ধর্মের কল ও কবজা
আফগানিস্তানে দেখা গেল, ভূমিকম্পে ধ্বংসস্তূপের তলায় আটকে পড়া পুরুষদের উদ্ধার করা হচ্ছে, শিশুদেরও, কিন্তু নারীদের নয়। কেন? নারী কি পুরুষের চেয়ে কম? তালিবানদের মতে আলবাত কম, কিন্তু এইক্ষেত্রে যুক্তিটা আলাদা। তালিবানরা মনে করে, তাদের ধর্ম অনুযায়ী, কোনও পুরুষ কখনও অনাত্মীয় নারীকে স্পর্শ করতে পারে না। উদ্ধারকারী দলের প্রায় সকলেই পুরুষ (কারণ স্বাস্থ্যক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ তালিবানরা পছন্দ করে না), তাই সেই পুরুষরা ধর্মচ্যুতির ভয়ে, নারীদের আর্তনাদ ও অনুনয় শুনতে পাচ্ছে না। পাশের গ্রাম থেকে মহিলারা এসে সেই উদ্ধারকাজ করবে, প্রতীক্ষা চলছে। যে-নারীরা নিজেরা হেঁচড়ে বেরিয়ে এসেছে, তাদের ওষুধপত্রও দেবে সেই গ্রামের মহিলারা। এমনকী, আন্তর্জাতিক সেবা-সংস্থা থেকে নারী ত্রাণকর্মীরা এসে সেবা করতে চাইলেও দেশে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না, কারণ তালিবানদের মতে, তাদের ধর্ম বলে, নারী শুধু পুরুষ-আত্মীয়ের সঙ্গেই বাইরে বেরতে পারে। তাহলে এই সেবিকারা পুং-আত্মীয় ছাড়াই ঘুরবে-ফিরবে কী করে?
ফট করে মনে হতে পারে, দেশের সর্বনাশ ও মানুষের প্রাণহানি আটকাতে ধর্মের বজ্র-আঁটন শিথিল করা উচিত, কিন্তু সে হল সুবিধেবাদী ঠাট। আফগান সরকারের এই ধর্মদৃঢ় অবস্থানের মধ্যে নীতি ও আদর্শকে সর্বোচ্চ স্থান দেওয়ার যে প্রতিজ্ঞা, যে কোনও মূল্যে ধর্মের শুচিতা বজায় রাখার যে আকুলতা, তা যেন আমাদের নজর না এড়িয়ে যায়। ধর্মের জন্য সব ত্যাগ করা যায়, কিছুর জন্যই ধর্মকে ত্যাগ করা যায় না— এই কঠোর প্রতিজ্ঞাকে (এবং প্রতিকূল বাস্তবে দাঁতে দাঁত চেপে তা রূপায়িত করার জেদকে) আমরা কুর্নিশ করতে যেন না ভুলি। এদিক-ওদিক কয়েকটা প্রাণ যেতেই পারে, কিন্তু সেজন্য তো ধর্ম-পতন সহ্য করা যায় না। যে নারী মণ-মণ পাথরের তলায় যন্ত্রণায় ও আতঙ্কে নীল, আর ক’মুহূর্ত পরে দম বন্ধ হয়ে যাবে, সে হয়তো প্রাণভয়ে ভেবে ফেলতে পারে, চুলোয় যাক ধর্ম, অনাত্মীয় পুরুষের হাত যদি আমায় টেনে তোলে, তুলুক না। তারও যাতে কিছুতে ধর্মচ্যুতি না ঘটে, উদ্ধারকারীরা সেদিকে কড়া নজর রেখে হাত অর্ধ-গুটিয়ে চুপ। গোলা লোক ভাবতে পারে, এ অমানবিক, কিন্তু ভয়াবহ সংকটের সময়েই তো ধর্ম-আঠার প্রকৃত পরীক্ষা ঘটে।
সিনেমার প্রচারের ঢোলশোহরত কি মানুষের বিরক্তি উৎপাদন করতেই?
পড়ুন ‘সামথিং সামথিং’ পর্ব ৭১…
ঠিক যেমন অন্য ধর্মে এককালে স্বামীর মৃতদেহের সঙ্গে জ্যান্ত সদ্য-বিধবাকে চিতায় চড়িয়ে দেওয়া হত, তখন মেয়েটি গায়ে আগুন লাগামাত্র ‘বাপ রে মা রে’ বলে চিতা থেকে পালিয়ে আসার উপক্রম করলে ধর্মনিষ্ঠরা (হিতৈষী পরিজনেরাও) বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে তাকে ফের চিতায় গুঁজড়ে দিত। বাঁশ তুলতে এবং মারতে নিশ্চয় কায়িক পরিশ্রম হত, হয়তো কাঁধ মচকেও যেত কখনও, সে-ক্লেশ উপেক্ষা করে তারা নাগাড়ে এই কাজ করে যেত, কারণ নারীকে শপথভ্রষ্ট হতে দেবে না, তার পাওনা পুণ্য তাকে অর্জন করাবেই। সেসব প্রথা অবশ্য এখন ঘুচে গেছে, ইদানীং এই ধর্মপরায়ণরা এর-তার ফ্রিজে উঁকি মেরে দেখছে। যদি সন্দেহ হয়, ভিনধর্মের লোক এই-ধর্মে নিষিদ্ধ মাংস খাচ্ছে, তখন তাকে বেধড়ক মেরে খুন করে, নিজ ধর্মের মান রাখছে। যখন তার নিজের ধর্মের লোক অন্য ধর্মের নারীকে ধর্ষণ করছে, তখন ধর্ষক (বা গণধর্ষণের ক্ষেত্রে ধর্ষকের দল) গ্রেফতার হলে সেই সিদ্ধান্তের বিপক্ষে গরগরে মিছিল করছে, এবং ধর্ষকরা ছাড়া পেলে তাদের হুড়িয়ে মালা পরাচ্ছে ও পায়ে হাত দিয়ে পেন্নাম ঠুকছে। অন্য ধর্মের সাত বছর বয়সি বালিকার ধর্ষিতা হাঁটু-ভাঙা মৃতদেহ ঝোপের পাশে মুচড়ে থাকলে মনে করছে, আঃ, দুরন্ত শাস্তি! এখানেও আধুনিক ন্যাকা-জাগ্রত মনোবৃত্তি ছিছিক্কারিয়ে উঠতে পারে। কিন্তু বুঝতে হবে, ‘ধর্ষণ খারাপ’, ‘হত্যা খারাপ’— এগুলো একবগ্গা গোঁয়ার বিবৃতি। দেখতে হবে, কাকে ধর্ষণ, কাকে খুন। একটা ভিনধর্মী লোক এবং তার দুই ছেলে একটা জিপের মধ্যে ছিল, সবাইকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারলাম— এ কিন্তু খুব সরল ও ধর্ষকামী কাণ্ড নয়। প্রকাণ্ড পরিকল্পনা, সাহস, দক্ষতা প্রয়োজন, সর্বোপরি অগ্নিসংযোগকারীর ভবিষ্যৎ-দুঃস্বপ্নও গজাতে পারে, ডিটেল-সহ (পোড়া চামড়ার গন্ধ ও ‘বাঁচাও! বাঁচাও!’ উন্মত্ত আকুতি)। ধর্মরক্ষার তাগিদে কেউ এই অপ্রিয় ও দুঃসাধ্য কাজ করলে, তাকে বীরের মর্যাদা দেওয়া হবে না? অভিনন্দন জানানো হবে না? মনে রাখতে হবে, নাবালিকাকে ধর্ষণ করে যৌন তৃপ্তি পাওয়া যায় না, শুধু নিজের ধর্মকে প্রখর ভালবেসে এ-কাণ্ড ঘটিয়ে যায় অক্লান্তকর্মা ধর্মযোদ্ধারা।
ধর্মকে কখনও ভুল বুঝতে নেই। সব ধর্ম আদতে বলে, প্রেম বিতরণ করো। এখন, অন্য ধর্ম আচমকা জনপ্রিয়তায় তাকে ওভারটেক করে গেলে খচাং রাগ চড়ে তো যাবেই। তখন পৃথিবীকে সংশোধনের জন্যই প্রতিদ্বন্দ্বী ধর্মাবলম্বীদের কিলিয়ে কাঁটাল পাকিয়ে দিতে হয়। এ তো একটা বাধ্যতা, মোটে গুন্ডামির গর্জন নয়। এছাড়া লোককে ভক্তিতে তটস্থ রাখার জন্য সামান্য কিছু দড়িদড়ার জোগাড় দেখতে হয়, নিষেধের পেরেক বিছিয়ে রাখতে হয়, যাতে সে সিধে সজাগ হয়ে চলে। আসল বার্তা হল: সবাইকে ভালবাসো, বিশেষত নিজের ধর্মকে।
অন্য এক ধর্মে এককালে বিশাল বিচার বসানো হত, নাস্তিক বা ধর্মবিরোধীকে শায়েস্তা করতে। অভিযুক্তের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ, সাক্ষী জোগাড়, স্বীকারোক্তি আদায় করতে বিভিন্ন যন্ত্র দিয়ে অত্যাচার, দোষী সাব্যস্ত হলে কখনও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত, কখনও বন্দি, কখনও পুড়িয়ে মারার ফরমান। এমনকী, মৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধেও নালিশ আসত (‘ও বেঁচে থাকতে ঈশ্বরকে বক দেখিয়েছিল ধর্মবাপা!’), দোষী প্রমাণিত হলে সমাধি থেকে তার হাড়গোড় তুলে এনে পোড়ানো হত। অর্থাৎ, ধর্মের প্রতি ভক্তি কারও যেন কণামাত্র না টসকায়, ধর্মকে আলগোছে করতলে ঘুরিয়েফিরিয়ে ‘এই যাঃ’ রবে মাটিতে ফেললে তার পরিণাম কী হতে পারে, তা যেন প্রকট জেগে থাকে— নিশ্চিত করতে একটা গোটা বিস্তৃত বিচার-বন্দোবস্ত তৈরি করা হয়েছিল। বিচারকমণ্ডলী, প্রহরী, তথ্য-জোগাড়ে, অত্যাচার-কর্মী, পোড়ানোর জল্লাদ, সমাধি খোঁড়ার কর্মচারী— এতগুলো লোককে সংগঠিত ও চালনা করা সহজ কথা নয়। অত্যাচারের জিনিসপত্র কেনা, এই সাঁড়াশিতে নাক টানা সেই জাঁতিতে কান কাটা, স্তূপীকৃত কাঠ ঠিকঠাক সাজিয়ে তাতে আসামিকে বেঁধে সাড়ম্বরে পোড়ানো, ডাইনি বলে দেগে দেওয়ার সভা-বিবরণী ভাল হাতের লেখায় টোকা, কম খাটুনি ও উদ্বেগ? তবু অর্থ ও সামর্থ্যের এই প্রবল বিনিয়োগ সোৎসাহে ঘটেছিল, কারণ ধর্মের পবিত্রতার ময়দানে আপস চলে না। এখন সেসব ঘুচেছে, কিন্তু বহু বছর ধরে ধর্মস্থানে শিশুদের ধারাবাহিক যৌন নিগ্রহের অভিযোগ রইরই উত্থিত। প্লাস নালিশ: কর্তৃপক্ষ সেই নিগ্রহকারীদের টানা প্রশ্রয় দিয়েছে। তাদের চিহ্নিত করা হলেও শাস্তি দেওয়া হয়নি, বা যেখানে বদলি করা হয়েছে সেখানে শিশুরা রয়েছে জেনেও সেই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তখন সেই শিশুরাও অত্যাচারের শিকার হয়েছে। এবং এই কদর্যতার প্রতিবাদ করে কোনও বিখ্যাত গায়িকা টিভি-অনুষ্ঠানে ধর্ম-নেতার ছবি ছিঁড়ে ফেললে, ধর্মানুরাগীদের দাপটে তাঁর কেরিয়ার তছনছ হয়ে গেছে। অবশ্য অভিযোগের অনেকটাই প্রমাণিত হওয়ার পর ধর্মপ্রধান অনুতাপ ও লজ্জার কথা স্পষ্ট ও একাধিকবার জানিয়েছেন। সব শুনেটুনে আবারও নির্বোধের পুঁচকে মগজে ধর্মঘৃণা টুকি দিতে পারে। কিন্তু তলিয়ে ভাবতে হবে: শরীর-মন জুড়ে নিগ্রহের আছাড়িপিছাড়ি যন্ত্রণা সহনের সুবাদে ওই শিশুগণের স্বর্গলাভ কি নিশ্চিত হল না? ঈশ্বর কি বেদনার্তদের প্রতি বিশেষ পক্ষপাতী নন, তিনি কি ‘এই মর-পৃথিবীতে যে যত ছটফটাবে, পরপারে নিখুঁত ২৩৭ গুণ সুখ তার বরাদ্দ’ পাটিগণিতে বিশ্বাসী নন? ধর্মগৃহে— যেথা আত্মবঞ্চনা ও আত্ম-রগড়ানির অ্যাক্কেরে চরকিবাজি রনরন, পারলে নিজের হেঁটে-কাঁটা-ওপরে-কাঁটা বিঁধে সক্কলকে ডেকে স্বনির্যাতনের রঙিন বিজ্ঞাপন রটানো হয়— যদি কিছু লোককে বীভৎস নিপীড়নের কর্কশ পাঠ ঘাড়ে ধরে কেউ দেয়ই, তবে অত্যাচারিত কি সটান বুঝে ফ্যালে না: এ মর্ত্যজীবন কী অসহ ক্লেদাক্ত এবং সুতরাং কী জম্পেশ আথিবিথি আগ্রহে শুধু দেবলোকের দিকে চিত্তদৃষ্টি ফোকাসিয়ে কোনওমতে এই আটপৌরে আয়ুটুকু ফুরিয়ে ফেলা উচিত? তাহলে কি সেই শিশুর জ্ঞানচক্ষু একটা সরু শিকের তীব্র (ও অনবরত) খোঁচায় উন্মীলনই করা হল না?
ধর্মকে কখনও ভুল বুঝতে নেই। সব ধর্ম আদতে বলে, প্রেম বিতরণ করো। এখন, অন্য ধর্ম আচমকা জনপ্রিয়তায় তাকে ওভারটেক করে গেলে খচাং রাগ চড়ে তো যাবেই। তখন পৃথিবীকে সংশোধনের জন্যই প্রতিদ্বন্দ্বী ধর্মাবলম্বীদের কিলিয়ে কাঁটাল পাকিয়ে দিতে হয়। এ তো একটা বাধ্যতা, মোটে গুন্ডামির গর্জন নয়। এছাড়া লোককে ভক্তিতে তটস্থ রাখার জন্য সামান্য কিছু দড়িদড়ার জোগাড় দেখতে হয়, নিষেধের পেরেক বিছিয়ে রাখতে হয়, যাতে সে সিধে সজাগ হয়ে চলে। আসল বার্তা হল: সবাইকে ভালবাসো, বিশেষত নিজের ধর্মকে। এবং সেই অনুরাগ জঙ্গি হওয়াই ভাল। এই তো ক’বছর আগে ‘শার্লি এবদো’ পত্রিকা একটা ধর্মকে ব্যঙ্গ করেছিল মনে করে সেই ধর্মের দু’জন লোক পত্রিকা-অফিসে গিয়ে ১২ জনকে হত্যা করল। আবার আরেকজন ধর্মপ্রেমী লোক স্টেজে লাফিয়ে উঠে সলমন রুশদিকে প্রচুর ছুরির কোপ মারল। যদিও সলমন বেঁচে গেছেন। তাঁর চোখ ও একটা হাত নষ্ট হয়েছে, লেখা থামেনি। বোঝাই যাচ্ছে, ওই ধর্মকর্মীর উচিত ছিল আক্রমণের আগে বাড়িতে আরও প্র্যাকটিস, কিংবা ছোট ছুরির বদলে খরখরে তরোয়াল নিয়ে ঢোকা।
আমরা যেন ধর্মকে পেল্লায় পালন করতে গিয়ে আধখ্যাঁচড়া ও ফাঁকিবাজ আচরণ না করি, দুর্গাপুজোর প্রাক্কালে এই হোক ডাইরি-লিখন।