ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • মিহি মন্তাজ: পর্ব ৫


    শুভময় মিত্র (August 13, 2021)
     

    মেঘদূত

    অনেকবার ডাকাডাকি করলাম। উত্তর দিল। তবে এল না। এগারোয় আছে। আমি যাব চারে। অপেক্ষা করলাম, আসবে। আমার তাড়া নেই। প্যাসেজটা বন্ধ দেরাজের মতো চুপচাপ। মাঝেমাঝে দূরে বা অনেক ওপরে হয়তো একটা টুং হল। এখানে আলো কম, সিলিঙের মধ্যে লুকোনো। দরজার পাশের বোতামের গায়ে লাল ডিসপ্লেতে কী একটা যেন থরথর করছে। ওটাই যা বলার বলছে। এদিক-ওদিক তাকালাম। প্যাসেজের দু’পাশে সার বেঁধে আরও আলো, কেউ স্থির, কেউ ব্লিঙ্ক করছে। সবাই লাল। সবার পাশে একই পোশাকের ভারী দরজা। চাইলেই খোলা যায় না। ডাক শুনে যদি নিতে আসে, তাহলে নিজে খুলবে। ঠিক পাশের দরজার ওপরের প্যানেলে নিঃশব্দে একটা কথা ফুটে উঠছে, আমি বিশ্রামে আছি, অন্য দরজা দেখে নাও। আমি জানি, এগুলোর ভেতরে বাড়ির সমান উঁচু টানেল আছে। এক মস্ত ভার উঠলে ঘর নামে। শিখরে গিয়ার পুলি নিয়ে বসে আছে যমদূত। ওদের দেখা যায় না যদিও।

    পিছনে আওয়াজ হল, কেউ এসেছে। সেও আমার মতো বোতামে ডাকাডাকি করে সুবিধে না হওয়াতে অন্যদিকে চলে গেল। স্ফটিকের মতো শিরা তোলা চটি ছাপা মেঝেতে জলছাপ রেখে গেল অনেকগুলো। চটির রবার স্ট্যাম্পের চারপাশে লক্ষ্মীছাপের মতো আরও ক’টি বিন্দু। শাড়ির টোপর থেকে ঝরেছে হয়তো। বাইরে কি বৃষ্টি এসেছে? কান খাড়া করে শুনলাম, ছপছপ আওয়াজটা মিলিয়ে গেল ওপরে। সিঁড়ি আছে নিশ্চয়ই। কে যেন কাউকে ডাকল, হাহাকারের মতো ইকো হল কোনও একটা হলোওয়েলে, ভয় পেলাম একটু। আজকাল এটা বারবার হচ্ছে। প্রায়ই ভয় করছে। অনেক কিছু ভুলে যাচ্ছি। কিছুতেই আর মনে পড়ছে না। হারিয়ে যাচ্ছে সামান্য সবকিছু, আর পাওয়া যাচ্ছে না। কী ভুলে গেছি তাও মনে পড়ছে না। সাইকো-অ্যানজিও করলে কি জানা যাবে, ঠিক কোথায় আটকে আছে জরুরি স্মৃতিকণা? অথচ, একটা চিরকুট, সেটা লন্ড্রির বিলও হতে পারে, অথবা কারুর ফোন নম্বর, প্রায় এক মাস ধরে, ওটাই বারবার বেরোচ্ছে পকেট হাতড়ালে। ওইটাই বেরোচ্ছে। একটু একটু করে অস্পষ্ট হতে হতে এখন অদ্ভুত চেহারা তার। নাকের কাছে এনে দেখলাম সেদিন, সাবানের কী সুন্দর ধূসর গন্ধ! এরপর ছিঁড়ে যাবে। কুটিকুটি করে ফেলবে নিজেকেই। ফেলিনি ওটাকে, শেষটা দেখতে চাই। 

    ধড়মড় করে নিজের সর্বাঙ্গ, যত খাঁজ, ভাঁজ, পকেট, ফোকর খুঁজতে লাগলাম। ঝোলাব্যাগের মধ্যে হাতড়াতে হাতড়াতে অনেক কিছুই ঠাহর হচ্ছিল, খামে ভরা কাগজটা ছাড়া। শক্ত, মেটাল হতে পারে, ভারী, নলওয়ালা জিনিসটা কী? আমার কি কোনওদিন, কোনও কারণে রিভলভার ছিল? খুব হাসলাম একচোট। অমনি মনে পড়ে গেল, যা খুঁজছি, যেটি দেওয়ার জন্যে এখানে এসেছি, বুকপকেটেই আছে। ঘণ্টা বাজল, একটু দূরে একটা দরজা খুলেছে, নরম আলো বেরোচ্ছে সেখান থেকে। কেউ ডাকেনি, তাও এসেছে। হুড়মুড় করে ওইদিকে দৌড়ে গেলাম। ঢুকে পড়লাম ভেতরে। দেখি আরও একগাদা কারা যেন। মেঝে বাদে সর্বত্র আয়না। দরজা বন্ধ হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলাম, মারাত্মক ভুল করেছি। আমি যে-ক্লাস্টারে যেতে চাই, এ সেখানে নাও যেতে পারে। সুইচের প্যানেলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সবচেয়ে তলার বোতামটা টিপতে লাগলাম, যদি দরজা খোলে। এখানেও ভুল, আমি ছিলাম জমিতে, জি-তে। টিপেছি বি, অর্থাৎ বেসমেন্ট। পাতালে নামবে। আমার মতো মেসেঞ্জার এখানে সুটেব্‌ল নয়, এ আবেদনের কোনও গুরুত্বও নেই। ফের চার নম্বর টিপে লাভ হল না। ও আগেই ঠিক করেছে সতেরোয় যাবে। হাল ছেড়ে নিজেকে দেখতে লাগলাম, কী অদ্ভুত মাল্টিডাইমেনশনাল চেহারা আমার। মুখ ঘুরিয়ে নিয়েও নিস্তার নেই, অন্য আমি তাকিয়ে দেখছে। মেঝেতে আয়না থাকলে কী হত ভাবতেই, চারপাশে অনেক সারি দাঁত দেখা গেল।

    সতেরোয় থামল, আমিও রেডি। দরজা খুলল না, এরা একটা রাজকীয় ডিলে করে সর্বত্র। একটু থেমে তবে খুলবে। এই সূক্ষ্ম সিদ্ধান্তগুলো তারাই নেয়, যাদের স্বোপার্জিত সম্পদ, আভিজাত্য, আপাত-নিস্পৃহতা আর অবজ্ঞার ওজনটা সাংঘাতিক বেশি। কুকুরদের কথা মনে হল। মধ্যবিত্তের সস্তা পুষ্যি সারাক্ষণ তিড়িংবিড়িং, ফ্যাচফোচ করে চলে, যে-কোনও ক্ষমতায় না থাকা রাজনৈতিক দলের লুজ চ্যাংড়াদের মতো।

    একটা মিউজিক শুরু হয়েছে। খুব চেনা সুর। এই ধরনের জায়গায় সাধারণত একটা নাছোড়বান্দা ইনস্ট্রুমেন্ট বাজতে থাকে। কয়েক সেকেন্ড পরে লুপে ফিরে ফিরে আসে। ঝুলন্ত মানুষকে জবরদস্তি হরিবোল শোনায়। এখানে তা হচ্ছে না। যেটা কানে আসছে, যেন অনেক ওপর থেকে, তা খোলা গলার মতো কিছু একটা। গানটা এগোচ্ছে নিজের পথ তৈরি করে, ধীর গতিতে। আমাকে আরও কাছে টেনে নিচ্ছে। আমি নিঃশব্দে উঠছি, উঠছি তো উঠছিই। গানটা বাড়ছে, সূক্ষ্মভাবে। সুরটা মাদকের মতো ছড়াচ্ছে আমার ব্রেনে। সুরের প্রিন্ট-আউটটা ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে কারুর হৃদয়ের অনেকগুলো রোলার পিষে। সুবহা, সুবহা… কত তলা দিয়ে যাচ্ছি তা দরজার ওপরের প্যানেলে জানিয়ে দিচ্ছে। একটু আস্তে আস্তে চলছে যেন। আমার তাড়া নেই। চোদ্দো পেরনোর সময় একবার বোতাম টিপেছিলাম, অকারণে। আঁতকে লাল হয়ে উঠেছিল বোতাম, থামেনি। কোথাও একটা থামবে নিশ্চয়ই। দরজাও খুলবে। খুললেই স্যাট করে বেরিয়ে আসব। আর কায়দাবাজির ফাঁদে পা দেওয়া নেই। থপথপ করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসব চারে। 

    সতেরোয় থামল, আমিও রেডি। দরজা খুলল না, এরা একটা রাজকীয় ডিলে করে সর্বত্র। একটু থেমে তবে খুলবে। এই সূক্ষ্ম সিদ্ধান্তগুলো তারাই নেয়, যাদের স্বোপার্জিত সম্পদ, আভিজাত্য, আপাত-নিস্পৃহতা আর অবজ্ঞার ওজনটা সাংঘাতিক বেশি। কুকুরদের কথা মনে হল। মধ্যবিত্তের সস্তা পুষ্যি সারাক্ষণ তিড়িংবিড়িং, ফ্যাচফোচ করে চলে, যে-কোনও ক্ষমতায় না থাকা রাজনৈতিক দলের লুজ চ্যাংড়াদের মতো। বড়লোকের গ্রেট ডেন ক্যাজুয়ালি আসবে, স্লোলি বসবে। প্রায় অদৃশ্য একটা নিস্পৃহ বিরক্তি নিয়ে সব দেখবে। শুঁকবে না অসভ্যের মতো। ভুলেও তেড়ে আসবে না, শুধু চলে যাওয়ার সময় হয়তো মৃদু একটা ভৌ। 

    আমাদের পাড়াতে অনেক বাজে ফ্ল্যাটবাড়ি হয়েছে। চারতলা হলেও সেখানে লিফ্‌ট বসানো আছে কায়দা করে। ফলপট্টির কাঠের প্যাকিং বাক্সের চেয়েও ছোট। জেলের মতো গরাদ লাগানো দরজা তার। টোল-বিশু বলেছিল, খরচ কমাতে এইসব বাড়ির তলাটা নাকি তৈরি হয় না, খোলা রেখে মাটি চাপা দিয়ে দেওয়া হয়। তা সত্যি হলে লিফ্‌টের তার ছিঁড়ে গেলে আমি নিশ্চিত, পূতিগন্ধভরা সিউয়ার পাইপের ওপরেই আছড়ে পড়বে। আমি এই মুহূর্তে যার ভেতরে আটকে আছি, তা হল এলিভেটর। এর জাত আলাদা। বেবিদা আমাকে পাঠিয়েছে এখানে। একটা খাম একজনকে দিয়ে আসতে হবে। বলল, ‘আমিই যেতাম, কিন্তু না, থাক। তুই জাস্ট ড্রপ করে দে, তাহলেই হবে।’ বেবিদার বাড়িরটা আবার অন্যরকম। ওর ফ্ল্যাট টপ ফ্লোরে, সামনে টেরেস, বাগান আছে, আমি খুব যাই। হিদারাম ব্যানার্জি লেনের গলি থেকে সিলিকন ভ্যালিতে চরে আসা লোক, কেতাই আলাদা। ওর অ্যাপার্টমেন্টের লিফ্‌টটা ওঠা-নামা করে মূল বাড়ির বাইরে দিয়ে। কাঁচের বাক্স, বাইরের সব দেখা যায়। ভয় করে, ভালও লাগে। মোর ইম্পর্ট্যান্ট, রাস্তার লোক দেখতে পায় কে উঠে যাচ্ছে। বা নেমে আসছে। প্রথমবার যখন গিয়েছিলাম, বেবিদা বলেছিল, ‘ঘাবড়াস না। সুইচ খুঁচোবি না। জাস্ট বলবি, বেবি। ঠিক জায়গাতেই থামবে।’ তাই হল। ওপরে পৌঁছতেই দেখি সে দাঁড়িয়ে আছে হাফপ্যান্ট পরে, ‘কী রে, ভার্টিকাল রোপওয়েটা কেমন লাগল?’ ওদের লিফ্‌টে কোনও গান হয় না, দরকার কী? সাইলেন্ট সিনেমা তো আছেই! বেবিদার অনেক হাইফাই ছেলেমানুষি আছে। সারাক্ষণ সারপ্রাইজ। মাঝে মাঝে অনেক শব্দ উচ্চারণ করে, যা আমি বুঝি না। একটা খুব সুন্দর, আরদুইনো। মনে আছে এখনও। সব থেকে বড় কথা, নিশ্চিন্তে কথা বলা যায় ওর সঙ্গে, যে-কোনও বিষয়ে। কখনও অন্যকে ছোট করে না। একা লোক, কথা বলতে ভালবাসে, আমারও শুনতে আপত্তি নেই। খুব যাই।

    ছাদঘরের, যেটাকে ও পেন্টহাউস বলে, তার পাঁচিলে ভর দিয়ে ও চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে মাঝে মাঝে। ঈগলের মতো দেখে কী সব। অনেকক্ষণ কোনও কথা বলে না। আমিও চুপ করে থাকি। আকাশে একটা প্লেন দেখতে পেয়ে একদিন বলল, ‘দাঁড়া, ট্র্যাক করি এটাকে।’ বলে, ফোনে কী একটা খুলল, দেখি ফ্লাইট রেডার। পৃথিবীর আকাশের ম্যাপ, প্রচুর প্লেন কিলবিল করছে সেখানে। বেবিদার ফোনের স্ক্রিন এশিয়া থেকে ইন্ডিয়া হয়ে আলিপুরে নামল সাঁইসাঁই করে, ওখানে স্পষ্ট দেখতে পেলাম আমাদের প্লেনটাকে। বলল, ‘থাই। ড্রিমলাইনার। দুবাই যাচ্ছে। কিন্তু এখানে কেন? যাকগে।’ আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা-পড়া মেটালের ঘরের মধ্যে ওর কথা বারবার মনে হতে লাগল। এদিকে দরজা খোলেনি কিন্তু। বাইরে একজনের ছায়া দেখতে পেলাম, সরে গেল। আবার ওঠা শুরু হল। এবারে আমার সত্যি ভয় করতে লাগল। ব্যাগের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে আবার স্পর্শ করলাম ওটাকে। মনে পড়ল, টর্চ। কয়েক সেকেন্ড পরে দেখি, ছোট্ট কাছের জানলার বাইরেটা যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। প্লেন নামার আগে কিছুক্ষণের জন্য আলো নিভিয়ে দিলেও, ল্যান্ডিংয়ের আগে যেমন ধীরে ধীরে ফিরে আসে সেটা, তেমনই। গানটাও অনেক স্পষ্ট, কথা শুনতে পাচ্ছি। মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে এলিভেটর থেমেছে। দরজা খুলে গেছে। বাইরে আলোয় আলো। সুবহা, সুবহা…

    যদি না বেরোই, তাহলে কী হবে? আবার আমাকে মুড়ে ফেলে নিজের মতো নামতে শুরু করবে? গানটার পরিচয়টা মনে পড়ছে না, কিছুতেই না। এটা এমন একটা জায়গা যে, শেষটা না শুনে বেরনো অসম্ভব। দাঁড়িয়েই রইলাম, যা হয় হবে। দরজাও অপেক্ষা করছে আমার জন্য। সাতে কেউ ডাকছে, দেখে নিয়েছি। আলো দপদপ করছে দ্রুত। ডাকুক, শেষটা আমার চাই। ‘সুনসান পনঘট মৃদুল সমীর। ধীরে ধীরে পঁহুছত যমুনাকে তীর…’ এই প্রথম অ্যাল্যার্ম শুনলাম, ও নেমে যেতে চায়। একটা শত্রুতা তৈরি হয়েই গিয়েছিল। ফিরে এল নিম্নস্তরের জেদ। এক পা বাইরে বের করে রাখলাম। করবেটা কী? পিষে দেবে? এতক্ষণ হাজার হাজার টুকরো করে দেখছিলি, এবারে দু’ভাগে চিরে দেখবি, যা পারিস করে নে, আমি গান শুনেই যাব। আমি ধরে ফেলেছি গানটা, শেষটা মাথায় এসেও গেছে। বাইরে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, নামবে নিশ্চয়ই। আর অসভ্যতা করা যায় না। দরজার সেন্সরকে ছুটি দিয়ে বেরিয়ে এলাম করিডোরে। আবার সেই ঔদ্ধত্যময় ডিলে, কিছুক্ষণ দেখে, একটু পরে দরজা বন্ধ হল। হঠাৎ এত আলোতে চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল আমার। মেয়ে নয়, মহিলা তো। উনি নামলেন না। বরং আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার হাতের খাম দেখে বললেন, ‘বেবি পাঠিয়েছে তো? এইদিকে।’ 

    চিঠি খুলে উনি নেড়েচেড়ে দেখলেন, মুখে একটা হাসি খেলে গেল। বললেন, ‘ওর কাছে তুমি খুব যাও তো।’ আমাকে চেনেন উনি? হাসিটা এখনও ঘামের তলায় পাউডারের মতো লেগে আছে মুখে। হয়তো ওঁর মুখটাই এমন। মধ্যবয়সে কেউ কেউ ঝরে যান মাটিতে। কেউ আবার প্রথমবার ফোটেন। উনি ড্রাই ফ্লাওয়ারের মতো। শরীরের যেটুকু দেখতে পাচ্ছি, ওঁর লং স্কার্টের মতোই, ঝলমলে ম্যাট। চোখের তলার আন্ডারশেডটা কালি না কাজলের স্মৃতি, বুঝতে পারলাম না। ওঁর চিঠি দেখা হয়ে গেছে, আমাকে ছেড়ে দিলেই পারেন, আটকে রেখেছেন তাও নয়। কলকাতার স্কাইলাইনের দিকে তাকিয়ে আছেন।

    এটাও টপ ফ্লোর, বিশাল ছাদ, তবে কোনও ঘর নেই। উনি এখানে আমার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন কেন? উনি যদি তিনি হন, তাহলে ওঁর চারে থাকার কথা। এক শটে সেখানে পৌঁছতে পারিনি, এইসব কাণ্ড উনি জানবেন কী করে? এত কথা তো ধাঁ করে জিজ্ঞেস করা যায় না, কেটে পড়ি বরং। চিঠি খুলে উনি নেড়েচেড়ে দেখলেন, মুখে একটা হাসি খেলে গেল। বললেন, ‘ওর কাছে তুমি খুব যাও তো।’ আমাকে চেনেন উনি? হাসিটা এখনও ঘামের তলায় পাউডারের মতো লেগে আছে মুখে। হয়তো ওঁর মুখটাই এমন। মধ্যবয়সে কেউ কেউ ঝরে যান মাটিতে। কেউ আবার প্রথমবার ফোটেন। উনি ড্রাই ফ্লাওয়ারের মতো। শরীরের যেটুকু দেখতে পাচ্ছি, ওঁর লং স্কার্টের মতোই, ঝলমলে ম্যাট। চোখের তলার আন্ডারশেডটা কালি না কাজলের স্মৃতি, বুঝতে পারলাম না। ওঁর চিঠি দেখা হয়ে গেছে, আমাকে ছেড়ে দিলেই পারেন, আটকে রেখেছেন তাও নয়। কলকাতার স্কাইলাইনের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমিও চেনা বাড়ি খুঁজছিলাম। বললেন, ‘তোমাকে পাঠানোর দরকার ছিল না। নিজে আসতে চায়নি, ফেয়ার এনাফ, কুরিয়ার করলেই পারত।’ অপরিচিতা, তবে একটু একটু করে স্পষ্ট হচ্ছে যেন, চেনাও লাগছে, ওই গানটার মতো, নিশ্চিত নই যদিও, চুপ করে রইলাম। ‘বেবির কলকাতার ফ্ল্যাটের ছাদটা আগে দেখা যেত, এখন মাঝখানে অন্য বাড়ি উঠে গেছে। ইন ফ্যাক্ট, এই রুফ-স্পেসটা ওরই। এই এন্টায়ার প্রপার্টির অনেক কিছু ও-ই কন্ট্রোল করে। অ্যাকচুয়ালি, হি পুশড ইউ আপ হিয়ার। হিজ ফাকিং অ্যাপস। হি হ্যাজ ওভাররাইড কন্ট্রোল ওভার অলমোস্ট এভরিথিং।’ এসব কথার মানে কী? স্বগতোক্তির মতো বলেই যাচ্ছেন ‘হি জাস্ট টেক্সটড, গেট ইওর ডেলিভারি অন টপ, আই ক্যান ওয়াচ দেন। এই দ্যাখো, পর পর মেসেজ, ফোর্থ ফ্লোর অ্যাপিল সাক্সেসফুলি ডাইভার্টেড। মেসেঞ্জার ইন এলিভেটর হেডিং আপ। ক্লাইম্ব দ্য স্টেয়ার্স, ফাস্ট, ইয়োর বামস উইল বি ব্যাক ইন শেপ আগেন…’ শেষ অংশটা উনি আর পড়লেন না।  

    মেয়েটা বেবিদার কেউ একটা। কিছু একটা ঝামেলা আছে। এর বেশি আমার জানার দরকার নেই। ‘আসছি আমি’ বলে ঘুরলাম। ওদিক চুপচাপ, একটু চা খেয়ে যান। না। অস্বাভাবিক নয়। আবার লিফটের দরজার সামনে এলাম, খেয়াল করলাম, একটাই এখানে, অন্য দরজাগুলো গেল কোথায়? ওপরে ওঠার স্তরে স্তরে একটার পর একটা মুছে গেছে বোধ হয়। চুড়োয় যে কেউ যেতে পারে না। আড়চোখে দেখলাম দরজায় দাঁড়িয়ে মেয়েটা একবার সেই কাগজ আর একবার দিগন্ত দেখে চলেছে। ব্যাকলিট, দারুণ লাগছে। স্কার্টের মধ্যে একটু যেন কোমর থেকে পা-এর আভাস। ডাকলাম, আসছে সে। এলিভেটর। এটাও কি রিমোটে আসছে? জাস্ট এক মুহূর্ত আগে আমি কী ভাবছিলাম, সেটাও কি বেবিদার সেন্সরে ধরা পড়েছে? ইফ সো, তাহলে ভাবতে হবে। দরজা খুলল। কোনও গান বাজছে না এখন। যেই ঢুকব, দরজা বন্ধ হবে, ওই গানটা শুরু হবে। শুনব না আর। সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলাম, এখন আমার ওপর আর রিমোট কন্ট্রোল চলবে না। গানটা কিন্তু মাথার মধ্যে বাজছে, বের করতে পারছি না। ‘বিরহ বেদনা তো মুছে গেছে কবে। মথুরা নগরপতি তাও তুমি কেন ফিরে যাও?’

    ব্যাগ হাতড়ে নিজের মোবাইল ফোন বের করলাম। উফ, আকাশ ভরা সিগন্যাল! এসো মা ইউটিউব, হেডফোন গুঁজে দিলাম কানে। সারা দুনিয়া থেকে আমি বিচ্ছিন্ন এখন। বেবিদা তুমি যত বড় বসই হও, তুমি পালিয়েছ। বা সে চলে  গেছে। তুমি ছাড়তে পারোনি আজও। তাই এইসব নজরদারি। যেটা শুনব ঠিক করলাম, পেয়ে লিংকটা পাঠিয়ে দিলাম। শুনো। একটার পর একটা ফ্লোর থেকে ফ্লোরে নামছি সিঁড়ি দিয়ে। ওপাশে এলিভেটর আমাকে খুঁজে চলেছে হয়তো। প্রত্যেক ল্যান্ডিংয়ের জানলায় এক-একরকম বর্ষার আকাশ। তোমার টেরাসে বসে শোনো তুমি, ‘ঘন ঘন রিম্‌ ঝিম্‌ রিম্‌ ঝিম্‌, রিম্‌ ঝিম্‌/ বরখত নীরবপুঞ্জ।/ শাল পিয়ালে তাল তমালে/ নিবিড় তিমিরময় কুঞ্জ।’

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook