অনুবাদ পেরিয়ে

Representative Image

‘রাত ঠিক আড়াইটের সময়ে আবার ঘুম ভেঙ্গে গেল আকাশের। মাথার পেছনে দুই হাতের তেলো রেখে স্থির হয়ে শুইয়ে রইল আকাশ। মাথার কাছে নাইট ল্যাম্প জ্বলছে। মৃদু আলোকে মৃদুতর করা হয়েছে কালো বনাত ঘিরে। সেই আলোয় অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে ছেলের মুখটা। একপাশ ফিরে, বাঁ হাতের বুড়ো আঙ্গুল মুখে পুরে, ডান হাত সামনে বাড়িয়ে খামচে ধরেছে আকাশের গেঞ্জি। এক বছরের শিশুকে কেউ শিখিয়ে দেয়নি কাকে অবলম্বন করে তাঁকে বেঁচে উঠতে হবে।’


অদ্রীশ বর্ধনের আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘তখন নিশীথ রাত্রি’-এর অংশটি উঠে এসেছে তাঁর জীবন থেকেই। ছ’য়ের দশকে অদ্রীশ বর্ধন যখন ‘আশ্চর্য’ পত্রিকা শুরু করলেন, তখন বাংলায় কল্পবিজ্ঞান লেখককের সংখ্যা নগন্যপ্রায়। পত্রিকার পাতা ভরানোর জন্যে সম্পাদনার পাশাপাশি দু’হাতে লিখেছেন মৌলিক গল্প, প্রবন্ধ আর অনুবাদ গল্প। প্রেমেন্দ্র মিত্রেরই পরামর্শে আকাশ সেন নামে প্রকাশ করতে থাকেন পত্রিকা। এর জন্যে লালবাজার থেকেও ডাক পান তিনি। স্মৃতিচারণায় তিনি বলেছিলেন— ‘আমার জানা ছিল না ছদ্মনামে সম্পাদনা করা বেআইনি।… ততকালীন ডিসি হেডকোয়ার্টারে ডেকে পাঠিয়ে প্রথমে খুব খোশগল্প করলেন। পরে আসল কথাটা পাড়লেন। জানিয়ে দিলেন ছদ্মনামে পত্রিকা করা যায় না।’

আরও পড়ুন: বাংলা সাহিত্যে কল্পবিজ্ঞানের প্রথম লেখক জগদানন্দ রায় বিস্মৃতই রয়ে গেলেন! লিখছেন দীপ ঘোষ…

পত্রিকা চালানোর সময়েই সাহায্য পেয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, দিলীপ রায়চৌধুরী প্রমুখ সাহিত্যিকদের। এশিয়ার প্রথম সায়েন্স ফিকশন সিনে ক্লাব থেকে ‘সবুজ মানুষ’ নামের সায়েন্স ফিকশন রেডিও স্টোরি আর এসেফ পত্রমৈত্রী ক্লাব— বাংলা কল্পবিজ্ঞানের জগতে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিলেন তিনি। সত্তর সালে বিয়ের একবছর পরে, তাঁর স্ত্রী এক শিশুপুত্রের জন্ম দেন। দুর্ভাগ্যক্রমে পরের বছরেই স্ত্রীবিয়োগ ঘটে। সত্যজিৎ রায়ের পরামর্শে পত্রিকা বন্ধ করে শিশুপুত্রটিকে বড় করার দিকে নজর দেন তিনি। সেই সময়েই তিনি লেখেন জীবনের একমাত্র সামাজিক উপন্যাসটি। আশ্চর্যভাবে উপন্যাসটি প্রকাশের পরেই, তিনি নিজে সেটি তুলে নেন। পরিবারের থেকে জানা যায় তাঁর সিদ্ধান্ত ছিল মৃত্যুর আগে পর্যন্ত যেন বইটি প্রকাশ না পায়। বইটির পাতায় পাতায় উঠে এসেছে এক অপার প্রতিশ্রুতিমান তরুণের কথা। দক্ষিণ ভারতে লোভনীয় চাকরি ছেড়ে সেই তরুণ কলকাতায় ফিরে সাহিত্যসাধনার বাসনায় হাতে তুলে নেয় কলম। স্ত্রীবিয়োগের যাতনা ভুলে যেতে সেই তরুণই আবার আশ্রয় নেয় সাহিত্যের। রাত জেগে শুরু হয় জুল ভার্নের অনুবাদ। পাশে সদ্য মা-হারা শিশুটিকে নিয়ে পাতার পর পাতা অনুবাদ করতে থাকেন তিনি।

অদ্রীশ বর্ধনকে সাহিত্যের একটি ধারায় বা সাহিত্যকর্মী হিসাবে একটি ভূমিকায় বাঁধা সম্ভব নয়। একদিকে যেমন আশ্চর্য, ফ্যান্টাসটিক বা কিশোর মনের সম্পাদক হিসাবে একনিষ্ট ভাবে কাজ করে গেছেন, গড়ে তুলেছেন কল্পবিজ্ঞান ও ফ্যান্টাসি লেখকদের প্রজন্মকে। আবার মৌলিক কল্পবিজ্ঞান ও গোয়েন্দা ধারায় লিখেছেন নাট বল্টু চক্র ও ইন্দ্রনাথ রুদ্রের মতো চরিত্রদের নিয়ে। প্রকাশক হিসাবে শুরু করেছিলেন আলফা-বিটা পাবলিকেশন সেই ছ’য়ের দশকেই। তারপরে বাড়িতে বসিয়েছিলেন নিজের প্রেস ‘দীপ্তি প্রিন্টার্স’। এরপর বহুদিন চালিয়েছেন ফ্যান্টাসটিক প্রকাশনা। বইমেলাতে ফ্যান্টাসটিকের স্টলে নিজে বসতেন প্রতি বছর। এসব বাদ দিয়েও শুধু অনুবাদের জন্যেই কিন্তু চিরকাল অদ্রীশ বর্ধনকে মনে রাখতে পারে বাঙালি।

১৯৬৩ সালে যখন প্রথম কল্পবিজ্ঞান পত্রিকা ‘আশ্চর্য’ শুরু হয়, লেখার অভাবে অদ্রীশ ও অন্যান্য লেখকদের তাকাতে হয় বিদেশি অনুবাদের দিকে। বাংলায় এর আগে প্রকৃত কল্পবিজ্ঞান নিয়মিতভাবে লিখেছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র ও হেমেন্দ্রকুমার রায়-ই। তাই দেখতে পাই ‘আশ্চর্য’-র প্রথম দুই বছরের মধ্যেই অদ্রীশ অনুবাদ করেছেন— জুল ভের্ন, এডগার অ্যালান পো, রবার্ট লুই স্টিভেনশন, জন উইন্ডহ্যাম, অ্যালেকজান্ডার বেলায়ভ, আর্থার কোনান ডয়েল প্রভৃতি বহু দিকজয়ী কল্পবিজ্ঞান লেখকের গল্প। এছাড়াও সিনে ক্লাবে যে সমস্ত সাইফি সিনেমা দেখানো হত, সেগুলি অবলম্বনেও লিখেছেন বেশ কিছু সংক্ষিপ্ত কাহিনি— দি ইঙ্ক্রেডিবল শ্রিংকিং ম্যান, ফার্স্ট মেন ইন দ্যা মুন, দ্যা অ্যাম্ফিবিয়ান ম্যান, দি থিং দ্যাট কুডনট ডাই প্রমুখ। পরবর্তীকালে এমনভাবেই লিখেছেন ইটি, কালো গর্ত, মেঘদীপের আতঙ্ক, নরবানরের গ্রহে প্রভৃতি বই।

সাতের দশক থেকে তিনি মনোনিবেশ করেন বিখ্যাত লেখকদের বইগুলি সম্পূর্ণ করার কাজে। প্রথমে জুল ভের্নের সমস্ত গল্পের অনুবাদ সম্পূর্ণ করে তিনি। এরপর হাত দেন শার্লক হোমসের সমস্ত গল্প অনুবাদে। শুধুমাত্র কোনান ডয়েলই নন, ওঁর পুত্র অ্যাড্রিয়ান কোনান ডয়েল ও জন ডিক্সন কার প্রকাশিত শার্লক হোমসের প্যাশটিশ গল্পগুলিরও অনুবাদ করেছিলেন তিনি। এছাড়াও অ্যানোটেটেড শার্লক হোমস অনুসরণ করে শার্লকের জীবনের উপরেও একটি ধারাবাহিক লিখেছিলেন। এরপর ফ্যান্টাসটিক পত্রিকার পাতায় তিনি অনুবাদ করেছেন আর্থার সি ক্লার্ক, রবার্ট হেইনলেইন, আইজাক আসিমভ এইচ জি ওয়েলস, এইচ রাইগার হ্যাগার্ড, ইভান ইয়েফ্রেমভ, এইচ পি লাভক্র্যাফট প্রমুখ অসংখ্য লেখকের গল্প-উপন্যাস।

গোয়েন্দা গল্পের মধ্যে তিনি শার্লক ছাড়াও জি কে চেস্টারটন রচিত আর-এক জগত বিখ্যাত গোয়েন্দা ফাদার ব্রাউনের গল্পগুলির সম্পূর্ণ অনুবাদ করেছেন। ছ’য়ের দশকে অমৃত পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে বেরোত শার্লক আর ফাদার ব্রাউনের গল্পগুলির অনুবাদ। অদ্রীশের অনুবাদের বৈশিষ্ট্য ছিল— অনেকসময়েই তিনি গল্পগুলিকে এনে ফেলতেন বাংলাদেশে, পালটে দিতেন চরিত্রগুলির নাম। ঠিক এইভাবে ফাদার ব্রাউন হয়ে গিয়েছিল ফাদার ঘনশ্যাম মন্ডল। তাঁর অনেক কেসের মধ্যে জুড়ে গেছিল ইন্দ্রনাথ রুদ্রের নাম। আবার ইন্দ্রনাথ রুদ্রের অনেক গল্পের মধ্যে পাওয়া যায় ইয়ান ফ্লেমিং এর জেমস বন্ডেরও ছোঁয়া। জেমস বন্ডের গল্পও তিনি অনুবাদ করেছেন একসময় একটি সংকলনের জন্যে।

হরর সাহিত্যের মধ্যে বাংলায় এইচ পি লাভক্র্যাফটের গল্পের অনুবাদ সর্বপ্রথম তিনিই করেন। ফ্যান্টাসটিক, আনন্দমেলা প্রভৃতি পত্রিকায় লাভক্রফটের বেশ কিছু গল্পের অনুবাদ প্রকাশ পেলেও শুধুমাত্র ‘দ্যা কেস অফ চার্লস ডেক্সটার ওয়ার্ড’ উপন্যাসটিই বই আকারে প্রকাশ পায়। অদ্রীশের মৃত্যুর পরে তাঁর পরিবারের সহায়তায় লাভক্রফটের অনুবাদের পাণ্ডুলিপিগুলি উদ্ধার হয়েছে। হরর সাহিত্যের আরেক সম্রাট এডগার অ্যালান পো-এর সমস্ত গল্প উপন্যাসের অনুবাদের কৃতিত্বও একমাত্র অদ্রীশ বর্ধনেরই।

বিশ্ববিখ্যাত ফ্যান্টাসি সাহিত্যের মধ্যে সি এস লুইসের দ্যা ক্রোনিকল অফ নার্নিয়া অবলম্বনে আশ্চর্য আলমারি, এডগার রাইজ বারোজের টারজান এবং জে আর আর টলকিনের লর্ড অফ দ্যা রিংসেরকিছু অংশ অনুবাদ করেছিলেন তিনি।

শুধু ইংরেজি ভাষার সাহিত্যই নয়, কথাসরিতসাগরের অনুবাদও করেছিলেন অদ্রীশ বর্ধন।

অদ্রীশ বর্ধনের অনুবাদের উপরে অভিযোগ এসেছে যে— বঙ্গীকরণ করতে গিয়ে তিনি বহু অংশ বাদ দিয়েছেন। অদ্রীশ যখন অনুবাদ করতেন, তখন বাঙালি পাঠকের কাছে ইংল্যান্ড-আমেরিকা গ্লোবালাইজেশনের দৌলতে এতটা কাছে চলে আসেনি। সাত ও আটের দশকের শিশু-কিশোররা এই অনুবাদগুলির মাধ্যমেই বিশ্বসাহিত্যের এবং পাশ্চত্যবিশ্বের স্পর্শ পেত। তাই আক্ষরিক অনুবাদ করে মূল পাঠের কাছাকাছি থাকার চেয়ে, সহজে শিশুমনকে যাতে ছুঁয়ে যাওয়া যায়, সেটাই উদ্দেশ্য ছিল তাঁর। বিশেষ করে উনিশ বা বিংশ শতকের শুরুতে— ইংরেজি গদ্যে যেরকম দীর্ঘ বর্ণনামূলক বাক্যের প্রথা ছিল, তা অনুবাদসাবলীল হওয়ার পক্ষে অন্তরায় ছিল। তাই পাঠক যাতে সেই বর্ণনায় হোঁচট খেয়ে পথ না হারায়, তাই তিনি অনুবাদের ক্ষেত্রে কাহিনির গতিকেই প্রাধান্য দিতেন।

অদ্রীশ বর্ধনের অনুবাদের উপরে অভিযোগ এসেছে যে— বঙ্গীকরণ করতে গিয়ে তিনি বহু অংশ বাদ দিয়েছেন। অদ্রীশ যখন অনুবাদ করতেন তখন বাঙালি পাঠকের কাছে ইংল্যান্ড আমেরিকা গ্লোবালাইজেশনের দৌলতে এতটা কাছে চলে আসেনি। সাত ও আটের দশকের শিশু-কিশোররা এই অনুবাদগুলির মাধ্যমেই বিশ্বসাহিত্যের এবং পাশ্চত্যবিশ্বের স্পর্শ পেত। তাই আক্ষরিক অনুবাদ করে মূল পাঠের কাছাকাছি থাকার চেয়ে, সহজে শিশুমনকে যাতে ছুঁয়ে যাওয়া যায়, সেটাই উদ্দেশ্য ছিল তাঁর।

তাঁর অনুবাদ কতটা সুখপাঠ্য হয়েছে, কতটা মূলানুগ ছিল— সেই নিয়ে তর্ক চলতেই থাকবে হয়তো। ডিন কুটজের ফ্যান্টমজ অবলম্বনে অদ্রীশ বর্ধনের আদিম আতঙ্ক বইটি যারা পড়েছেন, তাদের মতে অদ্রীশের বর্ণনা মূল গল্পের থেকে বহুগুণ শ্বাসরোধী হয়ে উঠেছে। এখানেই অদ্রীশ বর্ধনের সাফল্য। বাংলা সাহিত্যে স্পেকুলেটিভ ফিকশন অনুবাদের যে-ধারা তিনি এনেছিলেন, শুধু এই জন্যেই তাঁর কাছে আমরা চিরঋণী হয়ে থাকব।

তথ্য সহায়তা: সন্তু বাগ