চাপ
রাত ন’টা। অফিস থেকে বেরিয়ে একটা ফুটপাথের চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে নীলা। হাতের কাপ থেকে ধোঁয়া উঠছে। সে চায়ে চুমুক দেওয়া যাচ্ছে না। মাথা নিচু।
পাশ থেকে সেই পরিচিত কণ্ঠ, ‘কী অবস্থা? চোখমুখ এরকম থমথমে কেন?’
নীলা : আজ বিরক্ত ক’রো না নীলাব্জ। কিছু ভাল লাগছে না।
নীলাব্জ : ভাল কি তোমার কোনওদিনই সেরকম লাগে? বৃষ্টি পড়লেও রেগে থাকো, এগ মটন রোল খেতে বললেও রেগে থাকো…
নীলা : বাজে বোকো না তো! কাজ নেই কোনও, তুমি কি বুঝবে স্ট্রেস কাকে বলে?
নীলাব্জ : স্ট্রেস মানে, ইউ মিন চাপ?
নীলা গলার স্বর একটু উঁচু করে : আর কী মানে আছে স্ট্রেসের?
নীলাব্জ : আরে আস্তে, আস্তে! চা পড়ে যাবে তো। আসলে ফিজিক্সে পড়েছিলাম স্ট্রেস, স্ট্রেন, ইয়াং-স মডিউলাস, মনে আছে? আমি ভাবছিলাম…
নীলা : ছ্যাবলামি মারার একটা লিমিট থাকে নীলাব্জ! আমার ভাল লাগছে না।
নীলাব্জ : আচ্ছা বাবা, আমি কিছু বলছি না। চলো হাঁটি। তুমি বলো, কী এমন হল?
ওরা হাঁটতে শুরু করে।
আরও পড়ুন: ডিগ্রিই কি শেষ কথা বলে?
অনুপম রায়ের কলমে ‘নীলা-নীলাব্জ’ পর্ব ১৯…
নীলা : আমাদের অফিসের সুমনদা। বছর পঁয়তাল্লিশ বয়স। ভীষণ কাজের এবং যথেষ্ট সিরিয়াস। রেগুলার জিম করে, মদ-সিগারেট ছোঁয় না, তার দুম করে গতকাল হার্ট অ্যাট্যাক! দেখা গেছে, বিশাল হাই কোলেস্টেরল! দুটো ব্লকেজ। ডাক্তার বলছে, শুধুমাত্র স্ট্রেস থেকে। মানে তুমি ভাবো, ফিজিক্যালি কিছু করে নিজেকে ঠিক রাখা আর সম্ভব নয়। স্ট্রেস আমাদের শরীরের ভেতরে সব নষ্ট করে দেবে। রোগ ধরিয়ে দেবে আমাদের! মেরে ফেলবে এই স্ট্রেস।
নীলাব্জ : এটা নতুন কী বললে? জানতে না?
নীলা : তুমিও দেখছি আমাদের বসের মতো ইনসেন্সিটিভ।
নীলাব্জ : নিয়মিত চেক আপ করাত? না কি আচমকা ধরা পড়ল?
নীলা : এত আমি জানি না। আমাদের বস-ও আমাদের এইসবই বলল। সবাইকে এই সপ্তাহে ফুল বডি টেস্ট করাবে অফিস থেকে। আর আজ একটা কর্মশালা হল— Stress management: absorb stress better! সেটা শেষ হওয়ার পর নিজেকে দারুণ উন্নত মানের স্যানিটারি প্যাড মনে হচ্ছিল।
নীলাব্জ হেসে ফেলে : সব শেষে কী বলল? কাজ করে যান কিন্তু চাপ নেবেন না, তাই তো?
নীলা : যত ভুজুংভাজুং! এরকম বললেই হয়? এমন কাজের প্রেশার, এমন প্রতিযোগিতা চারদিকে, চাপ না নিলে হবে?
নীলাব্জ : হ্যাঁ, কর্পোরেটে কাজ করবে, চাপ থাকবে না, তা তো হতে পারে না। তারপর যদি উন্নতি করতে চাও, তাহলে তো …
নীলা : উন্নতি শুধু? সুমনদা তো আমাদের বলল, ওর চূড়ান্ত চাপ চাকরি যাওয়ার! যত ভালই কাজ করুক, যে কোনওদিন যে কারও চাকরি যেতে পারে। রিপ্লেস করার জন্য লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে আরও দশজন।
নীলাব্জ : তাই মেনে নাও চাপ থাকবে। দিন-দিন আরও বাড়বে। না নিতে পারলে কেটে যাও!
নীলা : ইয়ার্কি নাকি? কেটে যাও বলা যায় এভাবে?
নীলাব্জ : চাকরি ধরে রাখতে গেলে নিজের মূল্য সব সময় বাড়াতে থাকতে হবে। এমন মূল্যবান তুমি হবে যাকে ভীষণ প্রয়োজন কোম্পানির। তাকে রাখতেই হবে।
নীলাব্জ হাসে : ওটাই তো ম্যানেজমেন্ট। চাপ থাকবে, কিন্তু কেউ বুঝতে পারবে না। এই যে চারিদিকে এত লোক দাঁত ক্যালাচ্ছে, সবাই কি চাপমুক্ত? খবর নিলে জানবে, কার বাজারে পাঁচ কোটি দেনা, কার শরিকি মামলা চলছে পাঁচ বছর ধরে— তবু এরা কিন্তু দেখাচ্ছে না। বিন্দাস ঘুরে বেড়াচ্ছে। যে কোনওদিন কেস খেতে পারে, তবু আত্মবিশ্বাস কমছে না। আর এখন তো দেশে কেউ কোনও সমস্যাতে পড়লে একটাই সমাধান, পার্টিতে যোগদান করা। তারপর বাকি জীবন পার্টির হয়ে গলা ফাটিয়ে যাও।
নীলা : সেই মূল্য বাড়াতে গিয়েই তো জীবনে এত চাপ! কিন্তু তা কর্পোরেট শুধু কেন, সব জায়গাতেই।
নীলাব্জ : ঠিক। আমি আমার কথা ফিরিয়ে নিলাম। চাপ সর্বত্র। চাপ ম্যানেজ করতে শিখতে হবে তোমায়।
নীলা : তোমাকে দেখে তো মনে হয় না, তোমার কোনও চাপ আছে।
নীলাব্জ হাসে : ওটাই তো ম্যানেজমেন্ট। চাপ থাকবে, কিন্তু কেউ বুঝতে পারবে না। এই যে চারিদিকে এত লোক দাঁত ক্যালাচ্ছে, সবাই কি চাপমুক্ত? খবর নিলে জানবে, কার বাজারে পাঁচ কোটি দেনা, কার শরিকি মামলা চলছে পাঁচ বছর ধরে— তবু এরা কিন্তু দেখাচ্ছে না। বিন্দাস ঘুরে বেড়াচ্ছে। যে কোনওদিন কেস খেতে পারে, তবু আত্মবিশ্বাস কমছে না। আর এখন তো দেশে কেউ কোনও সমস্যাতে পড়লে একটাই সমাধান, পার্টিতে যোগদান করা। তারপর বাকি জীবন পার্টির হয়ে গলা ফাটিয়ে যাও।
নীলা : কিন্তু এটা তো দিখাওয়া! চাপ হচ্ছে না, তার কি গ্যারান্টি আছে? হয়তো এরা সব মানসিক বা শারীরিকভাবে অসুস্থ।
নীলাব্জ : শোনো নীলা, চামড়াটা একটু মোটা করো। চামড়াতেই লুকিয়ে আছে চাপ ম্যানেজ করার টেকনিক। লোকে চোর বলবে, কিন্তু গায়ে লাগবে না। লোকে চিটিংবাজ বলবে, কিন্তু গায়ে লাগবে না। আর গায়ে না লাগলে, মনেও লাগবে না, চাপটা হবে না জাস্ট।
নীলা : ওইসব দায়সারা কথা। চারটে পরপর চাকরির রিজেকশন লেটার এলে বুঝবে, কত ধানে কত চাল! মোটা চামড়া গুটিয়ে যাবে দু’দিনে।
নীলাব্জ : ভুল করছ নীলা। ঠিক সেদিন রাতে বাড়ি ফিরে এসে রিল বানাবে আর ইউটিউব চ্যানেল খুলবে: ‘How I failed in six interviews but found myself!’, দেখবে রাতারাতি হাজার-হাজার ভিউ আর ফলোয়ার। একটা রাস্তা বন্ধ হয়, একটা রাস্তা খোলে। সুতরাং, চাপ নেবেন না ম্যাডাম।
নীলা : আমি এখন কনটেন্ট ক্রিয়েটর হব? সেখানে প্রতিযোগিতা নেই? মিথ্যে বলার চাপ নেই? রেগুলার বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে বলে যেতে হয় হাসিমুখে। ‘শেয়ার মার্কেটে লাভ কী করে করবেন’ এরকম নাম দিয়ে ভিডিও বানাবে, নিজে কিন্তু এক পয়সাও লাভ করেনি সেখানে। লাভ করেছে এই ফালতু কোর্স বেচে! কিন্তু হাবভাবটা…
নীলাব্জ : এই হাবভাবটা… এই ইমেজটাই বাস্তব। চাপটা ট্রান্সফার করে দিতে হবে।
নীলা : তুমি চোর, বজ্জাতদের হয়ে ওকালতি করছ। জীবন মানে কী? অনবরত চাপের মধ্যে বেঁচে থাকা? এই নিরন্তর দৌড়ের মানে কী?
নীলাব্জ : সে-কথা আমি একদিন তোমায় জিজ্ঞেস করতাম। কিন্তু আজ তর্কের খাতিরে বলব যে, এই দৌড়টাই বেঁচে থাকা। চাপে থাকলে তবেই মানুষ কাজ করে। না-হলে মানুষ অলস। যত চাপ দেওয়া হবে, তত বেশি আউটপুট হবে।
নীলা : তুমি বুঝতে পারছ না। আমার শরীর, মন, সব একসঙ্গে প্রতিবাদ করছে। কাজের জায়গায় প্রতিটা হাসির পিছনে একটা ভয় আছে; চাকরি যাবে, রিভিউ খারাপ হবে, কেউ পিছনে কথা বলবে।
নীলাব্জ : এই ভয়টাই এনার্জি। ভয় থেকেই তো মানুষ কাজ করে। এই ভয়টা না থাকলে তুমি অলস হয়ে যেতে।
নীলা : ভয় আর প্রেরণার মধ্যে একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। আমি এখন শুধু পালাতে চাই।
নীলাব্জ : চাপমুক্ত জীবন কোথায় পাবে নীলা? তোমাকে সবসময় চাপের মধ্যেই থাকতে হবে। এটাই পৃথিবীর নীতি, ‘Survive or get scrolled away’।
নীলা : তোমার সঙ্গে কথা বলে আমার চাপ আরও বেড়ে গেল।
নীলাব্জ : কেন?
নীলা : এই চাপ আমি আর নিতে পারছি না। নিজেকে ব্যর্থ মনে হচ্ছে।
নীলাব্জ : ওই যে বললাম, নিজের ব্যর্থতাকেও কনটেন্ট বানিয়ে বেচে দাও। চাপ ট্রান্সফার করে দাও। এটা একধরনের রাজনীতি। দেখো না, কিছু মানুষকে কিছু একটা বললে সেটাকে কেমন ইস্যু বানিয়ে তুলতে পারে।
নীলা : এটা নোংরা নীলাব্জ। আমি এই অসভ্যতা করতে পারব না।
নীলা : আমি এখন কনটেন্ট ক্রিয়েটর হব? সেখানে প্রতিযোগিতা নেই? মিথ্যে বলার চাপ নেই? রেগুলার বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে বলে যেতে হয় হাসিমুখে। ‘শেয়ার মার্কেটে লাভ কী করে করবেন’ এরকম নাম দিয়ে ভিডিও বানাবে, নিজে কিন্তু এক পয়সাও লাভ করেনি সেখানে। লাভ করেছে এই ফালতু কোর্স বেচে!
কিন্তু হাবভাবটা…
নীলাব্জ : এই হাবভাবটা… এই ইমেজটাই বাস্তব। চাপটা ট্রান্সফার করে দিতে হবে।
নীলাব্জ : বেশ তাহলে তুমি ভদ্র বেকার হয়ে বসে থাকবে। তারপর নিজেই ক’দিন বাদে বিরক্ত হয়ে আবার এই জীবন-যন্ত্রণাতে ফিরবে। জীবন তো শান্তির নয় নীলা। শান্তি শ্মশানে। জীবনটা লড়াই। আর লড়াই মানে চাপ।
নীলা : মাঝে মাঝে ক্লান্ত লাগে নীলাব্জ। একটু সহানুভূতি খুঁজছিলাম। আরও হতাশ করে দিলে।
নীলাব্জ : এই রে! আমি তো ভাবলাম আমি উদ্বুদ্ধ করছিলাম তোমাকে।
নীলা : যাও তো! আমি চললাম।



