আমার ‘পথসেনা’

১৯৭৯ সাল। জনা পাঁচ-ছয় সদ্য পড়াশোনা শেষ করা, চাকরির ইন্টারভিউ দেওয়া যুবক। প্রতি সন্ধেতে লাগাতার গুলতানি, চার-পাঁচ রাউন্ড চা। হলুদ সুতোবাঁধা বিড়িতে টান, মাঝে মাঝে ফিল্টারলেস চারমিনার সিগারেটে ঘন-ঘন চুমু। তর্ক, ঝগড়া, ক্রিকেট, ফুটবল, রাজনীতি, খিস্তি, একঘেয়েমি, নরক গুলজার। এইভাবেই, আড্ডার ছলেই জন্ম হল পথসেনা-র! মফস্‌সল শহর কাঁচরাপাড়ার একমাত্র অঙ্গনমঞ্চ নাটকের দল। খুঁজতে-খুঁজতে খুঁজে পাওয়া। নিজেদের মতো করে একটা ঠেক, একটা ঠিকানা!

আরও পড়ুন: সুব্রত মিত্র থেকে প্রতিমা বড়ুয়া, গৌতম চট্টোপাধ্যায় থেকে জয়দেব বসু— ২৯সি ছিল এক তীর্থসম বৈঠকখানা! লিখছেন সার্থক রায়চৌধুরী…

মাত্র দু’বছর হল রাজ্যের রং সবুজ থেকে লাল হয়েছে। উনিশশো উনআশি! কেমন যেন মনে হতে শুরু করেছে, প্রত্যাশা বোধহয় পূরণ হচ্ছে না। খানিকটা স্বপ্নভঙ্গ, আবার স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখা— একটা দোদুল্যমানতা, একটা দোলাচল। ছোট্ট শহর কাঁচরাপাড়াতে তখন জ্বলজ্বল করে বিরাজ করছে সাত-আটখানা প্রসেনিয়াম থিয়েটারের দল। না, নিজেদেরকে কেমন যেন মেলানো যাচ্ছে না তাদের সঙ্গে। নিয়ম-নিষ্ঠার শৃঙ্খলা মেনে একজন নির্দেশক, একটা দম-আটকে-আসা শৃঙ্খলা, কেমন যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলতে চাইছে। নির্দেশককে মান্যতা দিতে একটা দূরত্ববোধ। তিনি বসছেন একটা চেয়ারে, সামনে টেবিল। বাকিরা বসছে বেশ কিছু দূরে, কতগুলো বেঞ্চে অথবা চেয়ারে। বিষয়বস্তুও কেমন শাসক দলকে তুষ্ট রাখার গল্প। না, এভাবে নয়। আমরা ছোট থাকব কিন্তু সবাই একরকম থাকব; সবাই সমান থাকব, কেউ বিশেষ হব না, কেউ বিশিষ্ট হব না, কেউ আলাদা হব না। আমরাই লিখব আমাদের নাটক, নির্দেশনা দেব সবাই মিলে, তর্ক করব, বিষয়বস্তু নিয়ে কাটাছেঁড়া করব, আড্ডার মেজাজটা অক্ষুণ্ণ রেখে একটা গঠনমূলক কিছু করব। কী হবে, কতটা হবে জানি না! আমরা বরং খুঁজে নিই আমাদের মতো করে আমাদের চলার রাস্তা!

দু’হাজার পঁচিশ। ছেচল্লিশ বছর অতিক্রান্ত! সবিনয়ে বলছি, আজও এই একই ধারা অব্যাহত। কেউ বিশিষ্ট হয়নি, কেউ বিশেষ হয়নি। আমরাই লিখেছি আমাদের নাটক। নিয়মের ফাঁস কোনওদিন গলায় চেপে বসতে দিইনি আমরা। এই ছেচল্লিশ বছরে এমন অনেক দিন গেছে, অনেক সন্ধে গেছে, যখন কেবল আড্ডাই মেরেছি। প্রসেনিয়াম থিয়েটার দলগুলোর মতো আমাদের টার্গেট পয়েন্ট ছিল না। প্রতিযোগিতার এই পিছল পথ আমরা সযত্নে এড়িয়ে, সহযোগিতার পথে হেঁটেছি। আড্ডা দিতে-দিতে, ইচ্ছেখুশির পাল তুলে দিয়ে খেয়ালখুশির ভেলায় চড়ে আমরা কাটিয়ে দিলাম এতগুলো বছর!

থিওসফিক্যাল সোসাইটি হলে নাটক ‘ভোমা’

দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় বছরেই আমরা খোঁজ পেলাম বাদল সরকার নামক এক মানুষের। থিয়েটারকে চার দেওয়ালের ঘেরাটোপ থেকে বের করে নিয়ে এসেছেন তিনি আরও সাত-আট বছর আগে। এনেছেন মুক্ত থিয়েটারের ভাবনা, এনেছেন থিয়েটারকে মানুষের কাছে নিয়ে যাবার ভাবনা। ব্যাস, আমাদের আর পায় কে! খুব সহজেই গাঁটছড়া বেঁধে ফেললাম আমরা সেই মানুষটার সঙ্গে! বছরের পর বছর ধরে, দশকের পর দশক ধরে চলল থিয়েটারের মান, উপস্থাপনার পদ্ধতি, আঙ্গিক ইত্যাদির সঙ্গে জীবনের যাপনকালকে আরও সহজ করা, আরও আটপৌরে করা, আরও ঋজু করা, আরও মজবুত করার প্রক্রিয়া। হ্যাঁ, আড্ডার মেজাজেই, গোল হয়ে বৃত্তাকারে বসে। চা-বিড়ি খেতে-খেতে। দুপুরে রুটি-তড়কা, কখনও মুরগির ঝোল সহযোগে; মানুষটার পাঠে, মানুষটার কণ্ঠে। সেই বিশাল মাপের সহজতার কাছে, অনায়াসে সহজ হতে পেরেছি আমরা, সেই আড্ডার মেজাজেই!

কার্জন পার্কে নাটক ‘স্পার্টাকাস’

কৈশোর থেকে যৌবনে যেতে-যেতে, আমরা জেনেছি খালাসিটোলার কথা; শুনেছি কফি হাউসেরর কথা। দেখেছি কত কালজয়ী সৃষ্টি হয়েছে এই আড্ডাগুলো থেকে! ‘অন্যপক্ষ’ কিংবা ‘শত্রুপক্ষ’ বলে যখনই কেউ দেগে দিয়েছে, পরোয়া করিনি আমরা। হেঁটেছি আমাদের মতো করেই। আমাদের গ্রাম-পরিক্রমা, আমাদের কর্মশালা— এই বিষয়গুলোর সঙ্গে যাঁরা সরাসরি সংযুক্ত, তাঁরা জানেন! বর্ণনা দিয়ে তা বোঝানো সম্ভব নয়। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিলে হয়তো খানিকটা বোঝা যাবে! আমাদের কর্মশালা, পরিভাষায় যাকে ‘ওয়ার্কশপ’ বলা হয়, এটা প্রসেনিয়ম থিয়েটারের থেকে একেবারে আলাদা। এখানে কোনও দর্শক-পরিদর্শক ঢুকতে দেওয়া হয় না। সকাল ন’টা থেকে বিকেল পাঁচটা অব্দি চলে কতগুলো পাগলের হাত-পা ছোড়া পাগলামি। একটা মূল মন্ত্র মাথায় রেখে— ‘উই আর অল আনসেফ দ্যাট মিনস উই আর অল সেফ!’ দর্শনে সমৃদ্ধ হয়ে, আদর্শে জারিত হয়ে, এই পাগলামির মেজাজে আড্ডা অথবা আড্ডার মেজাজে পাগলামিকে সঞ্জীবনী করেই হেঁটে গেলাম পঞ্চাশ বছর! হেঁটে যেতে চাই আরও হাজার বছর…