দরিয়াগঞ্জের আকাশ অংশত মেঘলা। দশ মিনিট হাঁটলে জ়িনাত-আল মসজিদ। দিল্লি গেট মেট্রো স্টেশনে নামছি যখন, টের পেলাম যোহরের নামাজ শেষ হয়নি। তিন নম্বর গেটের বাইরে মুহূর্মুহূ গজরানি। স্লোগান। থ মেরে যাওয়া রবিবারের ক্ষীণ ট্রাফিক। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের একটা মিছিল। পেছন ফিরে তাকালে, কোনও আদিমকালের জওহরলাল নেহেরু। চোখে, মাথায় আর বুকপকেটে পায়রাসমূহের বিস্তৃত ছোপ-ছোপ মল। মুখে মাস্ক নেই। আমরা হাঁটব নেহেরু-মূর্তির বিপরীতে। ডানপাশে, সমান্তরালে, আনসারি রোড। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস। নয়াদিল্লির অসংখ্য পাবলিশিং হাউস। আর বাঁ-দিকে, ছোলে-ভাটুরে আর সস্তার লেবুজলের ঠেলাগাড়ি এ-পাশ ও-পাশ রেখে জ্বলজ্বল করছে রবিবারের বই-বাজার।
আরও পড়ুন: কীভাবে কলকাতা হয়ে উঠল গির্জানগর? লিখছেন রামিজ আহমেদ
ব্রিটানিয়া ফিফটি-ফিফটি! ফিফটি-ফিফটি! শেষ আধঘণ্টা ধরে দুই বই-বিক্রেতা চিৎকার করছেন। ইতিহাসের নিরিখে, এ-বাজারে ওঁরা নতুন। মোটে পাঁচ বছর হল। ব্যাকগ্রাউন্ডে একগুচ্ছ বোগেনভিলিয়া। লাল। মাথার ওপর যে-পোস্টারখানা ঝুলছে, অর্থ হয়— যে কোনও বই, মাত্র ৫০ টাকা। জে. কে. রাওলিং, চেতন ভগত, জালালউদ্দিন রুমি, সুধা মূর্তি। লিস্ট লম্বা এবং প্রতিটি বইয়ের পাতাই কিঞ্চিৎ চকমকে।

বিস্কুটের বিজ্ঞাপনী ক্যাচলাইনে, বই যখন খাপে খাপ! তাহলে আরও দু’কদম চলতে আপত্তি ঘোর? ওই যে দেখুন, শ্রীমদ্ভগবদগীতা এবং অরুন্ধতী রায়ের ‘মাদার মেরি কামস টু মি’— কী আশ্চর্য সহাবস্থান! পাশে বসে ছিলেন ষাটোর্ধ্ব মহেশ কুমার। দীর্ঘ চার দশকের ব্যবসা। বেড়ে উঠেছেন বইয়ের সঙ্গে সঙ্গেই। ত্রিপলের ওপরে, আর্থার মিলারের ‘ডেথ অফ আ সেলস ম্যান’। খুশওয়ান্ত সিং-এর একটি উপন্যাস, ‘দিল্লি’। জওহরলাল নেহেরুর আত্মজীবনী—‘টুওয়ার্ডস ফ্রিডম’। সাজিয়ে রাখছিলেন একে-একে। আর বলছিলেন, এই পিডিএফের যুগে নতুন প্রজন্ম আর বই কিনতে আসে না তেমন। খুঁজে-খুঁজে বই পড়ার আগ্রহও বোধহয় চলে যাচ্ছে। যেহেতু উল্টেপাল্টে দেখছিলাম খুশওয়ান্ত সিং, এক ঝলক তাকিয়ে বললেন, আমার রেগুলার কাস্টোমার! প্রতি রবিবার। একেবারে বাঁধাধরা নিয়ম ছিল। আকাশ রং পালটে নেয় ততক্ষণে। রোদ মরে আসে। অকস্মাৎ সব ঝাপসা। মহেশবাবুর ত্রিপলের সামনেই বসে পড়ি।
ব্যাকগ্রাউন্ডে একগুচ্ছ বোগেনভিলিয়া। লাল। মাথার ওপর যে-পোস্টারখানা ঝুলছে, অর্থ হয়— যে-কোনও বই, মাত্র ৫০ টাকা। জে. কে. রাওলিং, চেতন ভগত, জালালউদ্দিন রুমি, সুধা মূর্তি। লিস্ট লম্বা এবং প্রতিটি বইয়ের পাতাই কিঞ্চিৎ চকমকে।
একটা-দুটো মানুষের আসা যাওয়া লেগেই থাকে। তবু খুশওয়ান্ত সিং লিখছেন, এক হিজড়ে ও দিল্লির কথা। অযুত-নিযুত মানুষের ঠাঁটিয়ে চড়, খিস্তি, আর অসম্মতিপূর্ণ যৌনতায় উভয়েই অভ্যস্ত। তাই যে প্রত্নযুগের প্রেম, প্রাচীন সেই সম্মোহন অথবা লাস্যমাখা চাহনি— লুকিয়ে রাখে গভীরে। প্রেমিক হও! দেখতে পাবে সেই প্রণয়ভরা মুখ। নইলে মনে হবে, কী কুৎসিত! গা ঘিনঘিনে। মহেশবাবু গল্প বলছিলেন। ১৯৬৪। দরিয়াগঞ্জের ফুটপাথ। পাতরি কিতাব বাজার। সেই সময়ে বইয়ের দোকানের সংখ্যা মেরেকেটে ৩০। অস্থায়ী। সকাল আটটা থেকে সন্ধে সাতটা। শুধুমাত্র সেকেন্ডহ্যান্ড বই। সাম্প্রতিককালে পাঠকের রুচি বদলে গেছে, বই-বিক্রেতার মন বদলে গেছে, তেমনই বদলে গেছে বই-বাজারের ঠিকানা। শুরুয়াতে, জামা মসজিদের কাছে। কস্তুরবা গান্ধী হাসপাতাল সংলগ্ন অঞ্চল। ২০১৯ সালে যখন দিল্লির মিউনিসিপাল কর্পোরেশান সিদ্ধান্ত নেয়, রাজধানীর সমস্ত ফুটপাথ খালি করতে হবে, অথবা ফুটপাথে বই-বাজার যেন অশোভন। সেই মুহূর্ত থেকে রবিবারের বই-বাজারের নতুন ঠিকানা, আসাফ আলি রোডের পাশে, মহিলা হাট। এতদিন পরিত্যক্ত ছিল। অগুনতি ভাঙাচোরা দোকানের আদল। রবিবার এলে, প্রাণ পায়। শ্বাস নেয়। ফুলের মতো ফুটতে থাকে জেমস হ্যাডলি চেজের একাধিক থ্রিলার। জাপানি মাঙ্গা সিরিজ। ড্যান ব্রাউন।

মহেশবাবুর দোকান ছেড়ে এগিয়ে যাই। এইবার চোখে পড়তে শুরু করে ভারতবর্ষের বহু এন্ট্রান্স-পরীক্ষার বই। ইউপিএসসি। জয়েন্ট এন্ট্রান্স। নিট। ইউজিসি নেট। এসএসসি সিজিএল। উপচে পড়ছে স্কুল আর কলেজ-পড়ুয়া। সঙ্গে একাডেমিক বই। রিসার্চ স্কলার। কেজিদরে খাতা। ওদিকে, বইয়ের দাম আরও কমতে থাকে। শোনা যায়, একশো টাকায় চারটে বই। থমকে যাই অদ্ভুত এক দোকানে। সন্দীপ বিদ্যার্থী। ঢালাও পোস্টেজ স্ট্যাম্পের পশরা সাজিয়ে বসেছেন। দুষ্প্রাপ্য কয়েন। কিছু পোস্টকার্ড। এ হল তিন প্রজন্মের সংগ্রহ। ব্যবসাও। ১৯১০। সন্দীপের ঠাকুরদা, রঘুবীর প্রসাদ চাকরি করছেন রেঙ্গুনে। ভারতীয় পোস্ট এবং টেলিগ্রাফ ডিপার্টমেন্টে। যখন বাড়ি ফিরতেন এলাহাবাদে, লুকিয়ে নিয়ে আসতেন সোনার গিনি। রেঙ্গুনের টাকা। পোস্টেজ স্ট্যাম্প। সন্দীপ বললেন, ব্যবসার পরিসর কমে গেছে ইদানীং। এই নতুন জায়গায়, স্পেসও অনেক কম। তবু আসেন কেন? বইবাজারের সঙ্গেই বুড়ো হব তো!
বাজার শেষের পথে, অ্যামাজন-ফ্লিপকার্টে যে-সমস্ত বই সহজলভ্য, তাদের দিকে তাকাই না। বরং চোখ চলে যায়— উর্দু ভাষায়, সাদাত হাসান মান্টোর গল্পের বই, অমৃতা প্রীতমের ‘কাগাজ তে ক্যানভাস’ কাব্যগ্রন্থের প্রথম সংস্করণে। দেখি আর. কে. লক্ষণের ‘দ্য আনকমন ম্যান’-এর খুব পুরনো একটি সংগ্রহ। পীযূষ মিশ্রর একটি কবিতার বই, ‘কুচ ইশক কিয়া কুচ কাম কিয়া’। ইতিমধ্যেই কেউ টিফিনবাক্স খুলে ভাগ করে নেয় রুটি আর ডাল। কেউ বলে, ‘গীতা কেন শ্রেষ্ঠ।’ কেউ আবার বলে, ‘ইসলামের পথে নারীদের ভূমিকা কী।’


পাঠক, আরও হাঁটতে চান? আসুন, আলাপ করিয়ে দিই ফারুক আহমেদের সঙ্গে। বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে। মাথায় কয়েকগোছা চুল। এক পৃথিবী সোয়্যাগ নিয়ে বসে আছেন চেয়ারে। যেন বই-বাজারের একমাত্র ডন। বলছেন, তিরিশ বছর ধরে পুরনো বইয়ের ব্যবসায়। দুর্মূল্য বই সংগ্রহ করতে যে-কোনও দিকেই চলে যেতে পারি। লাইব্রেরি, কাবাড়িওয়ালার ঠেলা। উভয়ই ঘেঁটে দেখতে প্রস্তুত। আ হিস্ট্রি অফ ওয়েস্টার্ন ফিলজফি। লেখক? বার্ট্রান্ড রাসেল। দ্য ক্যালকাটা সাইকি। জার্মান এক্সপ্রেসনিস্ট সিনেমা সংক্রান্ত একটি আশ্চর্য বই। চমক লাগে। দেখলাম, একবাক্স সোভিয়েতের বই আলাদা করে রাখছেন। আস্ত বই-বাজারে প্রোগ্রেসিভ পাবলিশার্সের বই চোখে পড়ল এই প্রথম। ইভান তুর্গেনিভের ফাদার অ্যান্ড সনস। তৎক্ষণাৎ এক যুবক এলেন। ফারুক সেই বাক্সে কার্ল মার্ক্সের তিন খণ্ডের ক্যাপিটাল ভরে, কষে বাঁধলেন। সেই যুবকের দিকে চোখ রেখে ফারুক বললেন, রেগুলার কাস্টমার। সোভিয়েত বইপত্তরের প্রতি অগাধ লোভ! ফারুকের অ্যাসিস্টেন্ট আমার সামনে তখন মেলে ধরেছেন, হলিউডের ইতিহাস। পল সেজানের চমৎকার একটি বই। ফরাসি পাবলিকেশান। রেখার আত্মজীবনী হাতে নিয়ে অবাক বালকের মতো হাসলেন। বললেন, শৈশবের খোয়াব! অভিতাভ বচ্চনের সঙ্গে দেখা হলে, এ-বই উপহার দেব। বই-বাজারের আট থেকে আশি, একত্রে, হেসে উঠবেন এরপর। এরপর শীত ঘন হবে। একজন বললেন, এক বস্তা মাল বেচতে পারলাম না আজও। শাহাজানাবাদ মুচকি হাসে শুধু।



