতে কীভাবে এক সংশোধনাগারের কয়েকজন বন্দি মিলে, শেক্সপিয়ারের নাটক মঞ্চস্থ করে শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও, তা ক্যামেরাবন্দী করেন। এছাড়াও তিনি বানিয়েছেন ‘ইউ ক্যারি মি’ (২০১৫) নামের পূর্ণদৈর্ঘ্যের কাহিনিচিত্র, যেখানে আমরা আধুনিক ক্রোয়েশিয়ার তিনরকম শ্রেণির তিনজন মহিলাকে দেখতে পাই, যাদের জীবনের নানাবিধ সমস্যা, স্বপ্ন ও স্বাধীনতা ছিল ছবিটির উপজীব্য। সেই ইভোনা ইউকা আবার ন’বছর পর ছবি বানিয়েছেন এবং কেন্দ্রে রেখেছেন ইতিহাসের এক অনুচ্চারিত অধ্যায়কে, যা অবশ্যই বাহবা পাওয়ার যোগ্য।
আলোচ্য ছবিটি সাদা-কালোতে বানানোর একটি বিশেষ কারণ আছে, যা ছবিটির শেষে বুঝতে পারা যায়। তবে, প্রশ্ন থেকেই যায় একতরফা চিত্রায়নে, খুব বেশি গভীরতায় না প্রবেশ করায়, চরিত্রগুলোর মনোজগতের প্রতি খুব বেশি গুরুত্ব না দেওয়ায় এবং আরও বেশি বৈচিত্র্যকে প্রাধান্য না দেওয়ায়, যা থাকা প্রয়োজন ছিল— এরকম ইতিহাস-মুখর একটি ছবিতে। এসবকে পাশে সরিয়ে রাখলে, ‘বিউটিফুল ইভিনিং, বিউটিফুল ডে’ একটি আলোচনাযোগ্য ছবি।



