ছায়াবাজি : পর্ব ২৪

দাসের পরিক্রমা

একেবারে প্রথমে দেখানো হয় একটা দীর্ঘ খাঁ-খাঁ প্রান্তর। তারপর অনেক ভেড়া। তারপর কিছু মানুষ, যারা কাঠের গুঁড়ি আর লোহার তার দিয়ে বেড়া তৈরির কাজ করছে। আচমকা একটা আর্তনাদ শোনা যায় এবং তারপরেই দেখা যায় একজন শুয়ে কাতরাচ্ছে, তার একটা হাত কাটা গেছে, বোধহয় বেড়ার ধারালো তার কাটতে গিয়ে। সে বার বার বলে, আমি ঠিক আছি, একটা হাত কাটা গেছে শুধু। কিন্তু ঘোড়ায় চড়া প্রহরী এসে পিস্তল বার করে, বলে, এ-জায়গায় একটা লোকের হাত না থাকা মানে একজন শ্রমিক কমে যাওয়া। এবং তাকে গুলি করে মেরে ফ্যালে। তারপর চেঁচিয়ে বলে, এই দেহটা গোর দেওয়ার জন্যে দুটো লোক চাই, বাকিরা কাজ করো। টানা-টানা চোখ ও কঠিন চোয়াল নিয়ে এই দৃশ্য দ্যাখে যে, সে-ই এই ছবির নায়ক, তার নাম সেগুন্ডো। সে একজন দো-আঁশলা লোক, আধা-শ্বেতাঙ্গ আধা-ইন্ডিয়ান। সে গোটা ছবি জুড়েই শুধু দ্যাখে, বিশেষ কথা বলে না। এই ভয়ানক হিংসার ঘটনায় আমরা একটু কেঁপে উঠি, বুঝতে পারি ছবির একদম গোড়াতেই লিখে দেওয়া ১৯০১ সালের চিলি-র এই জায়গায় এরকমটাই দস্তুর, সভ্যতার নিয়মকানুন বিশেষ নেই। তারপর আমরা দেখতে পাই শ্বেতাঙ্গ মালিক কিছুক্ষণ পরেই ওই প্রহরীকে (আমরা বুঝতে পারি সে নিছক প্রহরী নয়, একজন পরিদর্শক, নিয়ন্ত্রক) ডেকে বলেন, কিছু জায়গায় ইন্ডিয়ানরা বেড়া কেটে ভেড়াগুলোকে খেয়ে নিচ্ছে, তুমি আটলান্টিক অবধি আমার ভেড়াদের চালান করার একটা পথ একদম পরিষ্কার করে দাও (মানে, বিস্তৃত অঞ্চলে আদিবাসীদের মেরে অ্যাক্কেরে সাফ করো)। এই নিয়ন্ত্রক লোকটা, যে নিজেকে লেফটেন্যান্ট বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করে, সে সঙ্গে নেয় সেগুন্ডোকে (কারণ সেগুন্ডোর বন্দুকের টিপ অব্যর্থ), আর মালিক আরেকজনকে জোর করে সঙ্গে দিয়ে দেন, তার নাম বিল (তাকে মেক্সিকো থেকে আনা হয়েছে, সে ‘বহু মাইল দূর থেকে ইন্ডিয়ানদের গন্ধ পায়’)। সে অতি বদ, সর্বক্ষণ ক্যাটক্যাট করে কথা শোনায়। বিল সরাসরি সেগুন্ডোর প্রতি তার অপছন্দের কথা জানায় (কারণ ‘এদের বিশ্বাস করা যায় না, কখন কাকে গুলি করবে কিছু ঠিক নেই’) আর লেফটেন্যান্টও যে ঠিক কাজ করছে না— তাও জানিয়ে দেয়।

আমরা ভাবি স্প্যানিশ ভাষার ছবিটা (‘দ্য সেটলারস’, চিত্রনাট্য: ফেলিপে হাবেরলে, আন্তোনিয়া জিরারদি, মারিয়ানো লিনাস, পরিচালক: ফেলিপে হাবেরলে, ২০২৩) বোধহয় এই তিনজনের দিনের পর দিন পথ চলার মধ্যে দিয়ে তৈরি হওয়া সম্পর্ক নিয়ে গড়ে উঠবে। কিন্তু ছবি ঠিক সেদিকে যায় না। প্রথম যখন তিনজনকে ঘোড়ায় চড়ে যেতে দেখানো হয়, তা দেখানোর ধরন এবং পিছনে বেজে ওঠা বাজনা— এগুলো মিলিয়ে মনে হয় বোধহয় একটা জমজমাট ওয়েস্টার্ন ঘনিয়ে উঠছে, যেখানে তিন কমরেড তাদের পারস্পরিক প্রচুর অপছন্দ ও বিদ্বেষ সত্ত্বেও কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে লড়বে, রোমহর্ষক অ্যাডভেঞ্চারে জড়িয়ে পড়বে। কিন্তু ছবি সেদিকেও যায় না। বরং কিছুক্ষণ পর যখন একটা দৃশ্যে দেখানো হয়, আদিবাসীদের খটাস-খটাস করে গুলি করে মারা হচ্ছে, তখন হত্যার মধ্যে দিয়ে কোনও বীরত্ব নয়, দক্ষতা নয়, স্রেফ নীচতা ও অমানবিকতা ফুটে ওঠে। কয়েকটা লোক চুপ করে বসে আছে, আচমকা তাদের গুলি চালিয়ে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে, এর চূড়ান্ত ইতর নিষ্ঠুরতা আমাদের সামনে উন্মোচিত হয়। এক-একটা গুলির শব্দ তার সমস্ত হিংস্রতাটা নিয়ে হাজির হয়, কারণ তার কোনও প্রতিরোধ নেই, কোনও ফিরতি-গুলি নেই, লোকগুলো নিরস্ত্র, নিরীহ, নিঃসহায়। বিল ও লেফটেন্যান্ট মারতে থাকে, সেগুন্ডো সঙ্গে যায়, কিন্তু সে তার ভাইবোনদের মারে না, বরং বিলকে মারার জন্য রাইফেল তাক করে, কিন্তু শেষ অবধি তা পেরে ওঠে না, শূন্যে গুলি করে ক্ষোভ মেটায়।

ছবিটার ক্যামেরা-কাজ খুব সুন্দর, আর সেই লাবণ্যের মধ্যে আধিপত্যকামী মানুষের বেধড়ক হিংসা আরও প্রকট হয়ে ওঠে, কিন্তু ছবির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল, বারে বারে প্রত্যাশার তোয়াক্কা না করে অন্য দিকে চলে যাওয়ার প্রবণতা। প্রথমে ভাবা হল ওয়েস্টার্ন, বর্বরদের বিষাক্ত তিরধনুকের সঙ্গে মাত্র তিনজন আলোকপ্রাপ্তের লড়াই, দেখা গেল তা নয়।

ছবি জুড়েই সেগুন্ডোর চোখ ‘আক্রোশ’-এর ওম পুরীর মতো ধিকিধিকি জ্বলতে থাকে, এক সময়ে তার ও পোষা ঘোড়ার চোখ পর্দায় কাট করে এবং একেবারে পাশাপাশিও দেখানো হয়, যেন দুই প্রাণী, যারা শৃঙ্খলিত ও অবাধ দৌড়ক্ষম, যারা মূক ও বন্য, দাসত্বের কারণে ভেতর-গুমরোনো অথচ আনুগত্যের শেকলও ভাঙতে অপারগ। সেগুন্ডোর ওই আয়ত চোখ মেলে সমস্ত দেখা, দেখতে থাকা, চোখের জমি জুড়ে নিরন্তর ঘৃণার ঝলকানি— শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের নজর এড়ায় না। ইন্ডিয়ানদের হত্যা করার পর যখন একটি বাঁচিয়ে রাখা আদিবাসী রমণীকে প্রথমে লেফটেন্যান্ট ও পরে বিল ধর্ষণ করে, তারপর সেগুন্ডোকে সে-কাজ করতে বলা হয়, সে বলে, থাক, আমার দরকার নেই, তখন লেফটেন্যান্ট তাকে বলে, তুই কি ভেবেছিস আমি তোর ওই চোখ দিয়ে সারাক্ষণ আমাকে বিচার করে চলাটা লক্ষ করিনি? তোর ভেতরকার আগুন আমি এক মুহূর্তে নিভিয়ে দিতে পারি, কারণ তোর নিয়তিই হচ্ছে অন্ধকার। আমি যখন তোকে সঙ্গম করতে বলব, করবি, যখন শ্বাস নিতে বলব, নিবি। সেগুন্ডো অবশ্য গিয়ে সেই রমণীকে গলা টিপে হত্যা করে। আরও ধর্ষণ থেকে বাঁচায়। আরও কিছু নিষ্ঠুরতা আছে ছবিটায়, কিন্তু ছবিটা অবাক করে দেয় আচমকা একলাফে সাত বছর এগিয়ে গিয়ে, যেখানে চিলির রাষ্ট্রপতি দেশের শতবর্ষ পালনার্থে যে-প্রকল্প গ্রহণ করেছেন, তার অঙ্গ হিসেবে একজন লোককে (দেশপ্রেমী বুদ্ধিজীবী) পাঠিয়েছেন শ্বেতাঙ্গ মালিক হোসে মেনেন্ডেজের কাছে, সে বলছে, আপনার অধীনস্থ লেফটেন্যান্টের বিরুদ্ধে প্রচুর অভিযোগ আছে, সে বহু আদিবাসীকে বন্য প্রাণীর মতো শিকার করেছে, কখনও তাদের খাবারে বিষ মিশিয়ে গোটা দলকে নিকেশ করেছে। হোসে বলেন, এসব হাবিজাবি খবরকাগজের তৈরি গল্পগাছা, সেই লেফটেন্যান্ট এখন মারা গেছে, লোকে তাকে হিংসে করে এসব রটাত। বুদ্ধিজীবী বলে, এইরকমও রটনা আছে: আপনি জনজাতির মৃত মানুষের একটি কর্তিত কান এনে দেখালে এক পাউন্ড দিতেন, আর মৃতা রমণীর জরায়ুর জন্যে দিতেন দু’পাউন্ড। (আমরা দেখেছি আদিবাসীদের মৃতদেহগুলো শুইয়ে বিল তাদের একটা করে কান কেটে নিচ্ছে)। হোসের মেয়ে এসবের প্রতিবাদ করে। কিন্তু পরে যখন হোসে ও বুদ্ধিজীবী মুখোমুখি, বুদ্ধিজীবী বলে, হোসে যে বিরাট মাইল-মাইল জমির মালিক (যা চিলি ও আর্জেন্টিনাময় বিস্তৃত), তার অধিকারের পুনর্নবীকরণের জন্য দরকার কংগ্রেসের অনুমোদন, আর তাদের কানে যে-সব কুকীর্তির কথা পৌঁছচ্ছে, এই মহান জাতির ভাবমূর্তির পক্ষে অসুবিধেজনক। সেগুলো ‘ভাল দেখায় না’, নন্দনতত্ত্বের পক্ষে ক্ষতিকর। সেইজন্যেই কিছু সাহায্যের দরকার। তারপর গোসের কাছে সন্ধান পেয়ে, পুলিশ নিয়ে তারা পৌঁছয় সেগুন্ডোর কাছে, তার কাছে কিছু স্বীকারোক্তি শোনে। কিন্তু সেগুন্ডোকে জেলে নিয়ে যায় না, সেগুন্ডো ও তার বউকে আপাদমস্তক ধোপদুরস্ত ভব্যিযুক্ত পোশাক পরিয়ে বসিয়ে, মুভি ক্যামেরায় ছবি তোলে। সেখানে তাদের চায়ের কাপে চুমুক দিতে বলা হয়। যেমন ভদ্র চিলিবাসীরা করে থাকে। সেগুন্ডোর স্ত্রী সেই আদেশ মানতে অস্বীকার করে, চায়ের কাপ তুলে চুমুক দেয় না, তাতে বুদ্ধিজীবী তর্জন করে ওঠে, আপনি এই জাতির অংশ হতে চান কি না?

ছবিটার ক্যামেরা-কাজ খুব সুন্দর, আর সেই লাবণ্যের মধ্যে আধিপত্যকামী মানুষের বেধড়ক হিংসা আরও প্রকট হয়ে ওঠে, কিন্তু ছবির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল, বারে বারে প্রত্যাশার তোয়াক্কা না করে অন্য দিকে চলে যাওয়ার প্রবণতা। প্রথমে ভাবা হল ওয়েস্টার্ন, বর্বরদের বিষাক্ত তিরধনুকের সঙ্গে মাত্র তিনজন আলোকপ্রাপ্তের লড়াই, দেখা গেল তা নয়। পরে ভাবা হল জনজাতির প্রতিনিধি সেগুন্ডো অত্যাচারী শ্বেতাঙ্গদের ওপর প্রতিশোধ নেবে, বা ইন্ডিয়ানরাই একদিন সদলে এসে এই অত্যাচারীদের নিকেশ করবে, দেখা গেল তা হল না। যখন মনে হচ্ছে গল্পটা কোনদিকে যাবে রে বাবা, তখন এতক্ষণের চলন পুরো এড়িয়ে শ্বেতাঙ্গ মালিকের বাড়ির দৃশ্য আমদানি হল, যার মেয়ে বুদ্ধিজীবীকে বলল, আপনারা ওখানে বসে-বসে রাজনীতি করেন, কিন্তু আমাদের কাজ করতে হয়। কথাটার মানে দাঁড়ায়, কাজ সুষ্ঠু করার জন্য যত আদিবাসী মারতে হয়, মারব। এও জানা যায়, আমরা এতক্ষণ পর্দায় যাকে দেখছিলাম, সে মরে গেছে। আর সেগুন্ডোর মুখ থেকে একটু পরে জানা যায়, তারা কীভাবে আদিবাসীদের নেমন্তন্ন করে খাইয়েছিল, তারপর শ্রান্ত ও তৃপ্ত আদিবাসীরা যখন প্রচুর খেয়ে বিশ্রাম করছে, তাদের গুলি করে মেরেছিল। মানে, যে-সেগুন্ডোর ক্ষমাহীন নেত্রদ্বয় দেখে আমরা ভেবেছিলাম, এ একদিন-না-একদিন জ্বলে উঠবে ও ভাইবেরাদরদের হয়ে রুখে দাঁড়াবে, তার প্রতিবাদের ভাষা প্রতিরোধের আগুন ছিন্নভিন্ন করবে শত ষড়যন্ত্রের জাল, যে-সেগুন্ডো প্রথম হত্যালীলায় কোনও অংশ নেয়নি, সেই লোক পরে প্রভুর আদেশ মেনে স্বজন-হত্যা করেছে। আর তারপর, যখন তাকে ও তার বউকে পোশাক-আসাকে আড়ষ্ট পুতুল বানিয়ে চলচ্ছবি তোলা শুরু হয়, এবং এই নয়া-প্রভুদের আদেশ শুনে, তাদের ঔদ্ধত্য ও জোর-খাটানো দেখে সেগুন্ডোর বউয়ের ঠোঁট ক্রোধে কান্নায় অপমানে পরাজয়ে কাঁপতে থাকে, আমরা বুঝতে পারি, এরা কোনওদিনই স্বাভাবিক জীবন পাবে না, তাদের জমি কেড়ে নিয়ে হত্যা করা হবে, অথবা মহান জাতির ‘অন্তর্ভুক্ত’ করে নেওয়া হবে সেই জাতির ক্ষমতাবানদের নিয়ম ও ইচ্ছা অনুযায়ী। এই রাষ্ট্রের ইমেজ ও ‘অপটিকস’ যাতে ঠিক থাকে তা নিশ্চিত করতে গেলে, আদিবাসীকে পরতে হবে আঁটো ও অস্বস্তিকর পোশাক, চুমুক দিতে হবে অনভ্যাসের পানীয়ে, নইলে, বাইরে পুলিশ দাঁড়িয়ে রয়েছে, তারা অন্য শিক্ষার বন্দোবস্ত করবে। তাই নতুন দেশের জনতার মিলেমিশে থাকার সমীকরণে জনজাতির সরল গণিত স্রেফ এ-ই: হয় ঠ্যাঙাড়ে তাকে মারবে, নয় বুদ্ধিজীবী তার নিজস্বতা হরণ করবে। হয় বন্দুক তাকে লোপ করবে, নয় ক্যামেরার নজর-চক্ষুতে বন্দি হয়ে, সে যা নয়— তা-ই বলে চির-প্রতিভাত হবে। যখন ক্ষমতার মূল পেশিটা বারুদের জোর থেকে বুদ্ধির জোরে বদলেও যাবে, তার শোষণটা বদলাবে না। ওরা কান কাটত, এরা দু-কানকাটা করে বলবে আমাদের দলে ভিড়ে পড়ো, নইলে রইলে।

অসহায় সেগুন্ডোর অগ্নিবর্ষী চোখ বা তার স্ত্রীর অনিচ্ছুক ওষ্ঠ কোনও মীমাংসাই করতে পারবে না, প্রভুর সহায়ক, অনুকারী, তাঁবেদার হয়ে তাদের চেষ্টা করতে হবে ক্রমাগত প্রভু-প্রভু খেলার, তার জন্য নিজের আত্মীয় বা সংস্কৃতির বুক ফুঁড়ে দিতে হবে প্রায়ই, আবার সে-অভিমান ও অপরাধবোধও লালন করতে হবে নিজ হৃৎপিণ্ডে চোঁয়ানো ঘা হিসেবে, এক দো-আঁশলা অস্তিত্বে ও যাপনে দণ্ডিত থাকতে হবে চিরকাল, কারণ, গতাসু লেফটেন্যান্টের জ্বলজ্বলে কথানুযায়ী, শ্বাসও তো শেষ অবধি প্রভুর ইচ্ছাধীন।