ন্যায়, যুদ্ধাপরাধ, ভ্রমণ

Representative Image

লেখাটির শিরোনাম, ‘আশ্রম ফর ওয়ার ক্রিমিনাল’। লেখাটি প্রকাশিত ভাস্টি মিডিয়ার অনলাইন প্ল্যাটফর্মে। গোটা প্রতিবেদনের ছত্রে-ছত্রে যে-ঘটনার কথা দাবি করা হচ্ছে, তা এক লাইনে লিখলে দাঁড়াবে, ইজরায়েল-সেনারা গাজায় হত্যালীলা চালানোর পরে, ভারতের বিশেষ কিছু অংশে ছুটি কাটাতে আসছে। ছুটি কাটিয়ে, মানসিক প্রতিবন্ধকতা দূর করে তারা আবার দেশে ফিরে যাচ্ছে। শুধু তাই-ই নয়, ভারতের সেই নির্দিষ্ট অঞ্চলের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে নিজেদের মতো করে গড়ে তুলছে তারা।

সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু সমাজমাধ্যমে দাবি করা হচ্ছে, এই ভ্রমণ নাকি ইজরায়েল সরকারের অনুমোদিত। সেই সঙ্গে ভারতের ওই নির্দিষ্ট অঞ্চলে ইজরায়েল সেনার উপস্থিত সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল কেন্দ্রীয় সরকার। ভারত সরকার তাদেরকে গ্রেফতার করার বদলে তোষামোদ করছে, এমনই দাবি করছে সমাজমাধ্যমগুলি। গাজায় অমানুষিক হত্যালীলা চালানোর পরেও কীভাবে ইজরায়েল সেনারা এখানে ফুরফুরে মেজাজে থাকতে পারছে? সবটাই হচ্ছে সমাজের সামনে, তবুও কেন চুপ কেন্দ্রীয় সরকার? আইনের গ্যাঁড়াকল না কি কূটনৈতিক চালে ইজরায়েল সেনারা এদেশে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে?

রাষ্ট্রের বানানো ‘ন্যারেটিভ’ ব্যবহার করেই মধ্যবিত্তর মগজ পুষ্ট করা সম্ভব? পড়ুন: ‘চোখ-কান খোলা’পর্ব ১৬

ভারত এবং ইজরায়েলের ইতিহাস শুরু থেকেই আজকের মতো ঘনিষ্ঠ ছিল না। স্বাধীনতার পর ভারত উপনিবেশ-বিরোধী নীতির অংশ হিসেবে, দীর্ঘদিন প্যালেস্টাইনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। ইজরায়েল রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিলেও, কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে চার দশকের বেশি সময় নেয়, যা শেষ পর্যন্ত ১৯৯৬ সালে বাস্তবায়িত হয়। তবু বহু বছর এই সম্পর্ক ছিল সীমিত। কিন্তু একুশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম, নজরদারি-ব্যবস্থা, সীমান্ত-প্রযুক্তি ও সামরিক সহযোগিতার মাধ্যমে এই সম্পর্ক দ্রুত গভীর হতে শুরু করে। এই প্রেক্ষাপটেই ২০২৩-২০২৪ সালে গাজা ভূখণ্ডে ইজরায়েলি সামরিক অভিযান নজিরবিহীন মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করে।

দীর্ঘদিনের অবরোধে বিপর্যস্ত এই ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে নির্বিচার বোমাবর্ষণে হাসপাতাল, বিদ্যালয়, শরণার্থী আশ্রয় ও আবাসিক এলাকা ধ্বংস হয়, রাষ্ট্রসংঘ ও একাধিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্টে হাজার-হাজার সাধারণ নাগরিক ও বিপুল সংখ্যক শিশুমৃত্যুর তথ্য নথিভুক্ত হয়। যুদ্ধের নিয়ম লঙ্ঘনের মতো গুরুতর অভিযোগ ওঠে। যদিও ইজরায়েল সরকার একে আত্মরক্ষা হিসেবে দাবি করে এবং আন্তর্জাতিক বিচারব্যবস্থার দায় স্বীকার করে না। এই ভয়াবহ অভিযানের পরে বহু ইজরায়েলি সেনা, বিশেষ করে তরুণরা, গভীর মানসিক আঘাত ও যুদ্ধোত্তর মানসিক সংকটে ভুগতে শুরু করে, যা সে দেশের সমাজে নতুন নয়। কিন্তু গাজা অভিযানের পরে এই সংকটের মাত্রা আরও বেড়েছে।

এই অবস্থায় কিছু সেনা বা সদ্য প্রাক্তন সেনা ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে দেশ ছেড়ে দূরে যেতে চায়। বহু দশক ধরেই সামরিক পরিষেবা শেষে দীর্ঘ বিদেশভ্রমণ ইজরায়েলি সমাজে প্রচলিত একটি রীতি আর সেই ভ্রমণপথে ভারত, বিশেষ করে হিমালয়সংলগ্ন কিছু পর্যটনকেন্দ্র, দীর্ঘদিন ধরেই জনপ্রিয় গন্তব্য। ইতালির একটি সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে দেখা গিয়েছে, গাজা থেকে ফিরে কেউ-কেউ হিমালয়ের নির্জন এলাকায় ট্রেকিং, নিঃসঙ্গতা বা সাময়িক বিরতির মাধ্যমে যুদ্ধের স্মৃতি থেকে দূরে থাকতে চাইছে। যদিও এটিকে কোনও রাষ্ট্রীয় বা সামরিক কর্মসূচি হিসেবে কোথাও বর্ণনা করা হয়নি। তবু গাজায় গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের এই পটভূমিতে ইজরায়েলি সেনাদের ভারত ভ্রমণ কেবল পর্যটনের বিষয় হয়ে থাকে না। এখানে নৈতিক প্রশ্ন উঠে আসে, ভারত আইনগতভাবে এদের সাধারণ পর্যটক হিসেবে দেখলেও, ইজরায়েলের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান কৌশলগত ঘনিষ্ঠতা ও রাষ্ট্রীয় নীরবতা কি ধীরে-ধীরে যুদ্ধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগকে স্বাভাবিক করে দিচ্ছে?

ইজরায়েলি সেনা বা সদ্য প্রাক্তন সেনারা ভারতে মূলত কয়েকটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে বেশি আসছে এবং এই উপস্থিতি ধীরে-ধীরে সেই জায়গাগুলোর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চেহারাতেও প্রভাব ফেলছে। উত্তর ভারতের হিমাচল প্রদেশের পার্বত্য অঞ্চল, বিশেষ করে কুল্লু, মানালি, কাসোল উপত্যকা দীর্ঘদিন ধরেই ইজরায়েলি পর্যটকদের জনপ্রিয় গন্তব্য। একইভাবে উত্তরাখণ্ডের ঋষিকেশ ও ধর্মীয় আশ্রমঘেরা এলাকাতেও তাদের উপস্থিতি চোখে পড়েছে। পশ্চিম ভারতের গোয়া আর রাজস্থানের পুষ্কর অঞ্চলেও ইজরায়েলি পর্যটকদের আলাদা একটি ঘনত্ব দেখা যায়। এই সব জায়গায় ধীরে-ধীরে হিব্রু ভাষার সাইনবোর্ড, ইজরায়েলি খাবারের দোকান, নির্দিষ্ট অতিথিশালা ও ভ্রমণব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, যা স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে এক ধরনের নতুন বিদেশি সংস্কৃতির মিশ্রণ তৈরি করছে। এই উপস্থিতির সাংস্কৃতিক প্রভাব দ্বিমুখী। একদিকে স্থানীয় ব্যবসা,পর্যটন ও অর্থনীতিতে নতুন সুযোগ তৈরি হচ্ছে। হোটেল, খাবারের দোকান, যানবাহন পরিষেবা ইত্যাদিতে স্থানীয় মানুষ লাভবান হচ্ছে। অন্যদিকে, কিছু অঞ্চলে মাদক সেবন, উচ্চ শব্দে রাতভর মোচ্ছব, ধর্মীয় বা সামাজিক রীতিনীতির প্রতি উদাসীন আচরণ স্থানীয় সমাজে অস্বস্তি তৈরি করছে। পাহাড়ি গ্রাম বা ধর্মীয় শহরগুলিতে যে সংযত জীবনযাত্রা ছিল, সেখানে আচরণগত পরিবর্তন নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভও জমছে। আবার দীর্ঘ সময় ধরে এক জায়গায় অবস্থানের ফলে স্থানীয় তরুণদের জীবনধারা, পোশাক, খাবার ও বিনোদনের রুচিতেও প্রভাব পড়ছে। ফলে ইজরায়েলি সেনাদের এই ভ্রমণ শুধু ব্যক্তিগত বিশ্রাম বা পর্যটনের বিষয় হয়ে থাকছে না, এটি ধীরে-ধীরে ভারতের কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চলের সামাজিক কাঠামো, সাংস্কৃতিক পরিবেশ ও নৈতিক আলোচনাকেও প্রভাবিত করছে, যার সঙ্গে গাজা যুদ্ধের স্মৃতি ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিতর্ক অদৃশ্য ভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে।

গাজায় ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও শিশু মৃত্যুর অভিযোগ ওঠার পরেও, কীভাবে ইজরায়েলি সেনারা অন্য দেশে ছুটি কাটাতে পারে? এর উত্তর লুকিয়ে আছে আন্তর্জাতিক আইন ও রাজনীতির বাস্তব কাঠামোয়। যুদ্ধের সময়ে একজন সেনা সাধারণত রাষ্ট্রের নির্দেশে কাজ করে বলে তার দায় ব্যক্তিগত অপরাধ হিসেবে সঙ্গে-সঙ্গে নির্ধারিত হয় না। ফলে কোনও নির্দিষ্ট তদন্ত বা আদালতের আদেশ না থাকলে, সে স্বাভাবিক নাগরিকের মতোই যাতায়াত করতে পারে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত— যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার করতে পারে, কিন্তু সব দেশ এই আদালতের কর্তৃত্ব মানে না। ইজরায়েলও সেই আদালতের অধিকার স্বীকার করে না, ফলে সেখানে যুক্ত সেনাদের বিরুদ্ধে সরাসরি আন্তর্জাতিক গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা কঠিন হয়ে পড়ে। অন্য কোনও দেশ তখনই কাউকে গ্রেফতার করতে পারে, যখন তার বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট আদালতের পরোয়ানা থাকে অথবা সেই দেশ নিজস্ব আইনে গুরুতর আন্তর্জাতিক অপরাধের জন্য বিদেশি নাগরিকের বিচার করার অধিকার প্রয়োগ করে। বাস্তবে এই ক্ষমতা খুব কম দেশই ব্যবহার করে, কারণ এতে কূটনৈতিক সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি থাকে। একদিকে রাষ্ট্রসংঘ ও মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্টে গাজায় গণহত্যা ও যুদ্ধের নিয়ম লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠে আসছে, অন্যদিকে সেই অভিযানে অংশ নেওয়া সেনারা আইনের ফাঁকফোকরের সুযোগে অন্য দেশে পর্যটক হিসেবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই বৈপরীত্যই আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় নৈতিক সংকট, যেখানে অপরাধের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও, শক্তিশালী রাষ্ট্রের নাগরিকদের ক্ষেত্রে বিচার ও দায়বদ্ধতা বহু সময়েই বিলম্বিত বা অনুপস্থিত থেকে যায়।

অনেকে দাবি করেছেন, ইজরায়েলি সেনারা নাকি ভারতে ‘ডিটক্স’ করতে এসেছে, কিন্তু তথ্য বলছে এই দাবি সরকারি ভাবে সত্য নয়। ভারতীয় বা ইজরায়েলি সরকারের কোনও নথি, ঘোষণা বা নীতিতে এমন কোনও কর্মসূচির উল্লেখ নেই, যেখানে গাজা যুদ্ধের পরে সেনাদের মানসিক পুনর্বাসনের জন্য ভারতে পাঠানো হয়েছে। অর্থাৎ এটি কোনও সরকার অনুমোদিত বা রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা নয়।

বাস্তবে ইজরায়েলে বাধ্যতামূলক সামরিক পরিষেবার পরে, বহু তরুণ ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে দীর্ঘ বিদেশভ্রমণে যায়, এটি বহু দশকের পুরনো সামাজিক রীতি। গাজা যুদ্ধের পর কিছু মানুষ মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পেতে ভারতে এসেছে বলে সাংবাদিক প্রতিবেদনে উঠে এলেও, সেগুলো ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা, সরকারি নীতির নয়। এ-প্রসঙ্গে ‘ডিটক্স’ শব্দটি মূলত সামাজমাধ্যম ও রাজনৈতিক ভাষ্যের সৃষ্টি। যুদ্ধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের প্রেক্ষিতে এই ভ্রমণকে নৈতিক প্রশ্নের সঙ্গে জুড়ে দেখানো হচ্ছে, কিন্তু তথ্যগত ভাবে এগুলো ব্যক্তিগত পর্যটনই।

অনেকে দাবি করেছেন ইজরায়েলি সেনারা নাকি ভারতে ‘ডিটক্স’ করতে এসেছে, কিন্তু তথ্য বলছে এই দাবি সরকারি ভাবে সত্য নয়। ভারতীয় বা ইজরায়েলি সরকারের কোনও নথি, ঘোষণা বা নীতিতে এমন কোনও কর্মসূচির উল্লেখ নেই, যেখানে গাজা যুদ্ধের পরে সেনাদের মানসিক পুনর্বাসনের জন্য ভারতে পাঠানো হয়েছে।

ভারতের পর্যটন দপ্তরের হিসেব অনুযায়ী, প্রতি বছর দেশে এক কোটির বেশি বিদেশি পর্যটক আসে, কিন্তু তাদের মধ্যে কে মানসিক বিশ্রাম, কে ধর্মীয় উদ্দেশ্যে, কেই-বা নিছক ভ্রমণে এসেছে, এইভাবে আলাদা করে কোনও শ্রেণিবিভাগ করা হয় না। ইজরায়েল থেকে প্রতি বছর আনুমানিক সত্তর থেকে আশি হাজার পর্যটক ভারতে আসে, এই তথ্য বিভিন্ন কূটনৈতিক ও পর্যটন প্রতিবেদনে পাওয়া যায় এবং এদের বড় অংশই তরুণ, যারা সামরিক পরিষেবা শেষ করে দীর্ঘ ভ্রমণে বেরোয়। তবে এই সংখ্যাটি মোট বিদেশি পর্যটকের তুলনায় খুবই ছোট এবং কোনও সরকারি নথিতে ভারতকে মানসিক পুনর্বাসন বা যুদ্ধ-পরবর্তী ডিটক্সের কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি।

ইতিহাস বলছে, শুধু ইজরায়েল নয় যুদ্ধ বা সহিংস অভিযানের পরে অন্য দেশের সেনারাও ব্যক্তিগতভাবে ভারতে এসেছে, তবে কখনওই তা কোনও সরকারি বা রাষ্ট্রীয় পুনর্বাসন কর্মসূচি হিসেবে হয়নি। নয়ের দশক থেকে আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধে অংশ নেওয়া কিছু আমেরিকান ও ইউরোপীয় সেনা যুদ্ধশেষে ভারতে ভ্রমণে এসেছে বলে পর্যটন ও সাংবাদিক প্রতিবেদনে উল্লেখ পাওয়া যায়। বিশেষ করে গোয়া, হিমালয় ও আশ্রমকেন্দ্রিক এলাকায়। ভিয়েতনাম যুদ্ধের পরও কিছু পশ্চিমি সেনা ও প্রাক্তন সেনা ভারতে এসে আত্মান্বেষণ, ধর্মচর্চা, নিছক বিচ্ছিন্নতা খুঁজেছিল, যা তখনকার হিপি ট্রেল এর অংশ হয়ে ওঠে। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এই সব ক্ষেত্রেই তারা ব্যক্তিগত পর্যটক বা প্রাক্তন সেনা হিসেবে এসেছে। কোনও দেশই আনুষ্ঠানিকভাবে হত্যালীলার পরে সেনাদের ভারতে পাঠায়নি। যুদ্ধোত্তর মানসিক পলায়নের প্রবণতা আন্তর্জাতিক হলেও ভারত কখনওই কোনও দেশের জন্য সরকার অনুমোদিত ডিটক্সকেন্দ্র ছিল না। বরং ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত, আইনি ফাঁকফোকর ও পর্যটন সংস্কৃতির মিলনেই এই উপস্থিতি তৈরি হয়েছে।