সন্ধেবেলা সবাই মিলে গেলাম গুরুর ফার্মে। দেখি গুরু আমাদের দেখে খুব খুশি। বললাম— ওয়াহিদা এসেছিল—
গুরু বললে— এখানেও এসেছিল—
গুরু একটু ভাবল, মনে হল কিছু বলবে কিন্তু এড়িয়ে গেল কথাটা। আমি গুরুর দিকে চেয়ে তার মনের ভেতরটা দেখতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু নিজের মন সম্বন্ধে গুরু বড় সচেতন। টাকা-পয়সা সম্বন্ধে সাধারণ লোক একটু সচেতন হয় দেখেছি। কিন্তু গুরু যদি তার মন সম্বন্ধে আর একটু কম সচেতন হত, আমার অনেকবার মনে হয়েছে গুরু যদি একটু কৃপণ হত ভালো হত, গুরু যদি একটু স্বার্থপর হত ভালো হত, গুরু যদি একটু পরশ্রীকাতর হত তো ভালো হত। অন্তত অন্য লোকের পক্ষে ভালো না হলেও তার নিজের পক্ষে ভালো হত। তাহলে গুরু অন্তত তার মনটার কথা ভুলে থাকত, তার মনের যন্ত্রণার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেত!
ওয়াহিদা রেহমান খানিক পরেই চলে গেল। গুরু দত্তের সঙ্গেও দেখা করে গেল, আমাদের সকলের সঙ্গেও দেখা করে গেল। নানা ছবির ব্যাপারে ব্যস্ত। গল্প করবার, বিশ্রাম করবার সময়টুকু পর্যন্ত পায় না, কথায়-কথায় বললে— একটু ভালো করে খেতে পারি না—
গুরুকে কতদিন দেখেছি খাওয়ার সময়। মনে আছে তখন আমরা মাদ্রাজে। ভেনাস স্টুডিওতে তখন কী একটা ছবির কাজ চলছে। এক-একদিন আমিও থাকতুম। খাওয়ার ডাক এসেছে। নানা রকম খাওয়া। টেবিল-ভর্তি খানা। দেখলেই খেতে লোভ হয়। কিন্তু খেতে গিয়ে দেখি গুরু নেই। গুরু কোথায় গেল?
দেখি পাশের ঘরে গুরু একটা টেবিলে বসে একলা শুকনো রুটি খাচ্ছে।
বললাম— কি হল? আপনি একলা এখানে বসে খাচ্ছেন?
গুরু হাসল। বলল— ওখানে ভাত রয়েছে, ওখানে বসলে লোভে পড়ে সব খেয়ে ফেলব।
ভাত খাওয়ার লোভের ভয়ে গুরু সকলের সঙ্গে এক টেবিলে বসে খেত না। তারপর এক-একসময় দেখতাম গমের দানার ভাত খাচ্ছে।
আমি এইসব দেখে একটু অবাক হতাম। সিনেমার জগতে আমি কোনোদিন মেলা-মেশা করিনি বা হয়নি অথচ ঘটনাচক্রে আমার ভাগ্য আমাকে বার-বার টেনে নিয়ে গিয়েছে সিনেমা-থিয়েটারে।
ওয়াহিদার মুখ থেকে সেদিন যখন ওই কথা শুনলাম, তখন সিনেমা অভিনেতা আর অভিনেত্রীদের সম্বন্ধে আরো কৌতূহলী হয়ে উঠলাম। সব মানুষের সম্বন্ধেই আমার কৌতূহল অদম্য। মানুষের চরিত্র নিয়েই আমার কারবার। তার ওপর সিনেমার সঙ্গে জড়িত মানুষদের চরিত্র আরো বিচিত্র।
ওয়াহিদা রেহমান চলে যাবার পর আবার সেই একই রুটিন। সেই লেখা, লেখার নকল করা, অনুবাদ করা আর টাইপ করা। জীবনের সেই কটা দিন আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে আজও। চিত্রনাট্য আগেও করতে হয়েছে, তার পরেও করতে হয়েছে, কিন্তু সেই ১৯৬০ সালের মার্চ-এপ্রিল-মে মাসের সেই দেড় মাস যে আনন্দে কাটিয়েছি, তা আজও মনে আছে। মনে আছে বিশেষ করে, অন্য কিছু কারণে নয়, গুরু দত্তের জন্যে। গুরু দত্ত এমন কিছু মহামানব নয়। কিন্তু মহামানব না হলেও এমন এক চরিত্রের মানুষ, যা মানুষের সংসারে দুর্লভ। আমার নিজের ধারণা হয়েছে গুরু দত্তকে না দেখলে সংসারের অনেক কিছু দেখা বাকি থেকে যেত। যা হোক, একদিন চিত্রনাট্য লেখা শেষ হয়ে গেল। সবাই খুশি, সকলেরই পছন্দ হয়েছে। গুরুর মুখে হাসি। বললে— ভালো হয়েছে—
বললাম— আমি আমার মতো করে দিলাম, এখন আপনি আপনার মতো করে নেবেন—
গুরু বললে— আমি যদি আমার মতো করে বদলে নিই, আপনার কি কোনো আপত্তি আছে?
বললাম— আমার আপত্তি নেই, কারণ আমার ‘সাহেব বিবি গোলাম’ মানুষের ঘরে-ঘরে ঢুকে পড়েছে, একেবারে রান্নাঘরে পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। আপনি সেখান থেকে হটাতে পারবেন না—
সেদিন সেই পর্যন্তই হল। সবাই তখন ক্লান্ত। পরদিন আব্রার আল্ভি চলে গেল। মিস ভালেকর চলে গেল। অমলেন্দু বোসও চলে গেল। সকলের গন্তব্যস্থল বোম্বাই। লোনাভালা থেকে নব্বই মাইল দূরে। সমস্ত বাড়িটা ফাঁকা হয়ে গেল। একদিন যে-বাড়িটা আমাদের পাঁচজনের হাসি-গল্পের আওয়াজে গমগম করত, সেই বাড়িটা তখন একেবারে শান্ত।
আমি সেদিন দুপুরবেলা শ্রান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, যখন ঘুম থেকে উঠলাম তখন বেশ সন্ধে হয়ে গেছে।
আমি রতনকে জিজ্ঞেস করলাম— গুরু কোথায়?
রতন বললে— সাহেব ফার্মে গেছে—
আমি অবাক হয়ে গেলাম। গুরু চলে গেল, অথচ একবার বলে গেল না।
রতন বললে— সাহেব যাবার সময় খবর দিতে এসেছিলেন, আপনি তখন ঘুমোচ্ছিলেন। তাই আর ডাকেননি। আপনাকে যেতে বলেছে—
তাই-ই হল। তখন আর আমারও থাকতে ইচ্ছে করছিল না। সমস্ত বাড়িটা আমার কাছে বিস্বাদ হয়ে গেছে। মনে হচ্ছিল আমি যেন সেই ‘সাহেব বিবি গোলামে’র ভাঙা বাড়ির মধ্যে বসে আছি। আর আমার সামনে যেন সেই বউঠানের কঙ্কাল।
গাড়ি তৈরিই ছিল। তখনি সেই গাড়ি নিয়েই চলে গেলাম গুরুর ফার্মে। তখন অন্ধকারে চারিদিক ঢেকে গেছে। ফার্মের ভেতরে চারিদিকে ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে। নির্জন নিরিবিলি। শুধু ঘরে একটা পেট্রোম্যাক্স জ্বলছে।
আমার গাড়িটা ভেতরে ঢুকতেই গুরু বাইরে এল। দেখি লুঙ্গি পরা, গায়ে গেঞ্জি, পায়ে চটি। হাতে রং-এর তুলি। বললাম— কি করছিলেন?
গুরু বললে— জানালা-দরজায় রং দিচ্ছে গুরু! তার কি লোকের অভাব? তার কি টাকার অভাব!
গুরু বললে— আসুন, আর একটু রং দেওয়া বাকি আছে—
সেই সন্ধেবেলা সেই ফাঁকা মাঠের মধ্যে ছোট একটা বাংলো বাড়ির ঘরের ভেতরে আমি গুরুর আর এক রূপ দেখলাম। পায়ে রবারের চটি, পরনে চেক লুঙ্গি, গায়ে হাত-কাটা গেঞ্জি। একমনে কাঠের জাফ্রির ওপর বুরুশ চালিয়ে যাচ্ছে। গুরুর এ-রূপ কেউ কখনও দেখেনি আগে। লোকে গুরুর গাড়ি চালানো দেখেছে। গুরুর বাড়ি দেখেছে। গুরুর অভিনয়ও হয়তো অনেকে দেখেছে। বাইরে থেকে গুরুকে সবাই সিনেমার জগতের শৌখিন লোক বলেই জানে। কিন্তু এ-কি?
গুরু কাজ করতে-করতেই বললে— বিমলবাবু, এবারে কিছুদিনের জন্য ছুটি নেব আমি—
ছুটি! আমি গুরুর ছুটি নেওয়ার কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। যারা পরের চাকরি করে না, তারা স্বাধীন! আমার ধারণা ছিল সেই স্বাধীন লোকদের কাজই ছুটির কাজ। যেমন আমি। আমি যে বোম্বাই গিয়েছি ছবির কাজে, সেটা কি কাজ? গল্পের চিত্রনাট্য করার কাজটাই তো ছুটির কাজ! যে-কাজে আনন্দ আছে, সে-কাজকে আমি কাজ বলি না। সেই কাজটাই ছুটি। আমি সকাল থেকে সারাদিন যদি উপন্যাস লিখি, সেটা তো আনন্দের জন্যে করি। সেটা কি আমার পেশা? হয়তো পেশা। কিন্তু তার নব্বই ভাগ তো নেশা। কাজকে যদি আনন্দের মধ্যে দিয়ে পেশা করে নিই, তখন তো আর কাজ থাকে না। যদি অর্থ আসে তো আসুক। এলে ভালো, না এলেও এ নেশাকে ছাড়তে পারব না। লিখে যে অর্থ আসে সেটা আমার কাছে উপরি পাওনা, আনন্দটাই হচ্ছে আমার বেতন। বই-এর রয়্যালটিটা আমার খোরাকি, মাইনেটা হল আমার আনন্দ। ওই আনন্দটুকুর আশাতেই দিন-রাত লিখে যাই। তাই তখন সেই আনন্দের ভোগেও কেউ হাত বসাতে আসে তখন বাধে বিরোধ। তখন আমার নিরবচ্ছিন্ন আনন্দের সংসারে ভাঙন ধরে। তখনই বলতে ইচ্ছে করে— আর পারি না, এবার লেখা ছেড়ে দেব—
গুরু দত্তের সঙ্গে এ-নিয়ে আমার কথা হয়েছে। যখনই দুজন একলা থাকতুম তখনই দুজনে নিজের নিজের মনের কথা বলতুম। গুরুর মধ্যে দেখতাম দুটো সত্তা। একদিকে সে বিলাসী, ভোগী, খ্যাতিমান। সেখানে সে ব্যতিব্যস্ত। ইনকাম-ট্যাক্স, উকিল, স্টুডিও নিয়ে সে বিব্রত। তার সঙ্গে-সঙ্গে আর একদিকে সে জ্ঞানী, ধীর স্থির, বিবেকবান, দয়ালু, দাতা, নিস্পৃহ, নির্বিকার, নিরহঙ্কার।