মাও-এর মুখ

মাও সে তুং-এর ছবি প্রথম দেখি আমাদের বাড়ির কাছে, শ্রীরামপুর স্টেশনের সন্নিকটে, তৎকালে নবজাত সিপিআই(এম) দলের হুগলি জেলা অফিসে। তখন একতলা অফিস। জানালা দিয়ে দেখা যেত মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্ট‍্যালিনের ছবির পরেই মাওয়ের ছবিটি। তখন স্কুলের সপ্তম-অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। ১৯৬৭-’৬৮ সাল। স্কুলে যাতায়াতের রাস্তায় দেখতাম। অনেকেই চমকে যাবেন, ওই বয়সে একবার বাবার সঙ্গে তার অফিসে গিয়ে ফেরার সময় দেখলাম, ধর্মতলায় জনসভায় যেতে হাওড়া ব্রিজ দিয়ে যাচ্ছে আমাদের ওই সিপিএম অফিসের পশুপতিদা, নিতাইদারা, হুগলি জেলা কমিটির ব‍্যানার নিয়ে, মুখে স্লোগান: নকশালবাড়ি লাল সেলাম। তখন সিপিআই(এম) দলটির হুগলি জেলা সম্পাদক ছিলেন সুশীতল রায়চৌধুরী।

এর কিছু পরেই ১৯৬৯-এ যখন সিপিআই(এম-এল) দল গঠিত হল নকশালবাড়ির ঘটনায়, সুশীতল রায়চৌধুরী হলেন সে দলের মুখপত্র ‘দেশব্রতী’-র সম্পাদক। আর তখনই দেখলাম, সিপিআই(এম) জেলা পার্টি অফিস থেকে মাও সে তুংয়ের ছবিটি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

দেওয়াললিখনে মাও সে তুং-এর মুখের ছবি? নকশালপন্থীরা দেওয়াললিখনে এনেছিলেন এক অভিনবত্ব। দলীয় স্লোগান বা মাওয়ের কোনও উদ্ধৃতির সঙ্গে মাওয়ের মুখচ্ছবি। সেই ছবি ঠিক আঁকা নয়, ছাপাই ছবি। সে-ছবি প্রথম দেখেছিলাম শিয়ালদহর মিত্র ইনস্টিটিশন স্কুলের দেওয়ালে। চমকপ্রদ সে ঘটনা। বলি তাহলে?

আরও পড়ুন: অম্বা যাওয়ার পথে দেখি আমার বয়সি তরুণদের কাঁধে বন্দুক! মৃদুল দাশগুপ্তর কলমে ‘সংবাদ মূলত কাব্য’ পর্ব ২৫…

তখন, সেই সময় উঠেছিল এক লাল হাওয়া। আমার ওই কৈশোরে। গত শতাব্দীর ছয়ের দশকের শেষভাগ। বসিরহাটের ক্লাস সেভেনের ছাত্র নুরুল যেবার কেরোসিনের দাবির মিছিলে পুলিশের গুলি খেয়ে মারা গেল, দুদ্দাড় করে আমরা দুনিয়ার সব ক্লাস সেভেনের বালকের দল ‘বড়’ হয়ে গেলাম। দেবদ্বিজে ভক্তি গেল উবে।

তবে কিনা, ওই সময়টাতেই, ১৯৬৯ বা ১৯৭০-এ তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে যখন গণআন্দোলন উত্তাল হয়ে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের বাসনায়, যশোরের কালিয়া গ্রামটি থেকে আমার মামার বাড়ির দুর্গাপুজো উঠে এল কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের মির্জাপুরের মিত্র ইনস্টিটিউশনে। কালিয়ার সেই সেনবাড়ির দুর্গাপুজোর নেমন্তন্নর চিঠি পেয়ে আমার বাবা অতি উৎসাহিত, মা-ও খুব উল্লসিত হল। নব‍্য-নাস্তিক আমি না-যাওয়ার জন‍্য গাঁইগুঁই করছিলাম, সে আপত্তি ধোপে টিকল না। ধাক্কাপাড়ের ধুতি পরল বাবা, মা তাঁতের ডুরে শাড়ি, আমরা তিন ভাই, এক বোন কমলালয়ের নতুন পোশাকআশাক পরে ট্রেনে হাওড়া গিয়ে ট‍্যাক্সিতে মির্জাপুরের মিত্র স্কুলে পৌঁছলাম। মামাবাড়ির দুর্গাঠাকুর দেখতে গিয়ে দেওয়ালে নজর পড়ল আমার। দেওয়াল থেকে যেন বিদ‍্যুৎচমক দিতে লাগল।

সবিস্ময়ে আমি দেখলাম, আলকাতরায় তুলির আঁচড়ে ঝকঝক করছে আমার লেখা ছড়া— একা কানু গেছে জেলে / তৈরি আছে হাজার ছেলে।

শ্রীরামপুরের আমাদের স্কুলে আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়ে এই ছড়া আমার বন্ধুরা দেওয়ালে লিখেছিল। পরে, শুনেছিলাম কোন্নগরে, চন্দননগরের স্কুলেও লেখা হয়েছে। তখন ছিল না কোনও মুঠোফোন, বৈদ‌্যুতিন আন্তর্জাল, তাও উড়তে উড়তে সে ছড়া গিয়েছে মির্জাপুরের মিত্র স্কুলের দেওয়ালেও! সে-কাল ছিল এইরকম। বিস্মিত হলাম, উত্তেজনা বোধ করলাম, পুলকিতও। কাউকে কিচ্ছুটি বললাম না। আর ওই ছড়ার ওপরেই ছিল মাও সে তুং-এর টুপি পরা মুখের ছবিটি!

সুমন মুখোপাধ্যায় নির্দেশিত ‘হারবার্ট’ চলচ্চিত্রর এক দৃশ্য

তারপর ওই যে বলেছি, ইন্টারনেট ছিল না, মোবাইল ছিল না, যেন বিদ‍্যুতের বিচ্ছুরণে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল মাওয়ের মুখের ওই ছাপাই ছবি। দমদমে মামাবাড়িতে গেলাম, যাদবপুরে কাকুদের বাড়িতে গেলাম, বর্ধমানে গেলাম, বহরমপুর গেলাম আত্মীয়দের বাড়িতে, দেখলাম দেওয়ালে দেওয়ালে চীনের চেয়ারম‍্যানের মুখচ্ছবি। টুপির তারাটি-সহ।

সেই বাল‍্যে, কৈশোরে, মফসসল বাংলায় আমরা খুব একটা শান্ত সুশীল ছেলে ছিলাম না, ফুটবল খেলতে গিয়ে, সাইকেল চালানো শিখতে গিয়ে, গাছ থেকে পড়ে গিয়ে, জল-কাদায় আছাড় খেয়ে আমাদের কারও কারও হাত-পা ভাঙত। তখন এক্সরে হত, ডাক্তারবাবু প্লাস্টার লাগিয়ে দিত। আমারই ডান-বাঁ দু’টি হাতই ভেঙে ছিল। একবার যখন দশম শ্রেণিতে পড়া ক্লাস ইলেভেনের মানিক এসে বলল, যাদের যাদের এক্স রে প্লেট আছে, আমাকে দিবি তোরা। তখনই জানলাম, কাঠগোলার ভজাদা বাটালি দিয়ে ওই এক্সরে প্লেট খুদে খুদে মাওয়ের মুখটি তৈরি করে দেবেন। একে বলে স্টেনসিল। দেওয়ালে ওই প্লেট সেঁটে আলকাতরা বোলালেই মাওয়ের মুখের ছাপাই ছবি। একটি স্টেনসিল দিয়ে অনেক অনেক ছাপাই ছবি দেওয়া দেওয়ালে দেগে দেওয়া যায়।

এসব অনেক যুগ আগের কথা। অর্ধশতাব্দীর অধিককালের। শ্রীরামপুরের বাড়িটি ছেড়ে ১৯৯২ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত বরানগরে বসবাস করেছিলাম। বরানগরে অলিতেগলিতে ঘুরতাম। ওই ঘোরাঘুরিতে একদিন দেখলাম, কয়েক বছরের বর্ষায়, কালের হাত বোলানোয় একটি দেওয়ালের রং মুছে আগের প্রলেপ এদিকসেদিক ফুটে উঠেছে। তাতে মাও সে তুং-এর আলকাতরার ছাপাই মুখটি মৃদু মৃদু ফুটে উঠেছে। অস্পষ্ট, ঝাপসা।