বন্যা, আন্ত্রিক, জীবন
১৯৭৮ সালের ঘটনা, তখনও পুরোদস্তুর ডাক্তার হইনি। তখন নতুন সরকার এসেছে রাজ্যে। আর তার পরে পরেই এক ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল রাজ্যে। দামোদর, রূপনারায়ণ প্লাবিত হয়ে ওঠে। মেদিনীপুর জেলার একটা বড় অংশ, হাওড়া, হুগলি, বাঁকুড়া, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ ভেসে যায় তখন। তদানীন্তন রাজ্য সরকার ডাক্তারি ছাত্রদেরও সাতদিনের জন্য স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে চেয়েছিল, যাতে তারা জেলায় জেলায় ঘুরে ডাক্তারি পরিষেবা সামাল দেওয়া যায়। আমার তখন সবে পরীক্ষা শেষ হয়েছে, রেজাল্ট বেরয়নি। মনে আছে, আমি, সঙ্গে একদল ছাত্রছাত্রী, একদল জুনিয়র হাউজস্টাফ, কেন্দ্রীয় রিলিফ দপ্তরের গোডাউন থেকে রওনা দিলাম মেদিনীপুরের উদ্দেশ্যে, স্যালাইন-ভর্তি গাড়ি নিয়ে। মেদিনীপুরে তখন ভয়ংকর কলেরার প্রকোপ।
কিছুদূর গিয়েই আটকে যেতে হল, কারণ রাস্তা সম্পূর্ণ জলমগ্ন। একদল চাইছিল, সেখানেই থেকে যেতে। আরেকদল দায়িত্ব পালনে অনড়। দ্বিতীয় দল ভারী হল। ফলে বিকল্প রাস্তা খুঁজে আমরা মেদিনীপুর সদরে পৌঁছেছিলাম দু’দিন পর। গাড়ি যাতে নয়ানজুলিতে না পড়ে যায়, তাই কিছুটা রাস্তা আমাদের হেঁটেই যেতে হল। যাই হোক, সেখানে গিয়ে জানা গেল, এই গাড়ি নিয়ে যেতে হবে কোলাঘাট হেলথ সেন্টারে। এই সময় কিছু ডাক্তার দলছুট হয়ে পড়লেন, তাঁরা আবার কোলাঘাট অবধি যেতে চান না। কোলাঘাট অবধি যে রাস্তা, তা তখন সম্পূর্ণ জলের তলায়। কোলাঘাট রূপনারায়ণের ঠিক ধারে, রূপনারায়ণের বাঁধ তখন প্রায় ডুবন্ত। আমরা চারজন রওনা দিলাম। যেটুকু সুবিধে পাওয়া গেল, তা হল তৎকালীন আদিবাসী উন্নয়ন মন্ত্রী শম্ভু মান্ডির কনভয়ে আমরা ভিড়ে যেতে পারলাম। কারণ, একজন চিকিৎসক ছিলেন তাঁর বন্ধু।
আরও পড়ুন : সীমান্ত পেরিয়ে গরুর চিকিৎসা করতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা কোনওদিন ভুলব না!
লিখছেন অরুণ চ্যাটার্জি…
আরও একদিন পর আমরা কোলাঘাট পৌঁছলাম। হেলথ সেন্টার তখন জলের তলায়। এখন তো কলেরা বলে না, আইনি জটিলতায় আন্ত্রিক বলা হয়। ওখানে একটি বাঁশের মাচা বাঁধা হয়েছে রূপনারায়ণের ধারে, সেখানকার মেডিক্যাল অফিসারের তত্ত্বাবধানে। সেখানকার অবস্থা বেশ অস্বাস্থ্যকর। জলে রোগীদের মলমূত্র মিশে রোগ আরও ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বাড়ছে। আমাদের থাকার ব্যবস্থা হল একটি বাড়িতে, ভারত সেবাশ্রম সংঘের একটি ঘরে শোয়ার ব্যবস্থা হল। সকালে একটু চিঁড়েদই খেয়ে বেরনো, রাতে পেটচুক্তি খিচুড়ি— এইটা ছিল রোজের খাবার।
প্রথম কাজ হল আমাদের, হেলথ সেন্টারটিকে ঠিক করা, যাতে জলবাহিত রোগ না ছড়ায়। আমরা ওই ডুবন্ত হেলথ সেন্টারেই খাটের ওপর খাট পাতলাম। বাঁশের স্ট্রেচার, কলার ভেলা করে রোগীদের নিয়ে আসা হল। এইভাবে আমরা হেলথ সেন্টার রিক্লেম করলাম।
আমরা জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকেই স্যালাইন ও ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে চিকিৎসা করা শুরু করলাম। আর কোনও উপায়ও নেই তখন চিকিৎসার। তখনও বড় আকারের ত্রাণ পৌঁছয়নি কোলাঘাটে।
প্রথম কাজ হল আমাদের, হেলথ সেন্টারটিকে ঠিক করা, যাতে জলবাহিত রোগ না ছড়ায়। আমরা ওই ডুবন্ত হেলথ সেন্টারেই খাটের ওপর খাট পাতলাম। বাঁশের স্ট্রেচার, কলার ভেলা করে রোগীদের নিয়ে আসা হল। এইভাবে আমরা হেলথ সেন্টার রিক্লেম করলাম।
কার্তিক পূর্ণিমা কোলাঘাটে খুব বড় করে হয়। সন্ধে-রাতে আমরা তখন হেলথ সেন্টারের ছাদে বসে নজর রাখতাম, যাতে, যদি দূর থেকে রোগী আসে, আমরা বুঝতে পারি। এই কার্তিক পূর্ণিমার রাতটা আমার মনে থাকবে আজীবন। একজন বাবা এলেন তাঁর এগারো-বারো বছর বয়সি ছেলেকে নিয়ে। বাবারও আন্ত্রিক, ডিহাইড্রেশন। চোখ কোটরে ঢুকে গিয়েছে। কিন্তু ছেলে শ্বাস নিচ্ছে কি না, তাই প্রায় বোঝা যাচ্ছে না। বাবা ধরেই নিয়েছেন, ছেলে মারা গিয়েছে।
তখন কোনও আধুনিক ব্যবস্থা নেই। তাই ভেনেসেকশন করে, অর্থাৎ, শিরার ভেতর দিয়ে স্যালাইন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হল। এখনও মনে আছে, চামড়া কাটছি লোকাল অ্যানাস্থেশিয়া ছাড়াই, কিন্তু বাচ্চাটির কোনও সাড় পাওয়া যাচ্ছে না। প্রায় মৃত্যুর আগের অবস্থা। কখনও কখনও খাবি খাওয়ার মতো শ্বাস নিচ্ছে, বাকিটা অসাড়। তখন সিস্টারদের শাড়ি পরার রেওয়াজ ছিল। সেই শাড়ি গুটিয়ে, একহাঁটু জলের মধ্যে বারবার দু’জন সিস্টার বাচ্চাটির স্যালাইন বদলে দিচ্ছেন।
ক্রমে রাত শেষ হল। ভোরের আলো ফুটল। সকালে বাচ্চাটি উঠে বসল। আমরা আনন্দে চিৎকার করে উঠেছিলাম। ওই পূর্ণিমার রাতে যখন বাচ্চাটি এসেছিল, তখন তাকে মৃতদেহ বলেই ধরে নিয়েছিলাম। সে উঠে বসেছে!
মনে আছে, বাচ্চাটির বাবা হাত ধরে হেসেছিলেন আমাদের।
এখনও যখন মৃতপ্রায় একজন রোগী দেখি, সেই রাতের কথা মনে করি। ওইটা যদি সম্ভব হয়, তাহলে এটাও সম্ভব। অত সহজে মানুষের জীবন যায় না। সেই রাতে যাঁরা সাথী ছিলেন, তাঁরা এখন কোথায়, জানি না। সিস্টারদের তো কোনও খবরই নেই। কিন্তু সেই মুখগুলো মনে আছে।
মনে আছে, সাতদিনের জন্য গিয়ে থেকে গিয়েছিলাম একমাস। পরে ট্রেন চালু হতে দেউলটি থেকে ট্রেন ধরে ফিরেছিলাম কলকাতায়। মনের মণিকোঠায় থেকে যাবে সেই সময়টা।