সামথিং সামথিং : পর্ব ৬৩

Article about Charlie Hebdo genocide and controversy

শার্লি এবদো পারলি বটে

হাসির ব্যাপার সর্বত্র ঘটছে, আর ফোনে ফেসবুকে সতেরোশো চুটকি আঠেরো হাজার ক্রোশ ছড়াচ্ছে তিন সেকেন্ডে। রাজনীতির লোকেরা এখন কড়া হাসির আওতায়, মোদী মমতা নিয়ে হাসাহাসি যত, তার দেড়া খিলখিলের জন্যে লোকে তৈরি, ট্রাম্পের জমানা ফের শুরু। বাচ্চারা বলছে বড় হয়ে স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ান হবে, আর কে না বাসিমুখে ষাটটা হোয়াটসঅ্যাপ-ঠাট্টা ফরওয়ার্ড করে? বিশাল মজাম্যাপে হরেক রকম কমেডি, কোনও হাসাহাসি সরাসরি অভদ্রতা, অপমান, অন্যায় ছাড়া কিছুই নয়, আবার কোনও হাসিকে একটা শিবির গাল দিলেও অন্য শিবির মাথায় তুলে নাচিতং।

অবশ্য কেউ বলতেই পারে, আজ যাকে কদর্য মনে হচ্ছে কাল মূল্যবান মনে হবে, কেউ জিজ্ঞেস করবে ডিসটার্ব-ই যদি না-করবে তবে কমেডি হয়ে জম্মাবে কেন? বেশ কিছু মজার মূল উপাদান: শ্লেষ, যা ব্যক্তি বা সমাজের চ্যুতির ঘাড়ে আছড়ে পড়ে, আর কখনও মজাকারীর ঘাড়ে ফিরতি আছড়ায় বদ-সংগঠনের চাপাতি বা বুলেট।

কার্টুন- জ্যাপিরো

বছরদশেক আগে ‘শার্লি এবদো’র দফতরে দুই উগ্রপন্থী হামলা করেছিল। শার্লি এবদো একটা ফরাসি সাপ্তাহিক ব্যঙ্গ-পত্রিকা, যার উদ্দেশ্যই বহু প্রতিষ্ঠিত মৌচাকে ঢিল ছোড়া, কোনও কিচ্ছুকেই তারা বিদ্রুপের মুঠোর বাইরে মনে করে না, ডোন্ট-পরোয়া ও বেড়াহীন স্বাধীনতার রোখ নিয়েই চলে। ২০১৫ সালের ৭ জানুয়ারি দুই মুসলিম উগ্রপন্থী (তারা আবার ভাই) তাদের দফতরে হানা দিয়ে ১২ জনকে খুন ও ১১ জনকে আহত করে, কারণ পত্রিকায় মহম্মদের কার্টুন প্রকাশিত হয়েছিল। অনেকেরই সে-কাণ্ড মনে আছে, কারণ সাধারণত অমুক গোষ্ঠী তমুক জাতি সমুক ক্লাব ‘উফ দাদা বড্ড লেগেছে এবার হতচ্ছাড়াকে ব্যান করো’ রবে চিলচিৎকার মচালেও, এমনকী, ক্রুদ্ধ ঢিল-পাটকেল খিস্তিখামারি হানলেও, একেবারে ধাঁইধপাধপ গুলি চালিয়ে দেয় না।

সিরিয়াস লেখক বা যুক্তিবাদী খর-কলমচি কিংবা গ্যাঁট বিরুদ্ধবাদীকে মিছিল বাগিয়ে রাজ্যছাড়া করলেও, কমেডিয়ানের ভাগ্যে অতটা গুরুত্ব জোটা বিরল। কিন্তু কয়েকজন খ্যাত কার্টুনিস্ট গুলি খেয়ে মারা গেলেন ওই হানায়, আর কিছু লোক বেশ নার্ভাস হয়ে বলাবলি করল, ‘পত্রিকাটারও বলিহারি। এত বাড়াবাড়ির কী দরকার ছিল?’

সেই ঘটনার ১০ বছর পূর্তি উপলক্ষে শার্লি এবদো এখন কী করল? তারা কি বলল, ‘আহা একটি শান্তি-স্বস্ত্যয়ন করা যাক’? কিংবা ‘সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধায় মম ঘাড়ের পেশি শিথিল হয়ে মাথা কেমন আপনি নুয়ে আসছে দ্যাকো’? কিংবা ‘দেবতা মহান, আমরা সাষ্টাঙ্গ, এবার গাঁট্টা মেরে যাক ভক্ত-সাঙ্গোপাঙ্গ’?

উঁহু, অ্যাক্কেরে উল্টো। পত্রিকাটি একটি প্রতিযোগিতা আহ্বান করল: যে কোনও ভগবানের কার্টুন এঁকে পাঠান। সেটা যেন হয় ‘funny and mean’, মজাদার এবং তীব্র উপহাসময়। এই হচ্ছে কমেডিয়ানের স্পর্ধা। কোথায় ভয় পেয়ে থরথরাবে ও ভবিষ্যতে ঈশ্বরাঞ্চল মাড়াবে অবধি না, অথবা একপিস সাদা ন্যাকড়া জোগাড় করে শান্তিপ্রস্তাব প্রচারিবে দুরুদুরু পাঞ্জায়, তা না, তারা ঘটা করে ওই আক্রমণের দশম বার্ষিকী পালন করছে খর খোঁচা মেরে: দ্যাখ ব্যাটা, শুধু একটা ধর্মকে নয়, পারলে এবার দশটা ধর্মকে আঘাত করব।

কেউ বলতে পারে, ইচ্ছে করে ফের অশান্তি পাকাচ্ছিস কেন? সাঁকো নাড়াচ্ছিস কেন? উত্তরে পত্রিকা, বা তার সদস্য বিদূষক, গর্বিত ভাঁড়, কেলেঙ্কারিময় ক্লাউন বলবে, হুবহু ওইটাই তো আমার কাজ, আমার উদ্দেশ্য। জ্বালাতন। যেখানে মনে হবে ভুল হচ্ছে, অন্যায় ঘটছে, বা ভয়ের চোটে মিনমিনে নীরবতা বিরাজ করছে, সেখানে দংশাব আর চিমটাব। শুধু তা নয়, যেখানেই মনে হবে মজার সুযোগ আছে, মজা করব, ঝাঁকুনি দেব। বাকস্বাধীনতার কোনও সীমা থাকতে পারে না, সেই অধিকারের ডগায় কোনও তারাচিহ্ন দিয়ে মিনি-হরফে ‘শর্তাবলি প্রযোজ্য’ লেখা যায় না। যদি ক-কে নিয়ে ব্যঙ্গ করা যায়, তবে খ-কে নিয়েও যাবে। যে বলবে, আর যা-ই করো আমার আরাধ্য বা আদরণীয়কে নিয়ে কিচ্ছুতেই তামাশা গজানো চলবে না, তার উদ্যত তর্জনীকে হাসির হররায় ইয়ার্কির গররায় কাদামাঠের সুপার-সররায় উড়িয়ে নিয়ে ফেলব পগারের পারে। অচলায়তন আমার সর্বাধিক শত্রু, অসহিষ্ণুতাকে আমি অপরাধ বলে মনে করি। রসিকতাকে নিষিদ্ধ করা, বা গায়ের জোরে বিদ্রুপের অধিকার নাশের চেষ্টাকে চরম অসভ্যতা বলে ঠাওরাই, তাই তাকে আঘাত করব। বোঝাব, অসির চেয়ে মসী বড়, অন্তত অসির সামনে দাঁড়িয়েও মসী নির্ভীক, অসির মহড়া নিতে, ঝুঁকি নিতে তৈরি। সত্যি, কমেডিয়ান তো ফিরতি গুলি করতে পারে না। কিন্তু সে পুনরায় তার প্রসন্নতা ও ক্রোধ গোল্লা-পেপারওয়েটের ন্যায় টেবিলে সাজিয়ে ল্যাম্পের জ্যোতিবৃত্তে লিখতে-আঁকতে বসতে পারে। যুদ্ধে যেতে পারে না, কিন্তু ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ বানাতে পারে। মৌলবাদী গামবাট বন্দুক চালিয়ে সেন্সরসিপের চূড়ান্ত করেছিল, এবার পত্রিকা দশগুণ ঠ্যাঁটা হয়ে জানাল, যারা বেঁচে যায় তারা মৃতের মতো ঘাড় গুঁজড়ে থাকার সিদ্ধান্ত সবসময় নেয় না। 

সিরিয়াস লেখক বা যুক্তিবাদী খর-কলমচি কিংবা গ্যাঁট বিরুদ্ধবাদীকে মিছিল বাগিয়ে রাজ্যছাড়া করলেও, কমেডিয়ানের ভাগ্যে অতটা গুরুত্ব জোটা বিরল। কিন্তু কয়েকজন খ্যাত কার্টুনিস্ট গুলি খেয়ে মারা গেলেন ওই হানায়, আর কিছু লোক বেশ নার্ভাস হয়ে বলাবলি করল, ‘পত্রিকাটারও বলিহারি। এত বাড়াবাড়ির কী দরকার ছিল?’

প্রতিযোগিতার আহ্বান জানিয়ে পত্রিকা বলেছে, আপনি কি ভগবান ও ধর্মের শাসনে চলা একটা সমাজে বাস করে ক্লান্ত? বা, যে ধর্মান্ধ স্বৈরাচারীরা আমাদের জীবন নিয়ন্ত্রণ করে, তাদের প্রতি বিরক্ত? প্রশ্নগুলো চমৎকার, এবং কিছু সমাজের ক্ষেত্রে হাড়ে-হাড়ে সুপ্রযুক্ত। সেই সমাজে ধর্ম ও ধর্ম-ঠ্যাঙাড়ের অত্যাচার যখন শিগগির থামছে না (এবং মানুষের নিগ্রহ অন্য অপেক্ষাকৃত মুক্তমনা সমাজের মানুষকেও পীড়িত করছে), তখন তাকে নিয়ে কার্টুন এঁকে কিছুটা গায়ের জ্বালা মেটাতে হবে, আর তিন-চারটি  ধাক্কা মারতে হবে। প্রতি-ধাক্কার সম্ভাবনা অবশ্য শুধু প্রবল নয়, প্রায় নিশ্চিত, কারণ যত দিন যাচ্ছে পৃথিবী একটু বেশিই গোঁড়া ও কুচুটে-তর এবং একটা তো নয়, সব ধর্মই হিংসা ও লাঠিবাজির আখড়া। তাদের ভগবানকে অপমান করলে তারাই বা ছাড়বে কেন। এদিকে একটা ব্যঙ্গ-পত্রিকার কাজই প্রতিষ্ঠানকে আঘাত করা, যা-কিছু প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে বলেই চির-প্রতিষ্ঠিত থাকবে ভাবছে, বা তার প্রতিষ্ঠিত থাকা উচিত— কথাটাকে স্বতঃসিদ্ধ ধরছে, তাকে কৌতুকের শলাকায় চিরে দেখা ও দেখানো। তবে কি ফের শুরু হবে ঝঞ্ঝাট? বেশি দারোয়ান মোতায়েন করতে হবে পত্রিকার অফিসে এবং তাদের দিতে হবে ইয়া ইয়া দশ-ফুট লম্বা ঢাল? না কি এই দৃঢ়তা পুষতে হবে যে আরও গুলি খেলে আরও কার্টুন? দেখা যাক। ২০১১, ২০১৫ এবং ২০২০-তে যে-পত্রিকা উগ্রপন্থী হানা সয়েছে, এবং এতটুকু মচকায়নি, সে তো সতত তৈরিই। 

বাংলা ব্যঙ্গ-পত্রিকা ‘অচলপত্র’ প্রকাশিত হওয়ার পর আশাপূর্ণা দেবী মোটের ওপর প্রশংসা করেই একটি চিঠি লেখেন, যেখানে লিখছেন, ‘তবে নির্দোষ হাস্যরসাত্মক পত্রিকা প্রকাশ করতে পারা সহজ নয়। …কারণ, রঙ্গ এবং ব্যঙ্গের, পরিহাস এবং উপহাসের সীমারেখাটা এত সূক্ষ্ম যে, লঙ্ঘন হয়ে যেতে দেরী হয় না। …রসালো এবং ঝাঁজালো ভাষায় পরনিন্দায় পঞ্চুখ হবার মধ্যে আর যাই হোক কৃতিত্ব নেই।’ এর উত্তরে পত্রিকার সম্পাদক দীপ্তেন্দ্রকুমার সান্যাল তাঁর বক্তব্য জানাতে লিখলেন, ‘…যে নির্দোষ আনন্দের কথা তিনি বলেছেন তা শিশুপাঠ্য বই ছাড়া আর কোথাও নেই।

‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ ছবির একটি দৃশ্য

লরেল-হার্ডির রসিকতা নির্দোষ বটে,তবে তা ভাঁড়ামোরই নামান্তরমাত্র। চার্লি চ্যাপলিনের সমাজ ও ব্যক্তির প্রতি ব্যঙ্গ উদ্দেশ্যবিহীন নয়। যে-হাসির পেছনে গভীর বেদনা প্রচ্ছন্ন নেই, নেই কোন সুতীক্ষ্ন বিচিত্র বিদ্রূপ, তা শুধুই হাস্যকর।’ এই কথাটা টকাস করে বলে দেওয়া দরকার। নির্মলহাস্য অনেকের পছন্দ, কারণ তার মধ্যে কোনও আঘাত নেই, বিপদও নেই। তার মূল্য নির্ঘাত আছে, কিন্তু শুধু সেখানে হাস্যরস থেমে থাকলে মুশকিল। কাউকে যা চটায় না, তা খুব বেশি কিছু ঘটায়ও না। আর সেই প্রবণতার মধ্যে বহমান বাস্তবের প্রতি স্বেচ্ছা-উপেক্ষাও আছে, যা জাগ্রত কৌতুকবান বা মজা-পত্রিকাকে বেশিক্ষণ প্রাসঙ্গিক থাকতে দেয় না। তার সচেতনতা ও পর্যবেক্ষণ নিয়েও সন্দেহ হয়। ব্যঙ্গ-পত্রিকা জন্মায় আনন্দ দেওয়ার জন্য তো বটেই, কিন্তু একই ওজন ও তীব্রতায় আঘাত করার জন্য, অস্বস্তিতে ফেলার জন্য, বেয়াড়া প্রশ্ন করার জন্য। ‘রসালো এবং ঝাঁজালো ভাষায়’ ভুলগুলোকে টান মেরে নগ্ন করারই জন্য। এবং তা-ই পত্রিকাকে গুরুত্বপূর্ণ করে। সেই কর্তব্যগুলোকে এড়িয়ে শুধু পবিত্র খিলখিলের দিকে হেলেদুলে গাড়ি চালালে, ঠিক স্টেশনে নীতিদৃষ্টি ভিড়বে না, এক পৃথিবীর ভুলচুক হয়ে যাবে।