মশগুল : পর্ব ১০

Representative image

কালোর দোকানের আড্ডা

রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও চা খেতে আসেননি!

শুরুটা এভাবে করলাম কারণ, এই ভুল ধারণাটা ভাঙা দরকার; শান্তিনিকেতনের আকাশে-বাতসে যেমন একটা সময় গান ভেসে বেড়াত, এখন তেমন গুজব, গালগল্প ভেসে বেড়ায়; খুব আশ্চর্যের বিষয়, কিছু মানুষ সেসব আবার চোখ বন্ধ করে বিশ্বাসও করেন; আমি প্রায় তিন পুরুষ ধরে শান্তিনিকেতনে— এখানেই জন্ম, লেখাপড়া, কর্মজীবন; আমার বাপ-ঠাকুরদাও কালোর দোকানে নিয়মিত যেতেন, কিন্তু কখনও শুনিনি, রবীন্দ্রনাথ কালোর দোকানে এসে আড্ডা মারতেন বা ‘উদয়ন’ কিংবা ‘শ্যামলী’ থেকে চায়ের অর্ডার দিতেন। কয়েকজন গপ্পোবাজ আবার দু’ধাপ এগিয়ে; তাঁরা বলেন, শুধু রবীন্দ্রনাথই নন, গান্ধীজী শান্তিনিকেতন এলেই মাস্ট ভিজিট ছিল কালোর দোকান! — একে হয়না! সুগ্রীব দোসর! আসলে এসব গাঁজাখুরি মানুষ খায় ভাল, তাই মিথ্যার আশ্রয়।

শুধু তো বড় নাম দিয়ে ইতিহাস লেখা যায় না, সেখানে থাকে অনেক সাধারণ মানুষের কথা; সেই মানুষদের ব্রাত্য করলে, ইতিহাসের ‘সত্য’ লুকানো হয়। এমনকী আমরা তো কালোকেও দেখেছি বেশকয়েক বছর, ওঁকেও কিন্তু কখনও বলতে বা দাবি করতে শুনিনি— রবীন্দ্রনাথ বা গান্ধী কেউ এসেছিলেন ওঁর দোকানে।  

মাঠে বদমেজাজি, অথচ অলিপাবে অন্য চেহারায় ধরা দিতেন চিমা ওকোরি! অয়ন চক্রবর্তীর কলমে পড়ুন ‘মশগুল’ পর্ব ৯...

‘কালো’, ভাল নাম কালীপদ দলুই; প্রথমে দোকান করেন শ্রীভবনের মধ্যে; সময়টা ’৪০-এর প্রথমভাগ; মূলত চা-জলখাবার, লুচি, কচুরি সিঙারা— এ-সবই দোকানে পাওয়া যেত; বিশ্বভারতীর মূল কিচেনে তো লাঞ্চ বা ডিনার দেওয়া হতই, এটা, সমান্তরালভাবে শুরু হয়েছিল; প্রসঙ্গত কালো কিন্তু বিশ্বভারতীরই কর্মচারী, একাউন্টস বিভাগের পিওন ছিলেন;  ’৪০-এরই শেষ দিকে কালোর দোকান শ্রীভবন থেকে উঠে চলে আসে, বর্তমান রতনপল্লীর অবস্থানে; তখন আমরা ‘পাঠভবন’-এ ঢুকেছি সদ্য। আমাদের সিনিয়রদের দেখতাম, তাঁরা কালোর দোকানে যেতেন নিয়মিত; আমাদের সে কী অদম্য কৌতূহল! আমরাও ধীরে-ধীরে যাওয়া শুরু করলাম, ক্লাস নাইন-টেনে উঠে তা নিয়মিত হল;  শান্তিনিকেতনে তো সেই অর্থে রেস্তোরাঁ বলে তখন কিছু ছিল না, আমাদের একটু পয়সা-টয়সা হলে, ‘পৌষালি’ বলে একজায়গায় যেতাম— প্রতীচী, অমর্ত্য সেন-এর বাড়ি যেখানে, সেখানেই তার অবস্থান— তো বাকি দিনগুলো আমাদের ভরসা ছিল কালোর দোকানের মাছের চপ কিংবা সিঙারা।

কালীপদ দলুই ওরফে কালোর সঙ্গে লেখক ও তাঁর বন্ধুরা

আমরা যখন বয়সে একটু ছোট, কালোর দোকানের আড্ডায় বড়দের আড্ডাগুলো শুনতাম, আসতেন সৈয়দ মুজতবা আলি, হীরেন দত্ত, ভবতোষ দত্ত প্রমুখ;

একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে, অন্নদাশঙ্কর রায় ছিলেন কালোর দোকানের একটু সিনিয়র আড্ডাবাজ, বেশ একটু গুরুগম্ভীর ছিলেন, এদিকে সৈয়দদা মাটির মানুষ, সর্বোপরি— প্রখর সেন্স অফ হিউমার!

একদিন আড্ডায়, সৈয়দদা-কে , অন্নদাশঙ্কর বলে বসলেন,

—সৈয়দ বাবু, জানেন, এ-বছর আমার কটা অনুবাদ বেরিয়েছে? প্রায় ছয়-সাতটা!

—ও, তা বেশ অনেকগুলোই! আমার অত নেই! কিন্তু একটা অনুবাদ কিন্তু এবারে অনেকটা ছাড়িয়ে গেছে সংখ্যায় আপনাকে!

—কী-কী!? কোনটা আমাকে ছাড়িয়ে গেছে!

—কেন? রেলওয়ে টাইম টেবিল!? সব ভাষাতেই তো তার অনুবাদ বেরিয়েছে!  

তুমুল হাসি সকলের… এমনই ছিল কালোর দোকানের আড্ডার চেহারা! সতের থেকে সত্তর সকলেই আসতেন, গপ্পে-আড্ডায় মশগুল হতেন।

আরেকদিনের ঘটনা, হীরেন দত্ত, সুধাকর চট্টোপাধ্যায় এখানকার বরিষ্ঠ অধ্যাপক ছিলেন, ওঁরা একদিন কালোর দোকান থেকে একটু বেরিয়ে আলাদা গল্প করছিলেন, হয়তো কোনও জরুরি কথা!— সৈয়দ দা খেয়াল করে, বলে বসলেন, বাবা! এখানে তো আরেকটা ধর্মীয় বিপ্লব হবে বলে মনে হচ্ছে! উনিশ শতকে এক দত্ত-চাটুজ্জে (বিবেকানন্দ-রামকৃষ্ণ) কাঁপিয়ে দিয়েছিল পুরো দেশ! এখন দেখি আরেক দত্ত-চাটুজ্জের জুটি উঠে আসছে! আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।

একটা কথা এখানে বলা জরুরি, আমরা তো অনেকদিন বড়দের আড্ডা মারতে দেখেছি, কখনও ওঁদের পরনিন্দা-পরচর্চা করতে শুনিনি; এটা খুবই আশ্চর্যের এবং একইসঙ্গে আজকের প্রজন্মের কাছে শিক্ষণীয়, এখন দুটো মানুষের মধ্যে মতের অমিল হলেই যেমন নিন্দা, এর ওর নামে খারাপ কথা, বৈঠকখানায় বা কোনও আড্ডার ঠেকে শুরু হয়ে যায়— কালোর দোকানের আড্ডা ছিল এসব থেকে যথেষ্ট ব্যতিক্রমী।

কালোর দোকান থেকে আমাদের একটা বাৎসরিক পিকনিক হত প্রতিবছর; সেটা আবার কিছুটা ফ্যামিলি পিকনিকের চেহারা নেয়। মূলত, কোপাই, রায়পুর জমিদার বাড়ি ও গুনুটিয়াতেই আমরা পিকনিক করতে যেতাম; সবাই মিলে এখান থেকে বাসে করে হইহই করতে-করতে যাওয়া হত; গুনুটিয়াতেই ছিল, এক নীলকর, চিপ সাহেবের কুঠি, সেটা ছিল সেখানকার অন্যতম আকর্ষণ। সত্যজিৎ রায়ের ‘নীল আতঙ্ক’ গল্পটা কিন্তু এই কুঠিকে কেন্দ্র করেই। কী যে মজা হত পিকনিকে! সুরে-বেসুরে—সবাই গলা ছেড়ে গান গাইছে, গানের লড়াই চলছে, বাস দাঁড়িয়ে যাচ্ছে যেখানে-সেখানে, শান্তিদেব ঘোষের ভাই মন্টু দা, (সুবীরময় ঘোষ) ‘খর বায়ু বয় বেগে’ —মজা করে গেয়ে ফেললেন ‘ফর বায়ু বয় বেগে’— কারণ গানের লড়াইতে ‘ফ’ দিয়ে গাইতে হত, সেই মুহূর্তে মাথায় ‘ফ’ দিয়ে গান আসছে না, তাই এই বুদ্ধি! এমন কত মজার স্মৃতি!

কতগুলো গুজব এখানে ছিল, যার কিছুটা সত্যিও— সেগুলোর মধ্যে একটা, মন্টুদার সঙ্গে সুচিত্রা মিত্রের খুব বন্ধুত্ব, সে এতটাই বন্ধুত্ব ছিল, প্রেম হিসেবে আমরা ধরে নিতাম। একদিন আড্ডায় সুচিত্রা মিত্রের প্রসঙ্গ উঠল;

—মন্টুদা, কিছু মনে করবেন না, একটা প্রশ্ন করব?

—হ্যাঁ, করো,

—না, কিছু মনে করবেন না তো?

—আরে কী মনে করব, করোই না…

—না, সুচিত্রা মিত্রের সঙ্গে আপনার কি কোনও অ্যাফেয়ার ছিল?

—অমন স্মার্ট লোক মন্টুদা ব্যোমকে গিয়ে বলেন, ‘অ্যাফেয়ার’ বলতে তোরা কী বুঝিস?

—ব্যস! আমরা আমাদের উত্তর পেয়ে গেছি!  

কতগুলো গুজব এখানে ছিল, যার কিছুটা সত্যিও— সেগুলোর মধ্যে একটা, মন্টুদার সঙ্গে সুচিত্রা মিত্রের খুব বন্ধুত্ব, সে এতটাই বন্ধুত্ব ছিল, প্রেম হিসেবে আমরা ধরে নিতাম। একদিন আড্ডায় সুচিত্রা মিত্রের প্রসঙ্গ উঠল…

কালোর দোকানের আড্ডার আরেকটা অবিচ্ছেদ্য অংশ ক্রিকেট ম্যাচ! যে-সব দলে ভাগ হয়ে নামকরণ হত, সেগুলো ছিল বেশ মজার, কখনও বাঙাল-ঘটি, কখনও সিপিএম কংগ্রেস এসব নাম দিয়ে খেলা হত; একবার দেখা গেল, সিপিএম-এর দল ভরে গেছে, কিন্তু কংগ্রেসে লোক হচ্ছে না! সেই দেখে আমরা একটা নাম ঠিক করলাম, (ইংল্যান্ডে এরকম নামকরণ হয়), ‘ক্রিকেটারস ভার্সেস জেন্টলম্যান’! তার অনুকরণে আমরা করলাম বামপন্থী বনাম ভদ্রলোক;— এ আবার কিছুটা অশোক মিত্রের লেখা থেকে অনুপ্রাণিত।   

কালোদা-র মৃত্যুর পর, দোকান পরবর্তী সময়ে অনেকে সামলেছে, যার মধ্যে অন্যতম মদন দলুই, কালোদার ছেলে ও কালোদা-র ভগ্নীপোত চণ্ডী এড়ল; চণ্ডীদা-র স্মৃতি সত্যিই অমলিন! অদ্ভুত গানও করতে পারতেন চণ্ডী দা; সে-প্রসঙ্গে আসছি;

কালোদার দোকান প্রতিবছর পৌষ মেলাতেও বসত, অমর্ত্য সেনও সেই মেলার দোকানেই যেতেন; সে-বছর, অমর্ত্য সেন নোবেল পেয়েছেন, ইন্টারভিউ নিতে বাইরে থেকে প্রচুর লোকজন আসছে, যথারীতি কালোর দোকানেও লোকজন চণ্ডীদার ইন্টারভিউ নিচ্ছেন, অমর্ত্য সেন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছেন।

চণ্ডীদা ভীষণ স্মার্ট ছিলেন, সব প্রশ্নেরই উত্তর দিতেন, যা জানতেন না সেটাও কল্পনায় উড়িয়ে দিতেন, তো একজন জিজ্ঞেস করলেন, অমর্ত্য সেন ফুটবল খেলতেন? চণ্ডীদার সটান জবাব! ও বাবা! ফুটবল! খেলতেন মানে! ‘ওর পা থিকে কেউ বলই কেড়ে লিতে পারত না’। এদিকে, অমর্ত্য সেন জীবনে ফুটবলে পা-ই ছোঁয়ান নি।

একবার নাট্যঘরে একজন ম্যাজিক দেখাতে এলেন, চণ্ডীদাকে অল্প ট্রেনিং দিয়ে সহকারী হিসেবে নেওয়া হল; অনেকে ভাবল, চণ্ডীদা বেশ ভাল রকম ম্যাজিক জেনে গেছে; আমার বন্ধু বকা, মজার ঘটনা ঘটাল! বকা, ভাল নাম সৌরীন বন্দ্যোপাধ্যায় , সে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাতি;  বকা চণ্ডীদাকে ধরে বসল, কিছু ম্যাজিকের কায়দা কানুন শেখানোর জন্য! এদিকে চণ্ডীদাও বলছে, সে কিছু জানে না, বকা আর ছাড়ে না!

—এহ তুমি চেপে যাচ্ছ!

শেষে চণ্ডীদা নিরুপায় হয়ে একটা মজা করে বসল, বকাকে বলল, আপনাকে একটা ম্যাজিক দেখাতে পারি, কিন্তু আপনি কিছু মনে করতে পারবেন না! বকা বলল, হ্যাঁ! নিশ্চয়!-নিশ্চয়! ম্যাজিক দেখাবে, মনে করব কেন!

চণ্ডীদা কালোর দোকানের বাইরে একটা গণ্ডি কেটে দিল, বলল, আপনি গণ্ডির মধ্যে দাঁড়ান, আমি এমন ম্যাজিক দেখাব, এই গণ্ডির বাইরে আপনি কিছুতেই বের হতে পারবেন না; বকা গণ্ডিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, দোকানে, ঝুড়িতে চপ, সিঙাড়া  রাখা থাকত, চণ্ডীদা দোকানে গিয়ে একটা চপ তুলে, বকার দিকে দেখিয়ে, বলতে শুরু করল, আয়-আয় তু তু তু তু…

এদিকে বকার একেবারে বোকা বনে যাওয়া অবস্থা!

মেলায় কালোর দোকান জমজমাট হত খুব। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, দেবব্রত বিশ্বাস— এঁরা সকলে মেলার দোকানে যেতেন; একবার মেলায়, আইসিএস সত্যেন রায় কালোদা-কে সম্বর্ধনা দিয়েছিলেন, কী মজার, কালোর দোকানে, ওর দোকানেরই মিষ্টি দিয়েই সম্বর্ধনা দেওয়া হচ্ছিল, অবনীন্দ্রনাথের দৌহিত্র শোভনলাল গঙ্গোপাধ্যায় একটা কবিতা লিখেছিলেন,‘ছিল কালো, হল লাল/ বলে গেল, শোভনলাল।’

শান্তিনিকেতনের সঙ্গে কালোর দোকানের স্মৃতি অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে! কালোর দোকানের আড্ডাবাজরা মিলে আমরা তৈরি করেছিলাম ‘সেঁজুতি’, প্রায় প্রতিবছর, মেলার পাশে ‘সেঁজুতি’রও দোকান দিই আমরা বন্ধুরা মিলে; আসলে স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করি, যে স্মৃতির পুরোভাগে রয়েছে, আড্ডা, বন্ধুতা! এবং কালোর দোকানের প্রতি আমাদের আবেগ।