ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • উত্তরবঙ্গ ডায়েরি: পর্ব ১২


    সুমনা রায় (Sumana Roy) (February 5, 2022)
     

    আগুন-পাহাড় দার্জিলিং

    আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে ছিল প্রীতি। আমাদের ডিপার্টমেন্টে এসে যখন ভর্তি হয়, আমি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি শেষ করে যাব-যাব করছি। প্রীতির সৌন্দর্য কিন্তু তার সুন্দর চোখ বা নিখুঁত ঠোঁটে সীমিত ছিল না— এই সুন্দর মুখটা তৈরি হয়ে উঠেছিল ওর পরিবারের ইতিহাসের ঔজ্জ্বল্যে। আর ইতিহাসের দ্যুতিতে প্রীতি হয়ে উঠেছিল অসামান্যা সুন্দরী। অবশ্য আমি যাকে ‘সৌন্দর্য’ বলছি, সেটা হয়তো ‘ইন্টারেস্টিং’-এর একটা প্রতিশব্দ— এই সৌন্দর্যকে আরো একটু জানতে চাওয়ার কৌতূহল। 

    যে-বইটা আজ হাতে ধরে আছি, সেটার প্রথম খসড়া পড়ে মনে হয়েছিল, অবশেষে, দু-দশক পেরিয়ে, আমি প্রীতির ইতিহাস সম্বন্ধে কিছু ধারণা করতে পেরেছি। ‘রতনলাল ব্রাহ্মণ: আ রেড লায়ন অফ দ্য হিল্‌স’ যদি শুধুই ব্যক্তিগত ইতিহাসের গল্প হত, তা নিয়ে আমি এখানে লিখতাম না। কিন্তু প্রীতির এই বই দার্জিলিং পাহাড়ের ইতিহাসের এমন একটা দিক নিয়ে লেখা, যা নিয়ে সচরাচর আলোচনা হয় না। এমন একটা সময়ে যখন আমরা আমাদের প্রতিবেশীর ইতিহাস প্রায় ভুলতে বসেছি, এই বইটা মূল্যবান হয়ে ওঠে।    

    দার্জিলিং পাহাড়ে ‘মাইলা বাজে’ নামে পরিচিত রতনলাল ব্রাহ্মণ, প্রীতির পিতামহ। দার্জিলিং-এর রাজনৈতিক ইতিহাসে যুগান্তকারী ব্যক্তিত্ব রতনলালের জন্ম ১৯০০ সালে, ভিক্টোরিয়া ফল্‌স ব্রিজ-এর কাছে ভাক্তে বস্তিতে। প্রীতি অবশ্য এই মুহূর্ত থেকে বইটা শুরু করেন না; তাঁর ঠাকুরদার জীবনী শুরু হয় রতনলালের শেষ বয়স থেকে, যখন পৃথক রাজ্যের দাবি নিয়ে গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন তুঙ্গে।       

    ‘দীর্ঘ ছায়ার মাস হিসাবে মনে আছে সময়টা,’ প্রীতি শুরু করে, এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই, আমরা ‘ফায়ার! ফায়ার!’ রব এবং কোলাহলের মধ্যে ঢুকে পড়ি। বাড়িতে আগুন লেগেছে বা লাগানো হয়েছে; বাড়ির বাকি লোকেদের সঙ্গে প্রীতির তুতো-ভাই কুন্দন দাজুর সেই আগুন ‘নেভানোর প্রচেষ্টা বারবার ব্যর্থ হচ্ছে’, বাড়ির ‘একমাত্র ল্যান্ডলাইন টেলিফোন’ কাজ করছে না। দার্জিলিং-এর অধিবাসী এবং প্রবল পরাক্রমী রাজ্য সরকারের মধ্যে টান-টান উত্তেজনা এক লহমায় দৃশ্যমান। কী দেখেছিলেন দশ বছরের প্রীতি?  

        

    বিস্মিত, অসহায় অবস্থায় আমরা দাঁড়িয়ে যেন মনে-মনে চিৎকার করছিলাম। কিছুক্ষণ পর, পাহাড়ের আরো একটু নীচে আমার পিসির বাড়ির জানালা থেকে আমরা দেখেছিলাম কীভাবে ওই ক্রুদ্ধ আগুন তার ভয়াবহ ক্ষিদে নিয়ে আমার ঠাকুরদার বাড়িকে একটু-একটু করে গ্রাস করেছিল, যে-বাড়িটা একটা গোটা জীবন ধরে বানানো। চোখে জল নিয়ে শুধু একটাই কথা মনে হচ্ছিল—‘ঠাকুরদা এখানে থাকলে এটা হতে দিতেন না’।’    

    ‘ইউনিফর্ম-পরা কিছু লোক কয়েক গজ দূরে দাঁড়িয়ে… বাড়ির এক প্রান্তে একটা হলঘরে কয়েক ডজন এ-রকম ইউনিফর্ম-পরিহিত পার্সোনেল ছিলেন, কিন্তু কেউ একবারও সক্রিয়ভাবে আগুন নেভানোর কাজে হাত বাড়াননি… বিস্মিত, অসহায় অবস্থায় আমরা দাঁড়িয়ে যেন মনে-মনে চিৎকার করছিলাম। কিছুক্ষণ পর, পাহাড়ের আরো একটু নীচে আমার পিসির বাড়ির জানালা থেকে আমরা দেখেছিলাম কীভাবে ওই ক্রুদ্ধ আগুন তার ভয়াবহ ক্ষিদে নিয়ে আমার ঠাকুরদার বাড়িকে একটু-একটু করে গ্রাস করেছিল, যে-বাড়িটা একটা গোটা জীবন ধরে বানানো। চোখে জল নিয়ে শুধু একটাই কথা মনে হচ্ছিল—‘ঠাকুরদা এখানে থাকলে এটা হতে দিতেন না’।’    

    স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে, বিশেষত বিগত চল্লিশ বছরের দার্জিলিং-জীবন নিয়ে ভাবলে যেন বাড়ি পুড়ে যাওয়ার এই ঘটনাটা একটা মেটাফর হয়ে ওঠে। ‘জীবন এবং সংস্কৃতি-সমৃদ্ধ বাড়িটাতে আগুন লাগানোর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল এই সবকিছুকে ধ্বংস করে দেওয়া। ঠাকুরদা আমাদের একটা ব্যবহারিক, যুক্তি-বুদ্ধি-সঙ্গত সংস্কৃতিতে বড় করে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর একমাত্র ধর্ম ছিল হিউম্যানিজম, মানবতাবাদ’। বইয়ের ভূমিকায় যেমন রতনলালের বিষয়ে কৃষ্ণ সিংহ মোকতান লেখেন, ‘মাইলা বাজে ছিলেন প্রথম বিধায়ক যিনি চিরাচরিত নেপালি বেশে, অর্থাৎ দাউরা-সুরুয়াল এবং খুখুরি পরিধানে, বেঙ্গল লেজিসলেটিভ অ্যাসেমব্লিতে প্রবেশ করেন… রাজ্যসভার সদস্য হিসাবে নেপালিতে নিজের স্বাক্ষর করেন পার্লামেন্টে নেপালি/গোর্খা ভাষায় নিজের বক্তব্য পেশ করেন’। 

    রতনলালের নাতনির স্নেহময় লেখা পড়ে আমরা তাঁকে একজন স্ব-শিক্ষিত মানুষ হিসাবে খুঁজে পাই, যিনি তাঁর কঠিন বাল্যবয়সের বাধা-অসুবিধাগুলিকে — বিশেষত তাঁর বাবা-মায়ের মৃত্যু — তাঁর শিক্ষার বাসনায় এবং তাঁর কাছের মানুষদের শিক্ষার ক্ষেত্রেও কোনোদিন ছাপ ফেলতে দেননি। ‘মানুষ’ কথাটার অর্থ তিনি আহরণ করেন দুটো উৎস থেকে – মার্কসবাদ, এবং তাঁর নিজের সম্প্রদায়, অর্থাৎ গোর্খাদের থেকে, তাদের পরিচয়, এবং ভাষা এবং পরিচয় হিসাবে ‘নেপালি’, এই সম্বন্ধে তাঁর নিজস্ব মূল্যায়ন থেকে।  

    প্রীতি লিখছেন: 

    শপথ-গ্রহণের দিন এসে গেল এবং তিনি যত্নসহকারে তাঁর পোষাক বেছে নিয়েছিলেন। কর্তব্যক্ষেত্রের পরিধানে যেন সাংস্কৃতিক গর্ব সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে, এই ছিল তাঁর ইচ্ছা— দাউরা-সুরুয়াল এবং বির্কে টোপি, কোমরবন্ধে খুখুরি। সঙ্গী জ্যোতি বসুর চেয়ে উচ্চতায় প্রায় এক ফুট দীর্ঘ রতনলাল, ধীরেসুস্থে বিধানসভা ভবনের দক্ষিণ প্রবেশদ্বারে এসে পৌঁছলেন। গেটে তখন এক শ্বেতাঙ্গ সৈন্য, যে খুখুরি দেখে এই যুগলকে আর যাই হোক, ঠিক জনসাধারণের নেতা হিসাবে ঠাহর করে উঠতে পারে না। অপমান করে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘এই, ব্লাডি ইন্ডিয়ান, তোমাদের প্রবেশ নিষেধ’।        

    অসম্ভব সংবেদনশীল এই ঘটনাটা। কারণ আজও, প্রায় ৭৫ বছর পরেও, ভারতের এই প্রান্তের মানুষকে তাদেরই দেশের অন্যান্য প্রান্তে, দেশের রাজধানী-সহ, তাদের ‘ভারতীয়ত্ব’ প্রায়শই ‘প্রমাণ’ করতে হয়।   

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

    Read in English

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook